২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সঙ্কটে সৌদি আরব

সঙ্কটে সৌদি আরব - ছবি : সংগ্রহ

সৌদি রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে ১৬ মাস আগে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করা হয়। ৩৩ বছর বয়সী রাজপুত্র ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে আলোচিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য তিনি এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা তাকে কঠোর চরিত্রের একজন শাসক হিসেবে পরিচিত করেছে। যেখানে সৌদি বাদশাহর ভূমিকা ম্লান হয়ে পড়ছে। এই সময়ের মধ্যে কাতারের ওপর অবরোধ অরোপ, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে আটক করা, ইয়েমেনে যুদ্ধ প্রলম্বিত করা, রাজপরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির অভিযোগে বন্দী রেখে অর্থের বিনিময়ে মুক্তি দেয়ার ঘটনা, সর্বশেষ ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার অভিযোগ তার ইমেজ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

জামাল খাশোগির অন্তর্ধান সৌদি-তুর্কি সম্পর্কের ওপর শুধু প্রভাব ফেলছে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে সৌদি আরবের ওপর চাপ বাড়ছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত ঘোষণা করেছেন এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সৌদি আরবের সম্পৃক্ততা থাকলে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সাথে দুই দফা টেলিফোনে কথা বলেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেকে রিয়াদ পাঠিয়েছেন। স্পষ্টত সৌদি আরবের ওপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে। সৌদি আরব খাশোগি হত্যার কথা অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত এই অবস্থানে অনড় থাকা সম্ভব হবে না। বরং ঘটনাটি গোয়েন্দাদের ভুল কার্যক্রম হিসেবে তুলে ধরে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার ঘোষণা দেয়া হতে পারে। তখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা কে ছিলেন?

তুরস্কের গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদপত্রে জামাল খাশোগি সৌদি কনস্যুলেটে ঢোকার পর নির্যাতন ও হত্যার তথ্য প্রমাণ থাকার দাবি করা হয়েছে। জামাল খাশোগির হাতে থাকা অ্যাপল ঘড়িতে কনস্যুলেটে ঢোকার পর থেকে তার ওপর নির্যাতন ও হত্যার পুরো ঘটনার বিবরণ রেকর্ড হয়েছে। যা তার বাগদত্তার কাছে থাকা আইফোন ও আই ক্লাউডে রেকর্ড রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। তুরস্কের গোয়েন্দারা সিআইয়ের গোয়েন্দাদের সাথে তা বিনিময় করেছে এমন তথ্যও এসেছে। যদিও তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত এমন দাবি করেনি। তুরস্কের গণমাধ্যমে সৌদি আরব থেকে আসা ১৫ জন নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা খাশোগিকে হত্যা করেছে বলেও দাবি করা হয়েছে। যারা একটি প্রাইভেট জেটে ইস্তাম্বুল আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আবার ফিরে যায়। তুরস্কে আসার পর তাদের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। এখন সৌদি আরব ও তুরস্ক যৌথভাবে খাশোগির অন্তর্ধান ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।

জামাল খাশোগির অন্তর্ধান সৌদি রাজপরিবারের ভেতরে সঙ্কটের একটি রূপ মাত্র। যেখানে ভিন্ন মতাবলম্বীদের কঠোরভাবে দমনের নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। মাত্র কিছু দিন আগে ধর্মপ্রচারক সালমান আল আওদাহকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। রাজপরিবারের সদস্যসহ বহু লোককে অন্তরীণ রাখা হয়েছে।

জামাল খাশোগি সৌদি রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। মোহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কার কার্যক্রম বা রাজতন্ত্রের পুরোপুরি বিরোধী তিনি নন। তবে বিন সালমানের কিছু নীতির সমালোচক বলা যায়। ফলে তিনি মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরোধী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। জামাল খাশোগির বড় পরিচয় সৌদি আরবের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার। ৩০ বছরের বেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন। জন্ম মদিনায় ১৯৫৮ সালে। তার বাবা ছিলেন রাজপরিবারের চিকিৎসক। চাচা আদনান খাশোগি ছিলেন সৌদি আরবের বিখ্যাত অস্ত্র ব্যবসায়ী। একজন সংস্কারকামী সাংবাদিক হিসেবে তিনি সৌদি শাসকদের বিভিন্ন নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন।

খাশোগি সাংবাদিকতা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। সাংবাদিকতা শুরু করেন রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ইংরেজি দৈনিক সৌদি গেজেটের সংবাদদাতা হিসেবে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত লন্ডনভিত্তিক সৌদি মালিকানাধীন সংবাদপত্র আশ্শারাক আল আওসাতে কাজ করেছেন। একই সময় তিনি প্যান আরব সংবাদপত্র আল হায়াতেও প্রায় আট বছর লিখেছেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি ১৯৯০ দশকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘটনা কাভার করেছেন। আফগানিস্তান এবং আলজেরিয়ার ঘটনাবলির ওপর অসংখ্য সংবাদ ও সংবাদভাষ্য লিখেছেন। তিনি বিভিন্ন সময় ওসামা বিন লাদেনের সাথে দেখা করেছেন এবং সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তিনি ১৯৯৯ সালে সৌদি মালিকানাধীন সংবাদপত্র আরব নিউজের ডেপুটি এডিটরের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি আল ওয়াতান পত্রিকার এডিটর ইন চিফের দায়িত্ব পালন করেন। সম্পাদকীয় নীতির কারণে ২০০৩ সালে তাকে পত্রিকাটি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি রাষ্ট্রদূত প্রিন্স তুর্কি বিন ফয়সালের মিডিয়া উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন খাশোগি। ২০০৭ সালে তাকে আবার আল ওয়াতন পত্রিকার এডিটর ইন চিফ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু তিন বছর পর ২০১০ সালে তাকে আবার অব্যাহতি দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি তার নিজ ওয়েবসাইটে সৌদি সমাজ নিয়ে মন্তব্যে সীমা অতিক্রম করেছেন। একই বছরে তিনি সৌদি ধনকুবের প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালালের মালিকানাধীন সংবাদ চ্যানেল আল আরবের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। বাহরাইনের রাজধানী মানামা থেকে চ্যানেলটির কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৫ সালে চ্যানেলটি চালু হওয়ার একদিনের মাথায় বন্ধ করে দেয়া হয়। ধারণা করা হয় চ্যানেলটির সম্পাদকীয় নীতিতে বাহরাইনের বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাপারে উদার নীতি অবলম্বন করা হয়েছিল। জামাল খাশোগি রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে বিভিন্ন সময় আরব বিশ্বের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে মতামত তুলে ধরেছেন। ২০১৭ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ভার্জিনিয়ায় বসবাস করছিলেন। ওয়াশিংটন পোস্টে নিয়মিত কলাম লিখতেন। এ ছাড়া লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকাতেও লিখতেন। টুইটারে তাকে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ অনুসরণ করত।

জামাল খাশোগি ওয়াশিংটন ও লন্ডনে সৌদি দূতাবাসে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ভালো করে জানতেন সৌদি দূতাবাসগুলোর অভ্যন্তরে তার সাথে কেমন আচরণ করা হতে পারে। এর পরও কেন তিনি ইস্তাম্বুলে কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন তা একটি প্রশ্ন। তিনি কনস্যুলেটে তার সাবেক স্ত্রীর ডিভোর্স সংক্রান্ত কাগজের জন্য গিয়েছিলেন। তুর্কি এক নারী গবেষককে বিয়ে করার পাশাপাশি ইস্তাম্বুলে থাকার জন্য ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক ডেভিড হার্স্ট প্রশ্ন তুলেছেন তিনি কি কোনো ফাঁদে পড়েছিলেন? এ কথা সত্য যে, সাবেক গোয়েন্দা প্রধানের সাথে কাজ করা এবং রাজপরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে জামাল খাসোগি বহু বিষয় জানতেন যা সাংবাদিকতার পরিচয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি সম্ভবত এই জানার রেডলাইন অতিক্রম করেছিলেন।

জামাল খাশোগি সৌদি আরবের অভ্যন্তরে মুসলিম ব্রাদারহুডের ছাপ লাগিয়ে যে নিপীড়ন চলছে তার কঠোর সমালোচনা করতেন। তিনি টুইটারে লিখেছেন, যিনি সংস্কার, পরিবর্তন, আরব বসন্ত ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন এবং যারা তাদের ধর্ম আর স্বদেশের জন্য গর্বিত, তাদের গায়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের ছাপ লাগিয়ে দেয়া হয়। এখন মনে হচ্ছে ব্রাদারহুডের চিন্তাধারা মহৎ। জামাল খাশোগির অন্তর্ধান নিয়ে আরব বিশ্বের শাসকরা নীরব কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে তোলপাড় চলছে।

পশ্চিমা বিশ্বে প্রথম দিকে মোহাম্মদ বিন সালমানকে তুলে ধরা হয়েছে একজন সংস্কারকামী রাজপুত্র হিসেবে, যিনি ভবিষ্যতে সৌদি আরবে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ঘোষণার পর নিউ ইয়র্ক টাইমসের পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া সাংবাদিক টমাস ফ্রিডম্যান প্রশংসা করে লিখেছিলেন, ‘সৌদি আরবে আরব বসন্ত শুরু হয়ে গেছে। সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের নিজের সমাজের জন্য আছে বড় বড় পরিকল্পনা।’ সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি প্রদান, সিনেমা হল চালু করা, স্টেডিয়ামে এক সাথে নারী ও পুরুষের খেলা দেখার অনুমতি দেয়াকে মোহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কারের নমুনা হিসেবে হাজির করা হয়েছিল পশ্চিমা গণমাধ্যমে। কিন্তু এর আড়ালে ঢাকা পড়েছে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়ন ও সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের রক্তাক্ত ঘটনাপ্রবাহ।

বিন সালমানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের পেছনে বড় কারণ ছিল সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে আমূল পরিবর্তন এবং বিপুল অঙ্কের অস্ত্র কেনার চুক্তি। ইরানকে কোণঠাসা করতে ইসরাইল ঘেঁষা নীতি বাস্তবায়নে বিন সালমান ছিলেন অনড়। একই সাথে ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি ট্রাম্প ও তার জামাতা জ্যারেড কুশনারের বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মনে করা হয় জ্যারেড কুশনারের সাথে মোহাম্মদ বিন সালমান বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। জ্যারেডের সাথে মোহাম্মদ বিন সালমানের এই সম্পর্কের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি লবির ভূমিকা রয়েছে। এই সম্পর্ক গড়ার কারিগর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান।

অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কথিত রাজনৈতিক ইসলামকে মোকাবেলা বিন সালমানের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে তার প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে আবির্ভূত হন আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স। আরব বসন্তের প্রভাব ও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে কাতার এবং তুরস্কের সাথে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের বিরোধ জটিল আকার ধারণ করে। জামাল খাশোগির অন্তর্ধান নিঃসন্দেহে এই দুই দেশের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। তুরস্ক এ ক্ষেত্রে খুব সতর্কভাবে এগোচ্ছে বলে মনে হয়। সৌদি আরবের সাথে আলোচনার সম্পর্ক বজায় রেখে চাপ সৃষ্টির নীতি অবলম্বন করেছে দেশটি। ইতোমধ্যে সৌদি বাদশাহ তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলেছেন। এর আগে সৌদি আরব উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল তুরস্কে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে মক্কার গভর্নর ও বিন সালমানের উপদেষ্টা খালেদ আল ফয়সাল অন্যতম। খালেদের ছোট ভাই সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান তুর্কি আল ফয়সালের অধীনে জামাল খাশোগি এক সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।

এখন প্রশ্ন হলো, জামাল খাশোগির অন্তর্ধান সৌদি আরবের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে? লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, খাশোগির সৌদি কনস্যুলেটে ঢোকার ঘটনা ঘটেছে ২ অক্টোবর। দিন যত যাচ্ছে খাশোগির হত্যার বিষয়ে নানা রকম তথ্যপ্রমাণ আসছে। প্রথম দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো খানিকটা নীরবতা পালন করেছে। ধীরে ধীরে বিন সালমানের ওপর চাপ বাড়ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে এমন খবর এসেছে ক্রাউন প্রিন্সের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ধরনের খবর মোহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কারকামী ইমেজ নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। বিন সালমান সৌদি আরবে বিদেশী বিনিয়োগের যে পরিকল্পনা করেছিলেন তাতেও ধাক্কা লেগেছে।

এই অন্তর্ধান বা হত্যাকাণ্ড ছায়া ফেলেছে সৌদি আরবের বহুল প্রতীক্ষিত ‘দাভোস ইন ডেজার্ট’ সম্মেলনে। আগামী ২৩ অক্টোবর রিয়াদে তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্টিভ মুচিন এবং ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমন্ত্রী লিয়াম ফক্স এই সম্মেলনে অংশ না-ও নিতে পারেন, যা সৌদি আরবের জন্য বিশেষ বার্তা বহন করে। সম্মেলন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মার্কিন জ্বালানিমন্ত্রী আর্নেস্ট মোনিজ, ভার্জিন গ্যালাক্টিকের রিচার্ড ব্রনসন, ভিয়াকমের বব বিকাশ, উবারের সিইও দারা খোসরাওয়াশি, এওএলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ কেস, সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, সিএনবিসিসহ, ইকোনমিস্টসহ আরো প্রতিষ্ঠান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন কংগ্রেসম্যান সৌদি আরবের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ কিংবা অস্ত্র বিক্রি বন্ধের দাবি করেছেন। ডোনাল্ট ট্রাম্প অবশ্য অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের মতো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে সৌদি আরব এবং পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছে। সৌদি-আমিরাতি লবি যুক্তরাষ্ট্রে অত্যন্ত শক্তিশালী। যাই বলা হোক না কেন এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। এ ছাড়া তুরস্ক চাপ সৃষ্টির নীতি নিলেও সৌদি আরবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক তা চাইবে না।

এ কথা বলা যায়, জামাল খাশোগির অন্তর্ধান সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। সৌদি আরবে ক্রাউন প্রিন্স থেকে বাদশাহ হওয়ার জন্য তিনটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম হচ্ছে হোয়াইট হাউজের সমর্থন। দ্বিতীয়ত, রাজপরিবারের সমর্থন। তৃতীয়ত, সৌদি নাগরিকদের সমর্থন। মোহাম্মদ বিন সালমান রাজপরিবার এবং সাধারণ নাগরিকদের সমর্থন অনেকটা হারিয়েছেন। তিনি টিকে আছেন হোয়াইট হাউজের সমর্থনের ওপর। জামাল খাশোগি হত্যার সাথে যদি সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর সম্পৃক্ততার অডিও ও ভিডিও প্রকাশ করা হয় তাহলে বিন সালমানের ওপর হোয়াইট হাউজের সমর্থন অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউজ নতুন ক্রাউন প্রিন্স বেছে নিতে পারে, যা আঞ্চলিক রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।

সৌদি আরবের ওপর অবরোধ আরোপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসসহ নানা মহল থেকে যখন চাপ আসছে তখন মোহাম্মদ বিন সালমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি সিরিয়াবিষয়ক রাশিয়ার বিশেষ দূত আলেকজান্ডার লেভরানিতিয়েভের সাথে রিয়াদে বৈঠক করেছেন। অবরোধ আরোপের মতো পরিস্থিতিতে সৌদি আরব কী ধরনের নীতি গ্রহণ করতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আল আরাবিয়া টেলিভিশন চ্যানেলের জেনারেল ম্যানেজার তুর্কি আল দাখিল। সৌদি নীতিনির্ধারকদের বরাত দিয়ে তিনি বলছেন, অবরোধ আরোপ করার মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হলে সৌদি আরবের তাঁবুকে রাশিয়ার সেনাঘাঁটি স্থাপন করতে দেয়া হবে। যেখান থেকে সিরিয়া, ইসরাইল, লেবানন ও ইরাকে নজরদারি করা যাবে। তেল অস্ত্র ব্যবহার করা হবে।

সে ক্ষেত্রে তেলের দাম ৮০ ডলার থেকে বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ২০০ ডলার হবে। ইরানের সাথে বিরোধ কমিয়ে আনা হবে। হামাস ও হিজবুল্লাহকে শত্রু থেকে মিত্রে পরিণত করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে রাশিয়া ও চীন থেকে সমরাস্ত্র কেনা হবে। আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারের পরিবর্তে ইউয়ান ব্যবহার করা হবে। সৌদি আরবের এ ধরনের হুমকি বা নীতি পরিবর্তন খুব সহজ নয়। মূলত উল্টো চাপ প্রয়োগের কৌশল নিয়েছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সম্পর্ক এখন কোন পথে এগোবে তা দেখার বিষয়।
alfazanambd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement