২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কেশহীনার স্বপ্নবিলাস

কেশহীনার স্বপ্নবিলাস - নয়া দিগন্ত

সাবেক সোভিয়েত কমিউনিস্ট নেতা জোসেফ স্টালিনের ভাষায়,‘জনগণের জন্য এটা জানাটাই যথেষ্ট যে, দেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যারা ভোট দেন, তারা কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন না। যারা ভোট গণনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন, তারাই সিদ্ধান্ত নেন ফলাফল কী হবে।’ সবার জানা, এই স্বৈরশাসক নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না।

রাজনীতিকদের তুলোধুনো করতে ছাড়েননি আরেক সাবেক সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশ্চেভ। তিনি মনে করেন,‘রাজনীতিবিদরা বিশ্বের সব জায়গায় একই রকম। তারা আপনাকে বিশাল সেতু বানিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেবেন, যেখানে হয়তো কোনো নদীই নেই।’

মার্কিন কমেডিয়ান রবিন উইলিয়াম পুরো রাজনীতিকেই রীতিমতো ধোলাই দিয়েছেন। তিনি রাজনীতির সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন, ‘পলিটিক্স’ শব্দটির ‘পলি’ (poli) হচ্ছে লাতিন শব্দ, যার অর্থ ‘অনেক বা বহু’। আর ‘টিক্স’ (tics) হচ্ছে ‘রক্তচোষা পোকা’। কথাটা কিছুটা শ্রুতিকটু মনে হলেও তার বাস্তব প্রমাণ স্টালিন নিজেই। তিনি ‘সাম্যবাদী’ হলেও অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন, যা তার ঘোষিত আদর্শের সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।

যা হোক, নির্বাচন নিয়ে স্টালিনের বক্তব্য যে অমূলক এমনটা বলার সুযোগ নেই। কারণ, আত্মপূজা করতে গিয়ে ‘গণতন্ত্রবাদী’রাই গণতন্ত্রে কালিমা লেপন করেছেন। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তো গণতন্ত্রের সঙ্কট আরো প্রবল। ভোটাররা যেসব ক্ষেত্রেই নির্বাচনে নিয়ামক শক্তি হন না, এ কথাও সত্য।

আমরা বেশ চড়ামূল্য দিয়েই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু আমাদের মানসিকতার কারণেই গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম আজো শেষ হয়নি। সংগ্রামের দীর্ঘ পরিক্রমায় কখনো কখনো সাফল্যের সম্ভাবনাও হাতে এসে ধরা দিয়েছে। কিন্তু তা আমরা এগিয়ে নিতে পারিনি, বরং অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে।

দীর্ঘ সংগ্রামের সুফল হিসেবে জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার বাস্তবতায় আমাদের সংবিধানে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের বিধান সংযোজিত হয়েছিল। এর সুফলও আমরা পেতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু তা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। ফলে সংগ্রামী এ জাতিকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনকে গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। এই নির্বাচন থেকে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী সুবিধা গ্রহণ করলেও ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে হচ্ছে পুরো জাতিকে।

মূলত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো মহলেই বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি শতকরা প্রায় ৫ থেকে ১০ ভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে করা হয়। এ নির্বাচনের একটি ব্যতিক্রমী অনুষঙ্গ হচ্ছে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা, যা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন। তাই বিষয়টি বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে।

‘৫ জানুয়ারি’র নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ না নিলেও এবার কিন্তু তা হয়নি। এতে নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ হওয়ার বিষয়ে সংশয় আপাতত কেটে গেছে। আশা করা হয়েছিল, সরকার এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে হারানো গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনবে এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করবে।

কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য যতই সদিচ্ছা দেখাচ্ছে, সরকার ততই নির্বাচনী ময়দানকে অধিক অসমতল করে তুলছে। তফসিল ঘোষণার পর বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা, গণগ্রেফতার, জামিনে থাকা পুরনো মামলায়ও গ্রেফতার-হয়রানি অব্যাহত আছে। এমনকি বিরোধীদলীয় প্রার্থী গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে নির্বাচনী প্রস্তুতির মধ্যেই। ফলে সরকারি দলের প্রার্থীরা নির্বিঘ্নে নির্বাচনী প্রচারণা চালালেও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা আদালতে মামলা নিয়ে ব্যস্ত। একপক্ষ উন্মুক্ত ময়দানে নির্বিঘ্নে বিচরণ করলেও অপর পক্ষের হাত-পা বেঁধে দেয়া হয়েছে। বিষয়টি ক্ষমতাসীনদের কাপুরুষোচিত মানসিকতার পরিচয়।

নির্বাচন দৃশ্যত অংশগ্রহণমূলক হলেও সবার জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত হয়নি। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দাবি জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক মহলেও জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। প্রভাবশালী দেশ, দাতাসংস্থা এবং কূটনীতিকেরাও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির দাবিতে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বরাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, এমন প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের সাথে বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং আগামীতে বন্ধুত্ব থাকবে কি না, তা নির্ভর করছে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের ওপর।

নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি তো দূরের কথা, খোদ নির্বাচন কমিশনই বিরোধী দলের সাথে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে বলে মনে হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলীয় প্রার্থীরা বিরোধীদের চোখ উপড়ানো, কেন্দ্র দখলসহ প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন এখনো আছে ‘কালা পাহাড়ের নিদ্রায়’। সহসাই এই নিদ্রা ভঞ্জনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

বেসামরিক প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তিতেই ব্যস্ত রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সামান্য ত্রুটির কারণেও বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল করা হলেও গুরুতর অভিযোগের পর সরকারি দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। ঋণখেলাপি হওয়ায় কিছু মনোনয়ন বাতিল করা হয়; আবার একই অভিযোগে অভিযুক্ত, অনেকের মনোনয়ন বৈধ করা হয়েছে। তাই বর্তমান নির্বাচন কমিশন ও সরকারের সাজানো প্রশাসনের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারবে, এমন আস্থা কেউই রাখতে পারছে না।

অভিযোগ আছে, নির্বাচনকে অবৈধভাবে প্রভাবিত করার জন্যই সরকার গণপ্রশাসনকে ‘মনের মাধুরী মিশিয়ে’ সাজিয়েছে। এ দাবি যে একেবারে ভিত্তিহীন নয়, তা মাঠপর্যায়ের কিছু সরকারি কর্মকর্তার আচরণে সেদিকেই ইঙ্গিত করে। এমন বাস্তবতায় বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রশাসনের সচিব-বিভাগীয় কমিশনার-ডিসি-এসপিসহ ৯২ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে তাদের বদলি ও প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছিল নির্বাচন কমিশনে।

কিন্তু কমিশন এতে কান না দিয়ে শুধু নারায়ণগঞ্জের এসপিকে বদলি করে সেখানে আরো কট্টর আওয়ামীপন্থী ও বিতর্কিত ব্যক্তিকে পদায়ন করেছে, যার বিরুদ্ধে বিরোধী দলের হুইপকে প্রকাশ্যে পেটানোর অভিযোগ রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ‘হুদা কমিশন’ আরো একটি পাতানো ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের বেহুদা পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে।

মাঠপর্যায়ে ভোটের লাগাম যাদের হাতে, সেই রিটার্নিং অফিসারদের সরকারি দলের প্রার্থীর অনুকূলে নজিরবিহীন পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ নির্বাচনের আগেই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। বেশির ভাগ রিটার্নিং অফিসার আইনের অধীনে থেকে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে দলবাজি এবং খেয়ালখুশিমতো প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ-বাতিল করেছেন বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে।

সারাদেশে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও নির্বাচনী কাজে বাধাদানের ঘটনা ঘটছে। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় ড. কামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতারা হামলার শিকার হয়েছেন। পুলিশ পিটিয়ে প্রার্থীর পা ভেঙে দিয়েছে ও গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করছে, দেশের সব নির্বাচনী এলাকায় বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা হামলাসহ নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘দুঃখজনক’ বলেই দায় শেষ করেছে। বিরোধী দলের অভিযোগ- কমিশন নিরপেক্ষভাবে নয়, বরং সরকারি নির্দেশেই এই সব কাজ করছে। ‘সাক্ষী গোপাল’ নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও জোরালো প্রশ্ন উঠেছে।

মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী আদলে আবারো নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছেন। কিন্তু সব সময় যে সব কৌশল একইভাবে ফলদায়ক হয় না, তা বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমেই প্রমাণিত। ৫ জানুয়ারির যে কৌশল কাজে লেগেছে, এবার সে কৌশল কাজে না-ও আসতে পারে। একটা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনকে ভিত্তি করে সরকার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারলেও এবারের প্রেক্ষাপট আলাদা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সার্বিক পরিস্থিতি ক্ষমতাসীনদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই এবারে স্বপ্নবিলাসের অপমৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

এমনটি হয়েছিল এক কেশহীনা স্বপ্নবিলাসীর ক্ষেত্রে। বৈদ্যরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘গভীর রাতে নির্জন পুকুরে পরপর তিন ডুব দিলে তার চুল তিন হাত পর্যন্ত লম্বা হবে।’ বাস্তবেও হয়েছিল। কিন্তু সেই স্বপ্নচারিণীর মোটেই পরিমিতি বোধ ছিল না। তাই সে তার কেশরাশি আরো প্রলম্বিত করার জন্য চতুর্থ ডুব দিয়ে বসেছিল। কিন্তু ফলটা হয়েছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। সাবেক অবস্থা বহাল; আগের মতোই কেশহীনা। আর পঞ্চম ডুবে মহাবিপত্তি। একেবারে বস্ত্রহীনা।

smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল