বেক্সিটের ভূত ও ব্রিটেনের ভাগ্য
- মীযানুল করীম
- ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১৯:৪১
ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট ইস্যুতে গো-হারা হেরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র সরকারের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার পেন্ডুলামের মতো ঝুলছে। পরদিন আস্থা ভোটে তিনি টিকে গেলেও তার ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক ফাঁড়া সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। কারণ, অনাস্থার কবল থেকে আপাতত নিস্তার পেয়ে থেরেসা মে নিজেকে শক্তিশালী মনে করা বাস্তবসম্মত নয়। কথায় বলে, ‘এক মাঘে শীত যায় না’। তেমনি এবার বাংলা মাঘ মাসের তিন তারিখে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে কোনো মতে রেহাই পেয়ে থেরেসা মে ‘শ্বাস ফেলার সুযোগ’ পেলেন। কিন্তু আবার তিনি মুখোমুখি হতে পারেন পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের। তখন যে এর ফলাফল তার জন্য নেতিবাচক হবে না, তার নিশ্চয়তা আছে কি?
ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন দলের এমপিরা বিশেষ কোনো ইস্যুতে সঠিক মনে করে দলের বা দলীয় প্রধানের মত বা সিদ্ধান্তের বিপক্ষেও ভোট দিতে পারেন। এবার ব্রেক্সিট ইস্যুর ভোটাভুটিতেও তার প্রমাণ মিলেছে। বহুলালোচিত ব্রেক্সিট ইস্যু বেশ কিছু দিন ধরে ব্রিটেন তো বটেই, এমনকি পুরো ইউরোপেই শুধু নয়, বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। ব্রেক্সিট আর থেরেসা মে যেন সমার্থক হয়ে গেছেন। তাকে ব্রেক্সিটের এক ধরনের প্রতীক মনে করা যায়। সেই ‘ব্রেক্সিট ভূত’ শিগগিরই থেরেসাকে ছেড়ে যাবে বলে এখনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তিনি পার্লামেন্টে ব্রেক্সিটের বড়ি গেলাতে ব্যর্থ হয়ে বলছেন, ব্রিটেনের সব দলের সাথে আলোচনার মাধ্যমে, অর্থাৎ দৃশ্যত জাতীয় ঐকমত্যের নিরিখে ব্রেক্সিট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। অপর দিকে, ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের প্রধান প্রতিপক্ষ, শ্রমিক দলের প্রধান হিসেবে জেরেমি করবিন হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, ‘গ্রহণযোগ্য’ চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করা চলবে না। ব্রেক্সিট প্রশ্নে ব্রিটেনে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা কঠিন বলে মনে হচ্ছে।
BREXIT একটি নতুন পরিভাষা। Britain-এর Exit-কে বলা হচ্ছে Brexit (ব্রেক্সিট), ইউরোপ মহাদেশীয় প্রধানত অর্থনৈতিক জোট, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা ইইউ থেকে ব্রিটেন বের হয়ে আসাকে সংক্ষেপে বা এক কথায় ব্রেক্সিট বলা হচ্ছে। এই ইস্যুতে নিকট অতীতে রেফারেন্ডামে জয়ী হয়েছে ব্রিটেনের ক্ষমতায় আসীন রক্ষণশীল দল বা কনজারভেটিভ পার্টি। তারা ইইউ থেকে ব্রিটেনকে সরিয়ে আনার পক্ষে গণরায় পেলেও জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কিভাবে এ জন্য ‘সম্মানজনক’ চুক্তি করা যায়; সেটা এই সরকারের মাথাব্যথার একটা বড় কারণ। এবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপিদের অধিকাংশ ব্রেক্সিটের বিরোধিতা করায় থেরেসা মে সরকার কর্তৃক দেশকে ইইউ থেকে প্রত্যাহার করে আনার স্বপ্ন বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রী উভয় সঙ্কটে। আগের সিদ্ধান্ত মাফিক ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার আগে এই জন্য মর্যাদাকর চুক্তির বিষয়ে বিরোধী দলের সাথে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। অপর দিকে, তার রক্ষণশীল দলের সরকার এবং এতে নিজের নেতৃত্ব রক্ষা করা থেরেসার জন্য খুব কঠিন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, ব্রিটেনের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সঙ্কট ও টানাপড়েন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কতটা ও কেমন অভিঘাত সৃষ্টি করে, সেটাই লক্ষ করার ব্যাপার।
১৫ ডিসেম্বর ব্রেক্সিট ইস্যুতে পার্লামেন্টের ভোটাভুটিতে ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দল কেবল শোচনীয়ভাবে হারেনি, এর নেত্রী হিসেবে খোদ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে। এই পরাজয় যতটা না দলের, তার চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে ব্রেক্সিট প্রশ্নে অনমনীয় সরকারপ্রধান থেরেসা মে’র। তার দলের দু-একজন নন, এক সাথে ১১৮ জন এমপি ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে ভোট দিলেন! এটা বিরোধী দল লেবার পার্টির রাজনৈতিক অবস্থানের বিজয়সূচক শক্তি অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, এর আগে ব্রেক্সিট পক্ষ গণভোটে কোনো মতে উৎরে গেলেও ব্রিটেনের জনগণ এই ইস্যু নিয়ে গভীরভাবে দ্বিধাবিভক্ত ছিল এবং গত কয়েক মাসে ব্রেক্সিটের সম্ভাব্য ক্ষতির বিষয় জনমনে ও এমপিদের মাঝে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
ব্রেক্সিট ভোটে ‘গণতন্ত্রের মডেল’, ব্রিটেনের পার্লামেন্টে পক্ষে ২০২ জন এমপির ভোট পড়েছে। তবে বিপক্ষে ছিলেন এর দ্বিগুণেরও বেশিÑ ৪৩২ জন। লক্ষ করার বিষয় হলো, সরকারবিরোধী শ্রমিক দলের মাত্র তিনজন দলের নেতৃত্বের সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে ব্রেক্সিট সমর্থন করেছেন। অপর দিকে, ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এমপি ব্রেক্সিট ইস্যুতে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। তাদের সংখ্যা ১১৮। ব্রেক্সিটবিরোধী এই রক্ষণশীলদের নেতৃত্বে আছেন কিছু দিন আগে পদত্যাগী, প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী বরিস জনসন এবং তার সাথে, রিস মগ। আরেকটি দিক উল্লেখ করার মতো। তা হচ্ছে, বেক্সিট প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে ব্রিটেনের প্রদেশগুলোর মধ্যে স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড ছিল মোটামুটিভাবে বিপক্ষে। এবার পার্লামেন্টের ভোটাভুটিতেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) ৩৫ এমপি ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে (মানে, ব্রিটেন ইইউ ত্যাগ না করার পক্ষে)। সেখানে উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির (ডিইউপি) ১০ এমপিও ব্রেক্সিট ইস্যুতে সরকারের বিপক্ষে মত দিলেন। এর মানে, তারা চান ব্রিটেন যেন ইইউ ত্যাগ করে বেরিয়ে না আসে।
পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ব্রেক্সিট ইস্যুতে বিপক্ষের ৪৩২ জন এমপির মধ্যে সর্ববৃহৎ অংশটি শ্রমিক দলের। তাদের সংখ্যা ২৪৮ এবং তারা দলীয় প্রধান করবিনের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। এর পরই আসে জনসন-মগের নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীলদের ১১৮ জন এমপির কথা। ব্রেক্সিটের বিপক্ষে আরো আছেন এসএনপির ৩৫ জন, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা লিবডেম ১১ জন, ডিইউপির ১০ জন, স্বতন্ত্র পাঁচজন, প্লাইড কামরির চারজন এবং পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টির একজন এমপি।
এদিকে, ব্রেক্সিটের পক্ষে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির ১৯৬ জনের সাথে ছিলেন মাত্র ছয়জন। তাদের অর্ধেক লেবার পার্টির ভিন্ন মতদাতা এবং বাকি অর্ধেক স্বতন্ত্র।
থেরেসা মে সরকার আস্থাভোটে সৌভাগ্য বলে টিকে যাওয়ার পরপরই আলজাজিরা থেকে গ্যাভিন ও’ টুলির একটি ভাষ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এই ব্রিটিশ সাংবাদিক ও কলামিস্ট বলেছেন, এখন থেরেসা মে’র সামনে সুযোগ ও শঙ্কা- দুটোই অপেক্ষা করছে। ‘শঙ্কা’ হলো, তাকে হয়তো আবার আস্থা ভোটের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। আর ‘সুযোগ’ হচ্ছে, নিজের রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর সুরাহা করার প্রয়াস চালানোর সুযোগ পেতে পারেন তিনি। তবে ‘এখনও তার বিপদ পুরোপুরি কাটেনি।’ বাস্তবতা যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে বলা চলে ব্রেক্সিটের ‘ভূতের আছর’ থেকে থেরেসা মে মুক্ত না হলে ব্রিটেনের রাজনৈতিক অনিশ্চিত অবস্থা কাটবে না।
Hard হোক আর Soft হোক, Brexit-ই যদি এই বুড়ো বৃহৎশক্তির নিয়তি হয়, তাহলে ভবিষ্যতে অন্তত অর্থনীতির ক্ষেত্রে দেশটির জন্য কী অপেক্ষা করছে, কে জানে? এখন বিশ্বের বৃহত্তম বৃহৎশক্তি, তথা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে গণ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবুও ‘বনেদি’ সাবেক ঔপনিবেশিক পরাশক্তি ‘ব্রিটেন’ নামক দেশটার লোকসংখ্যা ও আয়তনের চেয়ে আজো তার আন্তর্জাতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। যদিও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত না যাওয়ার সে অতীত আর নেই; তবুও এর রাজধানী লন্ডন আজও বিশ্বে বিভিন্ন দিক দিয়ে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নগর এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির দিক দিয়ে ব্রিটেনকে উপেক্ষা করা সহজ নয়। তবে ব্রেক্সিট সত্যি সত্যিই বাস্তবায়িত হলে ব্রিটেনের শক্তি ও সুবিধা কিছুটা হলেও কমবে এবং ঘরে বাইরে ‘যুক্তরাজ্য’ নামের এই রাষ্ট্র বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হবে বলেই সবার ধারণা। আগামী মার্চ মাসের মধ্যে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া কার্যকর হওয়ার কথা।
এটা বিস্ময়কর মনে হতে পারে, ১৫ জানুয়ারি থেরেসা মে পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট ইস্যুতে শোচনীয়ভাবে হেরে গেলেন, তিনি পরদিনই সেই পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে জিতলেন। আসলে এর মূল কারণ হলো, ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের ১১৮ জন এমপি ব্রেক্সিট প্রশ্নে নিজেদের দলের নেতৃত্ব ও মূলধারার সাথে ভিন্ন মত প্রকাশ করে বিরোধী শ্রমিক দলের সাথে অভিন্ন অবস্থান নিয়েছিলেন। তবে তারা আস্থা ভোটের সময় থেরেসা মে’র নেতৃত্বাধীন, তথা নিজেদের দলের সরকারের প্রতি আস্থা ঘোষণা করেছেন। ১৫ তারিখে পার্লামেন্টে খোদ রক্ষণশীলদের বিরাট অংশের বিরোধিতাসহ বিপুল ব্যবধানে ব্রেক্সিটপক্ষ হেরে গেলে বিরোধী দলের নেতা জেরেমি করবিন এ সুযোগে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন। ব্রেক্সিট প্রশ্নে করবিনের লেবার পার্টি বা শ্রমিক দলের সাথে একাত্ম ছিল লিবডেম, এসএনপি, প্লাইড কামরি, গ্রিন পার্টি প্রমুখ দল। তারা অনাস্থা ভোটের সময়েও করবিনকে সমর্থন জোগায়।
ফলে তিনি অনেকটা নিশ্চিত ছিলেন যে, এবারের ধাক্কা আর থেরেসা মে সামলাতে পারবেন না। কিন্তু মে’র দলের সেই ১১৮ জন এমপি প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে একদিনের ব্যবধানে, সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে থেরেসার পতন আপাতত রোধ করেছেন। এটাকে বাংলাদেশের কায়দায় রাজনৈতিক ‘ডিগবাজি’ না বলে বরঞ্চ এর কারণটার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া উচিত। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, এই ১১৮ এমপি সম্ভবত মাত্র আট মাসের ব্যবধানে পার্লামেন্ট নি¤œকক্ষের আরেকটা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নন। সরকার সংসদে আস্থা হারালে নতুন করে নির্বাচনের আয়োজন করতে হতো। আগের দিনই জানা গিয়েছিল, ব্রেক্সিট ইস্যুতে থেরেসার আসন যতই নড়বড়ে হোক, আস্থা-অনাস্থা ইস্যুতে তার সরকারকে হঠানো সহজ নাও হতে পারে। কারণ থেরেসার দলে ব্রেক্সিট প্রশ্নে বিভাজন থাকলেও দলের সরকার বহাল রাখার পক্ষে তারা সবাই একমত। তদুপরি উত্তর আয়ারল্যান্ডের প্রভাবশালী আঞ্চলিক দল, ডিইউপি ব্রেক্সিট প্রশ্নে শ্রমিক দলের অনুগামী হলেও তারা কোনোভাবেই শ্রমিক দলীয় সরকার চাচ্ছেন না। এ অবস্থায় শিগগিরই আরেকটা সাধারণ নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় ফেরার যে আশা করেছিলেন জেরেমি করবিন, তা আপাতত অপূর্ণ রয়ে গেছে। শ্রমিক দলনেতা করবিন চান, ব্রেক্সিট অপরিহার্য হলে তা করতে হবে ‘জনপ্রিয়’ একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে। এ জন্য দেশের ভেতরে সব দলের সাথে এবং দেশের বাইরে আবার ইইউ নেতাদের সাথে আলোচনা করতে হবে।
এদিকে করবিনের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক দলের এমপি এবং সদস্যদের অনেকে চান, ব্রেক্সিট ইস্যুতে আবার গণভোট হোক। ২০১৬ সালের প্রথম গণভোটের বিপরীত রায় ২০১৯-এর দ্বিতীয় গণভোটে পাওয়ার ব্যাপারে তারা আশাবাদী। এর পাশাপাশি, আবার পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আনার বিষয়টিও শ্রমিক দলে বেশ আলোচিত হচ্ছে। দলের অন্তত কিছু এমপির মতে, এটাই রক্ষণশীলদের ক্ষমতার অবসান ঘটানোর ‘টেকসই কৌশল।’
ব্রেক্সিটের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইইউ, তথা ইউরোপসহ বহির্বিশ্বে অনেক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা স্বাভাবিক। এখন দেখা যাচ্ছে, ব্রেক্সিট ইস্যু ব্রিটেনের ঘরোয়া রাজনীতির অঙ্গনে প্রধান দু’দলের জন্যই অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। এক দিকে, রক্ষণশীল দলের সরকার এবার বরাতজোরে বেঁচে গেলেও এর আয়ু কত দিন, তার গ্যারান্টি নেই। অন্য দিকে, এই সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ, শ্রমিকদল এখন কী পদক্ষেপ নেবে, সে প্রশ্নে দলের নেতাদের দৃশ্যত ‘পরস্পরবিরোধী’ বক্তব্য বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে। ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার’ প্রবাদ থেকে প্রেরণা পেয়ে এ দলের একাংশ অচিরেই পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের পক্ষপাতী। অপরাংশের মতে, এটা করা হবে অর্থহীন কাজ। ভাষ্যকার গ্যাভিন ও টুলির ভাষায়, ‘এ নিয়ে শ্রমিক দলের ভেতরে যে লড়াই, এর ফল কী হবে, কেউ বলতে পারছেন না।’
প্রশ্ন হলো, শ্রমিক দলের নেতা করবিনসহ সিনিয়র নেতারা আবার রেফারেন্ডাম বা গণভোটের পরিবর্তে সরাসরি নতুন নির্বাচন চাচ্ছেন কেন? জবাব হচ্ছে, তারা আসলে ব্রেক্সিট ইস্যুতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চাচ্ছেন। থেরেসা মে’র আশঙ্কা, আবার অনাস্থা ভোটের আয়োজন করা হলে তার দল ঘটনাক্রমে হেরেও যেতে পারে। আর জেরেমি করবিনের আশঙ্কা, আবার গণভোট হলে প্রথম দফার মতো যদি বেক্সিটের পক্ষে গণরায় ঘোষিত হয় (যত অল্প ব্যবধানেই হোক)! মোট কথা, ‘বেক্সিট ব্যাধি’ ব্রিটিশ রাজনীতির উভয়পক্ষের জন্য উদ্বেগ ও অস্বস্তির হেতু হয়ে উঠেছে।
জানা গেছে, কিছু দিন আগে শ্রমিক দলের সম্মেলনে দলীয় নেতারা বলেছিলেন, ব্রেক্সিট নিয়ে আবার গণভোটের দরকার হবে না। কারণ নতুন করে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার মতো ‘অবস্থা তারা সৃষ্টি করতে পারবেন’। এ কারণে এখন মনে করা হচ্ছে, মাত্র দু’তিন সপ্তাহের মধ্যে আবার হয়তো থেরেসা সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। এভাবে ‘ধাক্কার পর ধাক্কা’ দিয়ে সরকার পক্ষকে দুর্বল করার প্রত্যাশার পাশাপাশি, থেরেসাও বসে নেই। তিনি ব্রেক্সিট প্রশ্নে বৈঠক শুরু করেছেন বিরোধী দলগুলোর নেতাদের সাথে।
পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে দেখা যায়- ‘কেহ কারে নাহি হারে, সমানে সমান’-এর মতো। পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে জিতেই আর দেরি করলেন না প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। তার সরকার নবজীবন পেয়েছে এই ভোটাভুটিতে। এখন তিনি এই জীবনের ‘আয়ুষ্কাল যাতে স্বাভাবিক হয়’, তা নিশ্চিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। একটি পত্রিকা লিখেছে, থেরেসা মে কোনোটিতে হারছেন (ব্রেক্সিট ইস্যু), কোনোটিতে জিতছেন (আস্থা ভোট), তার দম ফেলার ফুরসত নেই। কার্যত তিনি দম ফেলার সুযোগ পেলেন আস্থা ভোটে মাত্র ১৯ ভোটের ব্যবধানে জিতে নিজের সরকারকে টিকাতে পেরে। আগের দিন ব্রেক্সিট ইস্যুতে তিনি হেরে গিয়েছিলেন ২৩০ ভোটের ব্যবধানে। অর্থাৎ পর দিনের চেয়ে ১৩ গুণ বেশি ভোটের ব্যবধান ছিল আগের দিন। ১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যার আস্থাভোটের মহাবিপদ কাটিয়ে উঠে সে রাতেই থেরেসা মে সংলাপ শুরু করে দেন। তখন তিনি একের পর এক বৈঠকে বসলেন বিরোধী দলের নেতাদের সাথে। তার পরিকল্পনা হচ্ছে, আগামীকাল সোমবারের মধ্যে নতুন প্রস্তাব পেশ করা, যাতে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় সফল হতে পারেন।
বিদ্যমান সিদ্ধান্ত মোতাবেক, ২৯ মার্চের মধ্যে বিচ্ছেদ কার্যকর হবে ব্রিটেনের। এর অর্থ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কয়েক দশকের সম্পর্ক আর থাকছে না তাদের। হাতে আছে মাত্র ৬৮ দিন। ব্যক্তিগত বিচ্ছেদের ক্ষেত্রেই যেখানে নানা অভাবনীয় ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, সেখানে ব্রেক্সিটের মতো রাষ্ট্রীয় বিচ্ছেদের (তা-ও, বহু দেশের মহাদেশীয় মোর্চার সাথে) প্রভাবে ব্রিটেনে তাৎক্ষণিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়া অসম্ভব নয়। সম্ভাব্য সে সঙ্কট এড়াতে দ্রুত এমন চুক্তিতে পৌঁছতে হবে ব্রিটেনকে যা একই সাথে মর্যাদাকর ও বাস্তবসম্মত।
২০১৬ সালে ব্রেক্সিটের পক্ষে ব্রিটেনের অবস্থান সূচিত হওয়ার পর, আড়াই বছরের প্রয়াসের ফল ছিল গত নভেম্বর মাসে ইইউর সাথে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র চুক্তি। কিন্তু গত ১৫ তারিখে পার্লামেন্টে এটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এতে হঠাৎ অচলাবস্থার জের ধরে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয় থেরেসা সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু ৩২৫-৩০৬ ভোটে রক্ষণশীল দলের এই সরকার টিকে যেতে সক্ষম হয়েছে। মাত্র আগের দিন, ব্রেক্সিট ইস্যুতে উভয়পক্ষে কমবেশি বিদ্রোহ ঘটলেও আস্থা-অনাস্থা প্রশ্নে ‘বিদ্রোহী’ ছিলেন না কেউ।
তখন থেরেসা মে’র ভাগ্য যেন সূক্ষ্ম সুতায় ঝুলছিল। কারণ, শরিক দলের ১০টি ভোট বিপক্ষে গেলেও (এক ভোটের ব্যবধানে) ক্ষমতাচ্যুত হতো তার সরকার। উল্লেখ করা দরকার, আইরিশদের ডিইউপি দলের ১০ জন এমপি ব্রেক্সিট প্রশ্নে সরকারের বিপক্ষে থাকলেও পরদিন আস্থা ভোটের সময় সরকারের পক্ষে ছিলেন। আরেক আইরিশ সংগঠন সিন ফেইনের সাত এমপি কিন্তু ব্রেক্সিট ইস্যুতে নিরপেক্ষ থাকেন, যেমনটি ছিলেন হাউজ অব কমন্সের স্পিকার ও তিনজন ডেপুটি স্পিকার।
পার্লামেন্টে পরপর দু’দিন দু’দফায় গুরুত্বপূর্ণ ভোটাভুটির পর এখন চলছে রাজনৈতিক বিতণ্ডা। প্রধানমন্ত্রী তার ‘রাজনৈতিক প্রাণ’ ফিরে পেয়ে বলছেন, ব্রেক্সিট প্রশ্নে ‘জনগণের দেয়া রায় বাস্তবায়নের চেষ্টা’ করে যাবেন। আর বিরোধীদলীয় নেতা করবিনের হুঁশিয়ারি, ‘চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট নয়।’ এদিকে লিবডেম এবং এসএনপির সাথে প্রধানমন্ত্রী ত্বরিত বৈঠকে বসতে পারলেও লেবার পার্টি বা শ্রমিক দল তার সাথে আলোচনায় রাজি হয়নি। প্রতিক্রিয়ায় থেরেসার বক্তব্য, ‘আমাদের দুয়ার সর্বদাই খোলা।’ এখন তিনি জাতীয় স্বার্থে এক হওয়ার ডাক দিয়ে ব্রেক্সিট বিপদ কাটিয়ে ওঠার কোশেশ করছেন।
প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের সাথে কয়েকটি বিরোধী দলের বৈঠকে কী কথা হয়েছে? এটা জানার জন্য সবার কৌতূহল। লিবডেম নেতা ভিন্স ক্যাবল বলেন, তার সাথে বৈঠকে আবার গণভোটের দাবি জানিয়েছি। এসএনপি নেতা ইয়ান ব্ল্যাকফোর্ড বলেছেন, ব্রেক্সিট কার্যকর করার সময় বাড়িয়ে না দিলে গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ সঙ্কীর্ণ হয়ে যাবে। প্লাইড কামরি নেতা স্যাভাইল রোবার্ট জানান, আবার গণভোট করা এবং চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট নাকচ করার কথা তিনি বলেছেন সরকারপ্রধানকে।
ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দল এবং এর নেত্রী থেরেসা মে এক মুহূর্তও নষ্ট করতে চাচ্ছেন না। তাই তিনি যেমন বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠকে বসেছেন, তেমনি সিনিয়র মন্ত্রীরা আলোচনা করেছেন বিরোধী দলের অন্যান্য নেতার সাথে। উভয়পক্ষের ‘বিদ্রোহী’দের ম্যানেজ করার জন্যও তাদের সাথেও কথা বলা হবে। এতকিছু সত্ত্বেও আসল যে কাজ, অর্থাৎ ব্রেক্সিটকে ব্রিটেনের জন্য ‘লাভজনক’ করা, তার কি কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পেরেছেন?
পত্রিকার ভাষায় ‘এসব আয়োজনের সব কিছুই, গৃহবিবাদ নিরসন করে সম্মিলিত একটি প্রস্তাব প্রণয়নের প্রয়াস মাত্র। কিন্তু ইইউর সাথে দেনদরবার তো বাকি রয়ে গেছে।’
পাদটীকা : ব্রেক্সিট ইস্যুতে ব্রিটেনে চলছে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আন্দোলন। বিক্ষোভকারীদের প্লাকার্ডের কথাগুলো নজর কেড়েছে অনেকের। কোনো প্লাকার্ডে "Don't Betray Britain"-এর মতো সতর্ক বাণী। কোনোটাতে এমন কথা লেখা, যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘আমরা অনেক আগেই ইইউ ত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছি। তবুও আমাদের বের করে দেয় না কেন? ’ আর লন্ডনে পার্লামেন্টে বাইরে একটি ব্যঙ্গচিত্রে দেখানো হলো, ‘ব্রেক্সিট’ লেখা বেদিতে পা তুলে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে আপন মনে বেহালা বাজিয়ে চলেছেন। এটা শুনে জনগণ বিরক্ত হচ্ছে কি না, সেদিকে তার কোনো খেয়ালই নেই!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা