২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সিল উৎসবে জাতীয় নির্বাচনের মহড়া

সিল মারা ব্যালট - ছবি : সংগ্রহ

নির্বাচনে জালিয়াতির ঘটনা শুধু বাংলাদেশে ঘটে থাকে, এমন নয়। ভোটার উপস্থিতি ছাড়া বিজয়ী ঘোষণা বা ৯০ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হওয়ার উদাহরণ বহু দেশে আছে। নির্বাচনে যাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অংশ নিতে না পারেন, সে জন্য নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণাসহ ক্ষমতাসীন দলের নানা উপায় অবলম্বনের অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু এসব প্রথাগত কৌশল বাদ দিয়ে জালিয়াতির নির্বাচনের অভিনব সব পন্থা আবিষ্কার করা হয়েছে বাংলাদেশে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এবারের তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এসব নতুন কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে।

ক্ষমতাসীন দল আগেই নির্ধারণ করে রেখেছিল, সব সিটি করপোরেশনে জিততে হবে যেভাবেই হোক। এর আগে খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে যে কৌশল নেয়া হয়েছিল, তার সবই তিন সিটিতে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর সাথে আরো কিছু নতুন কলাকৌশলও যোগ করা হয়েছে। বাইরে শান্ত কিংবা উৎসবমুখর পরিবেশ, ভেতরে কেন্দ্র দখল। জাল ভোট, ব্যালট পেপার ছিনতাই, এজেন্টদের বের করে দেয়া, প্রার্থী ও সাংবাদিক প্রহারের মতো সব অবাঞ্ছিত উপাদানই যুক্ত হয়েছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। এবারে নতুন একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে। তা হলো, মেয়র প্রার্থীদের ভোট দুপুরের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। কারণ, কেন্দ্র দখল করে নৌকা প্রতীকে যথেচ্ছ সিল মারায় অনেক ভোটকেন্দ্রে আর ব্যালট পেপার পাওয়া যায়নি। খুলনার মতো এবারের তিন সিটি করপোরেশনে কেন্দ্রের ভেতরে বিরোধী প্রার্থীর এজেন্ট ছিলেন না। ভোটের আগের রাত কিংবা সকাল থেকে এজেন্টদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এজেন্টদের এই নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদঘাটিত হয়েছিল গাজীপুরে নির্বাচনের পর। বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের এজেন্টদের আগের রাতে বা ভোরে ধরে নিয়ে গিয়ে ৫০ বা ১০০ মাইল দূরে কোথাও ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যাতে ভোটকেন্দ্রে আর আসতে না পারেন।


খুলনা ও গাজীপুরে যেভাবে এজেন্টবিহীন ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরা হয়েছে, একই কৌশল তিন সিটিতে নেয়া হয়েছে। অবশ্য সিলেটে বেশির ভাগ কেন্দ্রে এজেন্ট থাকায় নির্বাচন হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। তবে জালিয়াতির নির্বাচনে বরিশাল নতুন মডেল গড়েছে। সেখানে অনেক কেন্দ্রে ১০টার মধ্যেই অনেক কেন্দ্রে ভোটপর্ব সাঙ্গ হয়ে গেছে। কারণ, মেয়র প্রার্থীর ব্যালট ভোট শুরু হওয়ার মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। বাংলাদেশে আগেও জালিয়াতির নির্বাচন হয়েছে। তবে নির্বাচনের দুই ঘণ্টার মধ্যে ব্যালট পেপার দিয়ে বাক্স ভরিয়ে বিজয়ী হওয়ার অভিনব পন্থা অতীতে অবলম্বন করা হয়েছে বলে কারো জানা নেই।


তিন সিটি করপোরেশনের ভোট কেমন হবে, তা নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগেই স্পষ্ট হয়ে যায়। নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনে বরিশালে বিএনপি দলের মেয়রপ্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারকে কোনো সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি। তিনি বরিশাল থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি নির্বাচনের দিন সকালে বুঝতে পেরেছিলেন, এই সাজানো নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া দূরে থাক, নেতাকর্মীরা ভোটও দিতে পারবে না। এ কারণে দুপুরের আগেই তিনি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। এরপর অন্য প্রার্থীরাও ভোট বর্জন করেছেন। বরিশালে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এতটাই মারমুখী যে, বাসদের নারী প্রার্থী ডা: মনীষা চক্রবর্তীকে নিপীড়ন করা হয়েছে; জাল ভোটের প্রতিবাদ করায় মারধরের শিকার হয়েছেন তিনি।


রাজশাহীতে বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল আগের দিন অভিযোগ করেন, তার ২৪ জন পোলিং এজেন্টকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষুব্ধ বুলবুল ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার নেতাকর্মীরা কাফনের কাপড় পরে মাঠে থাকবেন; কিন্তু বাস্তবতা অত সহজ নয়। ভোটের আগের রাতে নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে। নেতাকর্মীদের রাত থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। তাই তারা ভোটকেন্দ্রে সঙ্ঘবদ্ধভাবে যাওয়ার কোনো সুযোগ পাননি। এর পরও ভোটকেন্দ্রে কেউ যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দিয়েছে। ভোটের দিন বুলবুল নিজে ভোট না দিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হিসেবে ভোটকেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নিয়েছিলেন। এর পরও বলতে হবে, সিলেটে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বিএনপি যে সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছে, রাজশাহীতে তা সম্ভব হয়নি।


সিলেটে বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে ভোটের এক দিন আগে। সিলেটে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী দেয়া নিয়ে জোটের দুই দলের মধ্যে মনকষাকষি কম হয়নি। শেষ পর্যন্ত আরিফুল হক চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন এবং বিজয়ী হয়েছেন। তিনি ভোটের রাজনীতিতে অত্যন্ত দক্ষ হিসেবে পরিচিত। নানান চাপ ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট রাখার চেষ্টা করেছেন। সিলেটে সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আরিফুল হকের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন। জামায়াত এই নির্বাচনকে নিয়েছিল দলের নেতাকর্মীদের মাঠে ফিরিয়ে আনার কৌশল হিসেবে। জামায়াতের এই কৌশলের সুফল পুরোপুরি পেয়েছেন আরিফুল হক। কারণ, কেন্দ্রগুলোতে এজেন্ট থাকায় কেন্দ্র দখল করে সিল মারা কঠিন হয়ে পড়ে। অপর দিকে নৌকা ঠেকাতে ভোটাররা ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন। এর পরও বেশ কিছু কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট ছিলেন না। সিলেটে বিরোধী জোটের ভোট বিভাজনের কারণে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ছিল আত্মবিশ্বাসী। ফলে রাজশাহী বা বরিশালের মতো গণজালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে তুলনামূলক কম। সিলেটে কেন্দ্র দখলে কিছুটা প্রতিরোধের মুখেও পড়তে হয়েছে। বেশ কিছু ভোটকেন্দ্রে জামায়াতের নেতাকর্মীদের সাথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ ঘটে। পুলিশ গুলি চালিয়েছে এবং অনেকে আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।


ভোটের আগেই নানা আলামত জানান দিচ্ছিল, তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কেমন হবে। বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের পর যখন নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করা হয়, তখন কমিশন থেকে জবাব ছিল, তাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ বা পরোয়ানা থাকায় গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের সক্রিয় কোনো নেতাকর্মীর নামে এই আমলে মামলা নেই, এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। কার্যত ভোটের আগমুহূর্তে পুলিশ বিএনপি প্রার্থীদের পরিকল্পিতভাবে ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের চেয়েও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বেশি সক্রিয় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি বাহিনী। এজেন্টদের তালিকা ধরে তাদের গ্রেফতার ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ অনেক। অতীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিভিন্ন প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে কেন্দ্র দখল নিয়ে যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, এখন আর তেমনটি ঘটছে না। কারণ, বিরোধী পক্ষের এজেন্ট না থাকায় ভোট কেন্দ্র ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এতে নিজেদের মার্কায় সিল মারার কাজটি অবাধ হয়ে যায়। রাজশাহী ও বরিশালে মেয়র নির্বাচন দুপুরের মধ্যেই শেষ হয়েছে। এরপর ভোট গ্রহণ করা হয় শুধু কাউন্সিলর প্রার্থীদের।


সিলেটে বিএনপির প্রার্থী আরিফ বিজয়ী হয়েছেন। ফলে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে- এমন প্রচারণা শুরু হয়েছে। কিন্তু সিলেটের নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ব্যাপক জালিয়াতি জায়েজ করা যাবে না; বরং সিলেটের নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট হয়েছে যে, বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে যদি বেশির ভাগ কেন্দ্রে এজেন্ট দেয়া সম্ভব হতো তাহলে কোনো সিটিতে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে বিজয়ী হওয়া সম্ভব হতো কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে সব সিটি করপোরেশনে বিএনপি প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। এ কারণে এবারের নির্বাচনে ছলে-বলে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দল সম্মিলিতভাবে বিরোধী দলের প্রার্থীদের হারানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিবেশ নয়, বরং প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করাই ছিল নির্বাচন কমিশনের লক্ষ্য।


সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল আগামী সংসদ নির্বাচনের একটি মহড়া সম্পন্ন করেছে। নির্বাচনে কিভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করা হবে, ভোটকেন্দ্র কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়া কিভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, তার নানা ধরনের ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ হলো। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হলে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা যে পুরোপুরি কাজে লাগানো হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিরোধী দলের জন্য এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা কী- সেটিই বড় প্রশ্ন।


এই নির্বাচনে একটি বিষয় প্রমাণ হলো যে, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার ন্যূনতম সাহস ও সক্ষমতা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্বাচন কমিশন কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এ ছাড়া, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের অভিযোগ জানানোর পর কমিশন তাদের গ্রেফতারের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। গাজীপুর ও খুলনার নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশন মুখ রক্ষার জন্য হলেও বলেছিল, নির্বাচনের অনিয়মগুলো খতিয়ে দেখা হবে। এবার তিন সিটি নির্বাচনের পর স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘সব মিলিয়ে নির্বাচন ভালো হয়েছে। আমরা সন্তুষ্ট। যেখানে সমস্যা ছিল সেখানে তো আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।’


সিটি করপোরেশন নির্বাচন সত্যিকারভাবে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের সুযোগ হিসেবে নিতে পারত; কিন্তু কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি, বরং সবার কাছে এটা স্পষ্ট যে, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করার ব্রত নিয়ে তারা কাজ করেছেন। ফলে সাধারণ ভোটারেরা আর আস্থা রাখতে পারবেন না তাদের প্রতি। এই নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের চেয়ে ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। হয়তো দেখা যাবে, জাতীয় নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে থেকেই বিরোধী দলের এজেন্টদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রকৃতপক্ষে বিরোধীদলের মাঠের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না।

alfazanambd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement