২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রাপক মার্শা বার্নিকাটের মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প

প্রাপক মার্শা বার্নিকাটের মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প - সংগৃহীত

বুধবার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮-তে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গিয়েছিলেন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন বা জেনারেল এসেম্বলিতে। প্রেসিডেন্ট হবার পর এই নিয়ে তিনি দ্বিতীয়বার গেলেন বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশনের সর্বোচ্চ স্থানে। কিন্তু সেখানে নির্ধারিত সময়ের আধা ঘণ্টা পরে উপস্থিত হয়ে ট্রাম্প তার ভাষণে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেন এবং বিশ্বায়নের বদলে স্বদেশকে অগ্রাধিকার দেয়ার পক্ষে বলেন। তিনি জানান, ‘বিশ্বকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য দেয় আমেরিকা কিন্তু খুব কম দেশই আমেরিকাকে প্রতিদান দেয়। আমরা ভবিষ্যতে শুধু সেই সব দেশকেই সাহায্য দেব যারা আমাদের শ্রদ্ধা করে এবং যারা আমাদের বন্ধু।’

এরপর ট্রাম্প আমেরিকার বন্ধু ও শত্রু দেশের একটি লিস্ট দেন। বন্ধু রূপে সবচেয়ে প্রথমে তিনি উত্তর কোরিয়ার সর্বময় স্বৈরাচারী নেতা কিম জং উন-এর নাম করেন। অথচ বর্তমান বিশ্বে কিম জং উন-ই সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারী রূপে পরিচিত।
ট্রাম্প বলেন, সৌদি আরব ও ইউনাইটেড আরব এমিরেটস (ইউএই বা সংযুক্ত আরব আমিরাত) দুটি বন্ধু দেশ। উল্লেখ্য, এই দুটি দেশই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবার আগে তার সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। এই দুটি দেশ যে এখন ইয়েমেনে নির্বিচারে বোমা ফেলছে সে বিষয়ে ট্রাম্প কিছু বলেননি।

ইউরোপের মাত্র একটি দেশকে তিনি বন্ধু রূপে চিহ্নিত করেন এবং সেটি হচ্ছে পোল্যান্ড। এর একটি প্রধান কারণ হতে পারে এই মাসে পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে দুদা আমেরিকায় এসে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে দেখা করেন। তখন তিনি ট্রাম্পকে ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, পোল্যান্ডে যে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি আছে, সেটার নাম “ট্রাম্প ফোর্ট” (ট্রাম্প দুর্গ) তিনি করতে চান।

সবচেয়ে বড় শত্রু দেশ রূপে ট্রাম্প ইরানকে চিহ্নিত করেন। তবে সেই সাথে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকে “একজন ভালো ও চমৎকার মানুষ” বলেন।

খুব সম্ভবত জাতিসংঘে উপস্থিত হয়ে ট্রাম্পের মিত্র ও শত্রুদের এই নামকরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়নি। হয়তো ট্রাম্প জানেনও না যে আগস্ট ২০০৫-এ আমেরিকার দক্ষিণ উপকূলে যে বিধ্বংসী হারিকেন ক্যাটারিনা ঝড় বয়ে যায় তখন বাংলাদেশও এগিয়ে গিয়েছিল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। হারিকেন ক্যাটারিনার ঝড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ঘণ্টা প্রতি ৭৪ মাইল (১১৯ কিলোমিটার ঘণ্টা প্রতি) এবং এর ফলে ১২৫ বিলিয়ন ডলার পরিমাণের সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষের নিরাপদ আশ্রয়, পানি, খাবার ও চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য আমেরিকা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

সাহায্য করেছিল বিশ্বের বহুদেশ যাদের অন্যতম ছিল বাংলাদেশ।শুধু তাই নয়- সবচেয়ে বেশি সাহায্যকারী দেশগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই অবস্থান ছিল জাপানের সরকারি অনুদানের সমান। অবশ্য জাপানের বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেকে আরো দান করেছিল।

বাংলাদেশ কেন এবং কিভাবে বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ষষ্ঠ হয়েছিল এবং ইনডিয়া, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার ওপরে স্থান করেছিল?

সেই প্রশ্নের উত্তরটি জানা থাকলে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘে তার ভাষণে বাংলাদেশের নামটিও উল্লেখ করতেন। হারিকেন ক্যাটরিনা বয়ে গিয়েছিল তের বছর আগে। তখন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবলিউ বুশ ক্ষমতায় ছিলেন।

দুই মেয়াদে জর্জ বুশ ছিলেন প্রেসিডেন্ট এবং তার আমলে ইরাক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল আমেরিকা। সেই যুদ্ধে আমেরিকা চেয়েছিল বাংলাদেশ থেকে কিছু সৈন্য। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সেখানে পাঠাতে রাজি হননি বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। কেন তিনি রাজি হননি? সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং পরে সেটা বলা যাবে। কিন্তু তার সেই সিদ্ধান্তের ফলে আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্কে একটা গভীর ফাটল ধরেছিল।

ক্যাটরিনার প্রলয়ংকরী ঝড়ের বিবরণ পড়ে এবং বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে তার সচিত্র রিপোর্ট দেখে আমি বুঝতে পারি সেই ফাটল মেরামত করতে এবং আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক আবার ভালো করার একটা অপ্রত্যাশিত সুযোগ বাংলাদেশের এসেছে।

আমি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে (প্রাইম মিনিস্টার্স অফিস, সংক্ষেপে চগঙ বা পিএমও নামে পরিচিত) ফোন করে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিনা বিলম্বে দেখা করতে চাইলাম। তখন সকাল সাড়ে দশটা।

এগারোটার দিকে পিএমও থেকে ফোন এল এবং আমাকে যতো শিগগির সম্ভব সেখানে যেতে বলা হলো। আমি দ্রুত রেডি হয়ে পিএমওতে পৌঁছে গেলাম। সিকিউরিটি গেট পেরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর রুমে যখন ঢুকলাম তখন বেলা প্রায় বারোটা। দেখলাম হালকা বাদামি রংয়ের শিফনের শাড়ি পরা প্রধানমন্ত্রী। সেদিন আমিই ছিলাম তার রুমে প্রথম দর্শনার্থী। তার চোখে মুখে একটু জিজ্ঞাসু চিহ্ন। কোনো প্রশ্ন তিনি করলেন না। বসতে বললেন।

‘একটা ইমারজেন্সি বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি এসেছি।’ বললাম।
‘কি হয়েছে?’ তিনি জানতে চাইলেন।

‘আপনি নিশ্চয়ই আমেরিকায় হারিকেন ক্যাটরিনার সংবাদ পড়েছেন এবং টিভিতে ধ্বংসলীলা দেখেছেন, দুর্গতদের করুণ অবস্থা দেখেছেন।’

‘হ্যা। দেখেছি। খুবই খারাপ অবস্থা।’

‘ম্যাডাম, এই সময়ে আমেরিকাকে সাহায্য করা উচিত। বাংলাদেশ ছোট দেশ। গরিব দেশ। কিন্তু বিপদের সময়ে আমাদের সাহায্য করা উচিত বিপদগ্রস্ত অন্য দেশকে।’

‘নিশ্চয়ই। ঠিকই বলেছেন। এখনি কিছু করা উচিত।’ প্রধানমন্ত্রীর চোখে মুখে উদ্বেগ দেখলাম।

‘ধন্যবাদ আপনাকে। আমার প্রয়াত পিতা প্রায়ই কামিনী রায়ের একটি কবিতার শেষ চারটি লাইন বলতেন।

তিনি বলতেন, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে, আসে নাই কেহ অবণী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ তবে এর পরেই তিনি বিদ্রƒপ করে বলতেন, বাংলাদেশের মানুষের চিন্তাধারা অন্যরকম, তারা ভাবে, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসিয়াছি আমি অবণী পরে, প্রত্যেকে আমরা নিজের তরে।’ আপনি যে সেই সাধারণ পথে না গিয়ে আজ একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত নিলেন, এটা বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে অনেক সুফল বয়ে আনবে। কারণ, বাংলাদেশ একটি ঘূর্ণিঝড় প্রবণ দেশ এবং ভবিষ্যতে এপৃল ১৯৯১-এর মতো বাংলাদেশে আরো ঘূর্ণিঝড় হবে। তখন আমেরিকা আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল। চট্টগ্রাম পোর্ট এরিয়াতে তারা বহু কাজ করে চট্টগ্রাম পোর্টকে আবার সচল করতে পেরেছিল। আর হ্যা, আরেকটা স্থায়ী অবদান আমেরিকা রেখে যায়। তখন আমেরিকান সৈন্যরা মিনারেল ওয়াটার খেত। সেই থেকে গোটা বাংলাদেশে মিনারেল ওয়াটার, যেটা আসলে আমাদের দেশে সিদ্ধ পানি, সেটা খাবার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।’

‘এখন বলুন বাংলাদেশের কি করা উচিত।’ প্রধানমন্ত্রী দ্রুত আসল পদক্ষেপ কি হবে সেটা জানতে চাইলেন।

‘বাংলাদেশ দুটি কাজ করতে পারে। প্রথমত, যেহেতু আমাদের সেনাবাহিনী ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বা দুর্ঘটনায় কাজ করতে অভ্যস্ত সেহেতু এবার আপনি আমাদের সেনাবাহিনীর একটি অংশকে আমেরিকায় পাঠানোর প্রস্তাব দিতে পারেন। ফলে ইরাক যুদ্ধে অসহযোগিতার ফলে আমেরিকার বিরূপ প্রক্রিয়ার কাউন্টার ও পজিটিভ একশনের প্রস্তাব দেয়ার সুযোগটা নিতে পারেন। এতে বাংলাদেশের খুব খরচ হবে না। বাংলাদেশ বিমানে আপনি সেনাবাহিনীকে নিউ ইয়র্ক পাঠিয়ে দিতে পারেন। সেখান থেকে আমেরিকানরা প্রয়োজন মোতাবেক দক্ষিণ উপকূলে তাদের নিয়ে যাবে আমেরিকান প্লেনে।’

‘আমেরিকা রাজি হবে? তাদের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আমাদের সেনাবাহিনীকে রিলিফ কাজ করতে দিবে?’ প্রধানমন্ত্রী মত চাইলেন।

‘খুব সম্ভবত রাজি হবে না। তারা মনে করতে পারে এর ফলে আমেরিকান সেনাবাহিনীর মান একটু ক্ষুণœ হতে পারে। কিন্তু তাতে কি? আমেরিকানরা রাজি হলে তো ভালোই। আর রাজি না হলেও ভালো। ইরাকে সেনা পাঠাননি কারণ সেখানে মানুষের দুর্দশা বাড়তো। কিন্তু এবার আমেরিকা সরকার বুঝবে, মানুষের দুর্দশা কমাতে আপনার সরকার সদা প্রস্তুত।’

‘আপনার যুক্তি সঠিক। বেশ। সেই প্রস্তাব আমরা দেব। আর দ্বিতীয় কোনভাবে আমরা সাহায্য করতে পারি?’ খালেদা জানতে চাইলেন।

‘আমরা তাদের ক্যাশ ডলার দিতে পারি।’

‘হ্যা। সেটা সম্ভব। কিন্তু কতো? আমি সাইফুর রহমান সাহেবকে ফোন করছি।’ তিনি তার ইন্টারকমে নির্দেশ দিলেন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে কানেক্ট করতে।

কিছুক্ষণ পরেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপিত হলো। ওদিক থেকে অর্থমন্ত্রী জানালেন বাংলাদেশের ডলার তহবিলের অবস্থা।

‘অর্থমন্ত্রী দশ হাজার ডলার দিতে পারবেন।’ খালেদা ফোন রেখে দিয়ে বললেন।

আমি হেসে ফেললাম। বললাম, ‘দেখুন, যায়যায়দিন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা মাত্র। তবু, ইনডিয়াতে ভূপাল দুর্ঘটনার সময়ে, জাপানে কোবে ভূমিকম্পের সময়ে, এমন বিভিন্ন সময়ে অন্ততপক্ষে দুশ ডলার সাহায্য আমরা পাঠিয়েছি পত্রিকার পাঠকদের পক্ষ থেকে। সেই তুলনায় বাংলাদেশ সরকারের কি উচিত নয় এই সময়ে যতোটা সম্ভব বেশি দান করা?’
‘নিশ্চয়ই। তাহলে আমরা কতো ডলার সাহায্য দেয়ার প্রস্তাব করবো?’

‘সেটা আপনার সিদ্ধান্ত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলার তহবিলের ওপর নির্ভরশীল। আপনিই বলুন।’
‘তাহলে এক মিলিয়ন ডলার?’ প্রধানমন্ত্রী উৎসুকভাবে বললেন।

‘চমৎকার। আমাদের দেশের সীমিত সামর্থ্যে এক মিলিয়ন ডলার যে অনেক সেটা সবাই বুঝবে।’ আমি খুব খুশি হয়ে সায় দিলাম।

‘তাই হবে। আমি সাইফুর রহমান সাহেবকে এখনি বলে দিচ্ছি।’ এবার খালেদার মুখে গভীর তৃপ্তি দেখা গেল।
‘থ্যাংক ইউ ম্যাডাম।’

আমেরিকার বিপদে বাংলাদেশের এক মিলিয়ন ডলার দানের বিষয়টি আমেরিকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। তারা অবাক হয়েছিল গরিব বাংলাদেশের এই বদান্যতায়।

কিন্তু বাংলাদেশে এ বিষয়টি তেমন প্রচার পায়নি। যেমন প্রচার পায়নি সেই সময়ে বিএনপি সরকারের অনেকগুলো ভালো কাজের কথা।

বাংলাদেশে বসে আমার জানার উপায় ছিল না অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থানটি কি। কয়েক মাস পরে ক্যাটরিনা ঝড়ে বিভিন্ন দেশের সাহায্য প্রসঙ্গে মাসিক রিডার্স ডাইজেস্ট পড়ে আমি জেনেছিলাম বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। রিডার্স ডাইজেস্টের চার্টে আনন্দিত হয়েছিলাম দেখে যে প্রতিবেশী দেশগুলোর চাইতে বাংলাদেশের অবস্থান ওপরে। হ্যা, বাংলাদেশ পারে যদি নেতৃত্ব সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। গুগলে সার্চ দিলে বাংলাদেশের এই অতি অসাধারণ কৃতিত্ব বিষয়ে অনেক কিছু পাঠকরা জেনে নিতে পারেন।

কিন্তু এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমেরিকানরা কি জানে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চরম অমানবিক দুর্দশার কথা? কেউ কি এই বিষয়টি আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটকে এবং তার মাধ্যমে তার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জানিয়ে দেবেন?

লন্ডন
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮


আরো সংবাদ



premium cement