২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

‘এক টিপে নির্বাচন জয়’

‘এক টিপে নির্বাচন জয়’ - ছবি : সংগৃহীত

ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে প্রাচীন গ্রিসেই প্রথম গণতন্ত্রের সূত্রপাত হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০৮ সালে যে নির্বাচনপদ্ধতির উল্লেখ পাওয়া যায়, তা সত্যিই আকর্ষণীয়। ভোটারদের ভাঙা মাটির ওপর যে প্রার্থীকে তারা আগামী ১০ বছরের জন্য নির্বাসিত করতে চায় তার নাম লিখে জমা দিত। যদি এই ভোটের সংখ্যা ছয় হাজারের কম হতো তাহলে তাকে নির্বাচিতদের মাঝে রাখা হতো। অর্থাৎ ‘না’ ভোট দিয়ে নির্বাচনের ইতিহাস। এর একটি ভালো অর্থও আছে। তা হলো, সবারই নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকার আছে।
তবে এখন যদি এই পদ্ধতি চালু করা হয়, তবে কী হবে? বলা মুশকিল। তবে এটা সত্য, একটি নতুন চিত্র সামনে আসবে। ভেনিসেই সর্বপ্রথম ৪০ সদস্যের ‘গ্রেট কাউন্সিল’ নির্বাচন করে হ্যাঁ ভোটের মাধ্যমে।

তবে নির্বাচনপদ্ধতি বারবার পরিবর্তিত হয়েছে এর উদ্ভবের পর থেকে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৭৭৬ সালে তাদের সংবিধান জারির পর থেকে, এ পদ্ধতির নানা সংশোধন করেছে। একই ধারা বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেও পরিবর্তন ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা হয়েছিল- জন্মসূত্রেই সব মানুষ সমান। কিন্তু এর পরপরই দেখা গেল সবাই সমান নয় এবং এই ধারা এখনো চলছে। প্রথম দিকে আমেরিকার ২১ বছরের অধিক বয়সী জমির অধিকারীরাই ভোট দিতে পারত। সেখানে কালো-বাদামি চামড়ার মানুষের কোনো ভোটাধিকার ছিল না। কালো-বাদামিরা ভোটাধিকার পেল তাদের গৃহযুদ্ধের পর (১৮৬০-এর দিকে) যখন ক্রীতদাস প্রথা সীমিত করা হয়। কিন্তু এই কালো-বাদামিদের ভোটাধিকার নানা বন্ধনে আবৃত ছিল। আসলে সত্যিকারের ভোটের অধিকার আসে ১৯৬০-এর ‘ভোটিং রাইট অ্যাক্ট’ পাসের পর। অর্থাৎ শত বছরের পর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারের বয়স নিয়ে আন্দোলন শুরু হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমিতে। তখন ১৮ বছর হলেই জোর করে সামরিক বাহিনীতে ভর্তি করানো শুরু হয়। তখন দাবি ওঠে, যদি যুদ্ধের জন্য ১৮ বছরকে ধরা যায়, তবে কেন সে ভোটার হবে না। তখন ভোটারের বয়সসীমা ১৮ থেকে শুরু হয়।

আসলে নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিশ্বের অন্য দেশগুলো তাকে অনুসরণ করেছে। মহিলাদের ভোটাধিকার এসেছে সবার পরে মার্কিন সংবিধানের ১৮তম সংশোধনের মাধ্যমে। বিশ্বের সর্বত্রই মহিলা ভোটের অধিকার পরে এসেছে। তবে এই উপমহাদেশে যখন ভোটের প্রচলন হয়, তখন নারী-পুরুষের সমান ভোটের অধিকার একবারেই আসে।

ভোটের পদ্ধতি নানা রকমের। এর মাঝে পার্লামেন্ট পদ্ধতি ও প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি বেশি প্রচলিত। পার্লামেন্ট পদ্ধতি জনগণের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণ তারা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে। যদিও এই ধারণা এখন বাস্তবতার সাথে মিল কম। কারণ ভোটের পদ্ধতিসহ সব নির্বাচন কর্মকাণ্ডকেই প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রণের নানা উপায় বেরিয়ে গেছে। এই পদ্ধতিতে যিনি রাষ্ট্রপ্রধান হন, তিনি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত নন। শুধু প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। আবার পার্লামেন্ট পদ্ধতির একটি দুর্বলতা হলো, জনগণ নির্বাচন করে প্রার্থীদের মধ্য থেকে। তারা ভোট দিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করে না। ফলে তাদের সামনে কেবল ভোট দেয়ার অধিকারটুকু থাকে। তাদের ইচ্ছেমতো প্রার্থী নির্বাচন নয়। তবে একটি সুবিধা হলো বহু দল এমন নির্বাচনে প্রার্থী দেয়Ñ তাদের কেউ কেউ হয়তো জনগণের ইচ্ছের প্রার্থীর মতো হতে পারে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ দেশে এখন পার্লামেন্টারি সরকার কায়েম হয়েছে।
আরেকটি পদ্ধতি হলো ‘ইনস্টান্ট রানঅফ ভোটিং’ (আইআরভি)। এটা দুই দলবিশিষ্ট সরকার পদ্ধতিতে চালু। দুই দলের বাইরে কেউ প্রার্থী দিলে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর ব্যবহার বহুল। এখানে ভোটার ইচ্ছে করলে তিনটি মনোনয়ন দিতে পারেন। গণনায় প্রথম পছন্দটি হেরে গেলে, এই ভোটগুলো দ্বিতীয় পছন্দে স্থানান্তর করতে পারে। এই আইআরভি পদ্ধতি অনেক দেশে প্রচলিত। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি স্টেটেও চালু আছে।

তবে ‘ফিউশন ভোটিং’ বলে পরিচিত পদ্ধতিটি সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এ পদ্ধতিতে কোনো প্রার্থী ইচ্ছে করলে দুই-এর অধিক দলের হয়ে প্রার্থী হতে পারে। তবে তৃতীয় দলের উপস্থিতি এই পদ্ধতিতে উৎসাহিত করা হয়।

মধ্য যুগে নির্বাচনের উদ্ভব হয় রাজা বা চিফ ঠিক করার জন্য। এটা গ্রিসের রোমে প্রচলিত ছিল। যেমন ‘হলি রোমান এমপারর’ নির্বাচিত হতেন। তেমনিভাবে পোপেরও নির্বাচন হতো। আবার বৈদিক যুগে ভারতে রাজাও এভাবে নির্বাচিত হতেন। তবে তারা নির্বাচিত হতেন শুধু ‘জমির মালিকানা আছে’ এমন ভোটারদের দিয়ে। শ্রেণীবিভক্ত এই সময়ে শুধু ক্ষত্রিয়রাই রাজা বা প্রধান হতে পারত। পাল রাজারা এভাবে নির্বাচিত হয়েছিল।

তখন ভোটের পদ্ধতিগুলোও ছিল মজার। যেমন সঙ্গম যুগে ভোটারেরা মাটির পাত্রে নাম লিখে দড়িতে বেঁধে দিত। পরে সেগুলো গণনা করে প্রার্থী নির্বাচিত হতো। আবার বাংলায় পাল রাজারা ভূমিপ্রধানদের সম্মতিতে রাজা হতেন। আজকের তামিলনাড়–তে চোল রাজা নির্বাচিত হন তালগাছের পাতার ভোটে। পদ্ধতিটি ছিল এই তালপাতায় প্রার্থীর নাম লেখা থাকত। সেগুলো একটি বিরাট পাত্রে রাখা হতো। একটি বালককে বলা হতো সেখান থেকে প্রয়োজনীয়সংখ্যক পাতা উঠাতে। যেমন- যদি পাঁচজন সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কথা থাকলেÑ পাঁচটি পাতা উঠাত। এভাবে গণনা করে যার নাম বেশিবার উঠত সেই নির্বাচিত হতো। ধীরে ধীরে পদ্ধতির পরিবর্তন হতে থাকে এবং ১৭০০ শতাব্দীতে এত আজকের পদ্ধতি উন্মেষ ঘটে এবং ধীরে পরিবর্তনের পথ ধরে চলতে থাকে।

বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাতটি নির্বাচন এ দেশটির ইতিহাস গড়ে, বিশ্বে এগুলো বিশাল প্রভাব ফেলে। এ নির্বাচনগুলো হোল ১৮০০, ১৮২৮, ১৮৭২, ১৯১২, ১৯২৮, ১৯৪৮ এবং ১৯৬৮ সালের নির্বাচনগুলো। এসব নির্বাচনের মাধ্যমে ভুলগুলো নির্ধারণ হয়। ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (১৮২৮) জন্ম নেয়, ইলেকটরাল কলেজ পদ্ধতি সৃষ্টি হয় (১৮৭২), নির্বাচনী স্লোগানের জন্ম দেয়, চার দলের নির্বাচন (১৯৪৮) হয়।
মানুষ কেন ভোট দেয়? এর জবাব কঠিন। কারণ জবাব অনেক হতে পারে। তবে অনুসন্ধানীরা দেখেছেন, আসলে কারো ভোট একটি নির্বাচনকে নির্ধারণ করে না। তবে তারা ভোট দিতে কেন যায়? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা এর ব্যাপক আলোচনা করে মোটামুটি তিনটি কারণ নির্ধারণ করেছেন। ০১. নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মনে করে তাদের ভালো লাগে ০২. এটা একটা সামাজিক নীতি ০৩. ভোট দিতে ভালো লাগে। দেখা গেছে, শিক্ষিতরাই বেশি ভোট দেয়।

ভোটের ইতিহাস সত্যই চমৎকার। প্রথম দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোট দেয়ার অধিকারী ছিল শুধু সাদাদের। পরে শুধু করদাতারা ভোট দেয়ার অধিকার পায়। এর সাথে তাদের ধার্মিক হতে হতো। মাত্র ছ’টি স্টেটে (৫০টির মধ্যে) - ম্যারিল্যান্ড, ম্যাসাচুসেটস, নিউইয়র্ক, নর্থ ক্যারোলিনা, পেনসিলভানিয়া এবং ভারমন্ট কালো আফ্রিকানদের অধিকার দেয়। তবে মার্কিন সংবিধান ভোট দেয়ার অধিকারের বিষয়টি স্টেটদের কাছে রেখে দেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদেই এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। তখন কণ্ঠভোটের পরিবর্তে লিখিত ব্যালটে ভোটের পদ্ধতিটি চালু হয়। ১৮৩০ সালে ১০টি স্টেট সাবালকদের ভোটাধিকার দেয়। তবে আফ্রিকানদের ভোটাধিকার আসতে আরো সময় লাগে। ১৮২৬ সালে মাত্র ১৬ জন আফ্রিকান (নিউইয়র্কের) ভোটের অধিকার পায়।

মহিলাদের ভোটের অধিকার আসে। তবে কোনো কোনো স্টেটে তাদের এ অধিকার দিয়ে আবার কেড়ে নেয়া হয়। যেমন- নিউ জার্সিতে। ১২টি স্টেটে যারা ‘নিঃস্ব’ তারা ভোট দিতে পারত না।
ভোট নিয়ে সংঘর্ষ এবং হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড যেন একটি অঙ্গাঙ্গী ব্যাপার। সারা বিশ্বের চিত্র একই। এই কর্মকাণ্ড হয় ভয়ঙ্কর যখন রাষ্ট্র এর ভাগিদার হয়। ক্ষমতাসীন দল যদি অনুভব করে নিয়ন্ত্রণহীন সুষ্ঠু (ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার) নির্বাচনে তাদের পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা, তখন তারা প্রকাশ্যে ও পরোক্ষে নানা অজুহাতে সংঘর্ষ ও সঙ্ঘাত সৃষ্টি করে ভীতির রাজ্য কায়েম করে। এর সাথে তারা তৈরি করে নিবর্তনমূলক আইন এবং তার মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রায় সব নির্বাচনে সরব ও সচল দর্শক বলে অনেকেই অভিহিত করেন। অবশ্য এই অভিযোগ রাশিয়ার বিরুদ্ধেও। এটা বাস্তবতা যে, সুপার পাওয়ারগুলো তাদের প্রভাববলয়কে নিশ্চিত রাখতে এই কর্মকাণ্ডটি করে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডভ লেভিন এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘এই দুই শক্তি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া) ১৯৪৬ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে বিশ্বের ১১৭টি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে।’ অর্থাৎ প্রতি ৯টি নির্বাচনের একটিতে। এই হস্তক্ষেপ কখনো শক্তি দিয়ে, যেমন ভিয়েতনামে, ইটালিতে রোড আইল্যান্ডে। এই কাজটি তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ করে। সিআইতে প্রায় ২৫ বছর ধরে যিনি এই কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালনার সাথে ছিলেন তিনি হলেন এফ মার্ক ওয়াইট। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ব্যাগভর্তি অর্থ দিই। এটা দিয়ে রাজনীতিবিদেরা প্রচার থেকে শুরু করে সংঘর্ষ-সঙ্কট সৃষ্টি করে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ এবং জয় করে।’ ‘সরকার পরিবর্তনে তারা পারঙ্গম’, তিনি বলেছেন। হন্ডুরাস, ভেনিজুয়েলা, ইউক্রেনসহ বহু নির্বাচনে তাদের প্রত্যক্ষ হাত আছে বলে মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে রাশিয়া ও চীন নানা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছে বলে প্রচার হচ্ছে। এর জবাবে ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভের ডাইরেক্টর পিটার কর্নব্লাশ বলেছেন, ‘যদি চীন এমনটি সত্যিই করে থাকে, এতে নতুনত্ব কোথায়? যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের ওষুধেরই স্বাদ পাচ্ছে।’

এখন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে নির্বাচনে নানাভাবে। তার মাঝে ইভিএম (ইলেট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার প্রধান। এর পক্ষে এবং বিপক্ষে নানা সমালোচনা রয়েছে।
পক্ষে দেখা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি দল। আর বিরোধী দল এর বিপক্ষে।
বিশ্বের ২০টি দেশে এর পরীক্ষা হয়েছে এবং চালু আছে ১৩টিতে- আংশিকভাবে- এগুলো হলো ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা, প্যারাগুয়ে, বেলজিয়াম, ইউএসএ, স্পেন, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, ভুটান, জার্মানি, ভারত, নেদারল্যান্ডস এবং পানামা। জার্মানি, প্যারাগুয়ে এবং নেদারল্যান্ডস এটা বাদ দিয়েছে। অন্যরা দেশের বিভিন্ন অংশে এই ই-ভোটিং পরীক্ষা চালিয়েছে। কেবল ভারত এটাকে ব্যবহার করেছে এবং বিতর্কের মধ্যেও এটা চালু রাখতে চায়। উত্তর প্রদেশে রাজনীতিবিদ মায়াবতী দাবি করেছেন, এই ইভিএমের কল্যাণে সরকার জিতেছে এবং তিনি হেরেছেন। তিনি এর ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। তিনি বলেছেন, তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতাবানেরা জনমতের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতায় যাওয়ার সহজ পন্থা হিসেবে এই যন্ত্রের ব্যবহারের পক্ষপাতী। এ অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষামূলক নির্বাচনগুলোতে ‘পেপার ট্রেইল’ (অর্থাৎ প্রত্যেক চাপের সাথে একটি কাগজের কপি আসে) ব্যবস্থা করা। তবে এটা ব্যয়সাপেক্ষ এবং খানিকটা শক্তও।

ইভিএম চালুর বিপক্ষে পাঁচটি জোরালো যুক্তি। ০১. ইভিএম অতি সহজেই হ্যাক করা যায় ০২. ভোটারের পুরো তথ্য ইভিএমের মাধ্যমে জানা যায় ০৩. ইভিএম দিয়ে নির্বাচনের ফল সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় ০৪. যেকোনো অফিসার এর ফলাফল নিয়ন্ত্রণ (টেম্পার) করতে পারে ০৫. এর সফটওয়ার পরিবর্তনও সহজ।

এই পদ্ধতি যে দেশগুলো পরিত্যাগ করেছে তাদের মধ্যে আছে জার্মানি। এখানে কোর্ট এটাকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছে। হল্যান্ড এটা ব্যান করেছে। কারণ এতে স্বচ্ছতা নেই। ৫১০ কোটি ডলার ব্যয় করে (অনুসন্ধানে) আয়ারল্যান্ড এটা বন্ধ করেছে। ইটালি দেখেছে ই-ভোটিংয়ের ফলাফল সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটা বাদ দেয়া হয়। কারণ, এর সাথে কাগজের কোনো হিসাব থাকে না। ভেনিজুয়েলা, ম্যাসিডোনিয়া ও ইউক্রেন এটা নিষিদ্ধ করে যখন তারা ভোট চুরি উদঘাটন করে। ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড কখনো এটা ব্যবহার করেনি। অনেক বছর পরীক্ষা চালানোর পর ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলো ‘স্বচ্ছতার অভাব এবং সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য’ বলে ইভিএমের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি ইভিএমের বিষয়টি দেখা যায়, তবে আমেরিকা এবং ইউরোপ ইভিএম বন্ধ ঘোষণার মূল কারণ জানা যায়। কোনো কোনো সমালোচক এক চমৎকার মন্তব্য করেছেন, ‘ইভিএম এক স্বৈরাচারী হাতিয়ার। অন্যায়কে খুব সহজেই এই যন্ত্র ন্যায়ে পরিণত করতে পারে।’

ইভিএম চালুতে প্রধানত লাভবান হবে এর ভেন্ডাররা। বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচে কয়েক হাজার যন্ত্র কিনতে হবে এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও প্রয়োজন হবে অনেক বড় খরচ। সেজন্য এদের সাথে সংশ্লিষ্টরা এ ব্যবস্থা চাইছে। যেমন- বাংলাদেশে এই প্রকল্প চালুর জন্য নির্বাচন কমিশন এর মধ্যেই এক লাখ ৫০ হাজার ইভিএমের জন্য ৩৮ বিলিয়ন টাকার একটি প্রকল্প চালু করেছে। মেশিন টুলস ফাক্টরিকে কাজটি দেয়া হয়েছে। আর রিপ্রেজেনটেশন অব পিপলস অর্ডার (আরপিও) সংশোধন করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদে কমিশনার মাহবুব তালুকদার পদত্যাগ ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছেন। আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনে এর ব্যবহার করার জন্য সিইসি উৎসাহী বলে খবরের কাগজে রিপোর্ট বেরিয়েছে। কেন উৎসাহী, এ প্রশ্ন অনেকেই করছেন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে পাঁচটি যুক্তি এর ব্যবহারের জন্য। এগুলোর ওপর নজর রাখার কোনো উপায় নেই। কারণ ভোটার কোন বোতামে চাপ দিলেন এবং ভোট কোথায় গেল, জানার উপায় নেই। জনাব তালুকদারের নোট অব ডিসেন্টে বিষয়টি আরো সন্দেহ ঘনীভূত হতে বাধ্য। কারণ ‘এক টিপেই নির্বাচন জয়’ সম্ভব বলে যে ইভিএম নিয়ে চালু সেই বক্তব্য সত্য বলে মনে হতে বাধ্য। এর মাঝেই সরকারি দল বাদ দিয়ে সব রাজনৈতিক দল এই মেশিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে।
তালুকদার সাহেব সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই (যন্ত্র) ব্যবহারের জন্য অফিসারেরা যে ট্রেনিং পেয়েছেন তা অপ্রতুল। আমি মনে করি, এটা চালু ধীরে ধীরে করা যেতে পারে। প্রথমে স্থানীয় নির্বাচনে, পরে জাতীয় নির্বাচনে।’ জনাব তালুকদার আরপিওর সংশোধনের ঘোর বিপক্ষে ছিলেন।

তার যুক্তিগুলো অকাট্য। কারণ এই প্রযুক্তিটি প্রযুক্তির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলো তাহলে কেন ব্যাপকভাবে গ্রহণ করল না। আবার যারা এর পরীক্ষা করেছে, তারাও কেন এটা বাদ দিলো? এর জবাব অনেক হতে পারে। একটি অবশ্য হলো, নির্বাচন-ফলকে অত্যন্ত সহজে পাল্টে দেয়া যায়, যা ভোটারেরা মানবে না। এমন কর্মকাণ্ডের ফলে শান্তির পরিবর্তে অশান্তির ব্যাপ্তি প্রসার হবে।
অনেকেই বলছেন, নির্বাচন মাত্র দেড় মাসের মতো বাঁকি। এ সময়ের মধ্যে এই নতুন ব্যব
স্থা কোনোক্রমেই সঠিকভাবে পরিচালনা সম্ভব নয়। বিশেষ করে যে দেশে শিক্ষার হার এখনো অনেক নিচে। প্রচলিত নির্বাচনপদ্ধতি বহু বছরের পুরনো হওয়া সত্ত্বে, এখনো এখানে ভুল হচ্ছে, জনণের কাছে অবোধ্য হচ্ছে।
গত মার্কিন নির্বাচন নিয়ে এখনো নানা বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে। এমনকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বিতর্কে যোগ দেন। তিনি বলেন, রাশিয়া তার নির্বাচনে প্রযুক্তির মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করেছে। অর্থাৎ প্রযুক্তিনির্ভর নির্বাচনপদ্ধতির নিয়ন্ত্রণ কায়িক পদ্ধতির চেয়ে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ২০০০ সালের মার্কিন নির্বাচন, যেখানে বুশ ও গোরের নির্বাচন ফলের এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল এবং সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট তা সুরাহা করে।

এবারের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ আজ তার প্রান্তিকালের তীরে দাঁড়িয়ে। এর সঠিক নেতৃত্ব যেমন অত্যন্ত প্রয়োজন, তেমনি সঠিক পথের দিশাও দরকার। বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত জীবনে নেতৃত্ব বারবার ভুল করেছে। বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে একটি অনন্য দেশ। ঠিক এর রাজধানী ঢাকাও অনন্য। যেমনÑ এত ছোট্ট দেশে এত জনসংখ্যা কোথাও নেই। সেই হিসাবে অন্য দেশে যে সমস্যা ও সঙ্কটের পাহাড়, তেমনটি এখানে নেই। তাই শতাব্দীর পর শতাব্দীতে বহিরাগতরা এই এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে কখনো কৌশলে, কখনোবা প্রত্যক্ষ দখলের মধ্য দিয়ে। একই কারণে ব্রিটিশসহ সব শক্তি প্রথমেই এই এলাকা দখল বা নিয়ন্ত্রণ করেছে।

এখন কৌশলের অংশ হিসেবে নির্বাচনকে ব্যবহার করা হয়। তাই নির্বাচনে জনগণকে এ দিকে নজর দিতে হবে। এটা কোনো কৌশলের অংশ কি না। একটা জাতির ঐক্য নির্ভর করে তার বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং মানসিকতার ওপর। এগুলোর মধ্যে যদি একটি যোগসূত্র থাকে, তাহলে কোনো শঙ্কা থাকবে না। কিন্তু এমনটি হতে দেয়া হয় না এ যুগে।

তবে এ যুগকে অনেকেই মানসিক প্রতিবন্ধীর সময় বলে দাবি করেন। তাদের দাবির মূলে হলো নৈতিকতাসহ বিভিন্ন মানবিক গুণের ক্রমাবনতি। নৈতিকতাবাদীদের বিশাল বাধার মধ্যে ফেলার চেষ্টা। শুধু ক্ষমতা এবং শক্তি নানা আকারে বিস্তার লাভ করছে। মানুষের মধ্যে নানা বিভক্তি সৃষ্টি করে এই অদৃশ্য শক্তি তার স্বার্থ উদ্ধার করছে। নির্বাচন কেবল একটি সুযোগ দেয় এই আগ্রাসী শক্তিকে প্রতিহত করতে। এর জন্য সজাগ এবং সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন। নতুবা আবার যাত্রা শুরু হবে অজ্ঞাত লক্ষ্যের পথে।


আরো সংবাদ



premium cement