২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮ ফাল্গুন ১৪৩১, ২১ শাবান ১৪৪৬
`

নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অবসান

-

মিউনিক নিরাপত্তা সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের নিরাপত্তার জন্য মূল্য পরিশোধের কঠোর বার্তা দেয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার বিদায়ের ইঙ্গিত পেলেন ইউরোপীয় নেতারা। ট্রাম্প প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছেন, তাদের জন্য বিংশ শতাব্দী আর ফিরে আসবে না। মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স গণতন্ত্রের সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ভণ্ডামির জন্য ইউরোপীয় দেশ এবং ইইউর কর্মকর্তাদের নিন্দা জানিয়ে এক বক্তৃতা দিয়েছেন।

তার এই বক্তৃতা আমেরিকান রাইট গ্রুপ এবং পপুলিস্ট ইউরোপীয় যারা তাদের নিজস্ব ‘মেক ইউরোপ গ্রেট এগেইন’ মেগা আন্দোলন এগিয়ে নিচ্ছেন তাদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তবে সম্মেলনের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একটি ঠাণ্ডা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে ইউরোপীয়দের কাছে মনে হয়, এই দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন প্রথম প্রশাসন থেকে অনেকটাই আলাদা হবে।

কিন্তু উপলব্ধির সেই মুহূর্তটি ২৪ ঘণ্টারও কম সময় স্থায়ী হয়। পরবর্তীতে সম্মেলনে, অন্য দু’জন রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম (দক্ষিণ ক্যারোলিনা) এবং সিনেটর রজার উইকার (মিসিসিপি) বক্তৃতা করে মূলত বিপরীত বার্তা দেন।

সশস্ত্র পরিষেবা কমিটির প্রভাবশালী চেয়ারম্যান উইকার ইউক্রেনের জন্য ন্যাটো সদস্যপদ কার্যকরভাবে টেবিলের বাইরে ছিল বলে প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথের সমালোচনা করেন। গ্রাহাম অন্যত্র, আরো এগিয়ে গিয়ে জোর দিয়ে বলেন, ‘ট্রাম্প এখন ইউক্রেনকে ভিন্নভাবে দেখেন’।

কিন্তু এর আগে ট্রাম্প প্রশাসনের ফাঁস হওয়া এক বক্তব্যে ইউক্রেন সম্পর্কে বলা হয়, ‘এই লোকেরা আক্ষরিক অর্থে একটি সোনার খনির ওপর বসে আছে... আমি তাকে একটি মানচিত্র দেখালাম।’ যার অর্থ হবে ট্যাক্স বাড়ানো বা সামাজিক নিরাপত্তা জাল কাটা। কিন্তু উপরে উল্লিখিত বিবৃতি তাদের এই ধরনের দুঃস্বপ্নের বিপরীত বার্তা দেয়।

তবে বাস্তবতা হলো, ট্রাম্পের এই দ্বিতীয়বারের চারপাশের জিনিসগুলো স্পষ্টতই ভিন্ন। প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ছিলেন, যিনি ট্রাম্পের ‘খারাপ পুলিশ’কে ‘ভালো পুলিশ’ হিসেবে দেখাতেন। পেন্স ছিলেন একজন পুরনো ধারার রিপাবলিকান যিনি ইরাক যুদ্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন এবং প্রায়ই আশ্বস্ত করতেন যে, প্রতিরক্ষা-সম্পর্কিত বিষয়ে আমেরিকার প্রতিশ্রুতি রয়েছে ইউরোপীয়দের প্রতি। কিন্তু বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ইরাক যুদ্ধে লড়েছিলেন এবং মনে করেন, যুদ্ধটি একটি ভুল ছিল এবং একইভাবে নিজেকে রক্ষা করতে অনিচ্ছুক একটি মহাদেশকে (ইউরোপ) রক্ষা করার ব্যাপারেও তিনি বেশ সন্দিহান।

পেন্স, উইকার ও গ্রাহামের মতো, অনেকে এই বিষয়গুলোতে রিপাবলিকানদের অতীত অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করেন; আর ভ্যান্স ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব করেন। এর অর্থ এই নয় যে, উইকার ও গ্রাহাম প্রভাবশালী নন এবং আমেরিকার রক্ষণশীল আন্দোলনের জন্য খুব বেশি কিছু করেননি; উভয়ই সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান এবং ভালোভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। তবে তারা ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষে কথা বলছেন না। ট্রাম্প যা করছেন তাকে তারা সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।

আর পিস্টোরিয়াস? তিনি শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব নন। ২০২০ সালে, তিনি যখন জার্মানির মার্কেলের নিরাপত্তা উপদেষ্টা তখন ট্রাম্পের আমেরিকার সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ইচ্ছাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এ সময় মার্কেলের দল সিডিইউ ভোটে বেশ উচ্চতায় উঠেছিল। কিন্তু পিস্টোরিয়াসের এসপিডি আজ জার্মানিতে দূরবর্তী তৃতীয় স্থানে রয়েছে।

গ্রাহাম যে ‘সোনার খনি’র উল্লেøখ করছেন তা হলো ইউক্রেনের খনিজসম্পদ, যার অর্ধেক ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনে সামরিক সহায়তার বিনিময়ে দাবি করার কথা বিবেচনা করছে। অর্থাৎ ইউক্রেনকে নিরাপত্তা দেয়ার বিনিময়ে আমেরিকাকে দেশটির আয়ের অর্ধেক দিয়ে দিতে হবে। এটি ভলোদেমির জেলেনস্কি মেনে নিতে অস্বীকার করছেন। কিন্তু তার করণীয় কী তা স্পষ্ট নয়।

তবে কিছু ইউরোপীয় কর্মকর্তা স্পষ্টতই তাতে বিরক্ত ছিলেন। ক্রিস্টোফার হিউসগেন, তার চূড়ান্ত বক্তৃতা দেয়ার সময় (তিনি পদ থেকে অবসর নিচ্ছেন) কেঁদেছিলেন। তিনি মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের চেয়ার এবং এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মারকেলের উপদেষ্টা ছিলেন। তার এই কান্নাকে প্রতীক ধরে অনেক ইউরোপীয় মিডিয়া শিরোনাম করেছে ‘ইউরোপ কাঁদছে’। যদিও তিনি ভ্যান্সের বিবৃতির বিষয়ে ভিন্ন বক্তব্য দেয়ার জন্য অন্য রাজনীতিবিদদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। হিউসগেন ২০২১ সালে ডের স্পিগেলকে গর্বিতভাবে বলেছিলেন, তিনি ‘[তার] শব্দভাণ্ডার থেকে ‘পশ্চিম’ শব্দটি বাদ দিয়েছেন।’ কারণ হিউসগেনের জন্য, ‘এটি এখন আর পশ্চিম এবং প্রাচ্যের মধ্যে বিরোধের বিষয় নয়, তবে যে দেশগুলো একটি নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক আদেশ মেনে চলে... এবং যেগুলো মেনে চলে না তাদের মধ্যেকার বিষয়।’ তিনি যোগ করেন, ‘পশ্চিম একটি নেতিবাচক লড়াইয়ের শব্দে পরিণত হয়েছে, যা রাশিয়ান ও চীনারা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।’

এটি বিশ্বের এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে ‘নেতারা’ তাদের নিজস্ব সভ্যতা বর্ণনা করার জন্য পরিভাষা ত্যাগ করেন, কারণ অন্য লোকেরা এটিকে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করে এবং যেখানে একটি ‘নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক আদেশ’ জাতীয় স্বার্থের ওপরে রাখা হয়। ব্রাসেলস এবং উদারপন্থী আন্তর্জাতিকতাবাদীরা চাইলে তা দেখাতে অস্বীকার করতে পারেন। তবে এটি বাস্তবতা পরিবর্তন করবে না। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির সাথে নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার এখন আর মিল থাকছে না।

এ অবস্থায় ইউরোপ কি নিরাপদ থাকবে? ইউরোপের সম্মিলিত নিরাপত্তা সক্ষমতা দিয়ে রাশিয়াকে ঠেকানো কঠিন। ট্রাম্প ন্যাটোর নিরাপত্তা তুলে নিলে ইউরোপ অসহায় অবস্থায় পড়বে। ট্রাম্প ইউক্রেনের কাছে নিরাপত্তার বিনিময়ে যেভাবে অর্ধেক আয় দাবি করছেন সে রকম না হলেও ট্রাম্পকে ইউরোপের আমেরিকান নিরাপত্তা পাওয়ার জন্য অর্থ দিতে হবে। তার পরিমাণ কী হবে তা স্পষ্ট নয়।

মিউনিখ নিরাপত্তা শীর্ষ সম্মেলন সত্যিকার অর্থে ইউরোপকে অশ্রুসজল করেছে। এটি মার্কিন-ইউরোপ বিবাদের মাধ্যমে শেষ হয়। এমনকি এটি মার্কিন-ইউরোপীয় অংশীদারিত্বের ইতি ঘটাতে পারে। ভেঙে পড়তে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ব্যবস্থাটি। পশ্চিম নিজেদের মধ্যে বিভক্ত ছিল। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ইউরোপকে একাকিত্বে ঠেলে দিতে পারে।

ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডে স্পষ্টতই জয় পেয়েছে রাশিয়া। ‘ইউক্রেনে পুতিনের বিজয়’ পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ার জন্য রাশিয়ার ক্ষুধা বাড়িয়ে তুলবে। ন্যাটোর ভবিষ্যতের জন্য কোনো লক্ষ্য আর অবশিষ্ট থাকবে বলে মনে হয় না।

শুধু ইউরোপ নয় মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে এই নতুন পরিস্থিতি অনুযায়ী সবকিছু নতুন করে সাজাতে হবে। আন্তর্জাতিক উচ্চতর প্রতিষ্ঠান আর থাকবে না। কোনো নিয়মনীতি রাষ্ট্রের আগ্রাসনকে ঠেকানোর অবস্থায় থাকবে না। হয়তো বা বিশ্বা ‘প্যাট্রন স্টেটস’-এর জগতে চলে গেল, যেখানে যার ক্ষমতা আছে, অথবা যার সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা আছে, তার বক্তব্যই টিকে থাকবে।

‘ইউরোপীয় অহংকার’ ইউরোপকে ধ্বংসের কাছে নিয়ে গেছে। এ অবস্থায় ইউরোপকে নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্য ভাবার কোনো বিকল্প নেই। এর মধ্যে সেই আলোচনা ইউরোপে শুরু হয়েছে। ইউরোপের নেতারাই বলছেন এতদিন যে নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা ছিল তা আর থাকছে না। এ জন্যই হয়তো কানাডাকে ৫১তম প্রদেশ বানানো, পানামা খাল দখল করা, গ্রিনল্যান্ড কিনে নেয়া আর গাজার মালিকানা গ্রহণের কথা বলছেন ট্রাম্প। জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থা থেকে এক এক করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ট্রাম্প।

[email protected]

 


আরো সংবাদ



premium cement