জোটের রাজনীতি এবং সময়োপযোগী রাজনীতি
- সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
- ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:৩৭
নির্বাচনী পক্ষগুলোর মধ্যে ভারসাম্য ছিল না
আট সপ্তাহ আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হয়েছে। এই নির্বাচন নিয়ে কিঞ্চিত বিশ্লেষণমূলক আমার লেখা তিনটি কলাম এই নয়াদিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে বুধবার ১৬ জানুয়ারি, ২৩ জানুয়ারি এবং ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ সালে। আগ্রহী পাঠক বা রাজনীতিমনস্ক পাঠক এ পত্রিকার আর্কাইভসে গিয়ে অথবা আমার ওয়েবসাইটে গিয়ে পড়তে পারেন, যদি ইতোমধ্যে না পড়ে থাকেন।
এই নির্বাচনের রেশ কাটতে না কাটতেই ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনের ঢাকঢোল পেটানো শুরু হয়ে গেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বহু রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছে। অতএব বিশ্বের দৃষ্টিতেও এটি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বা ইনক্লুসিভ ইলেকশন। কিন্তু এটা নিরপেক্ষ হয়নি। আমরা যতই বলাবলি করি, সরকার বা ক্ষমতাসীন পক্ষ ততই বিষয়টি অস্বীকার করে। উভয়পক্ষের ঘোষণা ও প্রচার করার সামর্থ্য সমান নয়, ভারসাম্যহীন। এ ছাড়াও একটি কর্মে বা একটি কর্মশক্তিতে, ক্ষমতাসীন সরকারপক্ষ অসম্ভব শক্তিশালী; সেটি হলো- ভয়-ভীতি দেখানো। গ্রেফতার করার কাজটি তারা অনায়াসেই করতে পারেন। চাকরিজীবীকে চাকরিচ্যুত করার কাজটি সরকার অনায়াসে করতে পারে। মামলায় অভিযুক্ত দেখিয়ে হয়রানি করার কাজটি সরকার অনায়াসে করতে পারে। এসব কাজ রাজপথের বিরোধী দলের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই উভয়পক্ষের কর্মক্ষমতা ভারসাম্যহীন বলতেই হবে।
‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ’
নির্বাচনের পরে দলগুলোর করণীয় কী হতে পারে এটি কোনো গভীর গবেষণার বিষয় নয়। ইংরেজিতে বলে : ‘টাইম অ্যান্ড টাইড ওয়েটস ফর নান’; বাংলায় মানে দাঁড়াবে- সময় এবং জোয়ারের পানি কারো জন্য অপেক্ষা করে না। অর্থাৎ সময় এবং পানির স্রোত থেকে কেউ যদি কোনো উপকার পেতে চায়, তাহলে সময় ও স্রোতের চাহিদা মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কাজ করতে হবে। এইচএসসি পরীক্ষার সময় কোনো ছাত্র যদি নিজের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এসএসসির বই নিয়ে পড়ালেখা করে, তাহলে সে ফেল করতে বাধ্য। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার সময়, পরীক্ষার্থী যদি নিজের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে উপরের ক্লাসের কিছু পড়ে তাহলে তার প্রস্তুতি জোরদার হয়। যে সিদ্ধান্তটা শনিবারে নেয়ার কথা, সেটি শনিবারে না নিয়ে একদিন আগে শুক্রবারে নেয়া হলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারীরা একটা দিন বেশি সময় হাতে পান; অপরপক্ষে শনিবারের বদলে সিদ্ধান্তটি রোববার নিলে, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারীরা চব্বিশ ঘণ্টা সময় কম পাবেন। অতএব, আমার বক্তব্য হচ্ছে সময়ের কাজ সময়ে করাই ভালো। কথাটি খুব পুরনো। অতি সুপরিচিত বাংলা প্রবাদ : ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ’। মানে একটি কাপড় পরতে পরতে যদি কোনো একদিকে একটু ছিঁড়ে যায় তাহলে ওই ছেঁড়া জায়গাটাই যদি এক ফোঁড় সেলাই দেয়া হয়, তাহলে আর ছিঁড়বে না। অপরপক্ষে, ছেঁড়া জায়গায় যদি এক ফোঁড় সেলাই দেয়া না হয়, তাহলে ছেঁড়া অংশের ব্যাপ্তি বাড়তেই থাকবে এবং এরপর সেটা রোধ করতে গেলে অনেক ফোঁড় সেলাই দিতে হবে। একই কথা ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয়েছে এই ভাষায় : ‘এ স্টিচ ইন টাইম, সেইভস নাইন’। এই উদাহরণগুলো দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সময়োপযোগিতার প্রসঙ্গটি তুলে ধরছি।
জানুয়ারি ২০১৪ থেকে জানুয়ারি ২০১৯
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচন কোনোমতেই অংশদারিত্বমূলক বা নিরপেক্ষ ছিল না। নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই দেশব্যাপী আন্দোলন চলছিল; কঠোর আন্দোলন। এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দেশব্যাপী সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেনি। নির্বাচনের পরের দিনই সরকারবিরোধী আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছিল। নির্বাচনের কম-বেশি দুই সপ্তাহ পর, ১৮ কিংবা ১৯ জানুয়ারি ২০১৪ সালের সন্ধ্যায়, ঢাকার গুলশানে অবস্থিত বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, আপসহীন নেত্রী, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘দল পুনর্গঠনের পর আবার আন্দোলন শুরু হবে।’ এখানে দুটো কাজের উল্লেখ আছে। যথাÑ দল পুনর্গঠন এবং পুনরায় আন্দোলন শুরু করা। ‘দল’ বলতে বিএনপি। গত পাঁচ বছরে, সেই প্রতিশ্রুত পুনর্গঠন শেষ হয়নি। তা অসমাপ্ত রেখেই বা আংশিকভাবে পুনর্গঠিত বিএনপি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন যে, বিএনপি পুনর্গঠিত হলো কি হলো না তাতে আপনি জেনারেল ইবরাহিমের কী আসে যায়? উত্তরে বলব, ‘অনেক কিছু আসে-যায়।’ কারণ হলো, আমি নিজে একজন রাজনৈতিক কর্মী, আমি বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নামক দলের চেয়ারম্যান; এই দলটি ২০ দলীয় জোটের অংশীদার; ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক ও শক্তি হচ্ছে বিএনপি; অতএব, প্রধান শরিকের সুস্বাস্থ্য আমার অবশ্যই কাম্য; কারণ আমাদের চিন্তাচেতনা ও কর্মকাণ্ডের বেশির ভাগ এই প্রধান শরিককে কেন্দ্র করেই। আমার উপসংহার হলো, আংশিকভাবে পুনর্গঠিত বিএনপি এবং পূর্ণভাবে পুনর্গঠিত বিএনপির শক্তিমত্তা ও কর্মক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য হতে বাধ্য। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখের নির্বাচনে আমরা আংশিকভাবে পুনর্গঠিত বিএনপিকে পেয়েছি।
বিএনপির দাওয়াতে চট্টগ্রাম গমন
গত ১৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম যাই। গিয়েছিলাম, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির দাওয়াতে। মহানগর বিএনপির সভাপতি ডাক্তার শাহাদত হোসেন ফোনে দাওয়াত দিয়েছিলেন; আমি যেন ১৯ জানুয়ারি সকাল ১১টায় বিএনপি মহানগর কার্যালয়ে (নসিমন ভবন) বিএনপির একটি সংবাদ সম্মেলনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকি। আমাকে দাওয়াত দেয়ার পেছনে তিনি তিনটি যুক্তি দিয়েছিলেন। প্রথম যুক্তি : আমি চট্টগ্রামের সন্তান; দ্বিতীয় যুক্তি : আমি শহীদ জিয়ার সাথী রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা; তৃতীয় যুক্তি : আমি ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দলের প্রধান। চট্টগ্রামে মহানগরের কাজীর দেউড়ি বা স্টেডিয়াম এলাকাতে সরকারি সার্কিট হাউজ অবস্থিত। এই সার্কিট হাউজেই, ৩০ মে ১৯৮১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, একদল বিদ্রোহী সেনাদলের হাতে নিহত হয়েছিলেন, তথা শাহাদত বরণ করেছিলেন। ওই স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে সম্মান জানিয়ে, সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘর’। সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই জাদুঘরটি ছিল; এখনও আছে। কিছু দিন আগে সরকারপন্থী ছাত্রদের একটি নতুন সংগঠনের কিছু ছাত্র, সেই জাদুঘরের নামফলকটির ওপর আক্রমণ চালায়। তারা ‘জিয়া’ শব্দটিকে কালো কালি দিয়ে মুছে দেয়। অতঃপর পুরো নামফলকটি অনেক বড় একটি ব্যানার দিয়ে ঢেকে দেয়। ব্যানারটি দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরেরই সন্তান ও বর্তমান সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর নামে। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উভয়েই ছিলেন কারারুদ্ধ। উভয়েই সাম্প্রতিককালে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। সভাপতি কিছু প্রতিবাদমূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেটারই ধারাবাহিকতায়, মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার নামের ওপর হামলা, সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়ার নামের ওপর হামলা তথা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার নামের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে ওই সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। নিজের রাজনৈতিক বিবেক আমাকে নির্দেশ করেছিল, আমি যেন ডাক্তার শাহাদাতের দাওয়াত গ্রহণ করি এবং সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকি। যথাসময়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাই এবং সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হই। চট্টগ্রাম মহানগর থেকে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলোতে ছবিসহ সংবাদ, পরের দিন ২০ ফেব্রুয়ারি ছাপানো হয়েছে; ঢাকা থেকে প্রকাশিত দ্’ুএকটি পত্রিকায় ছবিবিহীন সংবাদ ছাপানো হয়েছে। আলোচ্য সংবাদ সম্মেলনে, বিএনপি মহানগর সভাপতি লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন; এর অতি সংক্ষিপ্ত সারমর্ম সংবাদপত্রে উল্লিখিত হয়।
সংবাদ সম্মেলন ও আমার যুক্তি
১৯ ফেব্রুয়ারির আলোচ্য সংবাদ সম্মেলনে ডাক্তার শাহাদতের আহ্বানে, তার বক্তব্যের পরপরই আমিও বক্তব্য রেখেছিলাম। আমার বক্তব্য ছিল মৌখিক; যার সারমর্ম নি¤œরূপ : বাংলাদেশের এই মুহূর্তের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি জাতীয় ঐক্যের বা জাতীয় ঐকমত্যের আহবান জানাচ্ছেন। বাংলাদেশের দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি তথা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার নাম নিয়ে যদি এরূপ অসম্মানজনক আচরণ করা হয়, তাহলে কি সেটা জাতীয় ঐক্য বা ঐকমত্য সৃষ্টির অনুকূলে যাবে? আমার দৃষ্টিতে, যাবে না। আরো একটি কথা, জিয়াউর রহমান ছিলেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা এবং সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। অতএব জিয়ার নামের উপর অসম্মানজনক আচরণ করে, সব রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধার প্রতি ও সব মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারের প্রতি এক প্রকার অবজ্ঞা প্রকাশ করা হলো। সব রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাই যুদ্ধ করেছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের তথা মুজিবনগর সরকারের অধীনে। অতএব, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলা ও অবজ্ঞা করা, বিশেষত জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের মতো একজন সেনানায়ক ও দেশনায়কের প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞা করার প্রতিবাদ জানাতেই হবে। শুধু প্রতিবাদ নয়, যে অবহেলা ও অবজ্ঞা করা হয়েছে, সেটা সংশোধন করার দাবি জানাতে হবে। আমি একজন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, বিএনপির সাথে পথচলা একটি শরিক দলের প্রধান হিসেবে সেই প্রতিবাদ ও সেই সংশোধন দাবি করছি।
সম্পূরক অবস্থান ও আত্মসমালোচনার আহ্বান
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডাক্তার শাহাদত আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার জন্য। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি এরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সময় আমাকে স্মরণ করার জন্য ও দাওয়াত দেয়ায়। ওই অনুষ্ঠানে বিএনপির কেন্দ্রীয় অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু সুফিয়ান ও মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্করসহ বেশ কিছু স্থানীয় নেতা উপস্থিত থাকলেও, ১৯৭১-এর রণাঙ্গনের কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের কোনো সুপরিচিত ব্যক্তিকে দেখতে পাইনি। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখের সংবাদ সম্মেলনের বা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বোঝাতে চাচ্ছি, মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক জেনারেল ইবরাহিম এবং মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম জেনারেল জিয়াউর রহমান পারস্পরিকভাবেই স্মৃতির জগতে, আবেগের জগতে সমান্তরাল সম্পূরক পথের পথিক। অপর ভাষায় বলা যায়, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, যদিও আকৃতিতে ও জনপ্রিয়তায় দল দুটোর মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ এবং বয়সে তিন দশকের তফাৎ তথাপি, রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ পথে সমান্তরাল ও সম্পূরক পথের পথিক। হ্যাঁ, দু’টি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীন দল সব সমস্যার সমাধান হুবহু একইভাবে কল্পনা কিংবা একই রকমের প্রস্তাব নাও করতে পারে; ভিন্নতা থাকতেই পারে; কিন্তু তারা পরস্পরের শুভাকাক্সক্ষী তো বটেই। শুভাকাক্সক্ষী হওয়ার মানেই হলো, একজন আরেকজনের সুখে-দুঃখে পাশে থাকবেন। নৈতিকতার দাবি হলো, সুখে থাকেন আর না থাকেন, দুঃখের সময় অবশ্যই থাকবেন। বিএনপির এখন দুঃখের সময় নয়; কিন্তু কঠিন সময়। আমরা পাশে ছিলাম গত প্রায় আট বছর; এখনও দূরে যাইনি। আমরা বিএনপির মঙ্গল চাই, কল্যাণ চাই, বিএনপি আরো শক্তিশালী হোক সেটা চাই, এ দলের সাংগঠনিক পুনর্গঠন সুসম্পন্ন হোক তা চাই, বিএনপি আত্মসমালোচনা করুক- সেটা কামনা করি। আত্মসমালোচনার কথা সব শেষে উল্লেখ করলাম। কারণ, প্রধান শরিকের সঙ্গে আট বছর থাকার ফলে, এর সুবিধা-অসুবিধা কিছু না কিছু অবশ্যই বুঝতে পেরেছি। সেটাকে মাথায় রেখেই আবেদন করছি, বিএনপি আত্মসমালোচনা এবং নিজেদের পুনর্গঠন সম্পন্ন করুক। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ঢাকা মহানগরে, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) গণশুনানির ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে, ছয় বছর আগের পার্লামেন্টে, বিএনপির চিফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুক কিছু আবেগময় কিন্তু বাস্তবসম্মত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তার বক্তব্যের একদম শেষে ছিল : বিএনপি যেন আত্মসমালোচনা করে সেই আহ্বান।
কেন পুনর্গঠনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি?
বারবার পুনর্গঠনের কথা কেন বলছি, তার কারণ আছে। সাড়ে সাত বছর জোটভুক্ত পথ চলার পর, বিগত সংসদ নির্বাচনে আমাদের দল একটি আসনে নির্বাচনের সুযোগ পেয়েছিল। তবে এটি নিষ্কণ্টক ছিল না। আসনের নাম ‘চট্টগ্রাম-৫’। ভৌগোলিকভাবে সম্পূর্ণ হাটহাজারী উপজেলা এবং চট্টগ্রাম মহানগরের এক নম্বর ও দুই নম্বর ওয়ার্ড মানে, দক্ষিণ পাহাড়তলী ও জালালাবাদ এই আসনের অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু আমি বিএনপির সদস্য নই কিন্তু জোটভুক্ত একটি শরিক দলের সদস্য এবং ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ পেয়েছিলাম, সেহেতু স্থানীয় বিএনপির সঙ্গে আমার ইন্টারঅ্যাকশন কেমন হয়েছিল, কী কী সুবিধা-অসুবিধা ছিল ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সবকিছুই লিখিতভাবে দৈনিক পত্রিকার কলামে আলোচনা করার জন্য উপযুক্ত সময়, নির্বাচনের পরবর্তী এই নবম সপ্তাহ নয়। আলোচনার উপযুক্ত সময় হয়তোবা আরো কিছু দিন পরে। যা-ই নিবেদন করতে চাই এবং যা-ই আলোচনা করতে চাই সেটা সাংগঠনিক বিষয়। ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ছিল মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন। বাছাইয়ে যখন আমি তথা ধানের শীষ টিকে গেলাম, তখনই আনুষ্ঠানিকভাবে একজন প্রার্থী হিসেবে আমার কর্মকান্ড শুরু। আরো অন্তত দশ দিন, পুনশ্চ : বেশি না হলেও অন্তত দশ দিন আগেই, এই কার্যক্রম শুরু করতে পারতাম, যদি কেন্দ্রীয় বিএনপি দূরদৃষ্টিপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত হতো। অবশ্যই বলে রাখতে হবে, ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে আমি অনুমোদিত প্রার্থী হলেও আমাদেরই ২০ দলীয় জোটের অন্য দু’টি নিবন্ধিত দলের দু’জন সম্মানিত প্রার্থী, ওই দু’টি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সম্মতিতে এবং বিএনপির উচ্চপদস্থ নেতৃত্বের সম্মতিতে, ওই দুইটি দলের তথা নিজ নিজ দলের প্রতীক নিয়েই বাছাইপর্বে টিকে যান এবং ১০ ডিসেম্বরের পরেও বহাল, কার্যক্ষম ও নির্বাচন সংক্রান্ত কাজে তৎপর ছিলেন। যা হোক, যেটা হয়নি বা যেটা পরিহার করা সম্ভব হয়নি সেটার ওপর আলোচনা এখন করছি না। ১০ ডিসেম্বর ২০১৮-এর পর আমার প্রথম পাঁচটি কাজের অন্যতম ছিল হাটহাজারী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির আহবায়ক ও সদস্য-সচিব বরাবর মৌখিকভাবে ও এসএমএসের মাধ্যমে একটি আবেদন রাখা।
আবেদনের বিষয় ও ভাষা ছিল অনেকটা এইরকম : ‘আমি জেনারেল ইবরাহিম, ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের জন্য মনোনীত হয়েছি এবং টিকেছি। মেহেরবানি করে, হাটহাজারী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির একটি সভা আহ্বান করুন, যেন নির্বাচন পরিচালনা বিষয়ে আমরা কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি।’ বলাই বাহুল্য, বিবিধ কারণে কমিটির সেই সভা অনুষ্ঠিত হয়নি বা করা সম্ভব হয়নি। কেন হয়নি? উত্তরটি সাংগঠনিক। এরূপ আরো বহু প্রশ্ন আছে যেগুলো সাংগঠনিক তৎপরতা, সাংগঠনিক আনুগত্য ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত। সেগুলো আজ আলোচনা করছি না; ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ আলোচনা করব। তাই বারবার তাগাদা দিচ্ছি, আমাদের জোটের প্রধান শরিক বিএনপি যেন তাদের সাংগঠনিক পুনর্গঠন, শুধু আক্ষরিক অর্থে নয়, বাস্তবিক অর্থেই সম্পন্ন করে। আগামী সপ্তাহে বা পরবর্তী কোনো একটি সপ্তাহের কলামে, এ প্রসঙ্গে আলোচনা হতে পারে। অর্থাৎ জোটভুক্ত একটি দলের একজন প্রার্থী, সংসদ নির্বাচন করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন, সেটি বাকি ২৯৯টি আসনের আগ্রহী ব্যক্তিদের কোনো উপকারে লাগতেও পারে মনে করেই, এই আলোচনাটি করা যায়। সাবেক এমপি ও সাবেক চিফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুকের আহ্বানটি (২২ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমতির মিলনায়তন) এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
পিলখানার ৫৭ ও চকবাজারের ৬৭ : শোক প্রকাশ
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৫ তারিখে তৎকালীন বিডিআরের সদর দফতর, ঢাকার পিলখানায় একটি ব্যাপক ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল। বিডিআর বিদ্রোহের আওতায় বা ছত্রছায়ায় সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস কর্মকর্তাকে ২৫ ফেব্রুয়ারি দিন, ২৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ও ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালের মধ্যে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা বিশ্বাস করি, তারা শহীদ। দীর্ঘ দিন আহ্বান জানাচ্ছি : ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখকে ‘শহীদ সেনাদিবস’ ঘোষণার জন্য এবং প্রতি বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয়ভাবে শোক প্রকাশ করার জন্য। আমাদের এ দাবি গ্রাহ্য হয়নি। যারা গ্রাহ্য করেননি তারা নিজেদের বিবেচনা ও নিজেদের দায়িত্বেই করেননি। আমি বা আমার মতো যারা এই আবেদন করেই যাচ্ছি, আমরা এখন অবসরের জীবনে আছি, নিরীহ জীবনে আছি, ক্ষমতাহীন জীবন কাটাচ্ছি; সুতরাং আবেদন জানানোর বাইরে আর কিছু করতে পারছি না। আজ থেকে পাঁচ দিন আগে, একান্তই অতর্কিতে ঢাকা মহানগরের পুরান অংশ তথা চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল। অন্ততপক্ষে ৬৭ জন পুরুষ-মহিলা ও শিশু অগ্নিদগ্ধ হয়ে ইন্তেকাল করলেন। এরূপ দুর্ঘটনায় যাদের মৃত্যু হয়, তাদের মহান আল্লাহ তায়ালা নিজ দয়ায় শহীদের মর্যাদা দান করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মানুষ স্তম্ভিত ও শোকাহত। জনগণের সেন্টিমেন্ট বা আবেগের প্রতি সম্মান জানিয়ে, এই মুহূর্তের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার, সোমবার ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ জাতীয়ভাবে শোক প্রকাশের জন্য নির্ধারিত করেছিল; জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছিল ওই দিন। নিরীহ ৬৭ জন ঢাকাবাসী তথা আল্লাহর বান্দার প্রতি এই সহমর্মিতা প্রকাশ করার জন্য সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সাথে সাথে এই আবেগমথিত প্রশ্নটিও রাখছি : একই সাথে কি পিলখানার ৫৭ জনের কথাটি উল্লেখ করা যেত না? অথবা রোববার ২৪ তারিখ চকবাজারের জন্য শোক প্রকাশ করে সোমবার ২৫ তারিখ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার জন্য কি শোক প্রকাশ করা যেত না? অথবা সোমবার ২৫ তারিখ শহীদ সেনাদিবসে শোক প্রকাশ করে মঙ্গলবার ২৬ ফেব্রুয়ারিতে চকবাজারের জন্য কি শোক প্রকাশ করা যেত না? আমার উত্তর আমার কাছেই থাকুক। পাঠকের উত্তর পাঠকের কাছে থাকুক না হয়। ক্ষমতাসীনদের উত্তর ক্ষমতাসীনদের কাছেই থাক। আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে এবং আমার দলের পক্ষ থেকে আমরা ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি মিলনায়তনে আলোচনা সভা করে, সেই ৫৭ জনের প্রতি সম্মান জানিয়েছি এবং সাথে সাথে ওই ৬৭ জনের প্রতিও সম্মান জানিয়েছি এবং সবার জন্য দোয়া করেছি। মাহাদী নামের একজন দুষ্ট তরুণ একটি পিস্তল বা খেলনা পিস্তল নিয়ে যাত্রীবাহী প্লেনের ভেতর ‘হাইজ্যাক হাইজ্যাক’ খেলা করতে গিয়ে নিজের করুণ পরিণতি ডেকে এনেছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়। ফলে টেলিভিশনের সংবাদে আমাদের আলোচনা সভাটির উল্লেখ একেবারেই সীমিত বা জিরো হয়ে পড়ে। কারণ সবার দৃষ্টি ও মনোযোগ টেলিভিশনের পর্দা ভেদ করে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে নিবদ্ধ ছিল; এ রকমই আমাদের দেশে হয়।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com.bd
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা