২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কোরবানির রকমফের ও পুরনো পাঁচালি

-

রাজধানীর রাস্তাগুলো দু’তিন দিনের জন্য হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেলে ঢাকা শহর যানজট ও জনজট থেকে মুক্ত থাকলে অস্বাভাবিক লাগে আমাদের কাছে। তেমন অবস্থাই বিরাজ করেছে প্রতিবারের মতো এবারের ঈদেও। এটা ছিল ‘বড় ঈদ’ বা ঈদুল আজহা। সবার জানা, ত্যাগ ও ধৈর্য এ ঈদের প্রধান শিক্ষা। ত্যাগ, তথা সংযমের শিক্ষা এ দেশের মানুষ কতটা গ্রহণ করে থাকে, বছরজুড়ে অসংযত আচরণে পরিপূর্ণ আমাদের জাতীয় জীবনই এর জ্বলন্ত সাক্ষী। একইভাবে ধৈর্যের পরীক্ষায়ও আমরা যথারীতি ফেল মারার ‘ঐতিহ্য’ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছি অনেক আগেই। যা হোক, ঈদুল আজহা উপলক্ষে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জিত হলো, আর যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার আলোকে কিছু কথা বলা দরকার।
মাত্র দিন কয়েক আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশে তোলপাড় আন্দোলন হয়ে গেল। এক দিকে বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিল, ক্লাস বর্জন ইত্যাদি। অন্য দিকে হুমকি, হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতন, রিমান্ড প্রভৃতি। এই আন্দোলনের জের চলছে এখনো। কিন্তু ঈদের ছুটিতেও সড়কগুলো নিরাপদ ছিল না। প্রতিদিনই প্রাণ ঝরেছে রাজপথে এবং তার কারণ যন্ত্রদানবের মানব হত্যা। বলা হয়ে থাকে, সড়ক দুর্ঘটনার বড় তিন কারণ- ওভারটেকিং, ওভারস্পিড আর ওভারলোড। ঈদের ছুটির মধ্যে যেসব ‘দুর্ঘটনা’ পথে-ঘাটে ঘটেছে এবং কারণ হয়েছে অনেকের মৃত্যুর, তার জন্য প্রধানত ওভারটেকিং আর ওভারস্পিড দায়ী। অর্থাৎ চালকের অসতর্কতা, অবাঞ্ছিত প্রতিযোগিতা এবং অপরিণামদর্শিতাই এসব দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। ওভার লোড যখন দুর্ঘটনার কারণ, তখন না হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাত্রীদের কিছুটা দায়ী করা যায়। কিন্তু ঈদের সময়ে রাস্তা যখন প্রায় ফাঁকা থাকে, সে সময় যানবাহনে ভিড় দেখা যায় না। বরং চালকেরা ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চালায় একেকজন মত্তমাতাল উন্মাদের মতো। পরিণামে প্রতিদিন ঘটে শোচনীয় মৃত্যু। গত শুক্রবার ফেনীতে বাস আর সিএনজির সংঘর্ষে ছয়জনের সকরুণ মৃত্যু তাদের পরিবারে ঈদের আবহের মাঝে আহাজারি ডেকে এনেছে। কেবল এদিনেই দেশে ১৩ জনের অপমৃত্যুর কারণ ‘সড়ক দুর্ঘটনা’।
ঈদুল আজহা মানে, কোরবানির ঈদ। কোরবানির অর্থ যে ত্যাগ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যারা নিরীহ সাধারণ নাগরিক, আমাদেরই বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সে ত্যাগ চরম দুর্গতি দুর্ভোগ, বঞ্চনা, বিপদের। অনেকেই বলে থাকেন, বৈষম্যভর্তি এ সমাজে এমনো কিছু ‘আলালের দুলাল’ রয়েছেন, যাদের গায়ে ফুলের পরশ লাগলেও তারা ব্যথা পান এবং মনে করেন, এই পোড়া কপালের দেশে জন্ম নিয়ে তারা এ দেশটাকে ধন্য করেছেন। ব্যঙ্গ করে এদের ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে, সৌভাগ্যের এ বরপুত্ররা মল ও মূত্র ছাড়া কিছুই ত্যাগ করেন না। সব ত্যাগ-তিতিক্ষা নির্ধারিত থাকে নিরীহ, নির্বিত্ত, নির্বিরোধ মানুষের জন্য।
এ দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে হরহামেশা যেসব কোরবানি বা ত্যাগের প্রমাণ রাখতে হয়, তার মধ্যে প্রথমেই আসে সড়কে যানবাহনের তাণ্ডবে প্রাণত্যাগের বিষয়। মাত্র এক দিনের টিভি সংবাদ থেকে কিছুটা তুলে ধরা যাক। ২৪ আগস্ট ঈদের আমেজের মাঝে বেসরকারি টিভি (মালিক একজন মন্ত্রী ও তার পরিবার) খবর দিয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় কোরবানির বর্জ্য অপসারণের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পরও এখানে সেখানে ময়লার স্তূপ। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীকে গবাদিপশুর পাশাপাশি পরিবেশের পরিচ্ছন্নতাও অনেক জায়গায় কোরবানি দিতে হলো। তবে ‘দেশ ক্ষীর আর মধুতে হাবুডুবু খাচ্ছে’ মার্কা ধারণা বিলাতে অভ্যস্ত, সরকারি টিভি একই সময়ে প্রচার করেছে, সব কিছু ফকফকা। মানে ঢাকায় কোরবানির বর্জ্য আর নেই। এদিকে একই সময়ে টিভির খবর, যে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরে গেছে অনেক আগে, সেখানে এখন কাঁচা চামড়া ঢুকছে অবাধে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাভারের নতুন ট্যানারি পল্লীতে তেমন সুযোগ-সুবিধা না থাকায় তারা রাজধানীর হাজারীবাগের পুরনো ট্যানারিতে চামড়া প্রসেসিং করছেন। এলাকাবাসী বলছেন, কর্তৃপক্ষ এই অবাঞ্ছিত কাজ দেখেও না দেখার ভান করছে। মোট কথা, চামড়া কারখানার চরম দূষণ ও দুর্গন্ধে নগরীর বিরাট অংশের বাসিন্দাদের স্বস্তি কোরবানি দিতে হচ্ছে। অপর দিকে চামড়া ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন কোরবানির চামড়ার সুষ্ঠু সংরক্ষণ না হওয়ায় এবং আনাড়ি হাতে চামড়া ছাড়ানোর ফলে তারা এবার সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ‘কোরবানি’ অর্থাৎ লোকসানের শঙ্কায় আছেন। ২৪ আগস্ট সন্ধ্যায় টিভিতে এর সাথে খবর দেয়া হলো, কিশোরগঞ্জের এক চরে বলখেলা নিয়ে মারামারিতে দু’জন নিহত। কোরবানির ঈদে ধৈর্য ও সংযমের মহান শিক্ষা আমরা কতটা আত্মস্থ করছি, নিছক ফুটবলকে কেন্দ্র করে দু’জনের এ বেঘোরে জান কোরবানি তার প্রমাণ বৈকি! একই সাথে, আন্তর্জাতিকপর্যায়ে ইয়েমেনে বিমান হামলায় ৩২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ট্র্যাজেডি তুলে ধরে, খোদ আরব ভূমিতেও আমরা কোরবানির শিক্ষা ভুলে হানাহানি চালিয়ে যাচ্ছি।

গো-বাদীরা ভারতকে গোল খাইয়েছে
ভারতে গো-বাদীদের তাণ্ডব চলছে কয়েক বছর ধরে। ‘গো-বাদী’ মানে, গরুকে পবিত্র মাতাজ্ঞানে উগ্র হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী, যারা শুধু নিজেরাই বিশ্বাসী নয়, অন্য ধর্মের মানুষের ওপরেও জোর করে তা চাপিয়ে দিতে চায়। চতুষ্পদ গরুর প্রাণহানি বন্ধ করতে সৃষ্টির সেরা মানুষের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটাতেও তাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। ভারতে রয়েছে কোটি কোটি গরু। এটাই স্বাভাবিক। পাশের মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে গরুর বিপুল চাহিদা থাকা এবং এ কারণে ভারত থেকে নানাভাবে এ দেশে নিয়মিত গরুর আগমনও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যা চরম অস্বাভাবিক, তা হলো, গো-রক্ষার নামে বাংলাদেশে ভারতীয় গরুর প্রবেশ নিষিদ্ধ করা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য ভারত সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সর্ববিধ প্রচেষ্টা। এই প্রেক্ষাপটে সে দেশের হিন্দুত্ববাদী কেন্দ্রীয় সরকারের জাঁদরেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে ভারতের গরু আসার বিরুদ্ধে ওঠেপড়ে লেগে যান। সঙ্ঘপরিবারে তার মতো নেতাদের ঘোষিত আকাক্সক্ষা ছিল, বাংলাদেশের মানুষের গো-মাংস ভক্ষণ বন্ধ করে দেয়া। এই অতিহিন্দু রাজনীতিকদের কেউ কেউ এমনকি বাংলাদেশীদের গরু খাওয়া ‘ভুলিয়ে দেয়া’র পণ করে বসেছিলেন। এটা ‘বাপের নাম ভুলিয়ে দেয়া’র মতো অবাস্তব ও অসম্ভব হুমকির মতো।
ভারত সরকার আর তার বিশ্বস্ত গোরক্ষকদের কড়া নজর ও খবরদারির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ভারতীয় গরুর আমদানি খুব কমে যায়। এতে প্রথম দিকে দু-এক বছর বিশেষ করে কোরবানির সময়ে আমাদের কিছু অসুবিধা হয়েছিল। কিন্তু এতদিনে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এখন এ দেশে, রাজধানীর উপকণ্ঠ থেকে প্রত্যন্ত পল্লী পর্যন্ত হাজার হাজার ডেইরিফার্ম বা গবাদি খামার। সেখানে অস্ট্রেলিয়া-ইউরোপের উন্নত জাত তো বটেই, উপমহাদেশের উন্নত জাতের সিন্ধি আর শাহিওয়াল প্রজাতির গরুও জন্ম দিয়ে পালন করা হচ্ছে। সযত্নে লালিত ও বর্ধিত হচ্ছে বাংলাদেশের চাটগাঁ ও পাবনাসহ বিভিন্ন এলাকার উন্নত ধরনের গরুও। লালন করা হচ্ছে ব্ল্যাক বেঙ্গল নামের উন্নত জাতের ছাগল। মোট কথা, গত কয়েক বছরে আমাদের ডেইরি খাতে, অর্থাৎ গবাদি পশুর প্রজনন ও পালনের দিক দিয়ে যেন বিপ্লব ঘটে গেছে।
এবার পত্র-পত্রিকায় দেখা গেছে পশু পালনে বাংলাদেশের স্বনির্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতির কথা। অর্থাৎ ভারতীয় গরুর ওপর নির্ভরতা অবিশ্বাস্যরকম কমে গেছে। দেশী উদ্যোক্তারা বলেছেন, গবাদিপশু পালনের খাতে গত কয়েক বছরের ক্রমবর্ধমান সাফল্য অব্যাহত থাকলে এবং এ জন্য সরকারি প্রণোদনা পর্যাপ্ত হলে, দেশ এ খাতে শতভাগ স্বনির্ভর হয়ে বরং রফতানিযোগ্যতা অর্জন করাও অসম্ভব হবে না। এদিকে, ভারতের ‘গো-বাদী’দের অব্যাহত হুমকি-হামলা এবং সন্ত্রাস-সহিংসতার মুখে বাংলাদেশের অপর প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে ১০ হাজার গরু এসেছে এবার ঈদে। এসব মিলিয়ে ভারতীয় অর্থনীতির যে কতবড় ক্ষতি হচ্ছে, তা ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদীরা খেয়াল না করলেও ভারতের সচেতন মানুষ ঠিকই টের পাচ্ছেন। অপর দিকে, আমাদের ডেইরি খাতের সম্ভাবনা ও সাফল্য বাড়ছে ক্রমাগত।

একই দেশে একই ঈদ দু’দিনে কেন?
মক্কা-মদিনা তথা আরব দেশের সাথে মিল রেখে একই দিন ঈদ করার প্রচলন দিন দিন বাড়ছে বলে প্রতীয়মান হয়। আগে এটা দেশের ২-১টি এলাকায় কোনো কোনো পীরের মুরিদ বা খানকাহর অনুসারীরা করতেন। এবার দেশের উত্তরাংশের ঠাকুরগাঁও এবং পূর্বাংশের চাঁদপুর জেলার বেশ কিছু গ্রামে মক্কা-মদিনার সাথে একই দিনে কোরবানির ঈদের নামাজ পড়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো- খোদ রাজধানীর পান্থপথে প্যান্ডেল করে নারী-পুরুষ শিশুদের ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে মঙ্গলবার দিন। একটি টিভি চ্যানেলে দেখা গেল, বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ও ইসলামি চিন্তাবিদ প্রফেসর এম শমসের আলী সেখানে ঈদের নামাজ আদায় করে বেরিয়ে আসছেন। স্মর্তব্য, ওআইসি আহ্বান জানিয়েছে যাতে মুসলিম বিশ্বের সব দেশে একই সাথে দু-ঈদ উদযাপন করার মাধ্যমে উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রকাশ পায়। যারা আরবের সাথে মিল রেখে একই দিনে ঈদ পালনের পক্ষপাতী, তারা ওআইসির এ প্রস্তাব কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছেন। আর যারা ‘ঐতিহ্য’ মোতাবেক বাংলাদেশে আরবের এক দিন পরে ঈদ পালন করায় অভ্যস্ত, তাদের প্রশ্ন হলো- ‘চাঁদ দেখা না গেলে ঈদ কিভাবে করা যাবে?’ সচেতন মুসলমানেরা মনে করেন, অবিলম্বে সরকার এবং ওআইসি মিলে এ ব্যাপারে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ না নিলে জনমনে বিভ্রান্তি বাড়বে।

তবুও মুসলমানরা ‘নন্দঘোষ’
কোনো কোনো পত্রিকা বিভিন্ন দেশে ঈদ উদযাপনের ওপর সচিত্র ফিচার ছাপিয়েছে। জানা যায়, কোরবানির ঈদকে বড় ঈদ বা ঈদুল কিবির বলা হয় মিসরসহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোয়। আফ্রিকার বহু এলাকায় ওই ঈদের নাম তাবাসকি বা তোবাসকি। নাইজেরিয়ায় এর নাম বারবার সালাহ। আবার সোমালিয়া, কেনিয়া ও ইথিওপিয়ায় সিদওয়েনি বলা হয় ঈদুল আজহাকে। তুরস্কে বলা হয় কুরবান বৈরাম (ত্যাগের উৎসব)। একই নামে ঈদটি পরিচিত পূর্ব ইউরোপের বুলগেরিয়া, বসনিয়া ও আলবেনিয়ায়। কুর্দিদের ভাষায়, ‘সেজনা কোরবানে’। কাজাখস্তানে অভিহিত হয় ‘কোরবান ঈত’ নামে। আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষায় এই উৎসবের নাম ‘ঈদ-ই-কোরবান’। তবে দেশটির পূর্বাংশে বহুল প্রচলিত, পশতু ভাষায় এর নাম ‘লয় আখতার’। সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় এর নাম বকরি ঈদ, যে নাম আমাদের উপমহাদেশেও প্রচলিত। মালয়েশিয়ায় ‘হরিরায়া কোরবান’। বাংলাদেশে গরুই সাধারণত কোরবানি দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে আরব জগতে দুম্বা, ভেড়া, উটের প্রাধান্য। ছাগল কমবেশি সব দেশেই কোরবানি দেয়া হয়। ভারতে প্রায় সর্বত্রই গরু কোরবানি দেয়া নিষিদ্ধ। তাই দেওবন্দের মতো বিশ্ববিখ্যাত মাদরাসায়ও মহিষ কোরবানি দিতে হয়।
আমার এক আত্মীয় কিছু দিন ইন্দোনেশিয়ার একটি এলাকায় ছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি জানিয়েছিলেন বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশটির একটি ব্যতিক্রমী প্রথার কথা। সে দেশে অনেক মসজিদে ঘণ্টা বাজানো হয় আজানের আগে। এবার জানা গেল, ঈদের জামাতের আগে চীনেও মসজিদে ঘণ্টা বা সাইরেন বাজিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, ঈদের নামাজের সময় হয়ে গেছে।
একটা কথা অনেকেই বলেন যে, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় অল্প বয়সেই পুরুষরা হজ করে থাকেন। এমনো শোনা গেছে, অনেক এলাকায় নাকি ‘হাজি’ না হলে পুরুষের পক্ষে বিয়ে করা কঠিন। এবার পত্রিকায় দেখা গেল, ‘ইন্দোনেশিয়ায় কেবল হাজিরাই কোরবানি দেন।’ জানি না কতটা বাস্তব, তবুও খবরটা পড়ে গেলাম, ‘(সে দেশের মুসলমানরা) রোজার ঈদ খুব আনন্দের সাথে পালন করলেও কোরবানিটা কোনো রকমে কাটিয়ে দেয়। ইন্দোনেশিয়ায় সাধারণত যারা হজ করেছেন, কেবল তারাই কোরবানি দেন। শুধু তাদের ওপর কোরবানি ফরজ।’ তবে শেষের কথাটা উদ্ভট ও ভিত্তিহীন বলতেই হয়।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং অমুসলিমদের ধর্মকর্মের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। এ দেশে কোনো কোনো সম্প্রদায়ের কিছু নেতা রাজনৈতিক উদ্দেশে যত অভিযোগ করুন না কেন, এটা তো অনস্বীকার্য- বাংলাদেশে অমুসলিমদের বিভিন্ন ধর্মীয় দিবসেও ছুটি থাকে। অথচ উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তবুদ্ধি, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি বড় বড় কথা বলেও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ (মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হলেও) বিশেষত মুসলমানদের ধর্ম পালনে বাধা দিয়ে থাকে। তবু মতান্ধ মিডিয়া আর একদেশদর্শী অ্যাকাডেমিশিয়ানদের প্রচারণা হলো, মুসলিমরা গোঁড়া আর ধর্মান্ধ।
বাংলাদেশের বহু প্রচারিত একটি পত্রিকা লিখেছে, জার্মানিসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে ঈদের ছুটি মেলে না। জার্মান মুসলমানেরা দুই ঈদসহ কোনো ধর্মীয় উৎসবেই সরকারি ছুটি পান না। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশটিতে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় উৎসবে ছুটি দেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ায় ঈদে ইসলামি বিদ্যালয়, সামাজিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকে বন্ধ। মুসলিমরা অমুসলিমদের কোরবানির গোশত দেন উপহার হিসেবে। তবে সে দেশে ঈদে কোনো সরকারি ছুটি নেই।

পাদটীকা : এবার কোরবানির ঈদে একটা বিজ্ঞাপন সবার নজর কেড়েছে। একটি স্টিল রিরোলিং মিলের বিজ্ঞাপনটির একেবারে উপরে লেখা- ‘কুরবানি হোক মনের পশুটাও’। মনে পড়বে নজরুলের কবিতা : ‘মনের পশুরে করো জবাই/পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।’ বিজ্ঞাপনটায় একটা গরু আঁকা হয়েছে কয়েকটি কথা দিয়ে। এগুলো মানুষের বড় কয়েকটি দোষ যা থেকে বিরত থাকলে ঈদুল আজহা উদযাপন সার্থক হবে। এগুলো হচ্ছে- হিংসা, নিষ্ঠুরতা, অহঙ্কার, লোভ, ক্রোধ, মিথ্যাবাদিতা ও লালসা।
(২) বছর বছর ঈদ আসে। তবুও আমাদের মাঝে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসে না। বনের পশু মনের মাঝে বসত গড়ে কেন? ফারুক নওয়াজের ‘কুরবানি হোক ত্যাগের বাসনা’ ছড়াটিতে এর জবাব মিলবে। ‘কুরবানি সে-তো ইবরাহিমের শ্রেষ্ঠ ত্যাগের কাহিনী/সেই সত্যটা হৃদয়ে ধারণ করতে আমরা চাহিনি/চাহিনি বলেই পশু কিনে এনে জবে করে করি ভক্ষণ/আমাদের মাঝে স্রষ্টা দেখেন ভোগের প্রকট লক্ষণ/কেউ গরু, কেউ উষ্ট্র-দুম্বা, কেউ খাসী, কেউ ষণ্ড/লোক দেখানোর প্রতিযোগিতায় অহমিকা প্রচণ্ড/সত্য যেনবা আড়ালে লুকায় মিথ্যামেকির গর্বে/বনের পশুরা বাঁচবে যেদিন মনের পশুরা মরবে/শোনো হে মানুষ, সত্য-শুদ্ধে ধৌত করো হে চিত্ত/মরিলে সঙ্গে যাইবে না কারো অহম ও অর্থবিত্ত/ভোগের বাসনা কুরবানি দিয়ে ত্যাগে করো মন দীপ্ত/অন্ধ দম্ভে অযথা কোরো না হৃদয় কালিমালিপ্ত/যেদিন মনের বেয়াড়া পশুরা বিষশরে হবে বিদ্ধ/ সেদিন সবার কুরবানি হবে ত্যাগের আলোয় ঋদ্ধ।’

পুনশ্চ : গরু মোটাতাজাকরণের স্বাস্থ্যসম্মত ও ক্ষতিকর- দু’ পন্থাই আছে। বৈধ পন্থাটিকে সরকারিভাবেই উৎসাহ দেয়া হয়। অবৈধ পন্থাটার ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও লোভী ব্যবসায়ীরা তার অনুসরণ থেকে বিরত হয় না। এবারো এটা দেখা গেছে। একটি দৈনিকে নিবন্ধের শিরোনাম, The danger of cow fattening আর সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে Strict steps needed to rein in steroid-fattened cattle. কিন্তু কে শোনে কার কথা?
এ তো গেল চতুষ্পদ পশুর কথা। কিন্তু বিভিন্ন সরকারের আমলে, সে সময়ের ক্ষমতাসীন মহলের লোকজনকে আর্থিকভাবে মোটা আর দাপট ও দৌরাত্ম্যের দিক দিয়ে তাজা করার মতলবে অঘোষিতভাবে নানা প্রকল্প গৃহীত হয়। সেগুলোর মধ্যে কিন্তু সবই নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ।


আরো সংবাদ



premium cement