২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

নির্বাচনে জামায়াত-জাতীয় পার্টি ফ্যাক্টর

নির্বাচনে জামায়াত-জাতীয় পার্টি ফ্যাক্টর - ছবি : সংগৃহীত

বৃহত্তর দুই জোটের মধ্যে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে আশা করা যায়। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় পর্যন্ত দুই জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে দরকষাকষি হয়েছে এবং প্রার্থী পরিবর্তন হয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বড় ধরনের মতবিরোধ দেখা দিতে পারে বলে যে আশঙ্কা ছিল বাস্তবে তা হয়নি, বরং ক্ষমতাসীন মহাজোটের মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে জাতীয় পার্টির সাথে বিরোধ তীব্র রূপ নিয়েছে। একই অবস্থা হয়েছে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের সাথে। ফলে ক্ষমতাসীন দল এক অর্থে জোটসঙ্গীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের মাঠে থাকতে পারছে না।

দুই জোটের মধ্যে প্রভাব বিস্তারকারী প্রধান দুই দল মহাজোটে জাতীয় পার্টি এবং ২০ দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামী। এ দুই দল কতটা আসন পাচ্ছে, সে দিকে সবার নজর ছিল। কারণ, জোটের রাজনীতিতে এ দুই দলের ভোটব্যাংক আছে এবং ফলাফল নির্ধারণে অত্যন্ত নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।
মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টি নৌকা প্রতীকে ২৯টি আসনে নির্বাচন করছে। অপর দিকে ১৩২টি আসনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় পার্টি আশা করেছিল, ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে কমপক্ষে ৫০টি আসন পাবে। কিন্তু চাহিদার চেয়ে অনেক কম আসন পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত আরো ১৩২টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে জাতীয় পার্টি। ফলে অনেক আসনে নৌকা-বনাম ধানের শীষের লড়াইয়ে লাঙ্গলে ভোট বিভাজন হবে। ফলে আসনভিত্তিক ভোটের হিসাব বদলে যাবে।

অপর দিকে ঐক্যফ্রন্টে জামায়াতে ইসলামী আশা করেছিল কমপক্ষে ২৫টি আসন পাবে। বিএনপির পক্ষ থেকে এই আসনগুলোতে জামায়াতের প্রার্থীদের প্রাথমিক মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল; কিন্তু জামায়াতে ইসলামী পেয়েছে ২২টি আসন। শেষ মুহূর্তে এসে জামায়াতকে ৩টি আসন ছাড়তে হয়েছে। এর মধ্যে দু’টি সিলেটে ও একটি সাতক্ষীরায়। সিলেটের একটি আসনে এবং সাতক্ষীরার ছেড়ে দেয়া আসনে জামায়াতের প্রার্থীরা একাধিকবার বিজয়ী হয়েছেন। ফলে দলের নেতাকর্মীরা আশা করেছিলেন অন্তত এ আসন দু’টি তারা পাবেন। সম্ভবত জামায়াতের অন্য কিছু আসন পাওয়ার আকাক্সক্ষা এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় আসন কমিয়ে আনার জন্য বিএনপির ওপর নানা মহলের চাপে জামায়াত এ তিনটি আসন পায়নি।
জোটের রাজনীতির স্বার্থে সামগ্রিকভাবে বিএনপি জোটসঙ্গীদের জন্য অনেক বেশি আসন ছেড়েছে।

বিএনপি যেখানে ছেড়েছে ৬০টি আসন, সেখানে আওয়ামী লীগ ছেড়েছে ৪২টি আসন। জাতীয় পার্টি ছাড়া মহাজোটের অন্য শরিকদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির জন্য পাঁচটি, জাসদ (ইনু) তিনটি, জেপি একটি, তরিকত ফেডারেশন দু’টি, জাসদ (আম্বিয়া) একটি এবং যুক্তফ্রন্টের জন্য তিনটি আসন ছেড়েছে। অপর দিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে জামায়াতে ইসলামীর জন্য ২২টি ছাড়া গণফোরামের জন্য সাতটি, জেএসডির জন্য চারটি, নাগরিক ঐক্যের জন্য চারটি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের জন্য চারটি এবং ২০ দলের অন্য শরিকদের জন্য ১৯টি আসন ছেড়েছে।

ব্যক্তিনির্ভর সাইনবোর্ড-সর্বস্ব ছোট দলগুলোর জন্য আসন ছাড়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়েছে। বরং দুই জোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী আরো বেশি আসন দাবি করার ন্যায্যতা ছিল। কারণ, ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টি মহাজোটের কাছ থেকে ৪৯টি আসন পেয়েছিল। অপর দিকে জামায়াতে ইসলামী ৩৯টি আসনে জোটবদ্ধ নির্বাচন করেছিল। জামায়াত কম আসন পাওয়ার পরও বিএনপির সাথে বড় ধরনের কোনো মতদ্বৈধতায় যাবে না। বিরোধী জোটের প্রার্থীদের জন্য এ দলের নেতাকর্মীরা কাজ করবেন। জামায়াত-বিএনপির আসন ভাগাভাগির দরকষাকষি তৃণমূলে ভোটের রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে না। সারা দেশে জামায়াতের ১০ থেকে ১২ শতাংশ ভোট রয়েছে। নিশ্চিতভাবে এই ভোট ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা পাবেন। জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তির সুফলও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা পাবেন, যা ফলাফল নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

অপর দিকে জাতীয় পার্টির সাথে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধ শেষ পর্যন্ত ভোটের ফলাফল কতটা প্রভাবিত করতে পারে তা দেখার বিষয়। সারা দেশে জাতীয় পার্টির ভোট রয়েছে ৮ থেকে ১০ শতাংশ। এই ভোট সামগ্রিকভাবে বিভাজিত হয়ে এককভাবে কোনো জোটের দিকে না-ও যেতে পারে। ভোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির দুর্বল অবস্থানের সুযোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। গত ১০ বছরে জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন দলের ‘বি’ টিম হিসেবে কাজ করেছে। অনেক জেলায় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি একাকার হয়ে গেছে। ফলে জাতীয়তাবাদী ইসলামপন্থী ভোট জাতীয় পার্টির দিকে না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। জাতীয় পার্টির সম্ভাবনাময় সংসদীয় আসনগুলো ছিল মূলত রংপুর বিভাগকেন্দ্রিক। রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় জাতীয় পার্টির ভিত্তি ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী।

কিন্তু বৃহত্তর রংপুরে জাতীয় পার্টি এখন অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ব্যক্তিগত আবেদনও আর আগের মতো নেই; বরং এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব বেড়েছে। ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল থেকে এ অঞ্চলের বদলে যাওয়া জনসমর্থনের চিত্রটি পাওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফামারীতে পাঁচটি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জামায়াত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। অপর দিকে জাতীয় পার্টির মাত্র একজন প্রার্থী উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে উত্তরাঞ্চলের ভোটে জাতীয় পার্টি এখন আর আগের মতো প্রধান ফ্যাক্টর নয়।

অনেকে মনে করেন, ক্ষমতাসীন জোট পরিকল্পিতভাবে বেশিসংখ্যক আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী দিয়েছে। বিশেষ করে প্রার্থী ঘোষণার আগে এরশাদের রহস্যময় অসুস্থতা এবং ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন ব্যক্তিকে মহাসচিব করা হয়েছে। এরশাদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের নানামুখী চাপ ছিল। এই চাপ কাটিয়ে ওঠার মতো শক্তি জাতীয় পার্টি বা এরশাদের নেই। বিএনপি যদি কোনো কারণে নির্বাচন বর্জন করে তাহলে যাতে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে হাজির করে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন দেখানোর পরিকল্পনা থেকে এমনটি করা হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট স্পষ্টভাবে বলছে, এবারের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত তারা থাকবে। সে ক্ষেত্রে বেশিসংখ্যক আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী দেয়া ক্ষমতাসীন দলের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। যদিও জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেছেন, শেষ মুহূর্তে তাদের প্রার্থীদের কারণে যদি মহাজোটের প্রার্থীরা সঙ্কটে পড়েন, তাহলে তাদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য বলা হবে। ভোটের আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর এমন ঘোষণা ভোটারদের মাঝে বরং উল্টো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। সব প্রার্থী এমন নির্দেশনা মানবেন তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

শুধু জাতীয় পার্টি নয়, মহাজোটের অন্য শরিক বি. চৌধুরীর যুক্তফ্রন্টের সাথে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে। বি. চৌধুরী এক সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের কাছ থেকে ১৫০ আসন দাবি করেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে পেয়েছেন মাত্র তিনটি আসন। এরপর যুক্তফ্রন্ট আরো ২০টি আসনে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকা ক্ষুদ্র দল জাসদ (ইনু) জোটের বাইরে চারটি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী অন্তত ২৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন। অর্থাৎ শুধু জাতীয় পার্টি নয়, সামগ্রিকভাবে মহাজোটে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ থেকেই গেছে। ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের ফর্মুলা কার্যকর হয়নি।

এখন প্রশ্ন হলো, ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে আসন নিয়ে এই অনাস্থার সম্পর্ক ভোটে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে? একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা কমে আসবে। জাতীয় পার্টি অরো ক্ষয়িষ্ণু একটি দলে পরিণত হবে। কিন্তু তা থেকে আওয়ামী লীগের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, জাতীয় পার্টির ভোটবিভাজন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে প্রভাবিত করবে না; বরং মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাথে গত ১০ বছরে জাতীয় পার্টির যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাতে চির ধরবে। আওয়ামী লীগের সাথে জোট গঠন করে সরকার ও বিরোধী দলে থাকার জাতীয় পার্টির অদ্ভুত রাজনীতি দলটির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে।

অপর দিকে, বিরোধী জোটের রাজনৈতিক কৌশলে ক্ষমতাসীন দল বিভ্রান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ আশা করছিল, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলে ২০ দলের মধ্যে ভাঙন দেখা দেবে, বিশেষ করে জামায়াতের অবস্থান নিয়ে বড় ধরনের বিরোধ তৈরি হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিএনপি যথেষ্ট ভারসাম্য স্থাপন করতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে জামায়াতও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল জামায়াত ইস্যুটি সামনে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। খালেদা জিয়াবিহীন বিএনপিতে মনোনয়ন নিয়ে বিভক্তি ও বিভাজন দেখা দিতে পারে, এমন ধারণা ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বদ্ধমূল ছিল। বিএনপিকে একটি দুর্বল দল হিসেবে ক্ষমতাসীনেরা বিবেচনা করেছে। বাস্তবে ক্ষমতাসীন দলের চেয়ে বিএনপিতে মনোনয়ন নিয়ে আন্তঃকোন্দল কম হয়েছে। জোট বা ঐক্যের স্বার্থে দলের অনেক সিনিয়র নেতা নির্বাচনে অংশ নেননি। এমন অনেক আসন জোটের প্রার্র্থীদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যেখানে সব নির্বাচনে দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে আসছেন। বিএনপি নেতাকর্মীরা সঙ্কট উত্তরণে এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।

প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থীকে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছিল, যাতে নির্বাচনের আগে কোনো আসন প্রার্থীশূন্য হয়ে না পড়ে। ক্ষমতাসীন দল আশা করেছিল, বিএনপির একাধিক প্রার্থীর মধ্যে বিরোধ থেকে সঙ্ঘাত সৃষ্টি হবে। কিন্তু তা তো হয়নি, বরং বিএনপিতে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। ফলে জোট ও দলের মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপি যথেষ্ট রাজনৈতিক কৌশলের পরিচয় দিয়েছে। অপর দিকে জোট নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে লেজেগোবরে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হলে জোটের রাজনীতির যে নানামাত্রিক মেরুকরণ হয়েছে, তার ফল আরো স্পষ্ট হবে।
[email protected]

 


আরো সংবাদ



premium cement