২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

স্মৃতিময় না বলা গল্প ও শিক্ষা

স্মৃতিময় না বলা গল্প ও শিক্ষা - ছবি : সংগ্রহ

নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অভিনন্দন
আজকের কলামটি শুরু করছি দৈনিক নয়া দিগন্তকে, এই পত্রিকার অনলাইন ও মুদ্রণ সংস্করণের লাখ লাখ পাঠক ও শুভাকাঙ্ক্ষীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে। আগামীকাল ২৫ অক্টোবর নয়া দিগন্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গত সপ্তাহের কলাম তথা ১৭ অক্টোবর তারিখের কলামটি ছিল স্মৃতিচারণমূলক। এই সপ্তাহের কলামটিও স্মৃতিচারণমূলক।

৭৩ সালের সেনাবাহিনী : ক্ষুদ্র খণ্ডচিত্র
১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকের কথা। তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাইজ ছোট ছিল; পাঁচটি সেনানিবাসে ছিল পাঁচটি নবগঠিত ব্রিগেড। এই ব্রিগেডগুলোর অধিনায়ক বা ব্রিগেড কমান্ডার প্রত্যেকেই ছিলেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। ব্রিগেডগুলোতে ব্যাটালিয়ন বা রেজিমেন্ট ছিল কম, ব্রিগেডগুলোতে এবং পুরো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অফিসারের সংখ্যা ছিল কম, সেনাবাহিনীর সদর দফতর তথা সেনা সদরে যতগুলো পরিদফতর (ডাইরেক্টরেট) থাকার কথা, ছিল তার অর্ধেক। কারণ, সেগুলো পরিচালনার জন্য যথেষ্ট অফিসার বা পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিজ্ঞ অফিসার ছিলেন না। ওই সময়ের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শতকরা নব্বই ভাগ অফিসারই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং আমরা একজন আরেকজনকে, বড় হোক ছোট হোক, মোটামুটি চিনতাম।

যে অল্পসংখ্যক অফিসার সেনাবাহিনীর সদর দফতরে বা বিভিন্ন ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে ছিলেন কিংবা বিভিন্ন ইউনিট ও প্রতিষ্ঠানে ছিলেন, তাঁদের ওপরে কাজের চাপ ছিল প্রচুর। উদ্যম ও আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। শান্তিকালীন অভিজ্ঞতার অভাব, অসীম উদ্যম, আন্তরিকতা ও যুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত ম্যাচিউরিটি দিয়ে মেটানো হচ্ছিল। আমরা যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর হাজার হাজার অফিসার যে সুযোগ বা অভিজ্ঞতা পায় না, তা আমরা পেয়েছিলাম; অর্থাৎ আমরা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। শান্তিকালীন সেনাবাহিনী যাকে বলে পিস টাইম আর্মি, সেটাতে চাকরি করার অভিজ্ঞতা বেশির ভাগ অফিসারেরই সীমিত ছিল, যেমন এক থেকে পনেরো বছর। উদাহরণ দিচ্ছি : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওই সময়ের সেনাপ্রধান (চিফ অব আর্মি স্টাফ) ছিলেন মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম এবং সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম; উভয়েই পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি কাকুলের ১২তম লং কোর্সের অফিসার তথা ১৯৫৫ সালে কমিশনপ্রাপ্ত এবং ১৯৭৩-এর ফেব্রুয়ারিতে তাদের সরেজমিনে চাকরির ১৮-১৯ বছর চলছিল। ফেব্রুয়ারির ছয় মাস পর, সেপ্টেম্বর মাসে, বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের দুই বছরের অ্যান্টিডেইট সিনিয়রিটি প্রদান করে।

আমরা কিন্তু ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩-এর কথা এবং সরেজমিনে চাকরির কথা আলোচনা করছি। গত সপ্তাহের কলামে বিস্তারিত লিখেছি নিজের কমিশনের ব্যাপারে। আমার কমিশন ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ। তাহলে যে সময়ের আলোচনা করছি, সেই ’৭৩-এর ফেব্রুয়ারিতে আমার চাকরির বয়স দুই বছর পাঁচ মাস; আমি ছিলাম ক্যাপ্টেন এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত উপ-অধিনায়ক। আজকের কলামে দু’টি গল্প বলছি; উভয়ের সাথেই চাকরির সম্পর্ক আছে।

প্রথম গল্প
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে, সামরিক প্রশিক্ষণ পরিদফতর ও গোয়েন্দা পরিদফতর- উভয় দফতর দেখাশোনা করতেন (আর্টিলারি কোরের অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধা) তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি সালাহউদ্দিন, বীর প্রতীক। তিনি একদিন সরাসরি আমাদের (দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ঢাকা সেনানিবাস) অফিসে ফোন করে আমাকে জানালেন, ভারতে ছয় সপ্তাহের একটা প্রশিক্ষণে তোমার নাম দিচ্ছি; আশা করি, তোমার কোনো সমস্যা নেই। বললাম, ‘জি না স্যার, সমস্যা নেই।’ নতুন জন্ম নেয়া বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জন্য কোনো ইন্টারসার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড (আইএসএসবি) ছিল না। ওই সিলেকশন বোর্ড স্থাপন করা প্রয়োজন। পাকিস্তানে আটক কয়েকজন বাঙালি অফিসারের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোয়েটা ও ঢাকায় অবস্থিত আইএসএসবিতে চাকরি করার অভিজ্ঞতা থাকলেও সে মুহূর্তে (ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩) বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে কর্মরত কেউ ছিলেন না, যিনি পাকিস্তান আর্মিতে আইএসএসবিতে চাকরি করেছেন। তাই নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় কয়েকজন অফিসারকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো।

যথারীতি আমার নাম গেল এ জন্য এবং ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা থেকে নতুন দিল্লির উদ্দেশে আকাশপথে রওনা দিলাম আমরা পাঁচজন। একজন বিমানবাহিনীর তৎকালীন স্কোয়াড্রন লিডার কামাল উদ্দিন, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন। দ্বিতীয়জন তৎকালীন মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান (মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে মৃত)। তৃতীয়জন হলেন তৎকালীন মেজর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) দানিয়াল ইসলাম। চতুর্থজন সুনামগঞ্জের সন্তান, আশির দশকের প্রতিমন্ত্রী, তৎকালীন ক্যাপ্টেন ইকবাল হোসেন চৌধুরী এবং পঞ্চমজন ছিলাম আমি নিজে। সিলেকশন বোর্ডে তিন ধরনের পরীক্ষক বা সদস্য থাকেন। প্রথমটি হলো, সভাপতি ও সহসভাপতি, যারা ইন্টারভিউইং অফিসার বা মৌখিক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী অফিসার হন।

দ্বিতীয় ধরন হলো, সাইকোলজিস্ট বা মনস্তত্ত্ববিদ, যারা প্রার্থীদের সঙ্গে সাধারণত কথা বলেন না। তৃতীয় প্রকার হলো, গ্রুপ টেস্টিং অফিসার বা জিটিও, যারা দুই দিনে মোটামুটিভাবে চার-পাঁচ ঘণ্টা করে, মোট আট-দশ ঘণ্টায় প্রার্থীদের সরেজমিনে বা মাঠে বিভিন্ন পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ করার পর প্রার্থী সম্পর্কে মতামত দেন। ওপরে যে পাঁচজনের নাম বললাম তার মধ্যে কামাল, ফারুক ও দানিয়াল ছিলেন ইন্টারভিউইং অফিসার হওয়ার জন্য মনোনীত। ইকবাল এবং আমি ছিলাম জিটিও প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মানদণ্ড অনুযায়ী, ইন্টারভিউইং অফিসার যারা হবেন, তাদের ন্যূনতম ১৫ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা প্রয়োজন এবং জিটিও যারা হবেন, তাদের ন্যূনতম আট বছর চাকরি প্রয়োজন।

হাফপ্যান্ট ও ফুলপ্যান্টের গল্প
ঢাকা থেকে দিল্লি। তখন দিল্লিতে আমাদের রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার ছিলেন ড. এ আর মল্লিক। আমরা এক রাত বা দুই রাত দূতাবাসের গেস্ট হাউজে থাকলাম। অতঃপর উত্তর প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত রুড়কি ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছলাম। প্রথম কার্য দিবসেই পরিচয় হলো আমার সরাসরি ইনস্ট্রাক্টর যিনি হবেন, তার সাথে; মেজর দেবেন্দ্র কুমার শর্মা বা ডিকে শর্মা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর আর্মাড কোর (সাঁজোয়া বাহিনী)-এর অফিসার, অরিজিনাল ইউনিট ৭৫ ল্যানসার্স। তার চাকরি ১২ বছর চলছিল। আমার সাথে পরিচিত হওয়ার প্রথম পর্যায়েই যখন শুনলেন, আমার চাকরি মাত্র আড়াই বছর চলছে, তখন মেজর শর্মা বললেন, ‘ইবরাহিম তু তো বাচ্চা হায়।’

আমিও বললাম, ‘শিওর- নো ডাউট অ্যান্ড নো অলটারনেটিভ।’ এর ভাবানুবাদ হলো, আমি যে বাচ্চা এটা নিঃসন্দেহ এবং এটার কোনো বিকল্পও নেই। তখন শর্মা বললেন, কেন? উত্তর দিলাম, হোয়েন মাই চিফ অব স্টাফ পুটস অন হাফশার্ট, হাউ ডু ইউ ওয়ান্ট মি টু পুট অন ট্রাউজার। ভাবানুবাদ : আমার সেনাবাহিনীর প্রধান যখন হাফপ্যান্ট পরেন, তখন আমি কিভাবে ফুলপ্যান্ট পরব? উত্তরের মাহাত্ম্য শর্মা বুঝতে পারলেন না। তাকে বুঝালাম। আমার সেনাপ্রধান এবং উপ-সেনাপ্রধান ১৯৫৫ সালে কমিশনপ্রাপ্ত, যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার এবং ফোর্স কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন, এ মুহূর্তে বাকি জ্যেষ্ঠ অফিসাররা তাদের থেকে কনিষ্ঠ। আট-নয় বছর চাকরি যাদের হয়েছে, তারা আপৎকালীন পরিস্থিতিতে ব্যাটালিয়ন তো বটেই, ব্রিগেডও কমান্ড করছেন। অতএব, আপনার এখানে রুড়কিতে, ন্যূনতম আট বছর চাকরি করা মেজর সাহেব কিভাবে আসবে?

হাসতে হাসতে শর্মা বললেন, ‘ইবরাহিম তু তো চালাক হায়!’ হাসতে হাসতে উত্তর দিলাম, উসিলিয়ে তো, মুঝকো ইহা ভেজা গিয়া। ভাবানুবাদ : ইবরাহিম তুই তো চালাক; আমি বললাম, ওই জন্যই তো আমাকে পাঠিয়েছে। আট-নয় সপ্তাহ পর ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে আমরা ফেরত আসি এবং আমরাই বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর জন্য ১৯৭৩-এর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সিলেকশন বোর্ড স্থাপন করেছি। চাকরি কম, বয়স কম, এ কথাগুলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তেমনই বহু পেশার জন্যই এই মুহূর্তেও অপ্রযোজ্য। এটা অপরিহার্য নয় যে, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে পৌঁছতে হলে, হল কমিটির সভাপতি বা কলেজ কমিটির সভাপতি, থানা কমিটির সভাপতি, জেলা কমিটির সভাপতি, বিভাগীয় কমিটির সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটির এটা-ওটা সম্পাদক ইত্যাদি সব পদেই থাকতে হবে- কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ১, ২, ৩, ৪, ৫, বা ৬ এইরূপ সিরিয়ালের নেতৃত্বে আসতে হলে। মেধা ও কর্মের ওপর ভিত্তি করে, এক্সিলারেটেড প্রমোশন বা ত্বরান্বিত পদোন্নতির প্রক্রিয়া পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত।

দ্বিতীয় গল্প : স্টাফ কলেজে পড়ার প্রসঙ্গ
বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর জন্য স্টাফ কলেজের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠা করা কঠিন ব্যাপার। ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় কাজটি করা সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭৬-এ উভয় সরকারের মধ্যে সমঝোতা হলো। ১৯৭৭ সালের শুরুতেই ব্রিটিশ মিলিটারি অ্যাডভাইজরি টিম ঢাকা আসলেন এবং স্টাফ কলেজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করলেন সরাসরি। ওই টিমে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ এবং মধ্যমপর্যায়ের ৮-১০ জন সদস্য ছিলেন। কলেজটির নাম দেয়া হলো ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ; সংক্ষেপে ডিএসসিএসসি; প্রতিষ্ঠিত হলো ঢাকার মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে। প্রথম কয়েকটি কোর্স ছয় মাস মেয়াদি হলো যাতে করে, তিন-চার বছরের মধ্যেই যে ব্যাক-লগ বা বকেয়া জমে গেছে, সেই অফিসারদের কোর্স করানো যায়। অবশ্যই প্রতিযোগিতামূলক লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রার্থীরাই কোর্স করবেন বা এখনো করেন। অতঃপর এগারো মাস মেয়াদি কোর্স শুরু হলো, যেটা মোটামুটিভাবে বিশ্বের সব সামরিক বাহিনীর সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। চাকরিতে উন্নতি করতে চান, এমন সব অফিসারই স্টাফ কোর্স বা স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষণ নিতে চান; আমিও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নই।

স্টাফ কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রথম উদ্যোগ
প্রথম পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলাম ১৯৮০ সালে মে-জুন-জুলাই মাসে। প্রথম উদ্যোগ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলাম। কারণটা ব্যাখ্যা করছি। ১৯৮০ সালের জুন মাসের এক রাতে, আর্টিলারি কোর-এর অফিসার মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল দিদারুল আলমের নেতৃত্বে একটি ক্যু বা সেনা-অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টা অভ্যুত্থানের জন্য নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগে নস্যাৎ করা হয়; আমাদের গোয়েন্দাদের সফল তৎপরতায়। তখন আমি ঢাকা সেনানিবাসে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক বা কমান্ডিং অফিসার; র‌্যাংক লেফটেন্যান্ট কর্নেল। আমার সুযোগ্য উপ-অধিনায়ক ছিলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে আমারই ক্লাস ফ্রেন্ড (সর্বদাই মেধাবী, পরিশ্রমী, বন্ধুবৎসল, সৈনিক বা কর্মিবান্ধব এবং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলকারী অফিসার) তৎকালীন মেজর শরীফ আজিজ। তিনি বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, বাংলাদেশের চার শতের অধিক ছোট-বড় নিরাপত্তা প্রদানকারী বা সিকিউরিটি কোম্পানির মধ্যে সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক সফল কোম্পানি (নাম : এলিট ফোর্স)-এর প্রতিষ্ঠাতা ম্যানেজিং ডাইরেক্টর।

আমি এবং শরীফ, উভয়েই স্টাফ কলেজের ভর্তি পরীক্ষার জন্য আবেদন করলাম। কর্নেল দিদারের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে পরিবেশ স্পর্শকাতর হয়ে উঠল। পরীক্ষা দিতে হলে, উপযুক্ত প্রস্তুতির জন্য, তিন বা চার সপ্তাহ ছুটি অতি আবশ্যক। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বললেন, ইবরাহিম ও শরীফ তথা অধিনায়ক এবং উপ-অধিনায়ক একত্রে ছুটিতে যেতে পারবে না। অপরপক্ষে, একজনের পর একজন যাওয়ার মতো সময়ও আর বাকি নেই। পারস্পরিক সম্মতিতেই আমি নিজের আবেদন প্রত্যাহার করলাম; শরীফ যেন ছুটি পায় সেই সুযোগ সৃষ্টি করলাম এবং শরীফ ছুটিতে গেল। শরীফ পরীক্ষায় ভালো করল এবং মেধা তালিকায় যে দুইজন প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছিল, তারা উভয়েই মালয়েশিয়া সামরিক বাহিনী কর্তৃক প্রদত্ত সরকারি স্কলারশিপ গ্রহণ করেছিল। তারা আমাদের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কুয়ালালামপুরে পড়তে চলে গেল। শরীফ ছিল মেধা তালিকায় দ্বিতীয়।

ভর্তি পরীক্ষার দ্বিতীয় উদ্যোগ
১৯৮১ সালে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আবেদনপত্র জমা দিলাম। তখন আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদর দফতর তথা সেনাসদরে, সামরিক প্রশিক্ষণ পরিদফতর বা মিলিটারি ট্রেনিং ডাইরেক্টরেটে জেনারেল স্টাফ অফিসার-ওয়ান (সংক্ষেপে : জিএসও-১); র‌্যাংক লেফটেন্যান্ট কর্নেল। এর মধ্যে ৩০ মে, ১৯৮১ সালে বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে গেল। চট্টগ্রামের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের নেতৃত্বে একটি ক্যু-দ্যে-তা বা সেনা-অভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত হয় (যদিও এই অভ্যুত্থানের নেপথ্য নায়ক ছিলেন অন্য ব্যক্তি; সেই বিবরণ এখানে দেবো না; আমার লেখা বই ‘মিশ্রকথন’-এ বিস্তারিত বিবরণ আছে)। ওই অভ্যুত্থানের পরিণতিতে, চট্টগ্রাম মহানগরের সার্কিট হাউজে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, বীর উত্তম জিয়াউর রহমান নিহত হলেন। দুই দিনের মধ্যেই অভ্যুত্থান দমিত হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জীবিত অভিযুক্তদের বিচারের জন্য কোর্ট মার্শাল গঠন করা হলো।

চট্টগ্রাম মহানগরের লালদীঘির পাড়ে অবস্থিত সুপরিচিত কারাগারের অভ্যন্তরে সেই আদালত বসে এবং বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। নেপথ্য নায়ক ছাড়া, অভ্যুত্থানের প্রকাশ্য মহানায়ক বা নায়কগণের মধ্যে ক্রমিক নম্বর ১ থেকে ৩, অভ্যুত্থানের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই নিহত হলেন (সেই হত্যার গল্পও অতি চাঞ্চল্যকর। কিন্তু আজ এখানে বলার জায়গা নেই)। জীবিত অভিযুক্তদের বেশির ভাগই মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ছিলেন এবং একটি পাতানো ক্রীড়ার মাধ্যমে তাদেরকে বিধ্বংসী খেলায় জড়িত করা হয়েছিল। প্রত্যেক অভিযুক্ত অফিসারের একজন করে উকিল বা ডিফেন্ডিং অফিসার (অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনকারী অফিসার) পাওয়ার অধিকার থাকলেও তৎকালীন সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনীর তিনজন অফিসারকে ২৯ জনের জন্য ডিফেন্ডিং অফিসার হিসেবে মঞ্জুর করেন বা মনোনয়ন দেন। তিনজনের মধ্যে দু’জনই ছিলাম রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা; আমি ছিলাম দু’জনের মধ্যে কনিষ্ঠ। কোর্ট মার্শালের গল্প এখানে বলব না; ‘মিশ্রকথন’-এ আছে। বলার বিষয় হলো, ভর্তি পরীক্ষার জন্য সময় ও ছুটি পেলাম না। দ্বিতীয়বারের মতো ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার আবেদনপত্র প্রত্যাহার করতে হলো।

ভর্তি পরীক্ষার তৃতীয় ও শেষ উদ্যোগ
১৯৮২ সালের মার্চ মাসের ২৪ তারিখ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে একটি রক্তপাতবিহীন ক্যু-দ্যে-তা বা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন; সামরিক আইন জারি হয়। সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ তথা মার্শাল ল অথরিটি, দমনমূলক বিভিন্ন কাজে হাত দেয়। এসব কাজের মধ্যে একটি ছিল সামরিক বাহিনীর অফিসারদের দিয়ে, কখনো কখনো বেসামরিক অফিসারসহ আবার কখনো কখনো বেসামরিক অফিসার ছাড়া, বিভিন্ন কোম্পানিতে বা অফিসে তদন্ত করানো। এ রকম একটি তদন্ত টিমে আমাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হলো (কিন্তু আমার মনের ভাষায় : আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়া হলো)।

সামরিক প্রশিক্ষণ পরিদফতরে নিয়মিত কাজ করার পর, সন্ধ্যা ৭টা-৮টা পর্যন্ত ওই কথিত তদন্তে ব্যস্ত থাকতে হতো। তদন্ত টিমের প্রধান ছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার বদরুজ্জামান; স্বাভাবিকভাবেই তিনি সব সময় বহিরাঙ্গনে যেতেন না। তদন্ত টিমের অন্য দু’জন সদস্য ছিলেন বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার গোলাম মোস্তফা এবং পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার মোহাম্মদ হানিফ। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য মোটেই সময় পাচ্ছিলাম না; পরীক্ষার আর মাত্র তিন-চার সপ্তাহ বাকি। ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আবেদনপত্র তৃতীয়বারের মতো প্রত্যাহার করার জন্য লিখিত আবেদন উপস্থাপন করলাম। আবেদন অনুমোদন করা বা না করার চূড়ান্ত ক্ষমতা ছিল, চিফ অব দি জেনারেল স্টাফ বা সিজিএস মহোদয়ের। ’৮০ ও ’৮১ সালে যেমন- ’৮২ সালেও সিজিএস ছিলেন মেজর জেনারেল নূরুদ্দীন খান।

তিনি আমাকে ভালো জানতেন, স্নেহ করতেন। আমাকে অফিসে ডাকলেন। অনেক বকা দিলেন, ধমক দিলেন, শাসিয়ে দিলেন এবং বললেন, দুই সপ্তাহের ছুটি করিয়ে দিচ্ছি। তিনি বললেন, পরীক্ষা দিতেই হবে। প্রস্তুতির জন্য পাওয়া মহামূল্যবান ছুটির সময়ে দিবারাত্রি পরিশ্রম করলাম। তখনকার আমলের স্টাফ কলেজে চাকরিরত এবং পরিকল্পিত ও সাজানো-গোছানো কাজের অভ্যাসের জন্য সুনামধারী মেজর সেলিম আখতারের শরণাপন্ন হলাম। আমরা উভয়েই প্রায় সমসাময়িক। সেলিম পরীক্ষা দেবে; প্রস্তুতি ওভার-কমপ্লিট; রিভিশন চলছে। আমি রিভিশনের সাক্ষী; তার বাসায় সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা প্রতি রাত। সেলিম এবং তার স্ত্রীর প্রতি আমি আজো কৃতজ্ঞ। পরীক্ষা হয়ে গেল, ফল বের হলো, প্রথম তিনজনের একজন হলাম। ইংল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে একটি করে স্কলারশিপ এসেছে মাত্র এক মাস আগে। চার সদস্যবিশিষ্ট ইন্টারভিউ বোর্ডের মাধ্যমে মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে ইংল্যান্ড যাওয়ার জন্য মনোনীত হলাম। অক্টোবর ১৯৮২ থেকে ডিসেম্বর ১৯৮২, শ্রীভেনহাম-এ অবস্থিত রয়েল মিলিটারি কলেজ অব সায়েন্স-এ আট সপ্তাহ এবং জানুয়ারি ১৯৮৩ থেকে ২০ নভেম্বর ১৯৮৩ পর্যন্ত, লন্ডন থেকে ৪০ মাইল দক্ষিণে ক্যাম্বারলি নামক স্থানে অবস্থিত দি রয়েল স্টাফ কলেজে, লেখাপড়া শেষ করলাম। আমার সমালোচকেরা বলেছিলেন, ইবরাহিম চালাক ছিল; এ জন্য প্রথম দুই বছর পরীক্ষা দেয়নি যেন ক্যাম্বারলি যেতে পারে। আমি বলতাম এবং এখনো বলি, মহান আল্লাহই আমার জন্য নির্ধারিত রেখেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত স্টাফ কলেজ ক্যাম্বারলিতে লেখাপড়া করা। আমি পরিকল্পনা করেছিলাম এক রকম, কিন্তু আল্লাহর হুকুম ছিল আরেক রকম।

সঠিক পথের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা
কল্যাণ পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৪ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে। আমাদের স্লোগান- ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’। আমাদের নিবন্ধন নম্বর ০৩১, মার্কা হাতঘড়ি। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিই। ২০০৯-২০১০-২০১১ সালে রাজনীতির অঙ্গনে স্বতন্ত্র অবস্থানে ছিলাম। রাজনীতির অঙ্গনে বৃহত্তর ও দর্শনীয় জায়গা তথা লার্জার অ্যান্ড ভিজিবল পলিটিক্যাল স্পেসের সন্ধানে, সমমনা বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির দাওয়াতে, জোটে গিয়েছিলাম। বিএনপির সাথে মতের মিল রেখে ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিনি। এতে অংশগ্রহণ করার জন্য সরকারি রাজনৈতিক দাওয়াত গ্রহণ করিনি। আরেকটি নির্বাচন সামনে। নদীর দুই তীরের মতো, রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন জোটে ভাঙাগড়ার রাজনৈতিক খেলা দৃশ্যমান। আমরা জোটের প্রতি দৃঢ়ভাবে আস্থা রেখে আগাচ্ছি। জোটের মনোনয়নে ব্যক্তি ইবরাহিম চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে ইনশাআল্লাহ নির্বাচন করবে। আমাদের দলের আরো ১২ জন প্রার্থী আছেন, কিন্তু প্রধান শরিকের সাথে সমঝোতায় কয়জনকে টিকাতে পারি, সেটা এখনো বলতে পারছি না। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, আমাদের সুনাম, ইজ্জত এবং আমাদের মনের ভেতরে দীপ্ত দেশসেবার প্রত্যয় ও দ্বীনের খেদমতের প্রত্যয় যেন মহান আল্লাহই নিরাপদ রাখেন।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি


আরো সংবাদ



premium cement