ঈদ কারো আনন্দের, কারো আহাজারির
- মীযানুল করীম
- ২৩ জুন ২০১৮, ১৭:৪৭
একটি সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে তিনি ক্ষমতাসীন দলের মেয়রপ্রার্থী। এবার ঈদের নামাজের মুনাজাতে তার বুক ভাসানো কান্না দেখে মানুষমাত্রই অবাক না হয়ে পারেননি। তবে আরো বেশি অবাক হয়েছেন দাবি আদায়ের জন্য ঈদের আগে থেকে শুরু করে ঈদের দিনেও স্কুলশিক্ষকদের রাজধানীতে রাস্তার ওপর দিনরাত পড়ে থাকতে দেখে। তাদের ব্যানারে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘গত ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন-এমপিওভুক্ত করার ঘোষণায় যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম আছে, সেগুলোতে এটা কার্যকর করা হবে।’ বাস্তবে তা আজও না হওয়ায় দুস্থ শিক্ষকেরা অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, ‘আমাদের বেতন নেই, তাই ঈদও নেই।’
ঈদের আগে থেকে শিক্ষকেরা পড়ে আছেন ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের রাজপথে। তাদের মধ্যে নারীও আছেন কয়েকজন। ঝড়বৃষ্টি, ধুলা-বাতাস, শব্দদূষণ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ইত্যাদির মাঝে তারা দিনরাত পড়ে আছেন। পথচারী আর যানের যাত্রীরা আসা-যাওয়ার পথে তাদের দিকে তাকান করুণার দৃষ্টিতে। কিন্তু ক্ষমতাবান যাদের তাকানোর কথা, তারা ব্যস্ত নির্বাচন, রাজনীতি, সংসদ, সফর আর উন্নয়নের জয়ঢাক পেটানো নিয়ে। এই ডিজিটাল ডঙ্কার উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ডুবাতে যেসব প্রচারণা চলছে, তার একটি হলো, বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। অতএব, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’ এমপিওভুক্তির দাবিতে রাস্তায় অবস্থানরত শিক্ষকেরা প্লাকার্ডে প্রশ্ন তুলে ধরেছেন, ‘মধ্য আয়ের দেশ হলো। কিন্তু আমাদের আয় বাড়ল কই?’ সরকারের কাছে এর জবাব নেই বলে কর্তৃপক্ষের মুখে রা নেই, যদিও অন্যান্য ব্যাপারে মুখে নিরন্তর খই ফোটে।
ঈদে সড়ক ভ্রমণ নির্বিঘœ হওয়ার আশ্বাস মন্ত্রী যতই দিন না কেন, এবারো সড়কে শুধু বিঘœ-বিপত্তি নয়, মৃত্যুর মতো মহাবিপদ ছিল ওঁৎ পেতে। ঈদের ছুটির তিন দিনে ৩৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। আসলে নির্বিচারে ‘দুর্ঘটনা’ বলে এত ভয়াবহ একটা বিষয়কে হালকাভাবে দেখা হয়। এতে ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো ‘দুর্ঘটনা’র খলনায়কেরাও এক ধরনের দায়মুক্তি ভোগ করে। ঈদের ছুটিতে বাস-মিনিবাস দুর্ঘটনা প্রতি বছরই হতে দেখা যায়। তবে এবার মোটরসাইকেল বিশেষ আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল। পত্রিকায় এই মোটরবাইক নিয়ে দু’রকম খবর দেখা গেছে। এক. শিরোনামে ‘ফুটপাথের আতঙ্ক মোটরবাইক।’ দুই. ঈদ ছুটিতে মোটরসাইকেল বা মোটরবাইক দুর্ঘটনায় এক ডজনের বেশি মানুষ নিহত। ফুটপাথে মোটরসাইকেল চালানো বেআইনি হলেও কমেনি একটুও। এর একটা বড় কারণ, খোদ আইনের লোকেরাই (যেমন, পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য) অনেক সময় ফুটপাথে মোটরবাইক চালিয়ে থাকেন। আর দুর্ঘটনার কারণ, নিয়ম না মানা এবং অসতর্কতা।
অর্ধশতাব্দী আগে পত্রিকায় কার্টুন ছাপা হয়েছিল, একজন শিখ তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসমেত হাফ ডজন মানুষকে একই মোটরবাইকে বসিয়ে চালাচ্ছেন। ছবিটিতে দেখা গেছে, এই ‘সর্দারজি’ তার যান্ত্রিক দ্বি-চক্রযানের ওপর আড়াআড়ি করে তক্তা রেখে বউ-বাচ্চাদের বসিয়েছেন। আর আমাদের দেশের বীর বাঙালিরা বিনা হেলমেটে এবং বিনা তক্তায়, নারী শিশুসহ পাঁচ-ছয়জন একই মোটরসাইকেলে তীব্র গতিতে রাজপথে ছুটে চলেন।
ঈদের বেলাগাম আনন্দ এবারো অনেকের জীবনে আহাজারির কারণ হয়েছে। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে বাসের ধাক্কায় পিকআপ আরোহী ৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তারা ঈদ উপলক্ষে আনন্দভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। মর্মান্তিক অঘটন ঘটেছে নরসিংদীতেও। সেখানে একজন খুদে ব্যবসায়ী স্ত্রী আর দু’কন্যাকে নিয়ে বিকেলে বেড়াতে যান রেলব্রিজের কাছে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, স্ত্রী ব্রিজটি পার হয়ে যেতে পারলেও স্বামী আর দু’মেয়ের মৃত্যু ঘটেছে ব্রিজের ওপর, ট্রেনে কাটা পড়ে। তারা নাকি তখন সেলফি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন। দু’কন্যার একজন আট বছর, আরেকজন মাত্র দুই বছরের শিশু। এ তো গেল মফঃস্বল সংবাদ। রাজধানীর ফাঁকা মন্ত্রিপাড়ায় কী ঘটেছে? নগরীর এক যুবক ঈদের মৌজে রাত্রে দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। রমনা পার্কের পাশে হেয়ার রোডে যানটি প্রচণ্ড বেগে পেছন থেকে ধাক্কা মারে রিকশাকে। এতে রিকশাটি সাথে সাথে দু’ভাগ হয়ে যায় আর গরিব রিকশাচালক হলেন মারাত্মকভাবে আহত। সর্বোপরি, সেই বেপরোয়া চালক অসাবধানতার মাশুল দিয়েছেন জীবন দিয়ে। ঈদের ছুটিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৩৬ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি আহত হয়ে কেবল ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালেই ভর্তি হতে হয়েছে ২০০ জনকে। এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা বৈকি। যে হাসপাতাল নিজেই ‘পঙ্গু’ হয়ে আছে বলে পত্রপত্রিকা জানায়, সেখানে শ’ দুয়েক মানুষ প্রায় একই সময়ে ভর্তি হলে সুচিকিৎসা কতটা পাবেন, সে প্রশ্ন থেকে যায়।
সদাসরব সড়কমন্ত্রী যা-ই বলুন, দেশের সড়কগুলোর বিরাট অংশের বেহাল দশা ঈদের সময়েও অব্যাহত ছিল। এবার ঈদের ছুটিতে বেশি পর্যটক সিলেট অঞ্চলে যাননি। এর কারণ কেবল বন্যা নয়, বেহাল সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও। যারা সিলেটে বেড়াতে গেছেন ঈদ উপলক্ষে, তাদের সম্পর্কে একটি পত্রিকার বক্তব্য, ‘ঈদে কিছু পর্যটক এসেছেন, তাদের এবার নানা ঝক্কিঝামেলা আর রাস্তার ভোগান্তি পেরিয়ে সিলেট ভ্রমণ শেষে সাথে নিয়ে যাচ্ছেন তিক্ত অভিজ্ঞতা।’
যুগের সাথে অনেক কিছুই বদলে গেছে। এই রূপান্তরে আছে ইতি ও নেতি-উভয়েই। আমাদের ঈদ সংস্কৃতি অতীতের চেয়ে বর্তমানে অনেকটাই পৃথক। এর কিছুটা সময়ের প্রয়োজনে; কিছুটা প্রযুক্তির প্রতাপে আর অনেকটাই এক প্রকার অবক্ষয়ের প্রভাবে। ঈদের দিনেও প্রকট হয়ে ওঠে মূল্যবোধের ক্রমবর্ধমান ও অব্যাহত ঘাটতি। এটা নজর এড়ায়নি ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন কিন্তু সমাজ সচেতন-এমন ব্যক্তিদেরও। তাইতো লেখক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবার লিখেছেন, ‘সামাজিকতা এখন বিপদের মুখে পড়েছে। ঈদের উৎসব যখন সামাজিক ও সর্বজনীন হতে চায়, তখন সামাজিকতার ওই বিপদগ্রস্ত দিকটা বেশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। উৎসবের আলো অন্ধকারটাকে ধরিয়ে দেয়। দুই কারণে ঘটেছে এই বিপদ। একটি আত্মকেন্দ্রিকতা, অপরটি বৈষম্য। এরা যে পরস্পরবিচ্ছিন্ন তা নয়; একেবারেই সংলগ্ন বটে।’ তিনি একটি দৈনিক পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় আরো উল্লেখ করেছেন, ‘কেবল ঈদের দিনে কি? রোজার শুরু থেকেই (হতদরিদ্র মানুষের) এই ভিড় শুরু হয়। গ্রাম থেকে চলে আসে অসহায় মানুষ। থাকে রাস্তায়। তারা কী খায়, কেমন করে থাকে, খোঁজ রাখার অবকাশ কোথায় ব্যস্ত ও বিচ্ছিন্ন মানুষদের? না, কেউ খোঁজ করে না। ইসলাম ধর্মের ঘোষিত একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য যে সাম্য, তা কার্যকর থাকে না।’
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নিজেকে বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পরিচয় দিতেই ভালোবাসেন। তিনিও হতাশ যে, এ দেশে ‘ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও ইহজাগতিক’ উৎসব ও দিবসগুলোও সর্বজনীন ও সামাজিক হয়ে উঠছে না। তাই তার ভাষায়, ‘পহেলা বৈশাখ মধ্যবিত্তের জন্য যতটা আনন্দ নিয়ে আসে, বিপন্ন কৃষকের জন্য তার একাংশও আনতে পারে না, উপায় নেই আনবার। .... নবান্নও এখন আর সকল মানুষের অনুষ্ঠান নয়, এমনকি কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষদেরও নয়।’
দেশে দেশে ঈদ উদযাপিত হয়ে আসছে প্রতি বছর। অমুসলিম বিশ্বের ব্রিটেন-আমেরিকায় বিশেষ করে যেখানে মুসলমানের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য, সেখানে তারা বিপুল আয়োজনে এবং আনন্দ-উৎসবের সাথে ঈদ উদযাপনের সুযোগ পেয়ে থাকেন। কিন্তু সব অঞ্চল কিংবা সব দেশের অবস্থা এক নয়। বর্তমান জার্মানি মুসলিম জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত উদার, বিশেষত মুসলমান অভিবাসী ইস্যুতে অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের ক্ষমতাসীন সরকার যে মহত্ত্ব ও মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে, তা নজিরবিহীন। তবে মুসলমানেরা সংখ্যায় কম, এমন এলাকায় ঈদ তো বটেই, জুমার নামাজও পড়ার ব্যবস্থা নেই সেই জার্মানিতেও। আমার এক নিকটাত্মীয় একটি ছোট জার্মান শহরে চাকরি করে। জুমার জামাতে শামিল হতে তাদের যেতে হয় অর্ধশত মাইল দূরে। ঈদের ছুটি তো নেই-ই; ঈদের নামাজ আদায় করাও তাদের ভাগ্যে জোটেনা।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, পাশ্চাত্যের বহু দেশের সরকার, বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া মুসলমানদের অসাম্প্রদায়িক ও সেকুলার হতে বলে, অথচ নিজেরা নানাভাবে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের পরিচয় দেয়, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে। যেমন- মসজিদ তৈরি, মাইকে আজান দেয়া, প্রকাশ্যে জামাতের সাথে নামাজ পড়া, নারীর হিজাব পরিধান প্রভৃতির বিরুদ্ধে ইউরোপের অনেক দেশের ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার এবং খ্রিষ্টান অধ্যুষিত সমাজ খড়গহস্ত। এর পরও মুসলমানেরা তাদের দৃষ্টিতে ‘গোঁড়া’ ও ‘মৌলবাদী’ এবং তারা নিজেরা ‘প্রগতিশীল’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’।
ওট্ঠো, রোজদারো। সারগাই খা লো, রাত দো বাজ গায়া। (ওঠো রোজদাররা। সেহরি খাও, রাত দু’টা বেজে গেছে)- এখন আর মাহে রমজানে ঢাকার মধ্যরাতে এমন আহ্বান জানায় না ‘সারগাইওয়ালা’রা। অতীতের মতো এই ঢেঁড়া পেটানো নকীব আর নেই; এমনকি, সজোরে কাসিদার কোরাস গেয়ে মানুষকে সেহরির জন্য জাগিয়ে দেয়ার রেওয়াজ প্রায় উঠে গেলেও রমজান আসে এই শহর ঢাকায়। এবারো এসেছিল, যথারীতি চলেও গেছে। তার অনুসরণ করে ঈদুল ফিতরও চলে গেছে বিদায়ের পথে। তবে এর জের কাটতে কিছু দিন তো লাগবেই।
একজন লেখক পুরান ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় মাহে রমজানের কিছু বিলুপ্ত ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ঢাকার নওয়াব ছাবগো আমল থেকা রোজদারগো ঘুম ভাঙাইবার লেগা মরদরা কাসিদা গাইতে বাইর হইত, আর বাড়িত বাড়িত থেকা বক্সিস উঠাইত। কাসিদা গাইত রোজার তিরিশ দিনরে দশ দিন কইরা ভাগ কইরা। পয়লা দশ দিন চানরাতি আমাদ, মইধ্যের দশ দিন খোশ আমদিদ, বিশ রোজার বাদে দশ দিন আলবিদা। আর আছিল ঈদ কাসিদা। ঈদের মিছিলে এই কাসিদা খুশির ফোয়ারা ছুটায়া দিত। অহন কিছু মহল্লা কাসিদার হরিপির (প্রতিযোগিতার) চল রাইখা কাসিদারে বাঁচায়া রাখছে। মাগার আমরা যে ছোট ওক্তে বিছানায় হুইয়া দূর থেকা কাসিদার সুর হুনতাম, ওইটা আর কানে আহে না।’
পাদটীকা : রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলের গেটে রমজানে রাজসিক ইফতারের বিজ্ঞপ্তি ছিল। ঈদে সেখানে এই দেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে কোনো বক্তব্য বা নোটিশ থাকবে- এটাই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। কিন্তু ঈদের ছুটিতে হোটেলটির গেটে ইফতারির বিজ্ঞপ্তি বিদায় নিলে সেখানে স্থান পায় সুইমিং কস্টিউম পরা কয়েকজনের ছবি, আর সাথে লেখা Embrace Swimming. ঈদের একটি প্রধান দিক হলো কোলাকুলি বা ঊসনৎধপব. অতএব, অন্তত ঈদ উপলক্ষে লেখা যেত Embrace all on Eidday.
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা