২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮ ফাল্গুন ১৪৩১, ২১ শাবান ১৪৪৬
`

পাঁচ ফেব্রুয়ারি : বিপ্লবের সাতকাহন

-

গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেল। পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পৈতৃক বাড়ি ‘ধানমন্ডি-৩২’ গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই সাথে দেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ঘটনায় দেশে-বিদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তাই এ ঘটনার বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। কেন এমন ঘটনা অভ্যুত্থানের ছয় মাস পর হলো এবং এর প্রভাবই বা কি সেই আলোচনা হওয়া জরুরি বলে মনে হয়েছে। যাতে এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশ স্থিতিশীল রাখা যায়।

প্রথমে বলতে হবে হাসিনার বক্তব্যের কারণে এ বিস্ফোরণ ঘটতে পেরেছে। গত ছয় মাসে তার বহুবিধ বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড ছাত্র-জনতার ক্ষোভের আগুনে বিদ্বেষের ঘি ঢাললেও এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। গত ৫ ফেব্রুয়ারি হাসিনার ছাত্রলীগের ওয়েব পেজে বক্তব্য দেয়ার ঘোষণার সাথে সাথে ফ্যাসিবাদবিরোধীদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। ছাত্রলীগকে গত ১৫ বছর তরুণরা হিংস্র্র হায়েনার মতো দেখেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিষ্ঠুরভাবে শিক্ষার্থী নির্যাতন চালিয়েছে ছাত্রলীগ। বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। নিজেরা আধিপত্যের লড়াইয়ে খুনোখুনি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা একরকম ছাত্রলীগের বন্দিশালায় আবদ্ধ থেকেছেন। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত করেছিল ছাত্রলীগ। অন্য দিকে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণসহ হেন অপকর্ম নেই যা করেনি। ফলে সাধারণ জনগণও প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন ছাত্রলীগের ওপর। তদুপরি বর্তমানে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ হয়েছে। এ নিষিদ্ধ ও ঘৃণ্য ছাত্র সংগঠনের ওয়েব পেইজে হাসিনার বক্তৃতা কোনোভাবে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা মেনে নিতে পারেননি। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ফেব্রুয়ারিজুড়ে বিভিন্ন উত্তেজনাকর কর্মসূচির ডাক দিলে তা জনমনে সন্দেহ সংশয়ের সৃষ্টি করে। এর মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংগঠনের ওপর ভর করে পতিত স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা দেশে একের পর এক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। আনসার বিদ্রোহ, উচ্চ আদালতে আজ্ঞাবহ বিচারপতিদের ব্যর্থ বিচারিক অভ্যুত্থান, ইসকনের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, আওয়ামী লীগের হিন্দু সম্প্রদায়ের আবরণে রাজপথে অসত্য হিন্দু নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন, সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার অপচেষ্টা হয়েছে একের পর এক। সচেতন মহলের মতে, হাসিনা এবং দেশে অবস্থানরত তার অনুসারীদের মাধ্যমে এসব অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। এসব সফল করতে তারা ১৬ বছরের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ অর্থ ব্যয় করছে। সেই সাথে ভারতের হস্তক্ষেপে এসব ঘটছে বলে দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রমাণও রয়েছে। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগের ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী কর্মসূচির ঘোষণা মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। ফলে আগস্ট অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। তাদের ধারণা, আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন বা পুনরুত্থান নির্ঘাত তাদের সমূলে ধ্বংসের কারণ হতে পারে। সুতরাং তারা আওয়ামী লীগের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত ‘ধানমন্ডি-৩২ নম্বর’ গুঁড়িয়ে দেন।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গত ছয় মাসে অভ্যুত্থানের আগের ও পরের বিভিন্ন বীভৎস ভিডিও ফুটেজ দেখছেন দেশবাসী। হৃদয়বিদারক এসব ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। এগুলো দেখে মানুষ আঁতকে উঠছেন। তারা বিশ্বাস করতে পারছেন না আওয়ামী লীগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কিভাবে নিজ দেশের তরুণ-কিশোর ছাত্র-জনতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে! এসব অমানবিক দৃশ্য মানুষের ক্ষোভ তীব্রতর করেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর যত দিন গড়াচ্ছে; তত পতিত সরকারের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুট, মেগা প্রকল্পের অর্থ লুটে কোটি কোটি ডলার বিদেশে পাচার করেছেন হাসিনার সাঙ্গপাঙ্গ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। হাসিনা স্বয়ং এবং তার আত্মীয়স্বজনের দুর্নীতির বিশাল চিত্র মানুষকে আরো ক্ষুব্ধ করেছে। বিলাসবহুল রিসোর্ট, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, প্লট, ফ্ল্যাটে দুর্নীতি, বিদেশে বাড়িঘর ক্রয় ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে শেখ পরিবার দুর্নীতিতে জড়িত ছিল বলে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। হাসিনা, তার বোন রেহানা, বোনের ছেলে ববি, তার নিজের ছেলে জয়ের বিরুদ্ধে এসব দুর্নীতির ফিরিস্তি উঠে আসছে সংবাদমাধ্যমে। সেই সাথে দেশের মানুষ জানতে থাকলেন ‘আয়নাঘরের’ হৃদয়বিদারক কাহিনী। আয়নাঘর থেকে ফিরে আসা ‘ভিকটিম’রা যেসব লোমহর্ষক নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন, তাতে দেশবাসী স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। হাসিনার হিংস্রতা ও হৃদয়হীনতা উন্মোচিত হতে থাকে। এতে করে দেশের মানুষের ক্ষোভ ও ঘৃণা সমান তালে বাড়তে থাকে।

পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর মাঝে মধ্যে হাসিনার গোপন ফোনালাপ ফাঁস হতে থাকে। বোদ্ধাদের ধারণা, ঠাণ্ডামাথায় এসব ফোনালাপ ধারণ করে মিডিয়ায় ছাড়া হতে থাকে! ফোনালাপে হাসিনার মিথ্যাচার, অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে প্রতিশোধের হুমকি, ছাত্র-জনতাকে আরো উত্তেজিত করতে থাকে। ফ্যাসিবাদবিরোধী শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেন হাসিনা বা আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনে তাদের ধ্বংস অনিবার্য!

ইতোমধ্যে ভারতের সাথে গত ১৫-১৬ বছরে করা হাসিনার বিভিন্ন চুক্তির অসমতার খবর প্রকাশিত হতে থাকে। আদানির সাথে চুক্তি, সীমান্তে শূন্য রেখায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের অনুমোদনের চুক্তি, বিনাস্বার্থে নিঃশর্তভাবে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট দেয়া, ফেনী নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহারের অনুমোদন এবং সর্বশেষ তিস্তা প্রকল্প বিষয়ে চীন থেকে সরে ভারতকে দেয়ার সিদ্ধান্ত ইত্যাদি জানতে পেরে মানুষ বুঝে নেন কিভাবে হাসিনা সর্বস্ব উজাড় করে ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছেন। পতনের কয়েক দিন আগে ভারতকে রেল ট্রানজিটের নামে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়ার ভয়াবহ চুক্তিতে মানুষের ক্ষোভ হাসিনার প্রতি তীব্র ঘৃণায় রূপ নিয়েছে।

সাড়ে ১৫ বছর ধরে ভারতের আধিপত্যবাদে দেশবাসীর ক্ষোভ চরম পর্যায়ে পৌঁছে। সেই ভারতে হাসিনা আশ্রয় নিয়ে দিল্লির প্রশ্রয়ে এসব দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন। ফলে ভারত ও হাসিনা বিরোধিতা দেশবাসীর কাছে সমার্থক হয়ে পড়েছে।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী ভারতের দুষ্টু আচরণ, হাসিনাকে অন্ধ সমর্থন, বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা, কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত নাক গলানো এসব নিয়ে বাংলাদেশবাসীর ভারতবিরোধী ক্ষোভ হাসিনা ও আওয়ামীবিরোধী ক্ষোভে রূপান্তরিত হয়। তা ছাড়া দেশবাসী বুঝতে পারছেন, একমাত্র ভারতের অন্যায় হস্তক্ষেপে হাসিনাকে দেশে এনে সুবিচারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না। ভারত নিজের বড়ত্ব ও শক্তিমত্তা দিয়ে হাসিনাকে আগলে রাখছে। ভারত ও হাসিনার প্রতি এ ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ে ‘৩২ নম্বর’ বাড়ির ওপর। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেড় হাজারেরও বেশি ছাত্র-জনতা হত্যা এবং আড়াই হাজারের বেশি মানুষের পঙ্গুত্ববরণের যে নৃশংস ঘটনা ঘটেছে তা হাসিনার নির্দেশেই হয়েছে, এটি পরিষ্কার। কিন্তু এ নিয়ে হাসিনার কোনো অনুশোচনা, পাপবোধ বা সহমর্মিতা তো নয়ই; বরং তার সেই আগের অহমিকা, আত্মম্ভরিতা আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য দেশের মানুষকে আহত করেছে। সেই সাথে হাসিনাকে সশরীরে বিচারের আওতায় আনতে না পারার হতাশা থেকে ছাত্র-জনতার পুনঃবিস্ফোরণ ঘটেছে ৫ ফেব্রুয়ারি। ফলে গত ১৫ বছর যে বাড়িটিকে নিউক্লিয়াস করে হাসিনা দেশে ফ্যাসিজম চালিয়েছেন, শোষণ করেছেন, অত্যাচার-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য বানিয়েছেন; সেই বাড়িটি জনরোষের নিশানায় পরিণত হয়। তা ছাড়া অনেকে মনে করেন, এ বাড়ির দোহাই দিয়ে হাসিনা দেশে আওয়ামীবাদ নামের ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিলেন। ফলে বাড়িটিই ছাত্র-জনতার কাছে ফ্যাসিজমের প্রতীকে পরিণত হয়ে পড়েছিল। সবশেষে হাসিনার ৫ ফেব্রুয়ারির বক্তব্য সেই জনরোষের আগুন জ্বালানোর সূত্রপাত করেছিল।

ছাত্র-জনতার ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু ‘ধানমন্ডি-৩২ নম্বর’ হলেও দেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, গত ৫ ফেব্রুয়ারির ‘সম্প্রসারিত অভ্যুত্থান বা বিপ্লব’ দেশের রাজনীতি ও আর্থসামাজিক পরিক্রমায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। এ পদাঙ্ক অনুসরণ করে গোষ্ঠীস্বার্থ কায়েমে কোনো কুচক্রী মহল কখনো যেন মব-কালচারের অনুশীলনে নামতে না পারে। ভারত এমনিতে প্রোপাগান্ডার ঝুলি নিয়ে বসে আছে। এতে তারা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশবিরোধী নেরেটিভে শক্তিশালী উপাদান যোগের অপপ্রয়াস পেতে পারে।

ন্যায়-অন্যায়ের বিষয়টি বিতর্কের বাইরে রেখে বলা যায়, এ ঘটনার কিছু প্রভাব পড়তে পারে। প্রথমত, ভবিষ্যতে যারা এ দেশে রাজনৈতিক সরকার গঠন করবেন তাদের জন্য এটি ‘জেন-জেড’-এর ফ্যাসিবাদবিরোধী একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা যেকোনো সময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেকোনো কিছু ঘটানো সম্ভব। কাজেই জনগণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি অনুশীলন দেখিয়েছেন। এ ঘটনা আওয়ামী লীগের জন্যও একটি কড়া সতর্কবার্তা দিয়ে গেল; অর্থাৎ ছয় মাস ছাত্র-জনতা আওয়ামী লীগ ও এর নেত্রীর কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এমনটি ঘটেছে।

দেশের নাগরিক সমাজ এ ধরনের কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত বোধ করে না। কিন্তু কোনো গোষ্ঠী দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করলে প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সে সম্পর্কে এ ঘটনা আগামীতে নমুনা হিসেবে কাজ করবে। কাজেই সরকারসহ সব পক্ষকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
e-mail : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement