২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সংলাপের পূর্বাপর ও গণতন্ত্র

সংলাপের পূর্বাপর ও গণতন্ত্র - ফাইল ছবি

দেশে সংলাপ-সমঝোতা নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ হয়েছিল সম্প্রতি। কিন্তু সে সুযোগটা কাজে লাগানো যায়নি। তবে এখনো সম্ভাবনা পুরোপুরি শেষ হয়নি। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের অতীত স্মৃতি মোটেই সুখকর নয়। কারণ, অতীতে কোনো সংলাপের ফলাফল জনগণের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না। এই ধারাবাহিক ব্যর্থতার জন্য রাজনৈতিক পক্ষগুলো পরস্পরকে দোষারোপ করে। প্রকৃতপক্ষে কারা দায়ী তা অবশ্য ইতিহাসই মূল্যায়ন করবে। সত্যটা যেকোনোভাবেই হোক প্রকাশ পায়। তাই রাজনৈতিক সঙ্কট, সংলাপের সফলতা ও ব্যর্থতায় যার যতটুকু ভূমিকা আগামী দিনের ইতিহাসই তা নিশ্চিত করবে। তাই সবাই ইতিহাসসচেতন হওয়া উচিত।

সংলাপ বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থানের পরও সম্প্রতি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে সরকারের একটা সংলাপ হয়ে গেল। আশা করা হয়েছিল, সংলাপের মাধ্যমে দেশে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ইতিহাসের অংশ হবেন। কিন্তু প্রথম দফা সংলাপের পরিসমাপ্তি যেভাবে হয়েছে তাতে ‘খাজনার চেয়ে বাজনা’ই ছিল বেশি। তাই সংলাপের সফলতা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কিছু বলতে পারেননি। যতটুকু বলেছেন তাতে হতাশা বেশ প্রবল। সদ্য সমাপ্ত সংলাপে পর্বত যে মূষিক শাবকও প্রসব করতে পারেনি, সে কথাই ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে। তাই প্রথম দফার সংলাপকে কেউ কেউ ‘সুপার ফ্লপ’ বলছেন। এ দাবিকে আরো জোরালো ভিত্তি দিয়েছে ড. কামাল হোসেন পুনরায় সংলাপ চেয়ে দ্বিতীয় দফা চিঠি দেয়ার মাধ্যমে। এতে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়, প্রথম দফা সংলাপ প্রায় ব্যর্থ। কোনো বিশেষ পক্ষের না উভয় পক্ষের এ ব্যর্থতা একদিন প্রকাশ পাবে।

রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে যে প্রায় নিষ্ফলা সংলাপ হয়ে গেল বা আগামীতে যেসব সংলাপ ও সমঝোতার চেষ্টা হবে তাতে কার ভূমিকা কী ছিল তা অবশ্যই ইতিহাসে স্থান লাভ করবে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের অতি সর্তক হয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত, যাতে ইতিহাস কাউকে খলনায়ক হিসেবে চিত্রিত না করে।

এবার সংলাপ শুরুর আগেই সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা থাকলেও মনে করা হয়েছিল যে, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে উভয় পক্ষই তাদের সনাতনী ধ্যানধারণা ও অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসবেন এবং মন্দের ভালো হলেও একটা ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের স্বপ্নভঙ্গই হয়েছে বলতে হবে। দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিকালেও রাজনীতিকেরা সঙ্কীর্ণ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেননি।

আশা করা হয়েছিল, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফার চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে। সরকার এ ক্ষেত্রে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’র কথা বললেও বিশেষজ্ঞরা অতীত নজির এবং সংবিধানসম্মত প্রস্তাবও উপস্থাপন করেছেন। সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সংবিধানের ১২৩(খ) ও ৫৬(৪) অনুচ্ছেদকে সামনে আনা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে গণপরিষদ বিলুপ্তির পর দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এমন নজিরও উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একগুঁয়েমির কারণেই সংলাপ-সমঝোতার বিষয়টি এখনো পেন্ডুলামের মতো ঝুলছে।

মানে, সংলাপ হলেও সমঝোতা হয়নি। যতটুকু জানা যাচ্ছে, তাতে দফাভিত্তিক আলোচনা হয়নি বরং সরকারের সাফল্যগাথা আর বিরোধী পক্ষের অসহায় আকুতিই প্রকাশ পেয়েছে। এখানে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কিভাবে করা যায় তা নিয়ে কোনো কথা হয়নি বরং ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের ভাষায়, প্রধানমন্ত্রী সংলাপে অংশগ্রহণকারীদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ‘নিশ্চয়তা’ দিয়েছেন। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতির ওপর প্রতিপক্ষ কতখানি আস্থাশীল তা নিয়ে কোনো কথা তিনি বলেননি। সংলাপ-পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে ড. কামাল জানিয়েছেন, আলোচনা হয়েছে কিন্তু সমাধান পাওয়া যায়নি। এতে প্রমাণিত হয়, সংলাপ দীর্ঘ সময় ধরে হলেও উভয়পক্ষে কোনো ধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

আমাদের দেশে সংলাপ নিয়ে এর আগেও ঢাকঢাক গুড়গুড় খেলা কম হয়নি। ১৯৮৪ সালে বিরোধীদলের সাথে দফায় দফায় সংলাপ হয়েছিল তদানীন্তন এরশাদ সরকারের। এমনকি বিষয়টি নিয়ে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদার জিয়ার মধ্যে শীর্ষ সংলাপও হয়েছিল; কিন্তু কোনো সংলাপই সফল হয়ে ওঠেনি। ১৯৯৪ সালের ৩১ আগস্ট রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের দুই উপনেতার মধ্যে বৈঠক হয়েছিল। তদানীন্তন কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা এনিয়াকু রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণ করলে তা-ও সফল হয়নি। এরপর তারই বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান মার্টিন স্টিফেনকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন সংলাপে মধ্যস্থতা করার জন্য; কিন্তু তিনিও সফল হতে পারেননি।

২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের আগেও তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তা প্রত্যাখ্যানের জের ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তা নিরসনে বাংলাদেশে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার; কিন্তু তাকে ব্যর্থতা নিয়েই ফিরে যেতে হয়েছে।

২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মধ্যে প্রায় তিন সপ্তাহ সংলাপ হয়েছিল নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে। ওই সময় তাদের মধ্যে ছয় দফা বৈঠক হলেও সমঝোতা হয়নি; বরং পরবর্তী সময়ে এক-এগারোর মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাই ঘটেছিল। এই ব্যর্থতার প্রায়শ্চিত্ত এখনো পুরো জাতিকেই করতে হচ্ছে। আরো কত দিন করতে হবে, তার কোনো টাইমফ্রেম নেই।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের শেষ দিকে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপে বসে বিএনপি। সঙ্কট নিরসনে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছেন জাতিসঙ্ঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। দফায় দফায় সংলাপ হলেও ফলাফল ছিল যথা পূর্বং তথা পরং, অর্থাৎ শূন্য।

অতীতে এ দেশে কোনো সংলাপ থেকেই ইতিবাচক ফল পাওয়া না গেলেও সর্বসাম্প্রতিক সংলাপে জনমনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছিল। তবু তারা আশাহত হয়েছে বলতে হবে। বিশেষ করে সরকারের ক্ষমতা হারানোর ভীতিকেই সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণ বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজে এভাবে ক্ষমতাকে ‘যক্ষের ধন’ মনে করার সুযোগ করো নেই। কারণ, শাসিত জনগণের সম্মতিই হচ্ছে গণতন্ত্র। তাই শাসনকাজে জনমতের প্রতিফলন ছাড়া গণতন্ত্র সফল ও বিকশিত হয় না। এ বিষয়ে সি এফ স্ট্রংয়ের মন্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তার ভাষায়, ‘শাসিতগণের সক্রিয় সম্মতির উপরে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত, তাকে গণতন্ত্র বলা যায়’।

মূলত আমাদের পশ্চাৎপদ ও অগণতান্ত্রিক মানসিকতার কারণেই স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো সংলাপই সফলতার মুখ দেখেনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জাতীয় স্বার্থের বিপরীতে সঙ্কীর্ণ ও তুচ্ছ গোষ্ঠীস্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতায় যখন দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ উপেক্ষিত হয় তখন ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে আর গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং জাতীয় স্বার্থ নিক্ষিপ্ত হয় আঁস্তাকুড়ে।

পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া মহাজনী মূলধনের চরম জাতীয়তাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ও সন্ত্রাসমূলক প্রকাশই হচ্ছে ফ্যাসিবাদ। এ মতবাদ চরম জাতীয়তাবাদী, অযৌক্তিক ধর্ম ও বর্ণবিদ্বেষ এবং উদ্দেশ্য সাধনে চরম বর্বরতার আদর্শ প্রচার করে। জাতীয় ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের বিকাশ যখন নিঃশেষিত, তখন পুঁজিবাদ শোষণমূলক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র গ্রহণ করে। আর তখনই ফ্যাসিবাদের নি¤েœাক্ত উপসর্গগুলো প্রকাশ পায়। ক. ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল নয়। মূলত ফ্যাসিবাদে নেতা যা আদেশ করবেন, তাই রাষ্ট্রের আদেশ বলে নির্বিবাদে মেনে নিতে হয়। খ. ফ্যাসিবাদ সমাজতন্ত্রেও অবিশ্বাস করে না। গ. ফ্যাসিবাদে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত হয় না। ফ্যাসিবাদের মূলমন্ত্র হলো সব কিছুই রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত, বরং কোনো কিছুই রাষ্ট্রের বাইরে নয়।

ঘ. ফ্যাসিবাদ শান্তি কামনা করে না। ফ্যাসিবাদ নিয়ত ‘সংগ্রামে’ লিপ্ত থাকার অনুপ্রেরণা জোগায়। মুসোলিনির মতে, মহিলাদের কাছে যেমন মাতৃত্ব, পুরুষদের কাছে তেমন যুদ্ধবিগ্রহ। ঙ. ফ্যাসিবাদে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং দলীয় নেতা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে ক্ষমতাসীন হন। একদল ও এক নেতাই সরকারের এবং সমাজের সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন। চ. ফ্যাসিবাদে এলিট শ্রেণীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে বিশ্বাস করা হয়, পৃথিবীতে কিছু ব্যক্তি শাসন করতে এবং অন্যরা শাসিত হওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করে।

মূলত সরকার হলো কোনো দেশের সর্বোচ্চ সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ যার মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালিত হয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়। সরকারের মৌলিক দায়িত্ব জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী দেশের নিরাপত্তা বিধান করা, সমাজের শান্তি বজায় রাখা, মানুষের জান-মাল রক্ষা এবং বিবাদের ক্ষেত্রে বিচারকার্য পরিচালনা করা। এসব কাজে সরকার যখন সফল হয়, তখন রাষ্ট্র কার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আর ব্যর্থ হলে তা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার রূপ নেয়। খোদ রাষ্ট্রই যখন কোনো গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় তখন সে রাষ্ট্র আর গণতান্ত্রিক থাকে না। রাষ্ট্রের যখন এহেন চরিত্র প্রকাশ পায়, তখন গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সংলাপ-সমঝোতার কোনো উপযোগিতা থাকে না।

দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের ক্ষেত্রে সংবিধান ও প্রচলিত আইন প্রধান প্রতিবন্ধক বলে কেউ কেউ দাবি করছেন; কিন্তু সংবিধান বা প্রচলিত আইন কোনোভাবেই সমঝোতা বা সুশাসনের জন্য প্রতিবন্ধক নয় তা দার্শনিক প্লেটোর বক্তব্য থেকে খুবই স্পষ্ট। তার মতে, ‘When the prince is virtuous, laws are unnecessary; when prince is not virtuous, law is useless. অর্থাৎ ‘শাসক যখন হবেন ন্যায়বান, তখন আইনের শাসন নি®প্রয়োজন। আবার শাসক যখন দুর্নীতিপরায়ণ তখন আইন থাকা নিরর্থক’। তাই সংবিধান বা আইন নয়; বরং সমস্যা হলো শাসকগোষ্ঠীর ন্যায়পরায়ণতা ও সদিচ্ছার অভাব। আর এই বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে সংলাপ-সমঝোতা-গণতন্ত্র, সর্বোপরি আমাদের জনগণের ভাগ্য।
smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement