নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনী মোতায়েন-২
- সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
- ২৮ নভেম্বর ২০১৮, ১৯:১২
এখন লেখালেখি ও আলোচনার সময়
যেহেতু মাস খানেকের মধ্যেই পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা, সেহেতু নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। আমি যে পয়েন্টটি হাইলাইট করতে চাচ্ছি বা উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরতে চাচ্ছি সেটা হলো, পার্লামেন্ট নির্বাচন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এটির ভালোমন্দ দিক নিয়ে, সময় হাতে নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করা ভালো। যতটুকু সময় আছে ততটুকুকেও কাজে লাগানো উচিত। আজকের আলোচনা নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা প্রসঙ্গে মাত্র এবং এর সঙ্গে আলোচনা করতে চাই, নির্বাচনকালে মোতায়েন করা সেনাবাহিনীর দায়িত্ব বা কর্ম।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার্য দিন
বর্তমানে বাংলাদেশে পার্লামেন্টারি নির্বাচন এক দিনে অনুষ্ঠিত হয়। এক দিনে অনুষ্ঠান করার পরিবর্তে, একাধিক দিনে অনুষ্ঠান করা যায় কি না বা একাধিক দিনে অনুষ্ঠান করা উচিত কিন্তু সেটিও একটি সময়োপযোগী আলোচনার বিষয়। কিন্তু সেটা আজকের এই কলামে নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে পার্লামেন্টারি নির্বাচনে পোলিং স্টেশন তথা পোলিং সেন্টারের সংখ্যা ছাব্বিশ হাজারের বেশি। সাধারণত প্রাইমারি স্কুল বা হাইস্কুল বা কোনো মাদরাসা ইত্যাদিতে পোলিং সেন্টার বা ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
কারণ, এই জায়গাগুলোতে আসা-যাওয়া সহজ, মানুষ চেনে এবং যথেষ্ট কামরা থাকায়, বিভিন্ন বুথ পরিচালনা করা যায়। প্রত্যেক পোলিং সেন্টারে নির্বাচনী কেন্দ্রে দুই-তিনজন অস্ত্রধারী পুলিশ, দুই-তিনজন অস্ত্রধারী আনসার এবং অনধিক ১২ জন বিনা অস্ত্রধারী আনসার থাকে; বেশির ভাগ পুরুষ কিছুসংখ্যক মহিলা আনসার। তারা আসে নির্বাচনের দু’দিন বা তিন দিন আগে। তাদের এমবডিমেন্ট করা হয় এবং নির্বাচনের এক দিন বা দু’দিন পরই তাদের ডিএমবিডমেন্ট করা হয়।
সেনাবাহিনী ও বিজিবি (অল্প কথা)
সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে ২০১৪ সালের অভিজ্ঞতা বাদ দিচ্ছি। ১৯৭৩ সালের মার্চের নির্বাচন থেকে ২০০৮ এর ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত, সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে যে রেওয়াজ ছিল সেটি এখানে আলোচনা করছি। দেশব্যাপী বা দেশের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন মেয়াদের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়, আবার দেশব্যাপী একই মেয়াদের জন্যও মোতায়েন করা যায়। দেশের কোনো কোনো অংশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় পাঁচ বা সাত বা নয় বা দশ বা বারো বা পনেরো দিনের জন্য। এই ছবিটি দেশের শতকরা ৭০ শতাংশ নির্বাচনী কেন্দ্রের জন্য প্রযোজ্য। সেনাবাহিনীর কাজ প্রসঙ্গে এই কলামে একটু পরেই আলোচনা আছে।
বাকি আনুমানিক ৩০ শতাংশ নির্বাচনী কেন্দ্রকে আমরা বলতে পারি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি মূল্যায়নপূর্বক কয়েকজন বেশি পুলিশ বা আনসার মোতায়েন করে। নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ডিউটি করে না। মহানগরীগুলোতে বিডিআর নির্বাচনী কেন্দ্রে প্রত্যক্ষ ডিউটি করলেও অন্যত্র প্রত্যক্ষ ডিউটি করে না। দেশের প্রতিটি থানায় বা উপজেলায় আলাদাভাবে সেনাবাহিনী বা বিজিবি (সাবেক বিডিআর) মোতায়েন করা হয়।
থানার সংখ্যা ও নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের বিবরণ
থানা শব্দের পরিবর্তে উপজেলা শব্দটিও পড়া যায়। বাংলাদেশের মানচিত্র ঘাঁটলে আপনারা দেখবেন, ১২০টি থানা বা উপজেলা আছে যেগুলো সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত তথা তাদের সঙ্গেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত। এ ছাড়া সমুদ্রবেষ্টিত বা দ্বীপাঞ্চলীয় থানা আছে পাঁচ-ছয়টি; যেগুলোতে নির্বাচনকালে নৌবাহিনী পাঠানো হয়। বর্ডারিং থানাগুলোতে সাধারণত সেনাবাহিনী পাঠানো হয় না, বরং বিজিবি (সাবেক বিডিআর) পাঠানো হয়। বিজিবি পাঠানো বললে ভুল হবে, বিজিবি, সীমান্ত এলাকায় সারা বছরই ডিউটি করছে। সুতরাং বিজিবি পাঠানো মানে ঢাকা বা সংশ্লিষ্ট সেক্টর থেকে অতিরিক্ত কিছু বিজিবি সৈন্য পাঠানো যাতে করে বিওপিগুলো একদম সৈন্যবিহীন না হয় বা বর্ডার পেট্রলিং একদম বন্ধ হয়ে না যায়।
বর্ডারিং থানাগুলোতে সেনাবাহিনী পাঠানো হয় না ইচ্ছাকৃতভাবে যাতে- সীমান্তবর্তী এলাকাতে সেনাবাহিনীকে চলাচল করতে না হয়। দেশের অন্যান্য সব থানায় সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। কোনো জায়গায় ৩০ জন, কোনো জায়গায় ৪০ জন ও কোনো জায়গায় ৫০ জন এরকমভাবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল ইত্যাদি নগর বা মহানগরে সেনাবাহিনী বা বিজিবি উভয়ই মোতায়েন করা হয়। বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি- এসব বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পড়ে। দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা তথা স্বাভাবিক সব কর্মকাণ্ডের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পড়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর। বেসামরিক প্রশাসন তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করার জন্য দেশের বিদ্যমান আইনের অধীনেই সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
সেনা মোতায়েন দর্শন বা তত্ত্ব
পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত, প্রচলিত বা অনুসরণ করা যে থিওরি বা তত্ত্বের ভিত্তিতে সেনাবাহিনী নির্বাচনকালে দায়িত্ব পালন করে আসছে সেটি হলো, ‘বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় কর্তব্য পালন’ তথা ইংরেজি পরিভাষায় ‘ডিউটিজ ইন এইড অব সিভিল পাওয়ার।’ মূল লক্ষ্য দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে পরোক্ষ যথা : শো অব ফোর্স বা শক্তি প্রদর্শন-এর দ্বারা অশান্তি-সৃষ্টিকারী মানুষের মনে বা বিশেষত সন্ত্রাসীদের মনে ‘ডিটারেন্স’ বা গণ্ডগোল না করার মানসিকতা সৃষ্টি করা; অপরপক্ষে শান্তিপ্রিয় জনগণের মনে আস্থার সৃষ্টি করা।
অপরটি হচ্ছে প্রত্যক্ষ যথা : নিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে দুষ্কৃতকারী দমন বা দুষ্কৃতকারী অধ্যুষিত এলাকায় অস্ত্র উদ্ধার বা অপরাধী গ্রেফতার ইত্যাদি। সেনাবাহিনীর সেনাদল কোনো থানা বা উপজেলায় মোতায়েন হওয়ার পর বেশির ভাগ সময় যানবাহনে করে এবং কোনো কোনো সময় হেঁটে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। এটিই তাদের অন্যতম কাজ। যদি নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন কোনো ম্যাজিস্ট্রেট আনুষ্ঠানিকভাবে বলে যে, কোনো এক জায়গায় গণ্ডগোল হচ্ছে যেটি দমন করার জন্য সেনাবাহিনী প্রয়োজন তাহলেই মাত্র ওই সেনাদল কাজে লাগে, তা না হলে ওই শো অব ফোর্সেই তাদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ থাকে।
বাংলাদেশের অনেক থানায় বা উপজেলায়, এখন ২০১৮ সালে এসেও, যোগাযোগের ব্যবস্থা এমন যে, ওইগুলোর অভ্যন্তরে চলাচলের বিশেষ কোনো উন্নত ব্যবস্থা নেই। চলাচলের জন্য অতিরিক্ত কোনো যানবাহনও নেই;ওই সব দুর্গম জায়গায় চান্দের গাড়ি বা ভ্যানগাড়ি বা গরুর গাড়ি বা নসিমন-ভটভটি বা ট্রাক্টর ছাড়া অন্য কোনো বাহন নেই। আরো কিছু থানা আছে যেগুলো এতটাই নদীমাতৃক যে, সেখানে কোনো সড়কই নেই এবং চলাচলের একমাত্র উপযুক্ত বাহন স্পিড বোট, শ্যালো ইঞ্জিনচালিত দেশী নৌকা বা লঞ্চ ইত্যাদি। যানবাহনের অপ্রতুলতার কারণে, যানবাহন চলাচলের সড়কের অভাবের কারণে এবং সৈন্য সংখ্যার স্বল্পতার কারণে একটি থানায় মোতায়েন করা সেনা দল বা বিজিবি দল-এর পক্ষে সবময়ই একটি স্থানে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়, কোনো কোনো সময় দু’টি স্থানে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয় এবং কদাচিৎ তিনটি বা তার অধিক স্থানে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়।
কতজন সৈনিক একটি থানায় বা উপজেলায় সাধারণত মোতায়েন হয় এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় যে, নিম্নে ২৫ থেকে ঊর্ধ্বে ৮০ জন পর্যন্ত যেতে পারে। আরো একটি উল্লেখযোগ্য বক্তব্য হচ্ছে, বিদ্যমান আইনে ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া সেনাদল কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। অতএব ম্যাজিস্ট্রেটের অপ্রতুলতা সেনাবাহিনীর কার্যক্ষমতা বিকাশে একটি সীমাবদ্ধতা। বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও বা শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গ হলেও তথা, মারামারি-কাটাকাটি-গণ্ডগোল ইত্যাদি লাগলেও, যদি ম্যাজিস্ট্রেট সেনাবাহিনীকে না ডাকেন, তাহলে সেনাবাহিনী কোনো কাজের জন্য এগিয়ে আসবে না। এটাই এই মুহূর্ত পর্যন্ত প্রচলিত রেওয়াজ। কিন্তু সম্মানিত ম্যাজিস্ট্রেটরা যেসব পরিস্থিতি নির্মোহ দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করবেন এর গ্যারান্টি কে দেবে?
অর্থাৎ উদাহরণস্বরূপ একটি কেন্দ্রের নাম মঙ্গলগ্রহ। মঙ্গলগ্রহ কেন্দ্রের আধাকিলোমিটার দূরে পরিকল্পিত গণ্ডগোল লাগানো হলো, পরিকল্পিতভাবে বোমাবাজি করা হলো, পরিকল্পিতভাবে নিরীহ মানুষকে পেটানো হলো, ভোটকেন্দ্রের লাইনের মধ্য থেকে প্রতিপক্ষের মানুষকে উঠিয়ে নেয়া হলো, হৈ হৈ রৈ রৈ আওয়াজ উঠল, কিন্তু পুলিশ কিছু করল না। তখন সম্মানিত ম্যাজিস্ট্রেট কী করবেন? অথবা মারামারি কাটাকাটি মোটামুটি হয়ে যাওয়ার নিপীড়িত নির্যাতিত দুর্বল পক্ষ স্থান ত্যাগ করার পর, আর্মিকে খবর দেয়া হলো; আর্মি কী করবে? অতএব, আমার আবেদনই হচ্ছে যে, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ফাঁক-ফোকর রাখা যাবে না।
যেহেতু গত দশ বছরের রাজনৈতিক অপশাসনের কারণে, মানুষ মনে করে পুলিশ বাহিনীতে রাজনীতিকীকরণ হয়েছে, তাহলে ওই পুলিশের ওপর আস্থা না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নির্বাচনের এক মাস আগে, নতুন কোনো পুলিশ বাহিনী তো আমাদের জন্য পয়দা হবে না; বিদ্যমান বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর আওতাতেই আমাদের কাজ করতে হবে, চলতে ফিরতে হবে। বাস্তবে বেশির ভাগ পুলিশ নির্মোহ দৃষ্টিতে কাজ করেন বা করবেন বলে মানুষের আশা। অল্প কিছুসংখ্যক পুলিশের মধ্যেই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। এইরূপ ভঙ্গুর ও স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে, মানুষের একমাত্র আস্থার স্থান হচ্ছে সেনাবহিনী।
শো অব ফোর্স তত্ত্ব এবং বর্তমান মানসিকতা
উপরে বর্ণিত ‘শো অব ফোর্স’ বা ডিটারেন্স তত্ত্বটি এখন কতটা বাস্তবসম্মত সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। আমার মূল্যায়নে, সেনাবাহিনীকে শুধু দেখেই ভয় পাওয়ার দিন চলে গেছে। কোনো উপজেলায় বা থানায় সেনাদল সশরীরে কোন্ জায়গায় অবস্থান করছে, ওই সেনাদলের কাছে কী যানবাহন আছে, থানা বা উপজেলার অভ্যন্তরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে ওই সেনাদলের তা তাদের একটি অংশের কত সময় লাগবে ইত্যাদি কোনো গোপন জিনিস নয়। এসব তথ্য বা মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে, একটি সেনাদল কোনো একটি থানায় মোতায়েনরত অবস্থায় কী কী কাজ করতে পারবে বা কী কী করতে পারবে না, সেটি বুদ্ধিমান জনগণ বিশেষত রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা অতি সহজেই হিসাব-নিকাশ করে ফেলতে পারে।
সম্মানিত পাঠক, খেয়াল করুন আমি যেই শব্দযুগল ব্যবহার করেছি সেটি হলো রাজনৈতিক সন্ত্রাসী। এ জন্যই বললাম যে, ‘শো অব ফোর্স’ তত্ত্বের কার্যকারিতা এখন অতি সীমিত। বিশেষত, এক দিন-দুই দিন একটি এলাকাতে ঘুরে আসলেই, রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা ওই এলাকা ছেড়ে পালাবেন, এমন না-ও হতে পারে। তাহলে কী করণীয়? সেনাবাহিনীকে এমন একটি সময় হাতে রেখে মোতায়েন করতে হবে, যেন সেনাবাহিনীর দল যাদের সেনাবাহিনীর পরিভাষায়, সেকশন বা প্লাটুন বা কোম্পানি বলে, ওই রূপ দলগুলো যেন তাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা নিবিড়ভাবে চেনে এবং ওই এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি নিবিড় জ্ঞান অর্জন করে। সে জন্যই ‘বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় সেনা মোতায়েন’-এর বিধি তথা ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ আংশিকভাবে বদল করার সময় এসেছে; তথা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
জাতির খেদমতে সেনাবাহিনী : উদাহরণ
এই কলামেরই উপরের অংশে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দর্শন বা তত্ত্ব আলোচনা করেছি। সেটি হলো স্বাভাবিক অবস্থায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সরকারের হুকুমে, বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসনকে বিভিন্ন নিয়মে সহায়তা করে; বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক দায়িত্ব পালন করে। এখন থেকে নয়-দশ বছর আগে, মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি ভালো কাজ হয়েছিল। কাজটি করেছিল তৎকালীন নির্বাচন কমিশন। কাজটি ছিল ভোটার আইডি কার্ড প্রণয়ন করে জনগণের হাতে পৌঁছে দেয়া।
দেড় বছরের কম সময়ের মধ্যে সমগ্র ভোটার সম্প্রদায়ের হাতে একটি করে কার্ড পৌঁছানোর বিরাট দায়িত্বটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল সেনাবাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততার কারণে। ভুলত্রুটি ছিল; কিন্তু কাজটি ছিল দারুণ। যখনই ঘূর্ণিঝড় বা বন্যা হয়, জনগণের খেদমতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। দুর্গম এলাকায় রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পুরো সেনাবাহিনীকে না জড়ালেও, সেনাবাহিনীর বিশেষ বিশেষ অংশকে জড়ানো হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহ দমন, শান্তি আনয়ন, শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন, জনগণকে অব্যাহত নিরাপত্তা প্রদান, সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নিরাপত্তা প্রদান ইত্যাদি কাজ সেনাবাহিনী করেই যাচ্ছেন।
পাঁচ-সাত বছর আগে সাভারের রানা প্লাজায় যে মারাত্মক দুর্ঘটনা হয়েছিল, সেই সময় সেনাবাহিনীর স্থানীয় অংশ উদ্ধার তৎপরতায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। জড়িত থাকবে না কেন? বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়া। জন্মলগ্নেই স্বাধীনতার জ্বলন্ত শিখা তাদের চেতনায় কল্পনায় মানসপটে ভাস্বর হয়েছিল এবং আজ অবধি ভাস্বর আছে। জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ চলার প্রথম দীক্ষা, প্রথম অনুশীলন ছিল ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। সেটি ছিল গণযুদ্ধ, সেটি ছিল জনযুদ্ধ, সেটি ছিল রণাঙ্গনের যুদ্ধ। জনগণকে সাথে নিয়ে জনগণের জন্যই খেদমত তথা দেশসেবার অভিজ্ঞতা ১৯৭১ সাল থেকেই উজ্জ্বল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক-সদস্যরা গ্রামবাংলার ছেলেমেয়ে। বাংলাদেশের শিক্ষিত ১৮-২০-২২ বছরের তরুণদের মধ্য থেকেই, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের উৎপত্তি। অতএব, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং জনগণের খেদমতের জন্য উদগ্রীব থাকবে এটিই স্বাভাবিক।
খেদমতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ
সেনাবাহিনী কর্তৃক জনগণের খেদমতে নিবেদিত কর্ম অনেক প্রকারের। দু-একটি উদাহরণ উপরের অনুচ্ছেদে দিয়েছি। সবচেয়ে বড় উদাহরণটি হচ্ছে, শান্তিকালীন সময়ে জাতীয় নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের খেদমতে সর্বদাই নিয়োজিত ও নিবেদিত হয়েছেন।
সেনা মোতায়েন : অতীত ও বর্তমানের সম্পর্ক
সেনা মোতায়েনের পদ্ধতি নিয়ে বা সেনা মোতায়েনের ব্যাপকতা নিয়ে বা সেনা মোতায়েনের নিবিড়তা নিয়ে এখন আলোচনা করছি। ওইটুক লিখেই আজকের কলামটি শেষ করব। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে, ডিজিটাল যুগে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, অতীতের সব কিছুই হুবহু প্রয়োগ করা যাবে না, এটি যেমন সত্য, সাথে সাথে এটিও সত্য যে, যেকোনো চিকিৎসা বা যেকোনো ব্যবহারের বা যেকোনো আচরণের বা যেকোনো মূল্যায়নের মৌলিক নীতি বা মূলনীতি অতীতে যা থাকে, বর্তমানেও সেটির অনেকটাই বহাল থাকবে বা প্রাসঙ্গিক থাকবে।
অর্থাৎ মৌলিক নীতি বা মূলনীতি হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয় না। এই প্রেক্ষাপটেই আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমার পক্ষ থেকে নির্মোহ মূল্যায়নে, আমার অভিজ্ঞতার আলোকে, অন্যতম শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসনীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন ছিল বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অস্থায়ী সরকারের আমলে, ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে, জেনারেল স্টাফ ব্রাঞ্চের অধীনস্থ, মিলিটারি অপারেশন্স ডাইরেক্টরেটের পুরনো ফাইলপত্র ঘেঁটে ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে অথবা ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে প্রকাশ করা বা ইস্যু করা নির্বাচনসংক্রান্ত পলিসি লেটার ঘাঁটলে, এটি বোঝা যাবে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কতটুকু আন্তরিকভাবে ওই নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করার জন্য অগ্রগামী ছিল।
ঠিক একই সময়ে অর্থাৎ জানুয়ারি ১৯৯১ বা ফেব্রুয়ারি ১৯৯১-এর কোনো সময় তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব আবদুল হামিদ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে, বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশ করা বা জারি করা নির্বাচনসংক্রান্ত পরিপত্র আবিষ্কার করে যদি ঘাঁটা যায়, তাহলেও পাঠকদের কাছে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রচুর আন্তরিকতার সঙ্গে, পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তাগাদা দিয়েছিলেন।
সব কর্মের লক্ষ্যবস্তু : জনগণকে সুযোগ প্রদান
এই কলামের পাঠক বা চিন্তাশীল সব সচেতন নাগরিকের কাছে আমার আবেদন থেকেই যাবে যে, তারা যেন একটি কথা বিবেচনা করেন। কথাটি হলো এই : কোন রাজনৈতিক দল জিতবে বা কোন রাজনৈতিক দল হারবে সেটি প্রধান বিবেচ্য বিষয় নয়; বিবেচ্য বিষয় হলো সব যোগ্য ভোটার যেন অবাধে, নিজের ভোট নিজে দিতে পারে এবং সেই ভোটের ফলাফল যেন প্রভাবান্বিত না হয় বা ভোট গণনায় বা ফলাফল প্রকাশে যেন কারচুপি না হয়।
লক্ষ্যবস্তু অর্জনে করণীয়
আমাদের অবজেক্টিভ বা লক্ষ্যবস্তু নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর, আমাদের চিন্তা করতে হবে এই অবজেক্টিভ বা লক্ষ্যবস্তু অর্জনের নিমিত্তে কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি, তার মধ্যে একটি হলো, সরকার যেন নির্বাচন কমিশনের ওপর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর অযাচিতভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি তার মধ্যে আরেকটি হলো, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা।
সেনাবাহিনী মোতায়েনের উদ্দেশ্য
অশান্তি সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের এলাকা থেকে দূরে রাখা, হোন্ডাবাহিনী, গুণ্ডাবাহিনীকে এলাকা থেকে দূরে রাখা, রাজনৈতিক মাস্তানদের এলাকা থেকে দূরে রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিবেশের উন্নতি করা এবং এসব কর্মকাণ্ডের সম্মিলিত ফলস্বরূপ মানুষের মনে এই আস্থা দেয়া যে, মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে, ভোট দিতে পারবে এবং ফলাফলে ভেজাল হবে না। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর মোতাবেক, ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। কিন্তু আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর কোন দায়িত্বটি পালন করবেন সেটি সম্বন্ধে যেন স্পষ্ট ঘোষণা থাকে। আমাদের আবেদন, যারাই গণ্ডগোল সৃষ্টি করতে পারে তাদের আগে থেকেই গ্রেফতার করার বন্দোবস্ত লাগবে। গ্রেফতার কে করবে? সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে? নাকি, সেনাবাহিনী করাবে পুলিশের মাধ্যমে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের ওপর নির্ভর করে মোতায়েন করা সেনাবাহিনীর ওপর জনগণ কতটুকু আস্থাবান হবে বা হবে না। আমরা আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে মাঠে ময়দানে স্বাগতম জানাচ্ছি।
কিছু সিদ্ধান্ত নির্বাচনের আগে নিতে হবে, এখন নয়
নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিরকম হয়, পুলিশ বাহিনীর আইজি কী বলেন বা কী নির্দেশ দেন, র্যাব বাহিনীর মহাপরিচালক কী বলেন বা কী নির্দেশ দেন, জনগণের মধ্য থেকে গুম হয়ে যাওয়া, গ্রেফতার হয়ে যাওয়া, ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া ইত্যাদির ফ্রিকোয়েন্সি বা হার কিরকম থাকে, ইত্যাদি সব কিছুর উপরেই নির্ভর করবে সেনা মোতায়েনের ব্যাপ্তি ও নিবিড়তা। ইতোমধ্যে পত্রিকায় লিখেই চলেছি, চৌদ্দ-পনেরো মাস আগেও লিখেছি। অদূর বা নিকট ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা না করে আমার কথাগুলো আমি বলে যাচ্ছি। যেসব সম্মানিত পাঠক, যেসব আগ্রহী পাঠক, যেসব পরিশ্রমী তরুণ কথাগুলোকে সংরক্ষণ করবেন, তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা থাকলেও চূড়ান্ত উপকারিতা পাবেন সংরক্ষণকারী নিজে। কারণ, সবসময় সব কথা বের হয় না। ব্যাখ্যা দেবো না শুধু মন্তব্যটিই করলাম : ‘বর্ষাকালে তুফান ছাড়া বৃষ্টি পাওয়া যায়, কিন্তু অক্টোবর-নভেম্বর অথবা মার্চ-এপ্রিল মাসে বৃষ্টি আসে সিডর আইলা নার্গিস ইত্যাদির সঙ্গে।’
আমি মতবিনিময়ে আগ্রহী
পত্রিকার কলামের মাধ্যমে সম্মানিত পাঠক সম্প্রদায়ের সাথে আংশিক মতবিনিময় হয়। এক্ষণে আমার পক্ষ থেকে উপস্থাপিত সারমর্ম হলো, সব ধরনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, পত্রিকায় কলাম লেখা, টেলিভিশন টকশোতে অংশগ্রহণ করা, ফেসবুকে পোস্ট দেয়া ইত্যাদি কাজ, মতামত আদান-প্রদানের অন্যতম স্বীকৃত উপকারী মাধ্যম। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই উপকৃত হই এবং স্বাগতম জানাই আমার লেখার ওপর সব মন্তব্যকে এবং প্রশ্নকে। এই কলামের এই স্থানে আমি কিছু তথ্য দিলাম। আমার ওয়েব সাইটের নাম: www.generalibrahim.com.bd,, আমার ইমেইল আইডি : [email protected] আমার ফেসবুক পেজের নাম দিলাম : ‘মেজর জেনারেল অব: সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক। ইউটিউবে আমার সাথে যোগাযোগের জন্য জেনারেল ইবরাহিম বীর প্রতীক (General Ibrahim Birprotik) ইত্যাদি উল্লেখ করলাম। আর ইংরেজি ভাষায় বা ইংরেজি অক্ষরে আমার নাম (সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ঝুবফ গঁযধসসধফ ওনৎধযরস) লিখলে আমার ফেসবুকে আমার পার্সোনাল টাইমলাইনেও যাওয়া যায়। পত্রিকার পাঠকদের সাথে আমাদের মতবিনিময় আরো যেন জোরালো হয়, আমি সেই বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করলাম। আগামী কয়েক দিন, কলাম লেখায় অনিয়মিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে; সে জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। [সমাপ্ত]
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:);
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা