২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সংবিধান ও রাজনীতি

হজ, মহররম, বিএনপি ও বাংলাদেশ

-

বিএনপিকে অভিনন্দন
বুধবার ২৯ আগস্ট ২০১৮, পাঠক এই কলাম পড়ছেন। তিন দিন পর ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৯৭৮ সালের এই দিনে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, এই দলের জন্ম ও যাত্রা ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের শুরুতে বহুদলীয় গণতন্ত্র রহিত করে একদলীয় রাজনীতি ও রাজনৈতিক শাসন চালু করা হয়েছিল।

ওই দলটির নাম ছিল ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা সংক্ষেপে বাকশাল। দলটি কার্যকর ছিল পরবর্তী আট মাসেরও কম সময়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে, তৎকালীন বাকশালের অন্যতম নেতা এবং দীর্ঘ দিনের আওয়ামী লীগ নেতা, খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি অতি ক্ষুদ্রাংশের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরকে হত্যা করা হয়। নতুন রাজনীতির উন্মেষ ঘটাতে তখন প্রায় ৩৬ মাস সময় লাগে। সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে নতুন করে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করা হয়েছিল। গণতন্ত্রের এই পুনর্জন্মের উদ্যোক্তা ছিলেন জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, তথা ’৮১-পরবর্তী পরিভাষায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

বিএনপির অন্যতম পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য হলো : বাংলাদেশের সীমানায় বসবাসকারী সব নৃগোষ্ঠী ও বাঙালিসহ সব ভাষাভিত্তিক জাতি-গোষ্ঠীর তথা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মানুষের একটি গর্বিত পরিচয় তথা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক এই দল। জন্মের পর থেকে মোটাদাগে তিন খণ্ডে ১৫ বছর দলটি বাংলাদেশের সরকার পরিচালনা করেছে। যেহেতু ১ সেপ্টেম্বরের আগে আজই হলো আমার সাপ্তাহিক কলাম প্রকাশের নিকটতম দিন বুধবার, তাই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে বিএনপিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর তিন দিন আগেই অগ্রিম শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।

ইবাদতের জন্য মুসলমাদের সময়সূচি
পৃথিবীতে যতগুলো দেশ আছে, তথা যতগুলো দেশ জাতিসঙ্ঘের সদস্য, তাদের মধ্যে বেশির ভাগ দেশেই মুসলমান আছে- কম হোক, বেশি হোক। কিছু দেশ আছে যার জনসংখ্যায় মুসলমানদের প্রাধান্য। যথা- ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, সৌদি আরব, ইরান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া ইত্যাদি। এ দেশগুলোকে মুসলিমপ্রধান দেশ বা মুসলিম রাষ্ট্র বলা হয়। আর কিছু দেশ আছে, যেগুলোতে মুসলমান জনসংখ্যা বিরাট কিন্তু সংখ্যাধিক বা মেজরিটি নয়; যার একটি উদাহরণ ভারত।

এগুলো ছাড়া পৃথিবীর প্রায় দেশেই কম বা বেশি হোক, মুসলমান আছেই। সুতরাং, সব দেশের সব মুসলমানকেই দ্বীন ইসলামের বড় বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা দিবসগুলো পালন করার জন্য ক্যালেন্ডারের শরণাপন্ন হতে হয়। মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর তারিখ বা ইবাদতের দিন-রাত্রিগুলোর তারিখ তথা পবিত্র দিনরাত্রিগুলোর তারিখ স্থির হয় চান্দ্র ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। অপর পক্ষে মুসলমানদের কিছু দৈনিক ধর্মীয় কাজ তথা ইবাদত সূর্যের সময়সূচির ওপর নির্ভর করে। যথা: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও রমজান মাসের ও অন্য যেকোনো সময়ের রোজা। ইসলামের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের একটি হলো- হজ। এটি অনুষ্ঠিত হয় চান্দ্রবর্ষের শেষ মাস তথা জিলহজ মাসের ৯ তারিখ।

জিলহজ মাস এলেই
১৯৮৯ সালের ২৫ জুন আমি ব্রিগেডিয়ার র‌্যাঙ্কে প্রমোশন পেয়েছিলাম। সাত দিন পর সপরিবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই উচ্চতর সামরিক লেখাপড়ার জন্য। বারো মাস পর ফিরে এসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে (আর্মি হেডকোয়ার্টারে তথা প্রচলিত ভাষায় সেনাসদরে) ২৬ জুন ১৯৯০ থেকে, ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনস হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করি। ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলাম। এই সময়কালের মধ্যে একবার হজ করার সুযোগ পেয়েছি।

মহান আল্লাহর দয়ায় সৌদি সরকারের আমন্ত্রণে, সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ-কর্তৃক নিয়মমাফিক মনোনীত হয়ে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে সস্ত্রীক পবিত্র হজ সম্পন্ন করেছিলাম ১৯৯২ সালের জুন মাসে। ওই বছর আমাদের প্রতিনিধিদলের নেতা ছিলেন তৎকালীন নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাইমেনুল ইসলাম। প্রতিনিধিদলে মেজর জেনারেল আবদুল মতিন বীর প্রতীক, মেজর জেনারেল মঞ্জুর রশিদসহ, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর মোট ৩০ জন চাকরিরত অফিসার সদস্য ছিলাম এবং প্রত্যেকেরই স্ত্রী সাথে ছিলেন। পবিত্র হজ ছাড়া ওমরাহ (প্রচলিত ভাষায় ওমরাহ হজ) করার জন্যও মহান আল্লাহ তায়ালা অনেকবার সুযোগ দিয়েছেন।

একটি ওমরাহের সময় আমার নিজের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৬ সালের ১৬ জুন আমি প্যারিস থেকে বিমানপথে জেদ্দা বিমানবন্দরে নেমেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, পবিত্র হজ সম্পন্ন করব এবং পবিত্র মদিনা নগরীতে জিয়ারত সম্পন্ন করবেই ঢাকা আসব। ঘটনাচক্রে এমনই হয়েছিল যে, জেদ্দা বিমানবন্দরে নেমেই দাওয়াত পেয়েছিলাম তৎকালীন জেদ্দা মহানগরীতে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেলের বাসায় চা খেতে।

দাওয়াতটি ছিল অস্বাভাবিক। তার বাসায় যাওয়ার পর আন্তরিকতা ও সৌজন্য বিনিময়ের পর তৎকালীন কনসাল-জেনারেল মোহসিন আলী খান আমাকে একটি বন্ধ ইনভেলাপ হস্তান্তর করেন। এর ভেতরে ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে আমার বাধ্যতামূলক অবসরের আদেশ। শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলেই ইনভেলাপটি গ্রহণ করেছিলাম এবং পরবর্তী চার ঘণ্টার মধ্যেই মহান আল্লাহর দয়ায় পবিত্র ওমরাহর অংশ হিসেবে তাওয়াফরত হয়েছিলাম।

ওই ১৯৯৬ সালের জুনের আগে একাধিকবার যেমন, তেমনই ১৯৯৬ সালের জুন মাসের পরও একাধিকবার পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরব যাওয়ার সৌভাগ্য মহান আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। সর্বশেষ গিয়েছি বেশ কয়েক বছর আগে। এখন মনটা ছটফট করছে আরেকবার যাওয়ার জন্য। জিলহজ মাস এলেই মনটা ওখানে চলে যায়। মহান আল্লাহর দয়া করে ডাক না দিলে আমি যে যেতে পারব না সেটাও সত্য এবং বাস্তব।

সর্বশেষ ওমরাহ করার সময় যেরকম ‘হেরেম শরিফ’ দেখেছি, ২০১৮ সালে সেটা সংস্কার হয়ে আরো বড় ও সুন্দর হয়েছে।

আরাফাত দিবস : চোখে দেখা একদিন, ক্যালেন্ডারে অন্যদিন?
যা হোক, ক্যালেন্ডারের বিষয়ে আলোচনা শুরু করি। হজ সম্পন্ন করার প্রক্রিয়ায়, প্রধানতম আবশ্যিক কাজ হলো-৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পরপরই শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। এটাকে হজের পরিভাষায় ‘ওকুফে আরাফাত বলা হয়; অর্থাৎ, আরাফাতে অবস্থান। এই দিনটিকে মুসলিম বিশ্বে পবিত্র দিন হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এটাকে বলা হয় ইয়াওমুল আরাফাত বা আরাফাত দিবস। গত বুধবার ২২ আগস্ট ছিল বাংলাদেশের জন্য পবিত্র ঈদুল আজহার দিন তথা ১০ জিলহজ।

বুধবারের আগে মঙ্গলবার ২১ আগস্ট ছিল বাংলাদেশের হিসাব মোতাবেক ৯ জিলহজ। সৌদি আরবের হিসাবে ৯ জিলহজ বাস্তবে হজ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেদিন ছিল বাংলাদেশে ৮ জিলহজ। সৌদি আরবের মক্কা নগরীর অদূরে আরাফাতের ময়দানে হাজীদের অবস্থান তথা হজের দিন ছিল সোমবার ২০ আগস্ট ২০১৮।

বহু বছর ধরেই এই দিনটিতে টেলিভিশনের সামনে বসে আরাফাতের ময়দানের হজের অনুষ্ঠানমালা দেখে আসছি; সোমবার ২০ আগস্ট ২০১৮, মহাখালী ডিওএইচএসে আমার অফিসে বসে এই অনুষ্ঠানমালা দেখেছি। টেলিভিশনে যতটুকু সময় দেখিয়েছে, ততটুকু সময় একাগ্রচিত্তে ওই অনুষ্ঠানমালাকেই অনুসরণ করেছি, যতবার টেলিভিশনে লাইভ ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ উচ্চারিত হয়েছে, ততবার নিজেও কণ্ঠ ও হৃদয় তার সাথে মিলিয়েছি।

অর্থাৎ, রোববার ২০ আগস্ট বাংলাদেশের হিসাবে ৮ জিলহজ। কিন্তু সৌদি আরব ও অধিক সংখ্যক মুসলমান দেশের হিসেবে ৯ জিলহজ ১৪৩৯ হিজরি এ বছরের হজ অনুষ্ঠিত হলো। আমার চোখের দৃষ্টিতে এবং অন্তরের ইবাদতের দৃষ্টিতে ওই দিনটিই ছিল ইয়াওমুল আরাফাত। কিন্তু প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, জিলহজ মাসের ৯ তারিখে ইয়াওমুল আরাফাত। বাংলাদেশে জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ছিল ২১ আগস্ট, ততক্ষণে আরাফাতের ময়দানের বাস্তব কাজ শেষ। আমার মনকে বাধ্য করা হচ্ছে একটি বিকল্প দিবসকে ইয়াওমুল আরাফাত মনে করতে। এটা একটা সমস্যা।

এর উপযুক্ত সমাধান আমার কাছে নেই; আমার ধর্মীয় জ্ঞান সীমিত। তবে জ্ঞানী-সচেতন ব্যক্তি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করছেন। আলোচনা ও গবেষণার বিষয়বস্তু হলো, এই একবিংশ শতাব্দীতে, আবহাওয়া বিজ্ঞানের উন্মুক্ত সুযোগ-সুবিধার যুগে, সৌদি আরব এবং বাংলাদেশে একইদিনে চান্দ্র ক্যালেন্ডারের তারিখ হওয়া সম্ভব কি না বা উচিত কি না বা বাস্তব কি না। বাংলাদেশের অনেক জায়গায়ই বহু বছর ধরে সৌদি আরবের ক্যালেন্ডারের সাথে মিল রেখে দিবসগুলো পালিত হচ্ছে। কোনটা ভালো সেটা বলতে পারব না। আমার মন যেটা চায় তা প্রকাশ করছি না। ধর্মীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞান, উভয়ের সংমিশ্রণে একটি উপযুক্ত সমাধান কামনা করি।

সামনেই শোকের মাস
২৯ আগস্ট ২০১৮ পাঠক এ কলাম পড়ছেন। হিজরি ক্যালেন্ডার মোতাবেক বাংলাদেশে আজ ১৭ জিলহজ। আর মাত্র ১২ দিন অথবা ১৩ দিন পর এই হিজরি বছর শেষ হবে। খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের শেষ দিন, ৩১ ডিসেম্বর তারিখকে নিয়ে যত অপ্রয়োজনীয় হইচই করি অথবা বাংলা ক্যালেন্ডারের পয়লা বৈশাখকে নিয়ে আমরা যতটুকু আনুষ্ঠানিকতা পালন করি, সে তুলনায় হিজরি বছরের আগমন ও প্রস্থান নিয়ে বলতে গেলে কোনো সাড়া দেই না।

আমার মন্তব্য এতটুকুই যে, এটা চাপিয়ে দেয়ার কোনো বিষয় নয়, এটা মনের আগ্রহের বিষয়। যার ইচ্ছা ডিসেম্বরের শীতের রাতে জেগে থাকবে, যার ইচ্ছা বৈশাখ মাসের গরমের দিনে ব্যস্ত থাকবে, যার ইচ্ছা মহররমের রাতে ইবাদত করবে, বা যার ইচ্ছা সচেতনভাবে ইতিবাচকভাবে সবগুলো দিনে বা রাতেই কোনো না কোনো অবদান রাখবে।

চলমান জিলহজ মাস শেষ হলেই আসবে ১৪৪০ হিজরি সালের প্রথম মাস, মহররম বা শোকের মাস। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মানসপটে শোকের মাস হচ্ছে মহররম। বিদ্যমান সরকারকর্তৃক উৎসাহিত, পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ধর্ম নিরপেক্ষ আবহে, বাংলাদেশের মুসলমানেরা এ শোকের মাস তথা মহররমকে কিভাবে বরণ করবে অর্থাৎ আগামী মহররমকে কিভাবে বরণ বা কিভাবে পালন করবে অথবা শোকের ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে কিভাবে স্মরণ করবে, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার।

আমার আহ্বান : প্রসঙ্গ মহররম
আমার নিজের লেখা (বাংলা ভাষায়) অন্যতম বইয়ের নাম ‘ব্যাটেলস অব ইসলাম’ অর্থাৎ, ইসলামের যুদ্ধগুলো। এখানে ১৩টি অধ্যায় এবং ১৩টি যুদ্ধের আলোচনা বা বিশ্লেষণ আছে। সর্বশেষ অধ্যায়টি কারবালার যুদ্ধ প্রসঙ্গে। অতি সম্প্রতি বইটির সরবরাহ শেষ হয়ে গিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে বইটি নতুন প্রচ্ছদসহ এবং বাঁধাই করা সংস্করণ বাজারে আসবে। এই বইটি একান্তভাবেই আমার পক্ষ থেকে মুসলিম উম্মাহর প্রতি খেদমত হিসেবে নিবেদিত।

অন্ততপক্ষে এই কলামের পাঠকদের প্রতি আহ্বান রাখব এবং পাঠকদের মাধ্যমে তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব শুভাকাক্সক্ষীদের কাছে আহ্বান জানাই, যেন তারা এবং আমরা সবাই মহররম সম্বন্ধে সচেতন হই। বর্তমানে ১৪৩৯ হিজরি শেষ হওয়ার পথে। এখন থেকে ১৩৭৮ চান্দ্রবর্ষ (তথা হিজরি বর্ষ) আগে, তথা ৬১ হিজরি সালের মহররম মাসের ১০ তারিখ, ইরাকের কারবালার প্রান্তরে যে শোকাবহ ঘটনা ঘটেছিল সেটা যেন আমরা স্মরণ করি, আলোচনা করি। সেটা থেকে আমরা যেন শিক্ষা গ্রহণে সচেষ্ট হই। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা স্মরণ করতে চেষ্টা করি যে, মহান আল্লাহ তায়ালার প্রিয়তম বন্ধু, বিশ্ব মানবতার কাণ্ডারি, কল্যাণের ধারক বাহক ও প্রতীক, হজরত মুহাম্মদ সা:-এর নাতি ইমাম হুসাইন রা:-সহ ঘনিষ্ঠ ৭২ জন পারিবারিক সদস্য একই স্থানে শক্রুর হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন, তথা শাহাদতবরণ করেছিলেন।

এই ঘটনার জাগতিক বিশ্লেষণ যেমন আছে, তেমনই আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিগত বিশ্লেষণও আছে। তবে আমরা জাগতিক বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধ থাকছি। ইমাম হুসাইন রা: ইরাকের কুফা নগরীর মানুষের আহ্বানে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু কুফাবাসী, সে সময়ের স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের প্রলোভনে বা নিপীড়নের মুখে, ইমাম হুসাইন রা:-এর পাশে এসে দাঁড়াতে পারেননি বা দাঁড়াননি।

ইয়াজিদের পক্ষ থেকে কারবালার ময়দানে উপস্থিত সেনাপতি ইমাম হুসাইন রা:-কে বারবার আহ্বান জানান ইয়াজিদের বশ্যতা স্বীকার করতে বা ইয়াজিদকে খলিফা মেনে বায়াত হতে এবং এর বিনিময়ে বহু লোভনীয় জাগতিক সম্পদ ও মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার গ্রহণ করতে।

কিন্তু রাসূল সা:-এর দৌহিত্র, এই আহ্বান ও প্রলোভন প্রত্যাখান করেন; তিনি সত্যের পথে অটল থাকেন এবং শিশু থেকে নিয়ে প্রবীণ পর্যন্ত সবাই একে একে শাহাদতবরণ করেন কারবালার ময়দানে। ২০০২ সালে দুইবার, তৎকালীন ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে, দুইজন সহকর্মী বা বন্ধুসহ ইরাক সফর করার সুযোগ পেয়েছিলাম; মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি এ জন্য অশেষ শুকরিয়া।

মুসলিম বিশ্বের কাছে- বিশেষ করে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায়, আওলিয়াকুল-শিরোমণি বা বড়পীর হিসেবে সম্মানিত ও পরিচিত, গাউসুল আজম হজরত শেখ মহিউদ্দিন আবদুল কাদির জিলানি রহ:-এর সমাধিস্থল জিয়ারত, নাজাফ শহরে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী রা:-এর সমাধিস্থল জিয়ারত এবং কারবালায় শহীদদের সমাধিস্থল জিয়ারতের সুযোগ পেয়েছিলাম; শোকর আলহামদুলিল্লাহ।

শুধু জিয়ারত নয়, জিয়ারতের মাধ্যমে আত্মোপলব্ধির সুযোগ এসেছিল। ৬১ হিজরির কারবালার ময়দান ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। ২০০২ সালের কারবালা একটি বড় শহর, ফোরাত নদীর তীরেই। ২০০৩ সালেই, আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করেছিল, শাসক সাদ্দাম হোসেন নিহত হয়েছিলেন। ২০০২ সালের ইরাক এবং আজকের ইরাক কোনোমতেই এক নয়।

বিদায়ী বছরে মুসলিম বিশ্বের হালচাল
নতুন হিজরি বছর আসার আগেই আমরা বলতে পারি- বিশ্বের মুসলমানেরা যদি উম্মাহ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে সেই উম্মাহ কোনোভাবেই শান্তিতে ও আনন্দে নেই। মুসলিম বিশ্বের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দেশ সৌদি আরব ও ইরানের মাঝে পরস্পরের কঠোর বৈরী সম্পর্ক। সৌদি আরব ও ইয়েমেন নামক দু’টি প্রতিবেশী দেশ পারস্পরিকভাবে যুদ্ধে লিপ্ত।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ইত্যাদি কয়েকটি উপসাগরীয় দেশ মিলিতভাবে কাতার নামক প্রতিবেশী মুসলমান দেশের সাথে বৈরী সম্পর্কে লিপ্ত। তুরস্ককে কেন্দ্র করে মুসলমান দেশগুলোর মনোভাব দ্বিধাবিভক্ত। একভাগ মনে করছে, তুরস্কের প্রতি সহানুভূতি দেখালে আমেরিকা অসন্তুষ্ট হবে, অন্যভাগ মনে করছে, তুরস্কের প্রতি সহানুভ‚তি দেখানো ‘ঈমানি দায়িত্ব।’

গত ৭০ বছরে-বিশেষ করে গত ৩৮ বছরে ইসরাইলের প্রতি মুসলমান দেশগুলোর মনোভাব ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়ে ইসরাইলের অনুকূলে চলে যাচ্ছে; সর্বশেষ সৌদি আরব ইসরাইলকে বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বিবিধ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সমস্যা মোকাবেলা করতে করতে এ পর্যন্ত এসেছে।

আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি মুসলিম বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রের সাথেই নিবিড়ভাবে জড়িত নয়; আবার দৃশ্যমানভাবে দূরত্বেও নয়, পাকিস্তান ছাড়া। মালয়েশিয়া নামক রাষ্ট্রটি ১৮ বছর আগে মুসলিম বিশ্বের অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্ব দিয়েছিল। এখন সেই স্থানটি তুরস্ক পূরণ করার চেষ্টা করছে।

পৃথিবীব্যাপী পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এবং বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতে ঘোষিতভাবে বা অঘোষিতভাবে হোক মুসলিম বিদ্বেষী আবহ বিরাজমান। ২০০১ সালের ১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক মহানগরীতে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর থেকে মুসলিমবিদ্বেষী পরিবেশ সৃষ্টি হতে থাকে এবং মুসলমানদের অতি ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন অংশ, তাদের প্রতিক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক বা উগ্র হতে থাকে। ফলে পরিস্থিতি ঘোলাটে ও উত্তপ্ত। বাংলাদেশও একটি গরম, ঠাণ্ডা- এ রকম ধারাবাহিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় কাটিয়েছে বা কাটাচ্ছে।

বাংলাদেশ কেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হচ্ছে না, এজন্য কারো কারো প্রশ্ন আছে অথবা সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ইসলাম ঘোষিত হওয়ার পরও, ইসলামি রেওয়াজের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বহু কিছু, রাষ্ট্রীয় আচার-আচরণে কেন বিদ্যমান, এটা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন আছে। এ ক্ষেত্রে সন্তোষজনক ভারসাম্য আনয়নের প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্যভাবে দৃশ্যমান নয়।

আমি, আমরা, বাংলাদেশের রাজনীতি
আমার ব্যক্তি পরিচয়ে ছয়টি আঙ্গিক প্রণিধানযোগ্য। মহান আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে আমি মানব জাতির অংশ হিসেবে একজন মানুষ তথা আরবি ও কুরআনের পরিভাষায় একজন ইনসান; এটা আমার প্রথম পরিচয়। ইনসান হিসেবে আমার দায়িত্ব দ্বিমুখী, তা হলো সৃষ্টিকর্তার প্রতি এবং সৃষ্টির প্রতি। আমার দ্বিতীয় পরিচয়- আমি একজন মুসলমান; মুসলমান হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার তৃতীয় পরিচয়- আমি একজন বাঙালি; বাঙালি জাতির একজন সদস্য হিসেবে, আমার আবেগ ও অনুভ‚তি লঙ্ঘনের অবকাশ নেই।

আমার চতুর্থ পরিচয়-বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা আমি; ওই সুবাদে আমার অন্তরে লালিত মুক্তিযুদ্ধের আদি ও অকৃত্রিম চেতনাগুলো এখনো পৃষ্ঠপোষকতার দাবি রাখে। আমার পঞ্চম পরিচয়-মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ও প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের আমি একজন নাগরিক তথা একজন বাংলাদেশী; বাংলাদেশী হিসেবে বাংলাদেশের খেদমতে, বাংলাদেশের সেবায় নিজেকে অতীতে যেমন নিয়োজিত রেখেছি, তেমনই বর্তমানে নিয়োজিত রাখতে চেষ্টা করছি।

এভাবে নিজেকে নিয়োজিত রাখার প্রক্রিয়াতেই, আমার পরিচয়ের ষষ্ঠ আঙ্গিক হলো- আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির ঘোষিত নীতিবাক্য (ইংরেজি পরিভাষায় ‘মটো’) হলো: ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’। আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাই। এ জন্য আমাদেরকে বিকশিত হতে হবে, জনগণের কাছে আমাদের পরিচিত হতে হবে এবং নেতাকর্মীদেরকে প্রস্তুত হতে হবে।

তার জন্য মানুষের কাছে আমাদের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা প্রকাশ করতে হবে। পরিবর্তন শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আনতে চেষ্টা করতে হবে। সে জন্য গণতান্ত্রিক সব কর্মকাণ্ডে তথা রাজনৈতিক সব ধরনের ইতিবাচক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকতে হবে আমাদের দলকে এবং আমাকে। এই গুণগত পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়ায়, বাংলাদেশের জন্য আগামী চার মাস বা পাঁচ মাস অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পক্ষগুলো যেন এই তাৎপর্য উপলব্ধি করেন, সেই কামনা করছি। সেই কামনার সপক্ষে ভবিষ্যতে আরো বলার চেষ্টা করব।

লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com


আরো সংবাদ



premium cement