দশ অক্টোবর ও গণতন্ত্রের দশা
- মীযানুল করীম
- ১৩ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:৫৭
দশ অক্টোবর বাংলাদেশের ইতিহাসের স্মরণীয় দিনগুলোর একটি। রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ের দক্ষিণ পাশে শহীদ জিহাদের স্মরণে স্থাপিত ফলকটি সেদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার গণ-আন্দোলন সূচিত হওয়ার দিনটির ২৮তম বার্ষিকীও অতিক্রান্ত। কিন্তু যে গণতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের একান্ত প্রত্যাশা, তা কতটুকু কায়েম হয়েছে আর কতখানিই বা ফিরে আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল? আজ আমাদের বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এবং সত্যের মুখোমুখি হয়ে, এ প্রশ্নের জবাব আন্তরিক উচ্চারণে প্রকাশ করতে হবে।
এবার ১০ অক্টোবর ছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসংক্রান্ত রায় ঘোষণার দিবস। এটা নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেই সাথে আমাদের আরো পেছনে তাকাতে হবে। জাতিকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থেই, বিশেষ করে নিকট অতীত থেকে বর্তমানের সর্বশেষ অধ্যায় অবধি দেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ অবগত ও মূল্যায়িত হওয়া জরুরি।
১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর এরশাদ পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা ঘটবে কিংবা সিরাজগঞ্জের ছাত্রনেতা জিহাদকে ঢাকায় এসে গুলিতে প্রাণ দিতে হবে, তা কি কেউ জানতেন? একজন সাংবাদিক হিসেবে নিজে সেদিন একটি অ্যাসাইনমেন্টে ঢাকা মহানগরীর বাইরে গিয়েছিলাম। ঘটনাক্রমে সংশ্লিষ্ট কর্মসূচিটি ছিল খোদ এরশাদের, যিনি তখন প্রবল প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতি ও একচ্ছত্র সরকারপ্রধান। সে অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। জায়গাটি ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ আর গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আকাশপথে গিয়ে একইভাবে ঢাকায় ফিরেছিলেন। আসার পথে হেলিকপ্টার থেকে গণ-আন্দোলনমুখর রাজধানীর উত্তাল বিক্ষোভের দৃশ্য তার নজর এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়।
সেদিন ভোরে মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে রওনা হয়েছিলাম জাতীয় প্রেস ক্লাবের উদ্দেশে। সেখানে সাংবাদিকদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন সরকারের উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা (ডিপিআইও) মরহুম তোফাজ্জল হোসেন। সংবাদকর্মীদের ‘মাইডিয়ার’ গোছের মানুষটি কথা বলতেন কম, কাজে ছিলেন সময়ানুবর্তী। তিনি পরে ভাষাসৈনিক হিসেবে একুশে পদক পেয়েছেন। যা হোক, তোফাজ্জল ভাই আমাকে দেখে বলে উঠলেন, ‘সেই মোহাম্মদপুর থেকে এত সকালে এখানে আসা very tough ব্যাপার।’ দিনটিতে এর চেয়ে অনেক বেশি rough and tough ঘটনা সবার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। সেদিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এর সাক্ষ্যই দেয়। আমরা টঙ্গি-পুবাইল হয়ে কালিগঞ্জের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত প্রাচীন খ্রিষ্টান জনপদ পার হলাম। নাগরী ও তুমুলিয়ার সুদৃশ্য গির্জা ও স্কুল চোখে পড়ল। এক সময় সবাই গন্তব্যে পৌঁছি। এ প্রসঙ্গে তদানীন্তন প্রেসিডেন্টের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার বয়ান শোনা যাক। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ খান ছিলেন ১৯৮৯-৯০ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসনকালের শেষ দুই বছর তার সামরিক সচিব। তিনি এই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসকের কার্যকলাপকে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন একটি বইয়ে। ডিসেম্বর, ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত বইটির নাম ‘এরশাদের পতন ও শাহাবুদ্দিনের অস্থায়ী শাসন : কাছ থেকে দেখা।’
এরশাদ পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা ১০ অক্টোবর ১৯৯০-তে। সেদিন রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ে বিক্ষোভরত গণতন্ত্রকামী জনতার ওপর গুলিতে নিহত হন ছাত্রনেতা নাজিরুদ্দিন জিহাদ। সেখানে এখন তার স্মৃতিফলক রয়েছে। সিরাজগঞ্জের জিহাদ ছিলেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সংগঠক।
জেনারেল মনজুর রশীদ তার বইয়ের ১৪-১৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘১৯৯০-এর ১০ অক্টোবর থেকে সম্মিলিত বিরোধী জোট নতুন করে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে। ১৯৮৭ সালের নভেম্বরের পর প্রেসিডেন্ট এরশাদকে হটানোর লক্ষ্যে তারা বড় ধরনের কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। ... বিরোধী জোটগুলো ১৯৯০-এর ১০ অক্টোবর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে এবং সচিবালয়ের চার দিকে অবস্থান নেয়। পুলিশ প্রহরায় চালিত সামান্য কিছু যানবাহন ছাড়া রাস্তা যানবাহনশূন্য ছিল। দোকানপাট ও বেসরকারি অফিসগুলো বন্ধ থাকে, তবে সামান্য উপস্থিতি নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি অফিসগুলোর কাজকর্ম চলে। সব রাস্তা বন্ধ করে সচিবালয়ের চার দিকে বিডিআর ও পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়। চীনের কারিগরি সহায়তায় নির্মিত একটি ছোট পানি সেচের বাঁধ উদ্বোধন করার জন্য বেলা ১১টায় প্রেসিডেন্ট ঢাকা ছেড়ে রূপগঞ্জে যান।
হরতালের দিনে রাজধানী ছেড়ে বাইরে গিয়ে জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার বিষয়টি ছিল এরশাদের একটা রাজনৈতিক কৌশল। রেডিও এবং টিভিতে দেখানো যে, হরতাল সফল হয়নি বা হরতালের ভয়ে তিনি ভীত নন। ডেপুটি কমিশনার এবং এসপিদের সহায়তায় স্থানীয় জাতীয় পার্টির নেতারা এ ধরনের সভার আয়োজন করতেন। ওই দিনও এ জাতীয় রুটিন ব্যবস্থার হেরফের হয়নি। ছোট্ট বাঁধ উদ্বোধনের পর প্রেসিডেন্ট জনসভাস্থলে যান। জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল ঠিক শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ঘেঁষে। তিনি স্বভাবসিদ্ধভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র সমালোচনা করেন এবং টিভি ক্রুরা বিটিভির সান্ধ্য খবরের জন্য জনসভার এমন কিছু কৌশলী ছবি তোলে, যাতে সভাকে বিশাল জনসমুদ্র বলে মনে হয়। এর উদ্দেশ্য অতি সুস্পষ্ট, অর্থাৎ দেশী শ্রোতা-দর্শক ও বিদেশী কূটনীতিবিদদের দেখানো যে, বিরোধীদের হরতাল ব্যর্থ হয়েছে এবং গ্রামবাংলার মানুষের এখনো তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আমরা ঢাকা ফিরে শুনতে পাই, রাজনৈতিক বিক্ষোভ হিংস্র রূপ ধারণ করেছে, পুলিশকে গুলি ছুড়তে হয়েছে, কিছু লোক নিহত হয়েছে এবং অনেক যানবাহন পোড়ানো হয়েছে। সন্ধ্য নাগাদ আরো জানতে পারি, বিভিন্ন স্থানে নিহতের সংখ্যা পাঁচ।
সেদিন সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল দৈনিক বাংলা মোড়ের অদূরে, মতিঝিলের ‘আল্লাহওয়ালা’ ভবনের সামনে। শাপলা চত্বর অভিমুখী প্রধান সড়কের দক্ষিণ পাশের ভবনটি এখন ‘যুব ভবন’। এরশাদ আমলে এখানে ছিল তার যুবসংগঠন, জাতীয় যুব সংহতি এবং ১৯৮৮ সালের প্রহসনমূলক নির্বাচনে গঠিত জাতীয় সংসদে ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদের কার্যালয়। তখন জাসদ অন্তত তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। ‘আল্লাহওয়ালা’ ভবনের সন্নিকটে সেদিন যারা গুলি করে বিক্ষোভরত একাধিক গণতন্ত্রকামীকে হত্যা করেছিল, তারা নিঃসন্দেহে ‘আল্লাহওয়ালা’ নয়, ‘মারণাস্ত্রওয়ালা’ ছিল।
এ প্রসঙ্গে মেজর জে. মনজুর রশীদ তার লেখায় জানিয়েছেন, পরদিন তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জে. মাহমুদুল হাসান (এখন টাঙ্গাইল বিএনপির নেতা) প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। এর আগে তিনি মনজুর সাহেবের অফিসে বসেন এবং তখন বলেছিলেন আগের দিনের ঘটনার ব্যাপারে। এই মন্ত্রী ক্ষোভের সাথে জানান, তাকে না জানিয়েই জাপার কয়েকজন নেতা হরতাল ঠেকাতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকে সেদিন জানা গেল, আগের দিন নিহত পাঁচজনের বেশির ভাগই পুলিশের গুলিতে মারা যাননি। তাহলে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছিল? এর জবাব পাওয়া গিয়েছিল পত্রিকার খবরে।
জেনারেল মনজুর রশীদ স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘আল্লাহওয়ালা ভবনে বিক্ষোভকারীদের হামলা হতে পারে অনুমান করে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। ভবনটির সামনে দিয়ে বিএনপির মিছিল যখন অতিক্রম করে, তখন ভবনের ভেতর থেকে গুলি করা হয় এবং তাতে তিন ব্যক্তি নিহত হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, কর্তব্যরত পুলিশ জাতীয় পার্টির বন্দুকধারীদের ওপর তলায় উঠতে দেখে তাদের পথরোধ করেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের অফিসের নির্দেশ পেয়ে তাদের ওপরে উঠতে দিয়েছে। পরদিন কিছু কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, আল্লাহওয়ালা ভবন থেকে ছোড়া গুলিতেই তিন ব্যক্তি নিহত হয়। এ ঘটনা সম্মিলিত বিরোধী দলের আন্দোলনে আরো জনসমর্থন পেতে সাহায্য করল। এরশাদের তৎকালীন সামরিক সচিবের ভাষায়, ‘এতে মানুষকে আন্দোলনে নামানোর মতো একটা ইস্যু হলো। এরশাদ ও তার দলের নেতারাই সেই সুযোগ বিরোধীদের হাতে তুলে দেন। পুলিশ কর্তৃক হত্যার প্রতিবাদে পরদিন অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। হরতাল শেষে বিভিন্ন জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং জনসভায় পুলিশের গুলিতে আরো একজন নিহত হয়।’
এরশাদ আমল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি বহুলালোচিত ও ঘটনাবহুল সময়। ১৯৯০-এর ১০ অক্টোবর ছিল তার শাসনকালের ইবমরহহরহম ড়ভ ঃযব ঊহফ. অবশ্য রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে নানাবিধ স্বেচ্ছাচারের ঊহফরহম এবং কাক্সিক্ষত গণশাসনের কতটা ইবমরহহরহম সম্ভব হয়েছে, ২৮ বছর পর আজো তা এক বিরাট প্রশ্ন।
এরশাদ শুধু একজন প্রেসিডেন্ট কিংবা একটি দলের প্রতিষ্ঠাতা অথবা সামরিক অভ্যুত্থানকারী একজন সেনাপ্রধান ছিলেন না। তিনি নিঃসন্দেহে এক বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য চরিত্র। ‘বিনাযুদ্ধে প্রধান সেনাপতি’ ও ‘রমণীমোহন পুরুষ প্রবর’ থেকে শুরু করে ‘অঘটন ঘটনপটিয়সী’, 'ঁহঢ়ৎবফরপধঃধনষব', কিংবদন্তির ‘ফিনিক্স পাখি’ প্রভৃতি ভালো-মন্দ অভিধায় তিনি বিভিন্ন সময় অভিহিত। বাস্তবতা হলো, তিনি সর্বাধিক আখ্যা পেয়েছেন ‘স্বৈরাচারী’ হিসেবে। অন্য দিকে এ দেশের নির্বাচন ও পার্লামেন্টসমেত প্রচলিত ‘গণতান্ত্রিক’ রাজনীতিতে আজ পর্যন্ত তিনি একটা উল্লেখযোগ্য ফ্যাক্টর। তার জীবন নানা দিক দিয়ে রেকর্ডে পরিপূর্ণ, যার সবই গৌরবের নয়।
সুবক্তা এরশাদ শিক্ষাজীবন ও পেশাগত পর্বে ভালো খেলোয়াড়ের পরিচিতি পেয়েছিলেন। রাজনীতির অঙ্গনে পদার্পণ করে ক্ষমতার খেলায় তিনি এযাবৎ ভালোই খেলেছেন। যে দেশে মানুষ ৬০ বছর বয়সেই বুড়িয়ে যায়, সেখানে এরশাদ পুরো সক্রিয় অবস্থায় ৮৮ বছর পার হয়ে গেছেন (প্রকৃত বয়স আরো বেশি হতে পারে)। এখনো তিনি একটি বড় দলের সদাতৎপর চেয়ারম্যান। এক সময় সর্বময় ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের সাথে দেশ চালিয়েছেন। এরপর তার চেয়ে ঢের বেশি সময় ধরে একইভাবে দলকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।
শুধু ‘স্বৈরাচার’কে নিন্দা-মন্দ করলে গণতন্ত্র আসে না। গণতন্ত্র সব ক্ষেত্রে চর্চা ও অনুশীলনের ব্যাপার। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি জীবনের নানা অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত না হলে কেবল নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নেহায়েত অপ্রতুল। তাই আজ ‘স্বৈরতন্ত্রী’র গৎবাঁধা সমালোচনার পাশাপাশি ‘গণতন্ত্রী’ মহলের গভীর আত্মসমালোচনাও দরকার। বিগত প্রায় তিন দশকে যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তারা নিজেদের অঙ্গীকারের প্রতি কতটা বিশ্বস্ত ছিলেন? তারা গণতন্ত্র জাতীয় জীবনে প্রোথিত করতে কিংবা টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন কি? যত দিন ‘স্বৈরাচার’ নিয়ে ক্ষমতার স্বার্থে অপরাজনীতি অব্যাহত থাকবে, তত দিন জনতার স্বার্থে গণতান্ত্রিক সরকার ও শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা