২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭ ফাল্গুন ১৪৩১, ২০ শাবান ১৪৪৬
`

দালাই লামা ও তিন বিশ্বশক্তির রাজনীতি

লেখক : মো: বজলুর রশীদ - ছবি : নয়া দিগন্ত

বর্তমান দালাই লামা, তেনজিন গিয়াতসো একজন আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি চতুর্দশ দালাই লামা এবং তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক কর্তৃপক্ষ। তবে তার ভূমিকার উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক মাত্রাও রয়েছে। বিশেষত তিব্বতের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতে। ২০১১ সালে দালাই লামা তার রাজনৈতিক ভূমিকা থেকে অবসর নেন এবং কেন্দ্রীয় তিব্বত প্রশাসনের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতার কাছে তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হস্তান্তর করেন। এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল তিব্বতি জনগণের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব পৃথক করা। সুতরাং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার রাজনৈতিক ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।

বৌদ্ধধর্ম বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে, বিভিন্ন অনুশীলন ও ঐতিহ্য ধর্মীয় ভিত্তিতে যোগ হয়েছে। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মকে বজ্রযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বলা হয়। এই ঐতিহ্যের মধ্যে আচার, ধ্যান, মণ্ডল ও মন্ত্র ব্যবহারের মতো অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জাপানে রয়েছে জেন ও বিশুদ্ধ ভূমি বৌদ্ধধর্ম। জেন বৌদ্ধধর্ম ধ্যান বা জাজেন এবং জ্ঞানের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিশুদ্ধ ভূমি বৌদ্ধধর্ম অমিতাভ বুদ্ধের প্রতি ভক্তি ও আনন্দের রাজ্য, বিশুদ্ধ ভূমিতে পুনর্জন্মের আশার ওপর জোর দেয়। মিয়ানমারে আছে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম। থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম হলো প্রধান রূপ, যা পালি ক্যানন ধর্মগ্রন্থ ও সন্ন্যাসী জীবনের ওপর জোর দেয়। অনুশীলনগুলোর মূলে রয়েছে ধ্যান, নৈতিক আচরণ ও স্বতন্ত্র প্রচেষ্টার মাধ্যমে নির্বাণের সাধনা।

বর্তমান দালাই লামার পরবর্তী যিনি ‘দালাই লামা’ হবেন সে ‘উত্তরাধিকার’ নিয়ে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও তিব্বতি বৌদ্ধদের একাংশের ভেতর দীর্ঘদিনের বিরোধ, বাগবিতণ্ডা ও রাজনৈতিক টানাপড়েন চলে আসছে। উত্তরাধিকার আকর্ষণীয় ও জটিল প্রক্রিয়া। সেটি ভিন্ন আলোচনা। বাছাই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ সময় নিতে পারে। কারণ এটি একটি গভীর আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। তবে এটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিব্বত এখন চীনাদের হাতে, তারা চাইছে দালাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচনে যেন তাদের মতামত উপেক্ষিত না হয়।

পরবর্তী দালাই লামা নির্বাচন নিয়ে চীনের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। চীনা সরকার তিব্বতি নব অবতারদের নির্বাচন এবং অনুমোদন প্রক্রিয়ার জন্য একটি বিশদ পদ্ধতিগত প্রয়োজনীয়তা আরোপ করেছে, যার মধ্যে তিনটি প্রধান নীতি রয়েছে : ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন। ২০০৭ সালে চীন ‘তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে জীবিত বুদ্ধদের পুনর্জন্ম’ সম্পর্কিত পদক্ষেপ পাস করেছে, প্রক্রিয়াটির ওপর তাদের কর্তৃত্ব জারি করেছে। এ ব্যবস্থা অনুসারে চীন সরকারকে অবশ্যই যেকোনো পুনর্জন্মের অনুমোদন দিতে হয়। এটি উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে, কারণ বর্তমান দালাই লামা, তেনজিন গিয়াতসো জানান যে এই বিষয়ে চীনা সরকারের কোনো বক্তব্য থাকা উচিত নয়। চীন সরকারের সম্পৃক্ততাকে তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং নির্বাচনটি তার রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দালাই লামা ইস্যুতে সক্রিয়ভাবে জড়িত। প্রাথমিকভাবে তিব্বতের অধিকারের জন্য কূটনৈতিক সমর্থন দিতে এবং তিব্বতিদের বিষয়ে জনমত সৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই সরব। স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও হোয়াইট হাউজের প্রতিনিধি ও সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তারা একাধিকবার দালাই লামার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। এসব বৈঠকে তিব্বতিদের মানবাধিকার এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। মার্কিন কংগ্রেস দালাই লামা ও তিব্বতের আকাঙ্খাকে সমর্থন করে বেশ কয়েকটি বিল পাস করেছে। যেমন- ‘রিজলভ তিব্বত আইন’ মার্কিনিরা চীনকে বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য দালাই লামার সাথে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন সরকার ধারাবাহিকভাবে তিব্বতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং চীনকে তিব্বতিদের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণে সহায়তা করা। তিব্বতিদের অধিকারের পক্ষে প্রচার এবং তিব্বতের পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথেও কাজ করছে। এতে কখনো কখনো চীনের সাথে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দালাই লামা ইস্যুতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিনি ঞরনবঃধহ চড়ষরপু ধহফ ঝঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ অপঃ, তিব্বত নীতি ও সহায়তা আইনে স্বাক্ষর করেন। এ আইনটি তিব্বতিদের দালাই লামার নিজস্ব উত্তরাধিকারী বেছে নেয়ার অধিকার আবার নিশ্চিত করে এবং তিব্বতে একটি মার্কিন কনসুলেট প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। পরবর্তী দালাই লামা যাতে চীনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই শুধু তিব্বতের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দ্বারা নিযুক্ত হন তা নিশ্চিত করাই এর লক্ষ্য। তবে চীন এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। চীন সরকার ও রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দালাই লামার বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু করে, তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং আন্তর্জাতিক চীনবিরোধী শক্তির হাতিয়ার বলে অভিযুক্ত করে। তারা তিব্বতে সামাজিক অস্থিরতার জন্য দালাই লামাকে দোষারোপ করে নেতিবাচক নিবন্ধগুলো আবার প্রকাশ শুরু করে। উপরন্তু তিব্বতের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দালাই লামার ছবি সরিয়ে চীনা নেতাদের ছবি প্রতিস্থাপন করে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এ আইনটি তিব্বতের বিচ্ছিন্নতাবাদী উপাদানগুলোকে গুরুতর সঙ্কেত পাঠিয়েছে এবং দৃঢ়ভাবে এর বিরোধিতা করেছে। এটি স্পষ্ট যে, চীন ট্রাম্পের এ কাজটিকে তিব্বতের ওপর তাদের কর্তৃত্বের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে এবং পুশব্যাকের পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

দালাই লামার উত্তরাধিকারে ভারতের স্বার্থ রয়েছে বেশ কয়েকটি। ১৯৫৯ সাল থেকে নির্বাসিত দালাই লামার ভারতে উপস্থিতি এবং তিব্বতি সরকারের উপস্থিতি ভারত ও তিব্বতি সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বন্ধন শক্তিশালী করেছে। দালাই লামার কেন্দ্রীয় তিব্বতি প্রশাসন নিয়ে চীন ভারতের ওপর ক্ষিপ্ত। দালাই লামা এবং তিব্বতের পক্ষে ভারতের সমর্থনকে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব প্রতিহত করার উপায় হিসেবে দেখছে চীন। ভারত মানবাধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে ওকালতি করাকে একটি শক্তিশালী কৌশল মনে করে। তিব্বত মালভূমি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভারতের আগ্রহ রয়েছে। ভারতে দালাই লামার প্রভাব এবং তিব্বতি সম্প্রদায়ের উপস্থিতি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তায় অবদান রাখবে বলে ভারত মনে করে। দালাই লামা ইস্যুতে ভারতের সম্পৃক্ততা বহুমুখী, যা ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের মিশ্রণ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলতি ১৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের কর্নাটকে দালাই লামার দীর্ঘায়ুর জন্য সাধু ও লামার বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

তিব্বতি জনগণ দালাই লামার নির্বাচন ও উত্তরাধিকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে তাদের জড়িত থাকার কয়েকটি মূল দিক রয়েছে। প্রক্রিয়াটি ঐতিহ্যগতভাবে আধ্যাত্মিক দর্শন এবং লক্ষণের সাথে শুরু হয় যা পুনর্জন্মের সন্ধানকে পরিচালিত করে। সন্ন্যাসী এবং উচ্চস্তরের লামারা সম্ভাব্য প্রার্থীদের শনাক্ত করতে এই লক্ষণগুলো ব্যাখ্যা করেন। দালাই লামার বংশের ধারাবাহিকতা এবং বৈধতা বজায় রাখার জন্য তিব্বতি জনগণের সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিব্বতি জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে যে বাছাই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক চাপ সত্তে¡ও তাদের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে নিহিত থাকবে।

চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সম্পর্কে তিব্বতি জনগণের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে জটিল ও বৈচিত্র্যময়। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে অনেক তিব্বতির চীনের সাথে বিতর্কিত সম্পর্ক রয়েছে। তিব্বতের ওপর চীনা সরকারের নিয়ন্ত্রণ, ধর্মীয় অনুশীলন এবং সাংস্কৃতিক মতপ্রকাশের ওপর বিধিনিষেধসহ তিব্বতিদের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও অবহেলিত তিব্বতে রেলপথ, বিদ্যুৎ ও চীনা বাজারের প্রচুর সরবরাহ ও তিব্বতিদের জীবনমান উন্নয়নের কারণে তিব্বতিরা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তিব্বত চীনাদের ভ্রমণের হটস্পট হওয়ায় তিব্বতিদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ২০২১ সালের হিসাবে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের বাসিন্দাদের মাথাপিছু আয় ছিল ২৪ হাজার ৯৫০ ইউয়ান, প্রায় তিন হাজার ৯৩৬ ডলার। পাঁচ বছর আগে ২০১৬ সালে, মাথাপিছু আয় ছিল ১৭ হাজার ৬২২ ইউয়ান, প্রায় দুই হাজার ৭৮০ ডলার; বছরে ১৪.৭ শতাংশ বৃদ্ধি। এটি স্পষ্ট যে, বিগত পাঁচ বছরে তিব্বতে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক বিকাশ হয়েছে। সবই চীনের কারণে।

তিব্বতিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইতিবাচকভাবে দেখে, বিশেষ করে তাদের অধিকার এবং মানবাধিকার বিষয়গুলোর প্রতি সমর্থন এবং ওকালতির কারণে। ভারত সরকার ও জনগণ তিব্বতিদের সমর্থন ও আশ্রয় দিয়ে, কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে। ভারতের এ পদক্ষেপে চীনবিরোধী মনোভাব রয়েছে এবং ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত। মূলত বিশাল তিব্বতের মতো কৌশলগত ভূখণ্ডকে নিরাপত্তার কাজে ব্যবহারের জন্য তিনটি বিশ্ব শক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে। এর মধ্যে চীন অনেকটা সফলকাম।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement