০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

জাতীয় নির্বাচন : সংখ্যালঘু সুরক্ষা

-

২০ নভেম্বর সুলতানা কামালের মাতা সুফিয়া কামালের মৃত্যুবার্ষিকী অনুষ্ঠিত হলো। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে বাণী দিয়েছেন দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি হলেন সুফিয়া কামাল। তার সাহিত্যে সৃজনশীলতা অবিস্মরণীয়।’

আমরা জানি, সুফিয়া কামাল অনেক কিছু নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। তিনি কবিতা লিখেছিলেন বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে। নারীহৃদয়ের ব্যাকুলতা নিয়ে। আবার কবিতা লিখেছিলেন রাজনীতি নিয়েও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানেন কি না আমরা জানি না, তিনি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে নিয়ে লিখেছিলেন আটটি কবিতা। সুফিয়া কামাল একসময় ছিলেন পাকিস্তানপন্থী। এই আটটি কবিতা হলো : নির্ভীক মহাপ্রাণ (মাহেনও, ডিসেম্বর ১৯৫২), হে সিপাহসালার (মাহেনও, ১৯৫৩ ডিসেম্বর), হে মহান নেতা (মাহেনও, ১৯৫৪ ডিসেম্বর), হে মশালধারী ( মাহেনও, ১৯৫৫ ডিসেম্বর), হে অমর প্রাণ (মাহেনও, ১৯৫৬ ডিসেম্বর), করো নাকো সংশয় (মাহেনও, ১৯৫৭ ডিসেম্বর), তোমার জন্মদিনে (পাক-সমাচার, ১৯৬৩ ডিসেম্বর), স্মরণীয় (পাকিস্তানী খবর, ১৪ আগস্ট ১৯৬৬)।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কে আর কোনো বাংলাভাষী কবি এত কবিতা লিখেছেন বলে আমাদের জানা নেই। এ দিক থেকে তাকে বলা যেতে পারে ‘পাকিস্তানপন্থী’ কবি। তার মৃত্যুদিবস পালনের সময় তার কাব্যচিন্তার এ দিকটির কথা কাউকে উল্লেখ করতে দেখা গেল না। অনেকের মতে, সুফিয়া কামাল ছিলেন রাজনীতিতে একপ্রকার সুবিধাবাদী। কথাটা আমাকে বলতে হচ্ছে, কারণ তিনি ধনী-দরিদ্রের দ্বন্দ্ব নিয়েও কিছু কিছু কবিতা লিখেছিলেন। কবিতা না বলে যাকে ‘বিবৃতি’ বলাই ভালো। কিন্তু এসব কবিতার জন্য ১৯৭০ সলে তাকে প্রদান করা হয়েছিল লেনিন পুরস্কার।

কবি সুফিয়া কামালের সাথে আমার কিঞ্চিৎ পরিচয় ঘটেছিল ‘সমকাল’ নামক বিখ্যাত মাসিক পত্রিকার অফিসে, যা প্রকাশিত হতো কবি সিকান্দার আবু জাফরের সম্পাদনায়। আমি তখন ঢাকায় থাকতাম। আর মাঝে মধ্যে সমকাল পত্রিকায় লিখতাম। তবে সমকালের সাথে, ঠিক সেই সময়ের অন্য লেখকদের মতো যুক্ত ছিলাম না। আমি ছিলাম সমকালচক্রের লেখকগোষ্ঠীর বাইরের একজন লোক। আমার মতো আর কোনো লোক সম্ভবত সে সময় সমকালে লিখতেন না। সমকালের একটা বিশেষ গোষ্ঠী ছিল, যারা প্রতি মাসে সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করতেন। আমি এ সভায় কখনো আমন্ত্রিত হতাম না। সমকাল আমার কাছে ছিল একটি রহস্যময় পত্রিকা। এ পত্রিকায় তখনকার মার্কিনপন্থী ও সোভিয়েতপন্থীদের হতে পেরেছিল এক বিচিত্র সমাহার।

সিকান্দার আবু জাফর ছিলেন মার্কিনপন্থী। তিনি সমকাল পত্রিকার প্রধান সম্পদক। সমকাল পত্রিকার দুইজন ছিলেন উপ-সম্পাদক। তারা হলেন- হাসান হাফিজুর রহমান ও বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। এরা পরিচিত ছিলেন বামপন্থী বা কমিউনিস্ট হিসেবে। বেগম সুফিয়া কামাল সমকাল-চক্রের একজন মধ্যমণি ছিলেন। তাকে কখনো মনে হতো মার্কিনপন্থী, আবার কখনো মনে হতো মস্কোপন্থী। ১৯৭১-এ সিকান্দার আবু জাফর ঢাকা থেকে চলে যান কলকাতায়। সেখান থেকে প্রকাশ করেছিলেন ‘সাপ্তাহিক অভিযান’ নামক একটি পত্রিকা। এর ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা’ করা।

এই পত্রিকা প্রকাশের জন্য আবু জাফর আর্থিক অনুদান পেয়েছিলেন সিআইএর কাছ থেকে। পত্রিকাটির সম্পাদক বাহ্যত ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর। কিন্তু এই পত্রিকার সম্পাদক কার্যত ছিলেন আহমদ ছফা। আবু জাফর ও আহমদ ছফা দু’জনেই ভাতা পেতেন একই উৎস থেকে। সিকান্দার আবু জাফর আমাকে ডেকে পাঠালেন। বলেন, তার পত্রিকায় আমাকে কিছু লিখতে। আমি বললাম, আপনি বলছেন যখন, তখন সম্ভব হলে কিছু লিখব। কিন্তু কোনো কিছু লিখবার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ ভারত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ দখল করার।

যখন এ কথা হচ্ছিল, তখন আহমদ ছফা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি কিছুই খবর রাখেন না। ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে। তারা চাচ্ছে না, ভারত যুদ্ধ করুক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে।’ যা হোক, নানা কারণেই কলকাতায় ছিলাম খুবই শঙ্কিত। আমি সিকান্দার আবু জাফরের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিই।

বেগম সুফিয়া কামালের মেয়ে সুলতানা কামাল ১৯৭১-এ ছিলেন ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশের রাজধানী আগরতলায়। সে সময় আগরতলা হয়ে উঠেছিল ঢাকা থেকে যাওয়া মস্কোপন্থীদের একটা বড় রকমের ‘আখড়া’। সুলতানা কামাল তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। সুলতানা সম্প্রতি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশে হাঙ্গামা হতে পারে। তাতে সংখ্যালঘুরা (সহজ কথায় হিন্দুরা) হতে পারেন নির্যাতনের শিকার। তারা যাতে নির্যাতনের শিকার না হন, সে জন্য সরকারকে সতর্ক হতে হবে।’ সুলতানা কামালের মধ্যে তাদের জন্য বিশেষ সহানুভূতি থাকা খুবই স্বাভাবিক। কারণ তিনি বিয়ে করেছেন সুপ্রিয় চক্রবর্তী নামে একজন হিন্দু যুবককে। এ বিবাহ বন্ধনে জন্ম হয়েছে তার মেয়ে দিয়া সুদেষ্ণা চক্রবর্তীর। সুলতানা কামাল তাই হিন্দুদের কথা বিশেষভাবে ভাববেন, সেটা খুবই স্বাভাবিক।

প্রথম আলো পত্রিকার খবরে ( ২১ নভেম্বর ২০১৮) দেখলাম, সংসদের ৫৮টি আসনে সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তা শঙ্কায় ভুগছেন। ৯৬টি সংসদীয় আসনে ১০ শতাংশের বেশি সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছেন। ভোটের আগে-পরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি করা হয়েছে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত ২০ নভেম্বর বলেছেন, ১৪-দলীয় জোটকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, যদি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের মনোনায়ন দেয়া হয়, তবে আমাদের পক্ষে ভোট দেয়া কতটা সম্ভব হবে, তা বলতে পারব না। একই তারিখে ঘাদানিক সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন, মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগের বড় চ্যালেঞ্জ জামায়াত বা বিএনপি নয়, বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দিতে না পারা। যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দিতে না পারলে সংখ্যালঘুরা হবেন বিশেষভাবে নির্যাতনের শিকার।

এই যুক্তিধারাটাকে আমাদের পক্ষে উপলব্ধি করা হচ্ছে কঠিন। কেননা সংখ্যালঘুরা কেবল আওয়ামী লীগকেই ভোট দেয়, এমন নয়। বিএনপির মতো দলে আছেন গয়েশ্বর রায়ের মতো হিন্দু নেতা। সবশেষে যেটা মনে রাখা দরকার, তা হলো- বাংলাদেশের যেসব হিন্দু আছেন, তাদের বেশির ভাগই হলেন নিম্নবর্ণের। তারা ঠিক হিন্দুত্ববাদী নন। আর তারা আওয়ামী লীগকে একটা হিন্দুবান্ধব দল বলে মনে করেন না। এ ছাড়া, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ওপর আরম্ভ হয়েছে নানাভাবে অত্যাচার। তা বাংলাদেশের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মনে ভারত সম্পর্কে সৃষ্টি করছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।

এ দিকে বাংলাদেশের সব বৌদ্ধ যোগ দেননি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদে। খ্রিষ্টানরা খুব কমই যোগ দিয়েছেন এ সংগঠনে। তারা তাই এ দেশের ‘সংখ্যালঘু’ বলতে যাদের ধরা হয়, তাদের কতটা প্রতিনিধিত্ব করেন, সেটা নিয়ে তোলা যায় প্রশ্ন। ১৯৭১ সালে এ দেশে উঠেছিল ‘জয়বাংলা’ আওয়াজ। বলা হয়েছিল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান পার্থক্যের প্রশ্ন তখন ওঠানো হয়নি। ওঠানো হয়নি উপজাতিদের প্রশ্ন। কিন্তু এখন এসব ওঠানো হচ্ছে। আর সুলতানা কামালের মতো মানবাধিকারের প্রবক্তারা তাদের অধিকার নিয়ে করতে চাচ্ছেন বিশেষ রাজনীতি। এটাকে বলতে হয়, বাংলাদেশের বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement