সংবিধান সংস্কারে পরিত্যক্ত ‘সমাজতন্ত্র’ পরিত্যাগ
- ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব
- ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০:৪১
সম্প্রতি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি প্রতিনিধিদল কমিউনিস্ট চীন সফর করে এসেছে। চীন সরকার তাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে যায়। এ ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্পূর্ণ নতুন একটি ঘটনা।
চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪৯ সাল থেকে সে দেশের ক্ষমতায়। যদিও আগের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে বেইজিং বহু দূর সরে গেছে। সমাজতান্ত্রিক দর্শনের কথাও এখন দেশটির নেতাদের মুখে আর শোনা যায় না। বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে উৎসাহিত করা বা সেসব দেশের বামপন্থী দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায়ও আগের মতো একপেশে নীতি থেকে চীন পিছিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বামপন্থী রাজনীতিক হিসেবে চীন সফর করেছিলেন ষাটের দশকে। এরপর বাংলাদেশের বাম রাজনীতির চীনপন্থী ধারাকে তারা সমর্থন ও সহযোগিতা করত। সেসব এখন ইতিহাস। বিশ্ব রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা এখন অনেকাংশে উদার নীতি অনুসরণ করছেন। তারা পররাষ্ট্রনীতিতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাল্লা দিচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলের বিপরীতে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে চীনের বিশাল বিনিয়োগ দেখে এর যৌক্তিকতা বোঝা যায়। চীন একদিকে মার্কিনবিরোধী ইরানের সাথে সখ্য-সহযোগিতার শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলেছে; অন্যদিকে আফগানিস্তানে তালেবানের সাথে কার্যকর কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়েছে। বেইজিং ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার তিক্ত সম্পর্ক উন্নয়নে দূতিয়ালির কাজ করে সফল হয়েছে। ফিলিস্তিনে মার্কিন-ইসরাইলি আগ্রাসনকে মুসলিম বিশ্বের মতো নিন্দা করছে। তাই জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের চীনে আমন্ত্রণ জানানোয় বিস্ময়ের মনে হয়নি। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী শক্তিগুলো জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে, তা মূল্যায়ন করে এ উপসংহারে পৌঁছা অযৌক্তিক নয় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীরা একটি সম্ভাবনাময় শক্তি, যাকে উপেক্ষা করা যায় না। আবার জামায়াত ভারতবিরোধী একটি শক্তি হিসেবে পরিচিত বলে চীন দলটিকে কাছে রাখতে চাইছে। শুধু চীন কেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরো কিছু দেশ জামায়াতে ইসলামীকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
আজকের লেখার বিষয় অবশ্য জামায়াতে ইসলামী নয়; বরং চীন, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের নামে যে অরাজকতা এক সময়ে চলেছিল এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না সে ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোর জন্য পেছনের কথা টেনে আনা। বিশেষ করে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রের নামে দেশে যে ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল; সে কথাগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরতে চাই আমরা।
বিশ্বের ইতিহাসে বিংশ শতকের কমিউনিস্ট বিপ্লব ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। কমিউনিস্ট নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে বিশ্বে সর্বপ্রথম কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয়। কমিউনিজমের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে ‘সর্বহারাদের রাষ্ট্রবিহীন রাজত্ব’ প্রতিষ্ঠা এবং চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছার আগে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হচ্ছে ‘সমাজতন্ত্র’। পুঁজিবাদী শোষণের অবসান, সম্পদের সমবণ্টন আর সর্বহারাদের (প্রোলেতারিয়েত) রাজত্ব কায়েমের আকর্ষণীয় স্লোগানে কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল।
৭০ বছরের সাধনার পরে দেখা গেল, সবই কেবল কুহেলিকা ও প্রতারণা মাত্র। কমিউনিস্ট শাসনে শোষণের অবসান হয়নি, সম্পদের সমবণ্টনের পরিবর্তে দুঃখ-কষ্টের সমবণ্টন হয়েছে আর সর্বহারাদের রাজের পরিবর্তে পার্টি নেতাদের স্বৈরশাসন চলেছে। কমিউনিস্ট নেতাদের ভোগ-বিলাসী জীবন, সীমাহীন দুর্নীতি ও কট্টর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদেরকে বিষিয়ে তুলেছিল। মাত্র ৭০ বছরের ব্যবধানে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজমের পতনের সাথে সাথে কমিউনিস্ট পার্টির কর্তৃত্বেরও অবসান ঘটে।
১৯৪৯ সালে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয়। মাওয়ের কমিউনিজম চীনে উল্লেখ করার মতো উন্নয়ন দেখাতে পারেনি। সাম্প্রতিককালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিজমের নীতি-আদর্শ থেকে সরে এলেও কমিউনিস্ট পার্টির কর্তৃত্ব এখনো বহাল আছে। তবে আগের সেই কমিউনিস্ট পার্টি আর নেই। দলটি একদলীয় কর্তৃত্ব চালালেও আদর্শ হিসেবে আর কমিউনিজম অনুসরণ করে না; বরং ৯০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে (২০১১) দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে : মাও সে তুংয়ের সব অর্থনৈতিক নীতিই ভুল ছিল। তার গৃহীত অর্থনৈতিক নীতির ফলে পুরো সমাজ বিশৃঙ্খলায় নিপতিত হয়। তার নীতির ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি শিল্পনীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে চীন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে।
মার্ক জে পেরি নামে একজন পণ্ডিত বলেছেন, কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র হচ্ছে বিংশ শতকের সবচেয়ে বড় মিথ্যা যা মানবজাতির জন্য বিশেষ কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারেনি। এ মতবাদের প্রবক্তারা মানুষকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হলে সমৃদ্ধি, সমতা ও নিরাপত্তা আসবে। কিন্তু এসব তো আসেইনি; বরং এর পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো দারিদ্র্য, কার্পণ্য ও স্বৈরতান্ত্রিকতার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে।
গণহত্যা বিশেষজ্ঞ রুডলফ জোসেফ রুমেল বলেছেন, ৩০ বছরব্যাপী ক্যাথলিক-প্রোটেস্টান্ট সঙ্ঘাতে ইউরোপে যত মানুষ নিহত হয়েছেন কমিউনিস্ট বিপ্লবে তার চেয়ে অনেক বেশি লোক জীবন হারিয়েছেন। স্টিফেন রোজফিল্ড তার বিখ্যাত ‘রেড হলোকাস্ট’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কমিউনিস্ট বিপ্লবে প্রায় ৭০ লাখ লোক নিহত হয়েছেন। এরূপ হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ্লাদিমির লেনিন ও জোসেফ স্টালিন, চীনের মাও সে তুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, পলপট ও উত্তর কোরিয়ার কিম উল সুং (দ্বিতীয়)। এ ছাড়া ইথিওপিয়ার হাইলে মারিয়াম, রুমানিয়ার চসেস্কু প্রমুখের নামও রয়েছে।
১৯১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ৯৫টি দেশে ছোট-বড় কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। তার মধ্যে ২২টি দেশে সফল হয়ে কিছুকাল টিকে ছিল। প্রায় ৫৫টি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু সফল বা টেকসই হয়নি। মাত্র ১০টি দেশে সমাজতন্ত্রকে সংবিধানে নামমাত্র স্থান দেয়া হয়েছিল; এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। কোনো কোনো দেশে আবার সমাজতন্ত্রকে ফ্যাশন হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। এসব দেশে মতবাদটির প্রতি আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কমিউনিজম তার অন্তর্নিহিত দুর্বলতায় অবশেষে তাসের ঘরের মতো ধসে গেছে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনি আশির দশকে তার একজন দূতকে সোভিয়েত সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে। তিনি একটি চিঠিও পাঠিয়ে ছিলেন এবং তাতে অন্যান্য বার্তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বক্তব্যের মমার্থ ছিল : ‘সমাজতন্ত্র একটি ক্ষয়িঞ্চু মতবাদ, অচিরে তা ধ্বংস হবে এবং কিছুকালের মধ্যে তা শুধু জাদুঘরে পাওযা যাবে।’
ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ সমাজতন্ত্রের সাথে তেমন পরিচিত ছিলেন না। তৎকালীন পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় দলটি জোরেশোরে সমাজতন্ত্রের কোনো প্রচারণা চালাতে পারেনি। শেখ মুজিব ছয় দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে সমাজতন্ত্রের প্রচারণা জমে উঠতে পারেনি। মওলানা ভাসানী ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’কে জনপ্রিয় করে তুলতে চাইলেও তিনি বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। শেখ মুজিব তার ভাষণে মাঝেমধ্যে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও বিশেষভাবে তাতে জোর দিতেন না। মুজিবের জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে বামপন্থী তথা কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেন। মুজিব নিজে যেমন কমিউনিস্ট ছিলেন না, তেমনি তার দল আওয়ামী লীগও সমাজতান্ত্রিক দল ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট ব্লক সমর্থন ও সহযোগিতা করায় এবং যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা করায় স্বাভাবিকভাবে মুজিব ও তার দল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে বন্ধু হিসেবে বেছে নেয়। তার চেয়েও বড় কথা মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। ভারত ছিল তখন সমাজতান্ত্রিক ব্লকের অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ। সুতরাং মুজিবের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক ব্লকের বাইরে যাওয়া সহজ ছিল না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মুজিব যেমন সমাজতান্ত্রিক ব্লকের সাথে থাকতে বাধ্য হন, তেমনি তিনি দেশের অর্থনীতিকেও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের তরুণ নেতৃত্ব সমাজতন্ত্রের মোহে আচ্ছন্ন ছিলেন। তারা হয়তো ভেবেছিলেন, পাকিস্তানের শোষণ থেকে দেশকে মুক্ত করে সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে শোষণহীন সমৃদ্ধ সমাজ ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা যাবে।
শেখ মুজিব সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। অবশ্য এতে সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সব ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান, পাট, টেক্সটাইল ও চিনিকল, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন, বিমান ও বৈদেশিক বাণিজ্যকে জাতীয়করণ করে। বেসরকারি বিনিয়োগসীমা মাত্র ২৫ লাখ টাকায় সীমিত করে দেয়া হয়। জাতীয়করণকৃত সব প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের।
দ্বিতীয়ত, দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত সব পণ্য বিক্রি ও বিতরণ করা হয় সরকার নিযুক্ত ডিলারদের মাধ্যমে, যাদের প্রায় সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থক। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের শুধু আমদানি লাইসেন্স দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের ফলে পরিত্যক্ত ৬০ হাজার বাড়ি আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়। এ সময়ে চোরাচালান ও ত্রাণসামগ্রীর আত্মসাৎ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এর ফলে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বিরাট অংশ দারুণ সম্পদশালী হয়ে উঠে। (সূত্র: তালুকদার মনিরুজ্জামান, দ্য বাংলাদেশ রেভ্যুলেশন অ্যান্ড ইটস আফটার ম্যাথ, ডিসেম্বর-১৯৯০)।
দেশবাসীর সাথে বিশ্ববাসীও বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করে, নবজাতক রাষ্ট্রটি শুরুতে ভ্রান্তনীতি, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে মুখ থুবড়ে পড়ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। আওয়ামী লীগ দেশের কৃষি জমিকেও রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছিল। পরিবার প্রতি ১০০ বিঘার বেশি জমি ব্যক্তিমালিকানা থেকে নিয়ে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। জমির মালিকদের ভূ-সম্পত্তির স্টেটমেন্ট দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে বিশেষ সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থকগোষ্ঠীও এটি পছন্দ করেননি। অবশ্য শেখ মুজিব চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো কৃষি সংস্কারের নামে কৃষকদের উপর দমননীতি চালাননি। তবে তার উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। মুজিব হয়তো বাস্তবতা উপলব্ধি করে ভূ-সম্পত্তি জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করেন। এরূপ সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে ১৯৭৪ সালে কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দেয়। বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতির ফলে দেশে দ্রব্যমূল্য ১৯৬৯ সালের তুলনায় আকাশচুম্বী (৩০০ শতাংশ) বাড়ে। পাশাপাশি জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিতে উৎপাদন ক্ষমতা সক্ষমতার মাত্র ৯ শতাংশ নেমে আসে। দেশের উৎপাদিত মৌলিক পণ্য পাট ও চালের বড় অংশ ভারতে পাচার হয়ে যায়। ১৯৭৪ সালের জুনে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ প্রকাশ্যে স্বীকার করেন, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না এবং দেশের অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়েছে। ঠিক এ সময়ে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দেয় বন্যা। এতে ১০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। পাটের উৎপাদন কমে যায়। ১৯৭৪ সালের শেষদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ৭০০ থেকে ৮০০ শতাংশ। এ সময়ে দুর্ভিক্ষে সরকারি হিসাবে সাড়ে ২৭ হাজার লোক না খেয়ে মারা যান। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা এক লাখের মতো।
প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমদের মতে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি ছিল ঝাপসা ও সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও অঙ্গীকারের অভাবে পূর্ণ (এমাজউদ্দিন আহমদ : ব্যুরোক্র্যাটিক এলিটস ইন সেগমেন্টেড ইকোনমিক গ্রোথ বাংলাদেশ অ্যান্ড পাকিস্তান, ১৯৮০)। আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ না হওয়ার কারণ চিহ্নিত করেছেন মওদুদ আহমদ : ‘আওয়ামী লীগ ছিল একটি দ্বন্দ্ববহুল বিশৃঙ্খল পেটি-বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংগঠন। অসংখ্য ধরনের শ্রেণী ও পেশার প্রতিনিধিত্ব নিয়ে দলটি একটি বহুমুখী শ্রেণী-চরিত্রের ধ্বজাধারী হিসেবে বিকশিত হচ্ছিল। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চিন্তাগত অভিন্নতার কোনো অস্থিত্ব ছিল না। ফলে নানাবিধ বিক্ষিপ্ত চিন্তাচেতনাকে একসূত্রে গ্রথিত করে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের দিকে তাদের উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। শেখ মুজিবের অজানা ছিল না, তার দলের লোকেরা সঙ্ঘবদ্ধ দুর্নীতি-চোরাচালানের সাথে জড়িত হয়ে জনগণের কাছে দলের গ্রহণযোগ্যতা দিনে দিনে কমিয়ে ফেলেছিল। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ বাস্তবায়নের চাইতে সঙ্কীর্র্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থ আদায়েই তার দলের লোকেরা অধিকতর ব্যস্ত ছিল।’ (মওদুদ আহমদ বাংলাদেশ : শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, ডিসেম্বর ১৯৮৩)।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছিল, অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের মতোই বাংলাদেশও শেখ মুজিবের সমাজতন্ত্রে সর্বাত্মক স্বৈরশাসন ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের দলন, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও দুর্ভিক্ষ এবং ধর্মীয় অবদমন প্রত্যক্ষ করেছে। প্রশ্ন হলো সেই ব্যর্থ সমাজতন্ত্রকে কেনো আবার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হলো? (দৈনিক নয়া দিগন্ত: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১১)।
১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের মূল সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’ গৃহীত হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে পঞ্চম সংশোধনীতে সমাজতন্ত্রকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করে বলা হয় ‘সামাজিক সুবিচার অর্থে সমাজতন্ত্র’। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে আবার ‘সমাজতন্ত্র’ পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ’৭০ দশক থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্র ক্রমান্বয়ে পরিত্যক্ত হতে শুরু করে। যখন তা প্রায় বিস্মৃত এক মতাদর্শ বলে গণ্য হচ্ছিল; আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সেই পরিত্যক্ত ‘সমাজতন্ত্র’কে সংবিধানে নতুন করে সংযোজন করে।
বিদ্যমান সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’ বহাল রয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারে বিভিন্ন কমিশন গঠন করেছে। ইতোমধ্যে কমিশনগুলো সুপারিশও পেশ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এ কমিশন যে সুপারিশমালা পেশ করেছে তাতে দেখা যায়, রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সাম্য, সামজিক সুবিচার ও মানবিক মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রের কথাও বলা হয়েছে। উল্লিখিত কমিশনের সুপারিশে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ পড়েছে। এমনকি জিয়াউর রহমানের ‘আল্লাহর উপর অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা’ কথাটিও সুপারিশ করা হয়নি। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আজ নয়; বরং পরিত্যক্ত ‘সমাজতন্ত্র’কে কমিশনও পরিত্যাগ করেছে দেখে আমরা স্বস্তিবোধ করছি।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা