২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭ ফাল্গুন ১৪৩১, ২০ শাবান ১৪৪৬
`

ভাষা আন্দোলনের অয়োময় প্রত্যাশা

লেখক : ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ - ছবি : নয়া দিগন্ত

৭৩ বছর আগে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি রাষ্ট্র্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায় এবং এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে যে আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল তার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব বাংলার সমাজে এক নতুন চেতনা ও মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। বায়ান্নর একুশে ফেব্র“য়ারিতে এ অয়োময় প্রত্যয় অর্জিত হয় যে, জাতি হিসেবে এ দেশ ও সমাজের সার্বিক আর্থসামাজিক ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যবহার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা।

ভাষা-কৃষ্টি প্রত্যেক জাতির প্রকৃষ্ট সম্পদ, তার রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক জীবনযাপনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের, সাবলিল স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনের এবং স্বনির্ভর জাতিসত্তার পরিচিতি লাভের একমাত্র সনদ। আর তাই যখনই আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষার ওপর শত্র“রা আঘাত হেনেছে তখনই আমরা রুখে দাঁড়িয়েছি। যেহেতু ভাষা বা সংস্কৃতি থেকে পৃথক হয়ে জাতি হিসেবে আমাদের কোনো অস্তিত্ব ভাবা সম্ভবপর ছিল না, সেহেতু আমরা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বাধীকার আদায়ের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। তৎকালীন সমাজে বাংলাভাষীরা রাজনৈতিক চেতনায় বেশ প্রখর ছিল না। কিন্তু একুশে ফেব্র“য়ারি তাদের সে মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিল- সন্দেহ নেই। ভাষার স্বাধিকার আদায় থেকে শুরু করে একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি আমরা তাই পরবর্তীকালে করেছিলাম। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা কতখানি প্রখরতা পেলে আমরা এতখানি পথ পরিক্রমের স্বপ্ন দেখেছিলাম এবং পথ পাড়িও দিয়েছি তার মর্ম উপলব্ধির মধ্যে একুশের চেতনার মাহাত্ম্য নিহিত।

ঔপনিবেশিক শাসনামলে অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে পূর্ব বাংলার জনগণ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে। দীর্ঘকাল বিদেশী শাসন ও শোষণে বিপর্যস্ত এদেশের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় মৌল পরিবর্তনের প্রত্যাশা ও প্রয়াসও দীর্ঘ দিনের। এদেশের রাজনীতি মূলত এবং মুখ্যত আপামর জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় বৈষম্য দূরীকরণের দাবি ঘিরে, বিশেষ করে মুখের ভাষা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অনির্বাণ আকাক্সক্ষা ঘিরে দানা বাঁধে। সেই আকাক্সক্ষা পূরণে সফলতা-ব্যর্থতার দায়ভার রাজনৈতিক অর্থনীতির নীতি নির্ধারকের। কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণে দূরদর্শিতার অভাব এবং আত্মস্বার্থবাদী ও গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গিতে জাতীয় ঐকমত্যের অভাবজনিত পরিবেশে জাতীয় অর্থনীতির সার্বিক সমৃদ্ধি সাধনের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ব্যাহত হয়ে থাকে। এহেন অপারগ পরিস্থিতিতে অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম্ভাবনাময় হয়েও বাংলাদেশও বাঞ্ছিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে পুরোপুরি সফল নয়।

একুশে ফেব্র“য়ারি শুধু আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা দিয়েছিল তা নয়; জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অর্থনীতির স্বয়ম্ভরতা অর্জনের একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও করেছিল। একুশের চেতনা এমনই প্রগতিশীল ছিল, এমনই প্রগাঢ় ছিল যে যার জন্য স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম আমরা সবাই।

একুশের ভাবধারা প্রথম দিকে ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীকালে তা দেশের আপামর জনসাধারণকেও স্পর্শ করেছিল। একুশ আমাদের যে চেতনা ও মূল্যবোধ উপহার দিয়েছিল- তা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, স্বৈরাচারের পতনকার্যে একতাবদ্ধভাবে অংশ গ্রহণ করতে, নিপীড়িত জনগণের পাশে এসে দাঁড়াতে এবং সর্বোপরি মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে।

একুশের চেতনা আমাদের সাহিত্যাঙ্গনেও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জাতীয়তাবাদী সাহিত্যের পাশাপাশি গণমুখী সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন আমাদের কবি-সাহিত্যকরা। সাহিত্যধারায় এক নবযুগের সূচনা হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। একুশের চেতনা তাই স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে আমাদেরকে একটি মহান আত্মপ্রত্যয়ী, স্বধর্মে নিষ্ঠাবান এবং স্ব-ঐতিহ্যের পরম পূজারী/অনুরাগী জাতিতে পরিণত হওয়ার মহাশিক্ষা দিয়েছিল। একুশ ঘিরে শোষণ, বঞ্চনা অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের যে মহামন্ত্রে আমরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ একাত্তরের সফল মুক্তি সংগ্রাম।

একুশের চেতনা কোনো অচল অনুভূতির নাম নয়; বরং সচল প্রগতিবাদ এর ভিত্তি। মূল্যবোধ উৎসাহ দেয় পুরাতন জীর্ণ ঘুণেধরা রীতি-রেওয়াজের পরিবর্তন সাধনে। উৎসাহ দেয় বিপ্লব করতে, বিদ্রোহ করতে- ওই সব বিবাদ বিসম্বাদের বিরুদ্ধে যা মানুষের আসল পরিচয় মনুষ্যত্ব হত্যা করে। বিদ্রোহ বিপ্লব তাই নতুন নতুন মূল্যবোধের জন্ম দেয়। আবার মূল্যবোধও বিপ্লবের-বিদ্রোহের সূচনা করে। মূল্যবোধ সৃষ্টির এটি সাধারণ এবং স্বাভাবিক নিয়ম হলেও অনেক সময় পরিবেশের অশুভ হাওয়া যে মূল্যবোধের জন্ম দেয় তা কোনোমতেই কল্যাণকর হতে পারে না; বরং তা ডেকে আনতে পারে মানব ভাগ্যের অশুভ পরিণতিকে।

সমাজে যখন নতুন মূল্যবোধের জন্ম হয় তখন পুরনো মূল্যবোধ ভেঙে যায়। এভাবে চলতে থাকে মূল্যবোধের ভাঙাগড়া পর্ব। যেহেতু এ সমাজের আবহাওয়া, পরিবেশ, প্রতিবেশ সদা পরিবর্তনশীল সেহেতু মূল্যবোধের নবমূল্যায়ন ঘটবে যুগে যুগে কালে কালে বিভিন্ন ঘটনা পরিক্রমায়; এটিই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু কখনো যদি এ গতিধারা ব্যাহত হয়, অর্থাৎ পুরনো মূল্যবোধের সংস্কার না হয় বা যুগের প্রয়োজনে নতুন মূল্যবোধের জন্ম না হয়, তাহলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা দেখা দেয়।

সামাজিক কাঠামো বা শ্রেণিভেদ অনড় থাকলে বা পরিবেশ তাড়িত অশুভ আবহাওয়ার কুলক্ষণে কুলগ্নে পড়লে পুরনো মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়। নতুন মূল্যবোধ জন্ম হওয়া তো দূরের কথা, পুরনো মূল্যবোধ জিইয়ে রাখার পরিবর্তে তার অবক্ষয় শুরু হলে তার চেয়ে শোচনীয় পরিণতি আর হতে পারে না। বলা বাহুল্য, একুশ শতকের শুরু কিংবা তার আগে থেকে যেন দেশে-বিদেশে সমাজ-অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতিতে প্রতিষ্ঠিত নানান মূল্যবোধের বহুমুখী ও ব্যাপক ভাঙাগড়া পরিলক্ষিত হচ্ছে।

মূল্যবোধ যদি কখনো অকল্যাণকর হয় তা হচ্ছে ওই সময়েই যখন পুরনো মূল্যবোধের সংস্কার করা বাদ রাখা বা প্রকারান্তরে তার অবক্ষয় হতে দেয়া। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মাঝে মধ্যে আমরা তেমনি এক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছি। দুঃখের কথা, যে মহান মূল্যবোধ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল; স্বাধীনতা লাভের পরে আমরা তা হারাতে বসেছিলাম। স্বাধীনতা আদায়ে আমাদের যে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া তা ঐতিহাসিক হলেও স্বাধীনতা রক্ষায় বা স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের অপারগতা অক্ষমতা মাঝে মধ্যে পরম দুঃখের বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমাদের সেই সব মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছে যা একদিন আমাদের উজ্জীবিত করেছিল এক মহান আদর্শে। আমরা মূল্যবোধের জন্ম দেইনি বা নবমূল্যায়ন করিনি- যা কিনা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।

কিভাবে এবং কেন আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছে তার ব্যাখ্যা এ প্রসঙ্গে করাটা যুক্তিযুক্ত বৈকি। তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের আগ্রাসী নীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি এবং ঐতিহ্য হত্যাকারী মনোভাবের বিরুদ্ধে আমরা কণ্ঠ সোচ্চার করেছিলাম। সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। তদানীন্তন সরকারের গোটা প্রশাসন যন্ত্র ছিল নানা প্রকার হীনতাদুষ্ট। বস্তুগত দৃষ্টিতে এসব থেকে মুক্ত এবং রহিত এবং শোষণহীন সমাজ গঠনই ছিল আমাদের সেদিনকার সংগ্রামের মূল মেনিফেস্টো। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের পর ৭৩ বছরে এবং স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে আমরা সে সবের বাস্তবায়নের কতটুকু সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি- এ মুহূর্তে তা বিবেচ্য। শোষক সমাজের স্বভাব পাল্টেছে কিনা দেখার বিষয়।

দেশের সাধারণ মানুষ একদিন এ শোষণনীতি থেকে মুক্তি পেতে সংগ্রাম করেছিলেন- আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যদি দেখা যায় শোষণ চলছে, অর্থনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্য দুর্দশা দূর হয়নি; বরং বেড়েছে, যদি দেখা যায় সমাজে নিঃস্ব আরো নিঃস্ব হয়েছে; আর বিত্তশালী আরো বিত্তশালী হয়েছে। সাধারণ মানুষ হতভাগার মতো এসব দেখতে দেখতে তাদের আগের সেই মূল্যবোধ যাবে হারিয়ে।

আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে বিদেশী ভাষা ও সঙ্গীত সাহিত্যের অনাকাক্সিক্ষত অনুপ্রবেশ, নানান উপায়ে যদি চলে অর্থনৈতিক আগ্রাসন, স্বনির্ভর ও স্বয়ম্ভরযোগ্য অর্থনীতি পঙ্গু করতে যদি চলে অধীন করার কূটপ্রয়াস, জনগণের কথা বলে গণ-অধিকারের অপব্যবহার, জনসেবার নামে যদি জনগণের হয়রানি বেড়ে চলে তাহলে একুশের মূল্যবোধ মূহ্যমান হয়ে পড়বে। সবাই দেখছেন শিক্ষায় অরাজকতা অনুপ্রবেশ করেছে, প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ আজ যেন অনিমেষ যাত্রী, আদর্শ ছাড়া, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেই সেই পবিত্র সম্বন্ধ। বড় দুঃখের হলেও বলতে হয়, একদিন যে কবি সংস্কৃতিকর্মী শিক্ষক বুদ্ধিজীবী আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার, লিখেছিলেন এন্তার কবিতা ও গান, মেধা ও মনন দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন প্রতিরোধের দেয়াল, তারাও যেন ভিন্ন পথযাত্রী সেজে নির্বিকার দর্শকের ভূমিকায়। তারা দ্বিধাবিভক্ত, দলীয় শ্রেণিগত অনিরপেক্ষতায় কোণঠাসা।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তেমন উল্লেখযোগ্য সৃজনশীল সাহিত্য চলচ্চিত্র গান রচিত হয়নি। যেমন হয়েছিল স্বাধীনতা-পূর্ব কালে। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সে অর্থে তেমন উল্লে­খযোগ্য কোনো জয়যাত্রা সূচিত হয়নি; বরং অপাঙ্তেয় অগ্রহণযোগ্য বিদেশী সংস্কৃতির বিকৃত উচ্চারণের অভিলাষ যেন অবিরত। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা নির্মল নয়, নয় অর্থবহও। অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত করে কিংবা উদাসীন থেকে কোনো প্রয়াস প্রচেষ্টা অর্থবহ পরিণতিতে নিয়ে যাওয়া দুষ্কর।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement