২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এখনো নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে উৎকণ্ঠা

এখনো নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে উৎকণ্ঠা - ছবি : সংগৃহীত

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্য সব জাতীয় নির্বাচনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হলেও নানা বিবেচনায় এবারের নির্বাচনের একটা ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। কেননা প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘ ১০ বছর পর একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে যাচ্ছে। দেশের ভোটারেরা এবার হয়তো সুযোগ পেতে পারে নিজেদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দেয়ার। আশা করা যায়, বহু তরুণ নতুন ভোটার এবার প্রথমবারের মতো ভোট দেয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। উপযুক্ত বয়সে ভোট দেয়ার অধিকার অর্জন সব নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার। গত ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ নাগরিকদের ঘটেনি। কার্যত নির্বাচন ছাড়াই সেই ২০১৪ সালে গঠিত হয়েছিল নানা বিতর্কে বিতর্কিত একটি সরকার। সেই সরকারের অধীনেই এখন নির্বাচন হতে চলেছে। তবে দেশের এখন যে পরিস্থিতি তাতে এই আশঙ্কা গভীরভাবে দেখা দিয়েছে যে, নির্বাচনী ব্যালট পেপারেই সব দল ও জোটের মনোনীত প্রার্থীদের নাম থাকবে বটে; কিন্তু ভোটারদের পক্ষে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে পছন্দের ব্যক্তিদের ভোট দেয়ার পরিবেশ থাকবে কি না। সে ব্যাপারে আছে নানা মহলের নানামাত্রিক সংশয়। বিশেষ করে একদলের প্রার্থী-সমর্থকদের যে উগ্রতা দেখা যাচ্ছে, তাতে তাদের আচরণ ভোটের দিন কতটা উচ্চ মার্গে গিয়ে পৌঁছবে তা আঁচ করা কঠিন নয়।

আর দেশের প্রায় অর্ধেক ভোটার নারীসমাজ। নির্বাচনী পরিবেশ যদি অনুকূল না হয়, তবে সেখানে পুরুষদের উপস্থিত হওয়াই তো অনিরাপদ। তাই নারীদের উপস্থিতির বিষয়টি তো চিন্তাই করা যায় না। সে ক্ষেত্রে এবারের কাক্সিক্ষত নির্বাচন আর ফলপ্রসূ হবে কোথায়? নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সরকারি দলের হামলা-নির্যাতন বন্ধ করার দাবি করা হচ্ছে বারবার। কিন্তু কমিশন এসব অভিযোগ উপেক্ষা করে মূকবধির থেকে মূর্তির মতো আচরণ করছে। তাই এই গুরুতর প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে সাংবিধানিক দায়দায়িত্ব ক্ষমতা কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে অঙ্গীকার কমিশন কর্তৃপক্ষ সংবিধান ছুঁয়ে করেছে; এর কী জবাব দেয়া হবে। তা ছাড়া, এই নির্বাচন যদি অবাধ নিরপেক্ষ না হয়, তবে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে প্রত্যাশা তা ভণ্ডুল হয়ে যাবে। আর এর ফলে দেশে যে অস্থিরতা ও অরাজকতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে, সে জন্য নির্বাচন কমিশনকে এর দায়িত্ব বহন এবং জাতির কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে।

ভোটের মাত্র কিছু দিন বাকি থাকলেও এখনো এই আশঙ্কা বিভিন্ন মহল থেকে করা হচ্ছে, আদৌ নির্বাচন হবে কি না। নির্বাচনের প্রাক্কালে এখন এই আশঙ্কা পোষণের বহু কারণ রয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগে কমিশনের জ্যেষ্ঠ কমিশনার হতাশার সুরে বলেছেন, ভোটের ময়দানে এখন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে মনে করি না। যে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচনে সব প্রার্থীর জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা। এখন তারাই যদি এ ক্ষেত্রে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তাহলে এটাই কি মনে করতে হয় না যে, পরিস্থিতি কতটা নাজুক। এখন ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হচ্ছে। তাই সরকারি দলের প্রার্থীরা পূর্ণ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিয়েই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। ফলে প্রশাসন তাদের হুকুমবরদারি শুনতে বাধ্য। তা ছাড়া, সরকার কিছু দিন আগে প্রশাসনকে তাদের সুবিধামতো করে বিন্যাস করেছে। তাই এসব সরকারি কর্মকর্তা সরকারি দলের প্রার্থীদের সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবেন সন্দেহ নেই।

নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থাহীনতা এবং তাদের অসহায়ত্ব সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একটা অনিশ্চিত অবস্থা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেই যদি নির্বাচন করিয়ে নেয়া হয়, তবে সে নির্বাচন বিশুদ্ধ হবে না। গণতন্ত্রের প্রধান অনুশীলন হচ্ছে নির্বাচন তথা দেশের মানুষের পছন্দের বহিঃপ্রকাশ। একে পাশ কাটিয়ে যদি ২০১৪ সালের মতো যেনতেনভাবে নির্বাচনী নাটক সাজানো হয়। তবে যে উদ্দেশ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা হচ্ছে- একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন করা, সে প্রত্যাশা পূরণ হবে না। রাষ্ট্রে গণতন্ত্র বহাল করার লক্ষ্যেই প্রকৃতপক্ষে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। কমিশন তার প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্যই তাকে গণতন্ত্রের মূল চেতনা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব শর্ত পূরণ করা। আর সে লক্ষ্যে সংবিধান তাদের যথেষ্ট ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু গত কয়েকটি নির্বাচনে কমিশনের যে ভূমিকা তাতে এ কথা বলা যাবে না যে, তারা তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কিছুমাত্র সফলতা পেয়েছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে সঙ্কট দীর্ঘ দিন ধরে চলছে, তার অন্যতম একটি কারণ কমিশনের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা। কমিশন গত ২০১৪ সালের নির্বাচনে সরকারের অনুকূলে ভূমিকা রেখেছে। এবারো এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনের যে চেহারা ফুটে উঠেছে, তাতে তারা নিরপেক্ষতা বজায় না রেখে সরকারি জোটের প্রার্থীদের প্রতি প্রকাশ্যে আনুকূল্য প্রদর্শন করছেন।

ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করার ঘটনা বিভিন্ন স্থানে ঘটছে। নির্বাচনী প্রচারকাজ পরিচালনার সময় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের ওপর সশস্ত্র হামলা করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অন্যায়ভাবে ঐক্যফ্রন্টের লোকদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা ও আটক করে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছে। এসব অন্যায়-অঘটনের প্রতিবাদে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা কমিশনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে এ কথা বলা যায় যে, নির্বাচনকে একটা প্রহসনে পরিণত করার সব আয়োজন চতুর্দিক থেকে করা হচ্ছে। এর কোনো প্রতিবিধানের উদ্যোগ নেই। অথচ কেউ এটা ভাবছে না যে, গণতন্ত্রের এমন করুণ দশা এই শাসনপদ্ধতির ভবিষ্যৎকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে তুলছে। আর এর পরিণতি দেশের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনবে।

এখন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাতে শুধু দেশবাসীই আতঙ্কিত নয়; যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় কমিশন এবং জাতিসঙ্ঘ সমভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দলীয় বাহিনীর মতো আচরণ করা এবং বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের যেভাবে হয়রানি করছে, তাতে তাদের পক্ষে নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক সমাজের দৃষ্টি এড়ায়নি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের এবং উল্লেখিত বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হবে।

এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী তাদের দক্ষতা ও কর্তব্যপরায়ণতার জন্য বহির্বিশ্বে সমাদ্রিত। তারা আন্তর্জাতিক শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ভবিষ্যতে যাতে এই দায়িত্ব অব্যাহতভাবে পালন করতে পারেন, সে জন্য তাদের ভূমিকা কখনোই এমন হওয়া উচিত হবে না, যাতে তারা নিন্দিত হবেন। বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষার কাজে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা শুধু সম্মানই অর্জন করছেন না, দেশের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন। এখন নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার কাজে তাদের বিরুদ্ধে যদি দলপ্রীতির অভিযোগ ওঠে, সুষ্ঠু ভোটের ব্যাঘাত ঘটে; তবে তারা আগামী দিনে একটি অরাজক পরিস্থিতি ডেকে আনবেন। এ জন্য তাদেরও মূল্য দিতে হবে।

আশা করা যায়, সেনা মোতায়েনে নির্বাচনী পরিবেশের একটি ইতিবাচক অগ্রগতি ঘটবে। এখন যাদের ভূমিকার কারণে পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, তারা তা থেকে বিরত হবে। অতীতে যেসব নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হয়েছে, সেসব নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের সেনা সদ্যরা শান্তির সময়ও বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছেন। তাদের ওপর দেশবাসীর আস্থা অপরিসীম। তাই এবার নির্বাচনে ভূমিকা রেখে তারা গণতন্ত্রের এই গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলনকে সফল করে তুলবেন। এবার সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা দেশের জনগণের ভোটাধিকারই শুধু ফিরে আসবে না, একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। যে সরকার শুধু দেশে গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করবে না, গণতন্ত্রের পাশাপাশি উন্নয়নের ধারাকেও ত্বরান্বিত করবে। কেননা গণতন্ত্র ও উন্নয়ন পাশাপাশি হাঁটে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে শাসনব্যবস্থায় একটা জবাবদিহিতা আসে। তাতে সুশাসন বিকাশ লাভ করে। সুশাসন দেশে অনিয়ম অন্যায় দুর্নীতিকে রোধ করতে সক্ষম হবে। এখন সুশাসন নেই বলে দুর্নীতি দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে।

নির্বাচনে সহিংসতার যে ব্যাপকতা এবং এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে পক্ষপাতিত্ব, তাতে প্রশাসনিক বিপর্যয়ের সাথে নাগরিকদের জান-মালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। অথচ একটি নিয়মতান্ত্রিক দেশে সরকারের দায়িত্ব নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই দায়িত্ব পালনে সরকারের চরম অক্ষমতা থেকে এটাই প্রমাণ হয়, তারা সুশাসন কায়েমের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। গত ১০ বছরে দেশে একটি জিনিসেরই প্রসার ঘটে আর সেটি হলো অনিয়ম-দুর্নীতি। বিশ্বের যেসব দেশ দুর্নীতির শীর্ষে রয়েছে, দুর্ভাগ্য হচ্ছে সে তালিকায় বাংলাদেশের নাম ওপরের সারিতেই অবস্থান করছে। সরকারি মহলেই এই ব্যাধির প্রকোপ বেশি। দুর্নীতি রোধের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় সংস্থা থাকলে সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটায় তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এবারের নির্বাচনে সরকারি দলের যেসব প্রার্থী দ্বিতীয়বারের মতো ভোট করছেন, তাদের গত পাঁচ বছরের অর্থবৈভব অবিশ্বাস্য মাত্রায় বেড়েছে। এসব প্রার্থী রাজনীতিতে এসে একে পেশায় পরিণত করেছেন। তারা এখানে অর্থলগ্নি করে তা সুদ-আসলে তুলে নেবেন। যেহেতু তারা বিজয়ী হওয়ার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করবেন, সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কলুষিত হবে। এসব ক্ষেত্রে যারা নব্য, পক্ষান্তরে যারা সুস্থ রাজনীতির ধারক-বাহক, যারা রাজনীতিকে দেশসেবা হিসেবে নিয়েছেন; তারা নির্বাচনে অর্থ ব্যয় করতে সমর্থ হবেন না। ফলে দেশের রাজনীতি বিত্তশালীদের হাতে গিয়ে পড়বে। রাজনীতিতে এসব ব্যক্তি নিয়ামক হয়ে উঠবেন। একই সাথে এ কথাও বলা যায়, নির্বাচনে অর্থবিত্ত প্রবেশ করলে ভোটে সৎ ব্যক্তিদের বিজয়ী হওয়া সম্ভব হবে না। তাতে গণতন্ত্রের মূল চেতনাই বিনষ্ট হয়ে যাবে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছে।

এমন পরিস্থিতিতে ভোটের রাজনীতিতে জনগণের যে প্রধান ভূমিকা তা এখন গৌণ হয়ে পড়বে। এটা কোনো বিশেষ দলকে বিজয়ী করতে পারে বটে, কিন্তু সেটি সত্যিকার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে ধ্বংস করবে। নিয়ম, আইনকানুন যদি মূল্যহীন হয়ে পড়ে, তবে সেখানে শুদ্ধতার যে শূন্যতা দেখা দেবে তা পূরণ করতে এগিয়ে আসতে পারে উগ্রবাদ। যা না দেশের কোনো কল্যাণ করবে, না সমাজ জীবনে বজায় থাকবে শান্তিশৃঙ্খলা। সব কিছু তখন অরাজকতার আঁধারে নিমজ্জিত হবে।
ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement