বাংলাদেশ-নির্বাচন-পরিবর্তন
- সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
- ০২ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:৩৬
জন্মদিনে পরিবর্তনের চিন্তা
পাঠক এই কলাম পড়ছেন আজ বুধবার ৩ অক্টোবর ২০১৮; আগামীকাল ৪ অক্টোবর আমার জন্মদিন। প্রতি সপ্তাহের বুধবারে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় কলাম লিখি। অতএব, আমার জীবনের ৬৯তম বছরের শেষ দিনে তথা ৭০তম বছরের প্রারম্ভে নিয়মিত কলামে আমার দৃষ্টিতে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্বন্ধে দু’টি কথা বলতে চাই। কলামের সারবস্তু ও পরিবর্তন। পৃথিবী পরিবর্তনশীল, সমাজ পরিবর্তনশীল, চিন্তা-চেতনা এবং জীবনধারণের প্রক্রিয়া পরিবর্তনশীল, জনগোষ্ঠী বা দেশের কৌশলগত লক্ষ্যগুলো পরিবর্তনশীল, উন্নয়নের কৌশল পরিবর্তনশীল এবং সর্বোপরি পৃথিবী বা দেশের ভৌতকাঠামো পরিবর্তনশীল। যেগুলো পরিবর্তনশীল, সেগুলোর পরিবর্তন যেন ইতিবাচক হয় এবং যেগুলো পরিবর্তনশীল নয়, সেগুলো যেন ইতিবাচকভাবে স্থিতিশীল থাকে- তার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ বা গোষ্ঠীকে সচেতন থাকতে হয়। যাদের প্রসঙ্গে সচেতন থাকার আহ্বান জানাচ্ছি, তাদের উদাহরণস্বরূপ তিনটি গোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করছি। প্রথম উদাহরণ, পবিত্র কুরআনের ভাষায় সালেহিন বান্দারা তথা সৎ ও কর্মশীল মানুষ। দ্বিতীয় উদাহরণ, সামাজিক বা সাহিত্যের ভাষায় বুদ্ধিজীবীরা এবং তৃতীয় উদাহরণ, দেশ ও সমাজ পরিচালনাকারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। নিজে যেহেতু ১০ বছর ১০ মাস ধরে একজন রাজনৈতিক কর্মী, সেহেতু আমি রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিবর্তন নিয়ে দু-চারটি কথা বলছি। আমার মতে, জীবনের ৭০তম বছরের প্রারম্ভে প্রথম কলামে পাঠকদের সাথে শেয়ার করাই উত্তম।
রাজনীতিতে ‘পরিবর্তন’ শব্দটি
২০০৭ সালের ৪ ডিসেম্বর একটি কনভেনশন সেন্টারে হাজারের অধিক রাজনীতিমনস্ক সমমনা ব্যক্তিকে নিয়ে ৪ ঘণ্টার সম্মেলনের পর বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই সময় জাতীয় মুদ্রণ ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সে সংবাদটি প্রচার করেছে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে। কিন্তু এ ধরনের সংবাদ এক দিনের বেশি মিডিয়ায় স্থান পায় না। সে দিন, কল্যাণ পার্টির উদ্বোধনী দিনে একটি ভাষণ দিতে হয়েছিল। এটি আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই রক্ষিত আছে। উদ্বোধনী ভাষণে আমরা ঘোষণা করেছিলাম আমাদের রাজনীতির লক্ষ্য। আমাদের লক্ষ্য ও স্লোগান- ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ (ইংরেজিতে : পলিটিক্স ফর চেইঞ্জ)। আমরা ওই লক্ষ্যেই কাজ করছি।
আমি নিজে একজন ক্ষুদ্র্র ব্যক্তি, আমাদের দলটি নিবন্ধিত কিন্তু তার ব্যাপ্তি সীমিত, আমাদের প্রচেষ্টা ক্ষুদ্র্র কিন্তু লক্ষ্য মহৎ। ৪ ডিসেম্বর ২০০৭ বেলা ২টার পরে, পরবর্তী ১২-১৪ ঘণ্টায় দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রদর্শিত সংবাদে আমাদের দলের উদ্বোধন ও লক্ষ্যের কথা বলা হয়। কিন্তু আমরা এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলাম না যে, আমাদের স্লোগান তাৎক্ষণিকভাবে আকাশে-বাতাসে ঝড় তুলবে। বলে রাখি, বাংলাদেশে যিনি বা যারাই ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারণাকে প্রকাশ করেছেন বা করবেন এবং সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন, আমরা সেই ধারণাকে, প্রকাশকে এবং সেই বাস্তবায়ন প্রচেষ্টাকে সম্মান করি। তবে যারাই গুণগত পরিবর্তন আনায় আগ্রহী, তারা স্বীকার করেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সেই পরিবর্তন আনতে হবে এবং পরিবর্তনের লক্ষ্যে জনমত সৃষ্টি করার জন্য অব্যাহতভাবে চেষ্টা করতে হবে। জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে মিডিয়া অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। জনমত সৃষ্টিতে পার্লামেন্টও গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবর্তনের জন্য সুযোগ : নির্বাচন
আমাদের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতেই হবে। সে জন্য একটি শুভসূচনা প্রয়োজন। সেই সূচনা করার একটি উপযুক্ত সুযোগ ছিল ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখের নির্বাচন; কিন্তু সুযোগটির সৎ ব্যবহার হয়নি। আরেকটি সুযোগ ছিল জানুয়ারি ২০১৪ সালের নির্বাচন; এটিও ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। আরেকটি সুযোগ হচ্ছে আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচন, যেটি এ বছরের ডিসেম্বরের শেষে অথবা আগামী বছরের জানুয়ারির শুরুর দিকে হওয়ার কথা। সুযোগটির সৎ ব্যবহার হবে কি হবে না, জানি না।
আগামী নির্বাচন যদি এমন সুন্দরভাবে করা যায় যে, সেটি পৃথিবীর সামনে একটি নজির হয়ে থাকে তাহলে আমরা মনে করব, আমাদের পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। এখনো নিশ্চিত নই যে, আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচন আমাদের কামনা মোতাবেক সুন্দর হবে কি না; কিন্তু সুন্দর হোক এটা কামনা করতে দোষ নেই। গুণগত পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করতে পার্লামেন্টে যাওয়া প্রয়োজন। কারণ, পার্লামেন্ট সদস্যদের কণ্ঠ অত্যন্ত জোরালো ও তাৎপর্যবাহী। পার্লামেন্টের বাইরের শক্তি এখনো এত শক্তিশালী হয়নি যে, পার্লামেন্টের শক্তিকে ছাড়িয়ে যাবে। তাই গুণগত পরিবর্তন তথা সংস্কার ঘরের ভেতরে ঢুকেই করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন, উপযুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টে যাওয়া। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নির্বাচনমুখী দল হলেও ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আমরা জোটের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে এবং গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিনি। ২০১৪ সালের জানুয়ারির পরিস্থিতি এবং ২০১৮ সালের অক্টোবর-নভেম্বরের পরিস্থিতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য তফাত আছে। যা হোক, যে উপলক্ষগুলোর মাধ্যমে পরিবর্তনের কথা বলছি, সেই পরিবর্তনে অনেক ছোট ছোট উপাত্ত থাকবে। এর দু-একটি মাত্র উল্লেখ করছি।
পরিবর্তনের উপাত্ত : উদাহরণ-১
রাজনীতিবিদদের ভাষায় শালীনতা ও শোভনতা থাকতে হবে। জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের মুখের কথা, বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন ইত্যাদি হওয়া উচিত তরুণ প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয়। মিডিয়াতে যেহেতু বিবিধ পেশাজীবীর বা বিভিন্ন বয়সের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের কথাবার্তা দর্শনীয় হয় বা শোনা যায়, সেহেতু যেসব মানুষই মিডিয়া সম্পৃক্ত এবং তাদের প্রত্যেকের ভাষায় শালীনতা ও শোভনীয়তা প্রয়োজন।
পরিবর্তনের উপাত্ত : উদাহরণ-২
জিদ ও গোঁয়ার্তুমি পরিহার করা উচিত। এ মুহূর্তে সরকারি বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শিবির বলছে, বিদ্যমান সংবিধান মোতাবেক, বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যেহেতু সংবিধান সংশোধিত হয়েছে, সেহেতু ক্ষমতাসীন দলের মতে, নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার আর কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক অঙ্গনের বিরোধী শিবির (যেখানে আমাদের দলও একটি শরিক) বলছে, একাধিক কারণেই ক্ষমতাসীন দলের এবং ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সরকার ও দেশ পরিচালনা অব্যাহত রেখে ওই পরিবেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে নিরপেক্ষ ফলাফল আশা করা অবাস্তব। এখন প্রশ্ন দাঁড়াল, কী নিয়মে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বিরোধী শিবিরকে আশ্বস্ত করা যায়, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। অপর ভাষায় বলা যায়, আমি এবং আমরা যারা বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধী শিবিরে আছি, আমরা কী নিয়মে আশ্বস্ত হবো, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু আর নিরপেক্ষ হবে?
অন্য কথায় বলতে গেলে এই দাঁড়ায়, যেহেতু নিরপেক্ষ সরকার পদ্ধতি এখন বাতিল, তাহলে সরকারি নিরপেক্ষতার পদ্ধতি কী হতে পারে; অথবা অন্য কোনো পদ্ধতি আছে কি না, যার মাধ্যমে বর্তমান সরকারি দল এবং বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনের বিরোধী শিবির উভয়ে আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে মানসিক স্বস্তি নিয়ে অংশগ্রহণ করতে পারে। এরূপ পদ্ধতি আবিষ্কার করতে গেলে অবশ্যই গবেষণা ও আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি চিন্তা করা প্রয়োজন এই মর্মে যে, মানসিক স্বস্তি নিয়ে যদি রাজনৈতিক অঙ্গনের কোনো একটি অংশ, নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, তাহলে পরিণতিতে কী হতে পারে?
পরিবর্তনের উপাত্ত : উদাহরণ-৩
আমাদের রাজনীতিকে বর্তমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, ভবিষ্যতের দিকে প্রসারিত করা। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এ তিন কালের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। উন্নত বিশ্বের প্রবণতা বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে নজর বেশি দেয়া। আমাদের মধ্যে যারা প্রবীণ, তাদের অনেকেরই মনে একটি ধারণা হলো, তারা (প্রবীণেরা) যা মনে করেন, দেশের সব মানুষই যেন তাই মনে করেন। আসলে দেশের তরুণ সম্প্রদায় বহুলাংশেই প্রবীণ সম্প্রদায় সম্পর্কে আস্থাহীনতায় ভুগছে। ইতিহাস সম্বন্ধে যতটাই আমরা তরুণদের ‘খাওয়াতে’ চাই, তারা ততটুকু খেতে প্রস্তুত নয়। তরুণেরা ক্রমান্বয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশীদের সাথে দেশে থাকা বাংলাদেশীদের ইন্টার-অ্যাকশন প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড বা তরঙ্গ জগতে কোনো সীমারেখা নেই; যার কারণে বাংলাদেশী তরুণ সম্প্রদায় বিশ্বের অন্য দেশের ও সমাজের তরুণ সম্প্রদায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হতে চায় এবং এ জন্য সুযোগ চায়। অতএব, আমাদের রাজনীতি আগামী দিনের বাংলাদেশের মালিক তথা বর্তমানের তরুণ সম্প্রদায়ের চিন্তা-চেতনা ও আশা-আকাক্সক্ষা একোমোডেইট করতে হবে বা এটাকে আশ্রয় দিতে হবে।
পরিবর্তনের উপাত্ত : উদাহরণ-৪
‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ বলতে বোঝাতে চাই যে, বিভিন্ন পেশার মেধাবী, সাহসী কর্মঠ, দক্ষ ও আগ্রহী ব্যক্তিরা যেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। ভূগোল থেকে একটি উদাহরণ দিই। ঢাকা মহানগরীর দক্ষিণ দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা নদীর পানি এত দূষিত যে, শুষ্ক মওসুমে (অক্টোবর থেকে মে) এই নদীর পানিকে ‘পানি’ বলা মুশকিল হয়ে যায়। এটাকে শুধু তরল পদার্থ বললেই চলে। অপর দিকে, বর্ষাকালে যখন বৃষ্টি হয়, এটাকে বুড়িগঙ্গার তরল পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। দূষিত তরল পদার্থের তুলনায় যখন স্বাভাবিক বৃষ্টির পানি নদীতে বৃদ্ধি পায়, তখন বুড়িগঙ্গার ‘পানি’কে আবার পানির মতো মনে হয়। অর্থাৎ বুড়িগঙ্গার দূষিত তরল পদার্থকে হালকা করতে হলে বাইরের পানি দরকার। তদ্রুপ, দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রবাহে, যদি উন্নত জীবন দান করতে হয়, তাহলে নতুন মানুষ, নতুন চিন্তা, নতুন মেধার প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ রাজনীতি নামক কর্মকাণ্ডকে সম্মানজনক করতে হবে। তাহলেই মানুষ রাজনীতি করতে আগ্রহী। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করার পর বড় হলে রাজনীতি করবে- এ কথা যেমন সত্য ও ভালো, তেমনই সত্য ও ভালো যারা ছাত্রজীবনে যারা রাজনীতি করেনি, তবে পরবর্তী জীবনে জড়িত হতে চায়; তাদের জন্য দুয়ার উন্মুক্ত রাখতে হবে।
ঐক্য ও স্বতন্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন
পাঠক এ কলামটি পড়ছেন বুধবার ৩ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে। গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বা দৃষ্টি আকর্ষণীয় রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে। ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মহানগর নাট্যমঞ্চে গণফোরাম সভাপতি ও প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের আহ্বানে একটি প্রক্রিয়ার সূচনা করা হয়েছে, যার নাম ‘ঐক্যপ্রক্রিয়া’। ওই সূচনার আগেই সুপরিচিত রাজনৈতিক নেতা ও নাগরিক ঐক্য নামক রাজনৈতিক দলের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার আহ্বানে তাদের দলের দু’টি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে জাতীয় প্রেস ক্লাবের বড় অডিটোরিয়ামে আমি সার্বক্ষণিকভাবে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় ২২ সেপ্টেম্বরের অনুষ্ঠানটির সীমাবদ্ধতা নিজেই উপলব্ধি করেছি এবং তাই সে দিন সেখানে যাইনি।
কেন যাইনি, সেটি ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর অবস্থিত বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে ব্যাখ্যা করেছি এবং ওই প্রসঙ্গে অতিরিক্ত প্রস্তাবও দিয়েছি। আমরা সেসব প্রক্রিয়াকেই সমর্থন করি- যেসব প্রক্রিয়া মানুষের কল্যাণ আনবে, দেশের কল্যাণ আনবে, মুক্তিযুদ্ধের আদি ও অকৃত্রিম চেতনাকে করবে সমুজ্জ্বল। ৩০ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি এককভাবে বিশাল ও সফল জনসভা করেছে। বিএনপি অবশ্যই বাংলাদেশের বৃহত্তম অথবা দু’টি বৃহৎ দলের এবং তাদের জনসভা বিশাল হওয়াই স্বাভাবিক। ২৭ তারিখের জোটের বৈঠকেই বিএনপি জানিয়ে দিয়েছিল, সেখানে শরিকদের দাওয়াত দেয়া হবে না। বহু লোকের প্রশ্ন, বিএনপি কি ২০ দলীয় জোটকে ‘মার্জিনালাইজ’ করে ড. কামাল ও প্রফেসর বি. চৌধরীর নেতৃত্বাধীন ঐক্যপ্রক্রিয়া বা জাতীয় ঐক্যকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে? আমার পক্ষ থেকে এর উত্তর, ‘না’। কিন্তু লাখো-কোটি মানুষকে তো আমি একা উত্তর দিতে পারব না।
আমার মনে স্থিত কিছু ধারণা
কিছু ধারণা স্থিতি লাভ করেছে আমার মনে। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের জন্য যে চেষ্টা সবাই করছেন বা আমরাও করছি এবং ভবিষ্যতেও করব, সেগুলো অবশ্যই আমার মনের ভেতরে থাকা, স্থিতিশীল ধারণাগুলোর সাথে সম্পূরক ভূমিকা রাখবে। একটি একটি করে সেই স্থিতিশীল ধারণাগুলো উল্লেখ করছি।
(এক নম্বর ধারণা) : বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগতভাবে সেই রণাঙ্গনের একজন যোদ্ধা। অতএব, আমৃত্যু আমার প্রত্যয় থাকবে, এ দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা এবং দেশকে নিরাপদ রাখা।
(দুই নম্বর ধারণা) : এক নম্বর ধারণার ধারাবাহিকতায় উল্লেখ করছি, অবদান রাখার জন্য এবং নিরাপদ রাখার জন্য, সুযোগ পেতে হবে বা সুযোগ করে নিতে হবে এবং এ কাজগুলো করতে হলে যে বৈরিতা সামনে আসে, সেটিকে মোকাবেলা করতে হবে।
(তিন নম্বর ধারণা) : বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। ১৯৭২ সালে যেমন ছিল, কিংবা ১৯৮২ সালে যেমন ছিল, ১৯৯২ সালে যেমন ছিল ও ২০০২ সালে যেমন ছিল, এখনো তেমনই সম্ভাবনাময় দেশ। ধাপে ধাপে সময় সময় ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন ভিন্ন নেতৃত্বে সম্ভাবনা পূরণের একেকটা ধাপ বাংলাদেশ পার হয়ে এসেছে। আবার সম্ভাবনার নতুন ধাপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। বিভিন্ন কালে ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক যে নেতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সম্ভাবনার ধাপগুলো অতিক্রম করেছে, আমরা তাদের সব সময় স্মরণ করব, স্যালুট দেবো।
(চার নম্বর ধারণা) : বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে, রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও প্রতিশোধস্পৃহা পরিহার করা অপরিহার্য। কিন্তু এ কথা বলা সহজ- এই মর্মে কোটি কোটি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা কঠিন বৈকি!
(পাঁচ নম্বর ধারণা) : ধাপে ধাপে সময় সময় উন্নয়নের সাথে সাথে আমরা অনেক বড় ভুলও করেছি। তার মধ্যে অন্যতম বড় ভুল হলো, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে ফেলা। তাই বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
(ছয় নম্বর ধারণা) : গ্লোবালাইজেশন বলি বা বিশ্বায়ন বলি, যে নামেই ডাকি না কেন- যোগাযোগের যুগে (ইংরেজিতে: ‘ইন দ্য এইজ অব ইনস্ট্যান্ট কমিউনিকেশন’), প্রতিবেশিত্ব বা সহাবস্থান- এরূপ শব্দগুলোর তাৎপর্য ভিন্নমাত্রা অর্জন করেছে। পৃথিবীর কোনো দেশই তাদের প্রতিবেশীর বৈরিতার মুখে স্বস্তিতে থাকতে পারে না। তাই স্বকীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি প্রতিবেশীর স্বকীয়তা ও নিরাপত্তার দিকে নিজেরা যেমন মনোযোগী থাকব, তেমনি প্রতিবেশীও যেন আমাদের স্বকীয়তা ও নিরাপত্তাকে সম্মান করে, এ জন্য ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে।
(ছয় নম্বর ও শেষ ধারণা) : ধর্মীয় বা কৃষ্টিগত বা ভাষাগত সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু উভয় ধরনের মানুষ দিয়ে একটি দেশ ও জাতি- বাংলাদেশ এই গঠনের বাইরে নয়। আমার ধারণা, সংখ্যাগুরুদের ওপর অলঙ্ঘনীয় দায়িত্ব হয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদান এবং জাতীয় অগ্রগতিতে সহযাত্রী করা।
তিনটি রাজধানীর একটি নিয়ে একটু কথা
ঢাকা মহানগর বাংলাদেশের জাতীয় রাজধানী। ‘জাতীয় রাজধানী’ মানে জাতীয় রাজনীতিরও রাজধানী। অনেক সময় হালকা মেজাজের বয়ানে বলতাম, বাংলাদেশে তিনটি রাজধানী আছে। প্রথম ও জাতীয় রাজধানী ঢাকা মহানগর। দ্বিতীয় রাজধানী সরকার ঘোষিত বাণিজ্যিক রাজধানী তথা চট্টগ্রাম মহানগরী। অবশ্যই আমার হালকা মেজাজের বয়ানে বলতাম, তৃতীয় রাজধানী হলো হেফাজতে ইসলামের রাজধানী, যার নাম হাটহাজারী। এটি চট্টগ্রাম জেলার একটি উপজেলা, চট্টগ্রাম মহানগরের উত্তর সীমান্তসংলগ্ন। তিনটি রাজধানীরই নাগরিক আমি।
এ হাটহাজারী উপজেলায় বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ (বা অনেকের মতে সর্ববৃহৎ) কওমি মাদরাসা আছে, যার নাম দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম। এই মাদরাসা যেমন পরিচিত, তেমনি তার মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফী (দা.বা.) পরিচিত। বাংলাদেশের এমন কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি নেই, যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শোনেননি। কিন্তু অসংখ্য মানুষই একটা কথা জানেন না যে, এই বিশ্ববিদ্যালয় হাটহাজারী উপজেলার কেন্দ্র্রস্থলেই অবস্থিত। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা যেটি সাধারণভাবে অনেকেই জানেন না, সেটি হলো- এই উপজেলার উত্তর অংশে, ছিপাতলী ইউনিয়নে অবস্থিত মাদরাসা শিক্ষার আলিয়া ধারার অন্যতম বৃহৎ ও প্রখ্যাত মাদরাসা; যার নাম ‘ছিপাতলী জামেয়া গাউছিয়া মঈনীয়া কামিল (এমএ) মাদরাসা’। এ কামিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব (পীরে তরিকত), শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব, সমাজসেবী আল্লামা মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (মা.জা.আ.)।
হাটহাজারী, নির্বাচন এবং ‘যদি’
এত কথা হাটহাজারী উপজেলা নিয়ে বলার পেছনে কারণ হলো, হাটহাজারীবাসীও একটি সুন্দর বাংলাদেশ চায়, একটি সুন্দর চট্টগ্রাম চায়, একটি সুন্দর হাটহাজারী চায় এবং চায় সুন্দর রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তারাও আগামী দিনে একটি সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে জোটে যোগদানের চূড়ান্ত বৈঠকের সময় তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমি যেন হাটহাজারীতেই নিজে রাজনৈতিক সময় ব্যয় করি। সেই থেকেই আমার প্রত্যয়, মহান আল্লাহর দয়ায় ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করব। এই প্রস্তুতি গত সাত বছরের। গত ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখের (চট্টগ্রাম মহানগর থেকে প্রকাশিত) দৈনিক পূর্বকোণ বা ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখের প্রথম আলোসহ, গত ১৮ মাসে বিভিন্ন তারিখে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক পত্রিকাতেই এ নিয়ে ইতিবাচক সংবাদ ছাপা হয়েছে। তারপরও অনেক প্রকার ‘যদি’ (ইংরেজি পরিভাষায় : if)-এর প্রভাব থাকবে।
যদি- ১. বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না বা এমন পরিবেশ হবে কি না, যেখানে বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে। যদি-২. বিএনপি নির্বাচনে গেলেও তারা ২০ দলীয় জোটের বাকি ১৯টি দলকে বা বিএনপি ব্যতীত অপর আটটি নিবন্ধিত দলকে সাথে নেবে কি না। যদি- ৩. বিএনপি চাইলেও আটটি নিবন্ধিত দলকে সাথে রাখার মতো রাজনৈতিক ও আইনগত পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে থাকবে কি না। যদি- ৪. বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব ২০ দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের কী পরিমাণ বা কী মানের মূল্যায়ন করবে : কঠোরভাবে, উদারভাবে নাকি অবহেলাভবে? যথা- ৫. বিএনপি কি ২০ দলীয় জোটের ওপরে তাদের নতুন পথচলার সঙ্গী ঐক্যপ্রক্রিয়াকে অধিকতর মূল্য দেবে? এসব ‘যদি’র উত্তর এখন পাওয়া যাচ্ছে না বা এখন পাওয়া যাবেও না। কিন্তু সময় বসে থাকছে না। ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপি যুগপৎ নির্বাচনের প্রস্তুতি ও আন্দোলন- এই থিওরিতে বিশ্বাসী। কিন্তু নির্বাচন নামক শব্দ বা নির্বাচন কর্মটির সঙ্গে একটি নির্বাচনী রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক এলাকার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এলাকা নির্দিষ্ট না থাকলে, নির্বাচনী প্রস্তুতি অসম্ভব। তাই বলছিলাম : অনেক ‘যদি’র প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।
আমার মুনাজাত
আজকের এ দিনে ৩ অক্টোবরে আমার জীবনের ৭০তম বছরের শুরুতেই দেশবাসীর কাছে, চট্টগ্রামবাসী এবং হাটহাজারীবাসীর কাছে, সেনাবাহিনীর সাবেক-সবার কাছে আমার প্রার্থনাÑ মহান আল্লাহ তায়ালা যেন আমাকে সুস্বাস্থ্য ও ভালো হায়াত দেন এবং মানুষের খেদমতের তৌফিক দেন।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com.bd
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা