অনিশ্চয়তার নির্বাচন
- আলফাজ আনাম
- ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৮:০৫
বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার কিভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়, সম্ভবত তার অন্যরকম একটি নজির হতে যাচ্ছে এবারের নির্বাচন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এ দেশের মানুষ নতুন ধরনের নির্বাচন দেখেছে। বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করায় ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিরোধী দল বর্জন করেছিল আর ২০১৮ সালে বিরোধী দলকে নির্বাচনের মাঠ থেকে ঠেলে দেয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দল নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলের প্রার্থী ও ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে আসতে না পারে, সে জন্য প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। বিরোধী দল যতই জানাচ্ছে নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত তারা মাঠে থাকবে, ক্ষমতাসীন দল ততই মারমুখী হয়ে পড়ছে।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নিজেই বলেছেন, আমি মোটেও মনে করি না নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে কিছু আছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কথাটি এখন অর্থহীন কথায় পর্যবসিত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করলেই যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, তা-ও উঠে এসেছে এই নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য থেকে। তিনি বলেছেন, সব দল অংশগ্রহণ করলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা হয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের সাথে এর সম্পর্ক নেই। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়া একটি প্রাথমিক প্রাপ্তি। আসল কথা হচ্ছে, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে কি না এবং বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে কি না? নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য না হলে অংশগ্রহণমূলক হলেও কোনো লাভ নেই।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে দেশে যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে নির্বাচন উপলক্ষে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মারধরের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে মাত্র। অতীতে নির্বাচনের সময় বা নির্বাচনী প্রচারণায় কখনো শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা হামলা বা আক্রমণের শিকার হননি। এবার সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের চেয়ে বড় বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিরাপত্তার দিকটি। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রবসহ বেশ কিছু নেতাকর্মী হামলার শিকার হয়েছেন। তাদের গাড়ি ভাঙচুর ও সাথে থাকা কয়েকজন কর্মীকে রক্তাক্ত করা হয়েছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যক্তিরা যদি এমন স্থানে হামলা ও লাঞ্ছনার শিকার হন, সারা দেশে দলের নেতাকর্মীরা কোন পরিস্থিতির মধ্যে আছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা যাতে বাড়ির বাইরে বের না হন, সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় ক্ষমতাসীন দল। ইতোমধ্যে বিরোধী দলের অন্তত পাঁচজন প্রার্থীকে তাদের বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রেখেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। অনেক প্রার্থী এলাকায় প্রচারণা চালাতে না পেরে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে এসেছেন। এর মধ্যে গণফোরামের প্রার্থী রেজা কিবরিয়া ও কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপাও আছেন। বিরোধী দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা যাতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ না নেন, সে জন্য ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। এর আগে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে গিয়ে আ স ম রব ও মাহমুদুর রহমান মান্না হামলার শিকার হয়েছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার মর্মাহত হয়েছেন। কিন্তু অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারছেন না। তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন।
শারীরিক আক্রমণের সাথে সাথে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র হননের কাজটি চলছে সমানতালে। ড. কামাল হোসেন ইতোমধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী আ স ম আবদুর রব কিংবা কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তানের এজেন্টের তকমা পেয়ে যাচ্ছেন। এর আগে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দাবি করেছিলেন, জিয়াউর রহমানও ছিলেন পাকিস্তানি চর। ড. কামাল হোসেন খামোশ শব্দ উচ্চারণ করার কারণে তাকে বলা হচ্ছে পাকিস্তানি ভাবধারার ব্যক্তি হিসেবে। আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের লক্ষ্য করে কতবার খামোশ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন, তা যেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ভুলে যেতে চাইছে। পরিহাস হচ্ছে, রাজনৈতিক দলের খুদকুঁড়ো খাওয়া পুঁচকে রিপোর্টাররাও এখন কামাল হোসনকে স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে নসিহত করে।
এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচনপূর্ব এমন সহিংসতা আগে কখনো হয়নি। বিরোধী দলকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে পুলিশকে ব্যবহারে সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে ক্ষমতাসীন দল নয়, পুলিশ এখন বিরোধী দলের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলকে বিজয়ী করতে নেতাকর্মীদের প্রস্তুতির কোনো খবর না পাওয়া গেলেও পুলিশ কিভাবে ক্ষমতাসীনদের বিজয়ী করবে, তার নানা খবর গণমাধ্যমে আসছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর যেসব হামলার ঘটনা ঘটেছে, বেশির ভাগ ঘটনায় পুলিশের অংশগ্রহণ ছিল।
নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সহিংসতা মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। বিরোধী দলের সমাবেশ বা মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটছে। সিরাজগঞ্জে বিএনপির একজন নারী প্রার্থীর সমাবেশে পুলিশ ছররা গুলি ছুড়েছে। এতে প্রার্থীসহ বহু লোক আহত হয়েছে। এই হামলায় একজন নারী কর্মীর দুই চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। নোয়াখালীতে বিরোধী দলের প্রার্থীর ওপর গুলি ছোড়ার সরাসরি অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএনপি নেতা মাহবুব উদ্দিন খোকন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন পেছন থেকে। অর্থাৎ সমাবেশ বা মিছিল থেকে যখন তারা ফিরে যাচ্ছিলেন তখন পেছন থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। অর্থাৎ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হতাহত করার লক্ষ্য নিয়ে এই আক্রমণ চালানো হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশ যৌথভাবে এসব হামলা চালিয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। নির্বাচনী প্রচারণায় এমন নিপীড়ন ও অত্যাচারের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। বাংলাদেশে এবারই প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে যে নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রার্থীর ওপর হামলা চালানো হচ্ছে।
সারা দেশে পুলিশ যেভাবে রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পড়ছে, তাতে এই বাহিনীর পক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। নির্বাচনে পুলিশ একটি পক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে অবিলম্বে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা না হলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে। শুধু স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নয়, নির্বাচন পরিচালনায় তাদের আরো বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। একই সাথে পুলিশের যেসব কর্মকর্তা সরাসরি রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করছেন এবং নিপীড়ন চালাচ্ছেন, তাদের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা না হলে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে।
সারা দেশে যে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশ বড় ধরনের অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচনপূর্ব এমন সহিংস পরিস্থিতি আগে কখনো তৈরি হয়নি। এক দিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হচ্ছে, অপর দিকে দেশজুড়ে চলছে গণগ্রেফতার। সাধারণ নেতাকর্মী ছাড়াও প্রার্থীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। গাজীপুর ও সাতক্ষীরায় বিরোধী দলের দু’জন প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্বাচনের মাঠে যদি প্রার্থী না থাকেন, তাহলে কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? প্রার্থী গ্রেফতারের পর তার সমর্থকদের ওপর যে নিপীড়নের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এবারের নির্বাচনে আরো কিছু বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। আদালত থেকে একের পর এক বিরোধী দলের একাধিক প্রার্থীর প্রার্থিতা স্থগিত করা হয়েছে। খালেদা জিয়াসহ বিএনপির অন্তত ১০ জন প্রার্থীর নির্বাচন করার পথ রুদ্ধ হয়েছে আদালতের রায়ে। সংসদ সদস্যরা পদে বহাল থেকে নির্বাচন করছেন, অথচ উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার পরও অনেকের প্রার্থিতা স্থগিত হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাদের ইস্তফা গ্রহণ করেনি। কার্যত এসব রায়ের মধ্য দিয়ে এসব আসনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা বিশেষ সুবিধা পাবেন।
আইনি মারপ্যাঁচ আর নির্বাচনের সহিংস পরিস্থিতি থেকে আবারো প্রমাণ হলো, বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সম্ভাবনা নেই। ২০১৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করার যারা সমালোচনা করেন তারা উপলব্ধি করতে পারছেন যে, তখন নির্বাচনে অংশ নিলেও এবারের চেয়ে ভালো নির্বাচন হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন সরকারের ইচ্ছার পুতুল মাত্র। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যে স্পষ্ট সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের আনুগত্য করে এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমে। স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই। দেশজুড়ে সহিংস পরিস্থিতির পরও নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ত ভূমিকায় প্রমাণ হয়, ক্ষমতাসীন দলের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন যেন তাদের প্রধান এজেন্ডা।
বাস্তবতা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন মিলে বিরোধী দলকে নির্বাচন থেকে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘মরে গেলেও আমরা নির্বাচন বর্জন করব না। আমার লাশ নিয়ে ভোট দিতে যাবে। আমি মরে গেলেও আমার আঙুল তো থাকবে। আঙুল ভোট দেবে।’ এমন দৃঢ়প্রত্যয় মানুষের মনে প্রবল নাড়া দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে ভয় হচ্ছে, নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে সাধারণ মানুষের নির্বাচনে সম্পৃক্ত হওয়ার ঝুঁকি তত বাড়বে। ভয়ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করে মানুষকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ অদ্ভুত নীরবতা পালন করছে। মনে হচ্ছে, ভোটাররা ঝিম ধরে আছে। তারা ভোট দেয়ার সুযোগ খুঁজছে। এখন সাধারণ মানুষ যদি এই সুযোগ করে নিতে পারে তাহলে অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাবে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ক্ষমতাসীন দল যেভাবে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে তাতে নির্বাচন যেন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
alfazanambd@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা