২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঢাকায় বসবাসের বিপদ

ঢাকায় বসবাসের বিপদ - ছবি : সংগৃহীত

আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা দিন দিন বাসের উপযোগিতা হারাচ্ছে। এমন তথ্য পাওয়া গেছে একাধিক জরিপ ও গবেষণা প্রতিবেদনে।
আন্তর্জাতিক এয়ার ভিজুয়ালের বিশ্লেষণে গত ১৯ ও ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশ সময় রাত ১১টায় বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকা ছিল এক নম্বরে। বায়ুশুদ্ধতার দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ অবস্থার শহরগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করছে ঢাকা। এ তালিকায় রয়েছে আমাদের পাশের দেশ ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লি আর পাকিস্তানের শহর লাহোর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ, পরমাণু শক্তি কমিশন ও যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে দু’টি গবেষণা করেছে। এতে উঠে এসেছে ঢাকার বায়ু নিঃশ্বাসের মাধ্যমে কতটা দূষিত পদার্থ আমাদের রক্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট এবং এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ-এ গবেষণা দু’টির ফল সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে। এ নিয়ে দেশের একটি প্রভাবশালী দৈনিক বিস্তারিত প্রতিবেদন ছেপেছে। ওই গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকার পথের ধুলোয় সর্বোচ্চ মাত্রায় সিসা, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নিকেল, আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের অস্তিত্ব মিলেছে। মাটিতে যতটা ক্যাডমিয়াম থাকা স্বাভাবিক, ঢাকায় পদার্থটি পাওয়া গেছে এর চেয়ে ২০০ গুণ বেশি। ক্যাডমিয়ামকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বলে শনাক্ত করেছে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার। বিশেষ করে প্রোস্টেট ও লাং ক্যান্সারের সাথে এর সংযোগ রয়েছে। অস্টিওপরোসিস ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয় এটি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরো পাঁচটি বায়ুদূষণকারী উপাদানের সাথে এটিকে নিষিদ্ধ করেছে। বাতাসে নির্ধারিত মাত্রায় বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থ ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এসব ধাতু নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বাতাসে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার রাস্তার ধুলায় সিসা ও নিকেলের মাত্রা দ্বিগুণের বেশি। হৃদরোগ, ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে ভারী ধাতু সিসা। এটি মানবদেহের শ্বাস-প্রশ্বাসপ্রক্রিয়া অকার্যকর করতে পারে। প্রসূতির জন্যও হতে পারে বিপদের কারণ। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার সাথে আমরা আগে থেকেই পরিচিত। বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ পানিতে এর মিশ্রণ ঘটে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। যেসব এলাকায় পানিতে আর্সেনিকের মিশ্রণ বেশি; সেখানে রোগবালাইও বেশি। ঢাকার রাস্তায় ধুলার মধ্যেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক শনাক্ত করেছে গবেষক দল। এসব ভারী ধাতু এতটাই সূক্ষ্ম যে, তা মানুষের চুলের ২৫-১০০ ভাগের বেশি ছোট। এসব সূক্ষ্ম ধাতুকণা ত্বকের সংস্পর্শে আসে এবং শ্বাস প্রশ্বাস, খাদ্যগ্রহণ ও পানীয়ের মাধ্যমে সহজে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
ধুলায় ভারী ধাতুতে স্বাস্থ্যঝুঁকিবিষয়ক গবেষণাটি করা হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে। রাজধানীর ২২টি সড়কের ৮৮টি এলাকার রাস্তা, ফুটপাথ, নর্দমার পাশের মাটি ও গর্ত থেকে ৩০০ গ্রাম করে ধুলার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত নমুনা পরে পরমাণু শক্তি কমিশনের গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ৮৮টি এলাকার সবখানে ভারী ধাতু পাওয়া যায়। যেসব এলাকায় যানজট বেশি বা যানচলাচল বেশি- সেখানে ভারী ধাতুর পরিমাণও বেশি। এর মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে, যেখানে ধাতু গলানো হয় সেখানেও। জিপিও, বঙ্গভবন ও রামপুরা টিভি স্টেশন এলাকায় ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ২০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাটারিচালিত যানবাহন ঢাকায় চলাচল করে। এসব যানবাহনে নিকেল ও ক্যাডমিয়াম ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়। ঢাকা মহানগরী অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে কলকারখানা। আবাসিক এলাকা আর কলকারখানা একই জায়গায় গড়ে উঠেছে। এসব কলকারখানার অনেকগুলোতে ক্যাডমিয়াম ব্যবহৃত হয়।

শুষ্ক মওসুমে ক্ষতিকর ভারী ধাতুকণা বাতাসে ভাসতে থাকে। শীত মওসুমে বায়ুতে ধূলিকণার পরিমাণ বেড়ে যায়। একইভাবে অন্যান্য মওসুমেও বৃষ্টি না হলে বাতাসে ক্ষতিকর ভারী ধাতুকণা বাড়তে থাকে। ঢাকায় এর অন্যতম কারণ এলোপাতাড়ি বাড়িঘর নির্মাণ ও শিল্পকারখানার অনিয়ন্ত্রিত দূষণ।

ঢাকায় ঘরের বাতাসে সূক্ষ্ম বস্তুকণা ও গ্যাসীয় পদার্থের দূষণ নিয়ে গবেষণাটি করা হয় ২০১৭ সালে। ওই বছরের অক্টোবরে পাঁচটি আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের ঘর থেকে বাতাসের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ওই সব নমুনায় দেখা গেছে, ভবনের ভেতরের বায়ুতে সূক্ষ্ম বস্তুকণার ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ঘরের বাসিন্দাদের শরীরে ঢুকে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। দূষণের উৎস হিসেবে বলা হয়, বাইরের দূষিত বায়ুর ৪২ শতাংশ ঘরে ঢুকে পড়ে। একই সাথে ঘরের মধ্যকার ময়লা-আবর্জনা, ডিটারজেন্ট, রান্না ও টয়লেট থেকেও দূষিত পদার্থ বাতাসে যুক্ত হয়। গবেষণায় খিলক্ষেত এলাকায় সবচেয়ে বেশি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পাওয়া গেছে। এরপর রয়েছে দোলাইপাড় ও রামপুরার বাসাবাড়ি। দূষণের সাথে বৃষ্টিপাতের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ঢাকায় আগের চেয়ে বৃষ্টিপাত কমে গেছে। ফলে দূষণের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়েছে।

প্রচারণার ককটেল উৎপাত ঢাকায়
‘আবার আইলো নির্বাচন’ কানফাটা আওয়াজে চার দিকে প্রকম্পিত হচ্ছে। চটুল গানের নকল করা সুরের সাথে নির্বাচনী স্লোগান জুড়ে দেয়া হয়েছে। এই কাজে ‘জনপ্রিয়’ হিন্দি ও বাংলা গানকে তারা বেছে নিয়েছে। স্টুডিওতে কপি কাট করে তৈরি করা হয়েছে নির্বাচনী প্রচারণার ককটেল। মাইক লাগিয়ে রিকশা চলছে। সেই রিকশা যাত্রীশূন্য। সিটে বসানো রেকর্ডার। মাইক থেকে ককটেল ফাটার মতো উচ্চ আওয়াজ হচ্ছে। উৎকট সুরের ঝাঁজে চার পাশের পরিবেশ দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। কোনো কোনো প্রচারণার আওয়াজে হৃদকম্পন হওয়ার উপক্রম।

ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতায় আসা নতুন ওয়ার্ডগুলোতে প্রথমবারের মতো কাউন্সিলর নির্বাচন হচ্ছে। একই সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে উপনির্বাচন হচ্ছে। এই নির্বাচনী প্রচারণার দমকা বাতাস সব যেন উড়িয়ে নিতে চাচ্ছে। মানুষের কান ঝালাপালা। বিশেষ করে যেখানে দুটো ওয়ার্ডের সীমানা মিলেছে, সেখানে ভোগান্তির সীমা-পরিসীমা নেই। নির্বাচন কমিশন একটু জনবান্ধব হলে নির্বাচনী আচরণবিধিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, সর্বোচ্চ কত ডেসিবেল আওয়াজে প্রচারণা চালানো যাবে। অর্থাৎ শব্দের মাত্রাই বা কেমন হবে। যে মাত্রা মানুষের সহনীয় ততটুকু শব্দে প্রচারণা চালানোর অনুমতি দিতে পারে নির্বাচন কমিশন।

প্রচারণা চালানো হচ্ছে, ‘প্রার্থীদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। তারা জনদরদি, গরিবের বন্ধু’। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে- এসব শব্দবন্ধনীতে যাদের নামে ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের কারো কারো দখলদার, মাস্তান, গডফাদার, সন্ত্রাসী ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই। প্রচারণার ভাষা কেমন হবে তা নিয়েও কমিশন দিকনির্দেশনা দিতে পারে। এবারের নির্বাচনে একটি বহুল ব্যবহৃত স্লোগান- ‘ভোট চাই ভোটারের, দোয়া চাই সকলের।’ এই স্লোগান পুরো দেশেই চালু আছে। যিনি দোয়া চাইছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিনি মুসলমান। তাদের চিন্তা-বিশ্বাস অনুযায়ী অন্য ধর্মের মানুষেরা বিশ্বাসী নন। দোয়া শব্দটির বাংলা অর্থ, প্রার্থনা। সে অনুয়ায়ী একজন প্রার্থী হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মের নাগরিকদের কাছে আবেদন করছেন, তারা যেন স্রষ্টার কাছে তার জন্য প্রার্থনা করেন। মুসলমানেরা কুরআনকে নির্ভুল এবং মান্য বলে মনে করেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, প্রত্যাখ্যানকারীর দোয়া লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় (সূরা মুমিন; আয়াত ৫০)। তাহলে এ ধরনের একটা স্লোগান নিজের চিন্তা, বিশ্বাস ও ধর্মের অবস্থান থেকে স্ববিরোধী। প্রার্থীরা এ ধরনের একটি স্লোগান দেবেন কি না, ভেবে দেখতে পারেন।

বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। জনপ্রিয় প্রধান দলগুলো বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। তাদের অভিযোগ, ভোটারের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচন হচ্ছেন না। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সরাসরি প্রভাব খাটানোর মাধ্যমে সরকারের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করানো হচ্ছে। সদ্যসমাপ্ত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান বিরোধী জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এমন অভিযোগ করেছে। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মাত্র ছয়টি আসন পায়। অন্য দিকে আওয়ামী লীগ পেল ২৫৮টি আসন। নির্বাচনের এমন অস্বাভাবিক ফল পুরো ব্যবস্থাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

jjshim146@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement