২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইসির মূর্তি ও ভাবমূর্তি

-

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন ধরনের মডেল অনুসরণ করা হবে, তার কিছু আলামত পাওয়া যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিদ্ধান্ত থেকে। নিকট অতীতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের বাইরে শান্ত পরিবেশ বজায় রেখে ভেতরে ব্যালট বাক্স ভরানোর মডেল অনুসরণ করা হয়েছিল। এ মডেলের মূল কারিগর ছিল পুলিশ। এবারো নির্বাচন কমিশন এমন শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মডেল অনুসরণ করতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কমিশনের বেশ কিছু সিদ্ধান্তে এমন আভাস পাওয়া যায়। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন- এবারের নির্বাচন হয়তো ‘অংশগ্রহণমূলক’ হবে, কিন্তু অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘গায়েবি’ ভোটে ব্যালট বাক্স ভরানোর অনেক খবর গণমাধ্যমে এসেছিল। বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়ায় জাল ভোট দেয়ার দৃশ্য এবং কেন্দ্র দখলের ভিডিও আর ছবি প্রকাশ করা হয়। এই ছবি এবং ভিডিও এসেছিল ভোটার ও সাংবাদিকদের মাধ্যমে। নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরাও এমন ছবি ধারণ করেছেন। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গায়েবি ভোট দেয়ার এমন কৌশল ফাঁস হয়ে যেতে পারে বলে নির্বাচন কমিশনের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে।

নির্বাচন কমিশনের সচিব ইতোমধ্যে পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের কাজের ব্যাপারে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। পর্যবেক্ষকদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি স্টাইলে নির্দেশনা হচ্ছে- তারা ভোটকেন্দ্রে ঢোকার পর মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকবেন; কোনো ধরনের ছবি তুলতে পারবেন না, গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে কথা বলতে পারবেন না। অপর দিকে, সাংবাদিক বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ভোট দেয়ার দৃশ্য কিংবা ভোটকেন্দ্রের খবর লাইভ প্রচার করা যাবে না। সাংবাদিকদের কাজের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত গাইডলাইন এখনো আসেনি। ধারণা করা যায়, সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে কমিশন আরো কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। নির্বাচন কমিশনের বৈঠকগুলো থেকে সাংবাদিকদের বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটছে।

নির্বাচনের দিন সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা যেন নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেখেছি, ২০১৪ সালের প্রহসনমূলক সংসদ নির্বাচনে যেসব আসনে ভোট হয়েছে, সেসব আসনের অনেক কেন্দ্রের চিত্র লাইভ প্রচার করা হয়েছিল। তাতে দেখা গেছেÑ ভোটকেন্দ্রে কোনো মানুষ ছিল না এবং বাইরে কুকুর-বিড়াল শুয়ে আছে। আবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ছয় বছরের বালক দু-চারটা নয়, ১০০ ভোট দেয়ার রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এসব খবর নিঃসন্দেহে নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে। এ কারণে আগেভাগেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তদুপরি, ভোটকেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সাধারণ মানুষের হাতে থাকা ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিশেষ করে মোবাইল ফোন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের যেন বড় শত্রু হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন সবার হাতে প্রচারযন্ত্র। যন্ত্রটি হচ্ছে মোবাইল ফোন। এবার নতুন ভোটাররা সবাই ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিশেষ করে স্মার্টফোনের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাথে সংযুক্ত। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ হিসাব বলছে, বাংলাদেশে ৯ কোটি পাঁচ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে আট কোটি ৪৭ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন মোবাইল ফোনে। দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৫ কোটি পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন ১০ কোটি ৪১ লাখ মানুষ।

এ হিসাবে অনুমান করা যায়, দেশের প্রত্যেক ভোটারের কাছে মোবাইল ফোন রয়েছে। মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটে যারা সংযুক্ত, তাদের বেশির ভাগের ফেসবুক পেজ আছে। ফেসবুক পেজে নির্বাচনকেন্দ্রিক যে প্রচারণা শুরু হয়েছে, তা সরকারের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। নির্বাচনের আগে ফেসবুক নিয়ন্ত্রণের কৌশল নেয়া হতে পারে। মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেটে ধীরগতি চলার নির্দেশনা দেয়া হতে পারে, যাতে ছবি ও ভিডিও দ্রুত আপলোড এবং শেয়ার করা না যায়। সামাজিক মাধ্যম কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশন মোবাইল ফোন অপারেটর, বিটিআরসি এবং টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সংস্থার সাথে বৈঠক করেছে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখন দেখার বিষয়- ফেসবুকে প্রচারণার জন্য কাকে, কিভাবে আইনের আওতায় আনা হয়।

সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক ছাড়াও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কাজের ব্যাপারেও নির্বাচন কমিশনের কিছু বক্তব্য বিস্ময়কর। দেড় হাজার জুডিশিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচনে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা বা জালিয়াতি রোধে নির্বাচনী আইন কেউ লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধান আছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ভোটকেন্দ্র ঘুরে অনিয়ম পেলে এতে জড়িতদের শাস্তি প্রদান করেন। এ ক্ষেত্রে তারা দায়িত্ব পালন করে থাকেন স্বাধীনভাবে। এবার নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে- প্রিজাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে পারবেন না। প্রত্যেক ভোটকেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকেন না। সাধারণভাবে ম্যাজিস্ট্রেটরা ভ্রাম্যমাণ দায়িত্ব পালন করেন। এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্র যান। আবার কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তখন তাদের সাথে ম্যাজিস্ট্রেট রাখা হয়।

ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও থাকেন। ধরা যাক, একটি ভোটকেন্দ্রে আসার পথে তিনি অনিয়ম পেলেন, এ জন্য কাউকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু এর আগে প্রিজাইডিং অফিসারের অনুমতি নিতে হবে। দেখা যাবে, ততক্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তি কেন্দ্র থেকে চলে গেছেন। এমনকি, সে ব্যক্তি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর চড়াও হতে পারেন।

বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে পুরো নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করতে কার্যত প্রধান ভূমিকা পালন করেছে পুলিশ। এবারের নির্বাচনেও পুলিশের ভূমিকা নানাভাবে আলোচিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে কারা প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, তার তালিকা এবং তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। পুলিশের কাছে নিশ্চয়ই আগে থেকে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় বিরোধী দলের সক্রিয় নেতাকর্মীদের তালিকা রয়েছে। বিরোধী দলের প্রার্থীদের পক্ষে স্বাভাবিকভাবেই এ নেতাকর্মীরা নির্বাচনী এজেন্ট হবেন। দেখা যাচ্ছে- একটি ভোটকেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার এবং এজেন্টদের তালিকা পুলিশ আগেই করে ফেলেছে। পুলিশ এখন এ তালিকা ধরে ভোটের আগে ‘সব ধরনের ব্যবস্থা’ নিতে পারবে। মামলার ভয় দেখাতে পারে, মাদক বা ভুয়া মামলা দিতে পারে, এমনকি টাকার খেলাও খেলতে পারে। এ তালিকা ধরে ধরপাকড় চলছে।

পুলিশ নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছে না বলে ইতোমধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে। পক্ষপাতমূলক আচরণ করতে পারে, এমন বেশ কিছু পুলিশ কর্মকর্তার নাম দেয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনের কাছে। অতীতে প্রতিটি নির্বাচনের সময় প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনে রদবদল আনা হতো। কারণ, দীর্ঘ দিন একটি সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে পুলিশের সাথে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশেষ সংযোগ সৃষ্টি হয় এবং বিশেষ ধরনের সুবিধাভোগী শ্রেণী সৃষ্টি হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে কোনো প্রার্থী বা দলকে বিজয়ী করতে চেষ্টা চলে, যা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বড় ধরনের অন্তরায়।

বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে পুলিশ প্রশাসনে আশু পরিবর্তন আনার দাবি কার্যত নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, সারা দেশে নির্বাচনব্যবস্থা মনিটরিংয়ের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে এই কমিটিতে অনেক বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তাকে রাখা হয়েছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যাদের নামে অভিযোগ করা হয়েছে, তারা সবাই এ মনিটরিং-প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। দেশে গত কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পুলিশ নির্বাচনী আচরণবিধি এবং আইনি অধিকারের বাইরে গিয়েও কাজ করেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের ভেতরে বসে ক্ষমতাসীন প্রার্থীর পক্ষে সিল মারা, বিরোধী দলের প্রার্থীর এজেন্টদের আগেই গ্রেফতার করা এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের সভা-সমাবেশে বাধা দেয়ার অভিযোগ ছিল। নির্বাচন কমিশনের তদন্তেও এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। কিন্তু এরপরও কমিশন বিরোধী দলের দাবি আমলে নেয়নি।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে পুলিশ যে অতি উৎসাহ দেখাচ্ছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাদের বিভিন্ন ধরনের পুরনো মামলা, এমনকি মাদক মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। ফলে নির্বাচনের আগে তাদের বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা কম। এমনকি নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী গুম হয়েছেন। কিন্তু এর সাথে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনও পুলিশের ওপর কার্যত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছে বলে মনে হয় না। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচনের সক্ষমতা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের মতো অবস্থা নেই।

পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তারা কোনো দলের কর্মচারী নয়। নির্বাচনকালীন সময়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু এবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পুলিশের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, নির্বাচন কমিশন পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারছে না। অবশ্য সে ধরনের সদিচ্ছা কমিশনের আছে, এমন মনে করা কঠিন। নির্বাচনের আগে পুলিশের অতি উৎসাহী তৎপরতা বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণ মানুষ যদি ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশকে বাধা হিসেবে বিবেচনা করে, তাতে বড় ধরনের সঙ্ঘাতের শঙ্কা সৃষ্টি হবে। কারণ মানুষ কখনো কখনো অধিকার আদায়ের ব্যাপারে অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।
alfazanambd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement