‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১:১২
‘পাপে পাপ আনে পুণ্যে আনে সুখ’ প্রবাদবাক্যটির তাৎপর্য মানুষ বোঝে ও মানে। পাপীরা যতই চাতুর্য প্রদর্শন করুক না কেন। কোনো-না-কোনো সময় তাদের জবাবদিহি করতে হবে। আর পুণ্যও কখনো বৃথা যায় না। কোনো-না-কোনো সময় এর প্রতিদান বা প্রতিফল মানুষ লাভ করে। আমরা তো সবসময় এভাবেই বলি যে, ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া আছে। নিউটনের সূত্র মোতাবেক, প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।
এই সূত্র অনুযায়ী আওয়ামী নেতৃত্ব এখন দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং তাৎক্ষণিক ফল ভোগ করছেন। তারা দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে যদি পাপ করে থাকেন তাহলে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী আগামী ১৫ বছর তার দহন ভোগ করবেন। তাদের কেউ কেউ পাপের মাত্রা অনুযায়ী মধ্যমেয়াদি সাজা ভোগ করবেন আর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জন্য তাৎক্ষণিকভাবেই আক্রান্ত হবেন। আমার কাছে অবাক বিস্ময় লাগে যে, তিনি এতকিছুর পরেও মানুষের নাড়ির খবর রাখেন না। যে শক্তি মদ-মত্ততা ও ঔদ্ধত্য দ্বারা বাংলাদেশকে শাসন-ত্রাসন করেছেন, সেই কু-নীতির মনোভাব থেকে এখনো তিনি এক ইঞ্চি সরে দাঁড়াননি। সত্যিই তিনি মনে করেন এটি তার পৈতৃক সম্পত্তি। যেমন ইচ্ছা তেমন করবেন। এরা কোনো দেশের নাগরিক নয়। প্রজাই বটে। যখন তখন এদের জীবন, সম্মান ও সম্পদ কেড়ে নেয়া যায়।
বিগত গণবিপ্লবে অঝোরে যে রক্ত ঝরেছে তার কথা-বার্তায়, বক্তৃতা-বিবৃতিতে এর কোনো লেশমাত্র রেশ নেই। মানুষকে প্রতারিত করার জন্য ১৮ জুলাইয়ের পর তিনি মায়াকান্না জুড়ে দেন। দক্ষ অভিনেত্রীর মতো হাসপাতালে হাসপাতালে গিয়ে চোখের পানি ফেলেন। কী অপরূপ অভিনয় দক্ষতা। যিনি হত্যার আদেশ দিয়েছেন সেই লাশের সামনে দাঁড়িয়েই তিনি আহাজারির অভিনয় করছেন। ‘সত্যিই সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ’, আর এর নেত্রী।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের রক্তক্ষরণজনিত ঘা শুকিয়ে আসছিল। সময় নাকি একসময় সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। মানুষের মন খুবই সঙ্কীর্ণ। মানুষ ক্ষমাশীলও বটে। আর তা না হলে যেখানে আওয়ামী খেলোয়াড় কাউয়া কাদের পাঁচ লাখ লাশের কথা বলেছিলেন, সেখানে তেমন কোনো রক্তপাতই হলো না কেন! তাহলে কি আওয়ামী আত্মা রক্তক্ষুধায় এখনো কাতর! বাম বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ একে পাতানো ফাঁদ বলে বর্ণনা করছেন। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য আওয়ামী নীলনকশার কথা বলছেন কেউ কেউ। আসলে এটি হচ্ছে হাসিনা বিকারতন্ত্রের ক্ষমতা লাভের বেপরোয়া অপচেষ্টা। তার বিবেক-বুদ্ধি ক্ষয় হয়েছে, লয় হয়েছে। একবার হাইকোর্ট বলেছিলেন তিনি ‘রং হেডেড’। আসলে কথাটি যে মিথ্যা নয় তিনি তার প্রমাণ রাখলেন।
জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার তার বাতিক ছিল। যখন তখন মন চাইলেই তিনি তা করতেন। এখন যে তার গদি নেই লোক-লস্কর, উজির-নাজির নেই তা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। দিল্লি থেকে ঘোষণা করলেন যে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। তবে যাদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, সে মানুষগুলো যে কত ক্রুদ্ধ হয়ে আছে তার খবর তিনি রাখেন না। তিনি যে ক্রিয়া দেখানোর চেষ্টা করলেন তার প্রতিক্রিয়া হলো ভয়ানক। ক্রুদ্ধ ছাত্র-জনতা স্বৈরাচারের শেষ চিহ্ন ৩২ নম্বরকে গুঁড়িয়ে দিলো। এ দেখে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের দরদ উতলে উঠল। যারা ছাত্র-জনতার ওপর রক্ত নদী দেখে আহা উহু করেননি তারা ৩২ নম্বরের অবসানে অশ্রুপাত করলেন। যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, মানুষের প্রতি মমত্ব পোষণ করেন, তারা অশান্তি-অনাসৃষ্টি চান না। কিন্তু ইটটি মারলে পাটকেলটি তো খেতেই হবে। কিন্তু দিল্লি ঘটনাটি সেভাবে দেখতে রাজি নয়। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা যে ভাষায় বিবৃতি দিয়েছেন, তা অকূটনীতিসুলভ ও অনধিকারের শামিল।
আসলে আওয়ামী জাহেলিয়াত যে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের সর্বত্র, তার প্রমাণ মানুষ পেল গাজীপুরে। ৩২ নম্বরের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় দেশের কোনো কোনো জায়গায় হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। আওয়ামী সামন্তবাদের প্রভুরা এখনো বহাল আছেন নগরে-বন্দরে-জনপদে। গাজীপুরে জাহেল জাহাঙ্গীরের কথা এত সহজে ভুলে যাওয়ার নয়। তিনি নতুন করে পুরনো ঘটনা ঘটাতে চাচ্ছেন।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গত শুক্রবার রাত ৯টার দিকে সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের গাজীপুরের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর শুরু হয়। এটি জানার পর তা প্রতিহত করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা গাজীপুরের শিক্ষার্থীরা মন্ত্রীর বাড়িতে সমবেত হন। সেখানে গিয়ে দেখা যায় লুটপাট হচ্ছে। এটি শোনার পর ছাত্ররা লুটপাট প্রতিহত করতে এগিয়ে যায়। হুট করে সেখানে আওয়ামী আদম জড়ো হয়ে যায়। মুখ বাঁধা কিছু লোক রামদা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে, কয়েকজনকে বেধড়ক পেটায় ও কুপিয়ে জখম করে। পরে অন্য শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে গেলে তাদের ওপরও হামলা হয়। পুলিশকে জানানো হলে থানা পুলিশ রহস্যজনক নিষ্ক্রিয়তা প্রদর্শন করে। দুই ঘণ্টা পর পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে।
ওই দিন রাত ৩টার দিকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিক্যাল হাসপাতালে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম। এর আগে রাত পৌনে ২টার দিকে হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিয়ে সারজিস আলম বলেন, ‘খুনি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বাংলাদেশে যে দু-তিনটি জেলায় রণক্ষেত্র হয়েছিল, যে দু-তিনটি জেলায় ছাত্র-জনতা বুক পেতে দিয়ে, রক্ত দিয়ে, সবার সামনে থেকে এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে তার একটি হলো গাজীপুর।’ তিনি ঘোষণা করেন, খুনি হাসিনা ও খুনি জাহাঙ্গীরের দোসররা যদি গাজীপুরে আবার উৎপাত করতে চায়, ছাত্ররা আর তাদের ছাড় দেবে না। হামলার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে গাজীপুর সদর থানা ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়। মহানগর পুলিশ কমিশনার এ ঘটনায় পুলিশের দেরির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
গাজীপুর ও অন্যত্র এসব পুলিশি অব্যবস্থা এবং নতুন করে আওয়ামী নেতাকর্মীদের অপতৎপরতা রোধে অবশেষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলেই ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করা হয়। অভিযান সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব:) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, দেশকে যারা অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে, এ ক্ষেত্রে যারা আইন অমান্য করে, দুষ্কৃতকারী ও সন্ত্রাসী তারাই গ্রেফতার হবে। এই অপারেশনটি চলবে ততদিন যতদিন দেশ ডেভিলমুক্ত না হবে। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, যৌথবাহিনী দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করেছে। গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে এক সভায় এই অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, এই সিদ্ধান্তটি অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল।
আওয়ামী লীগের যারা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মতো ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ছিল, তাদের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান শুরু করলে সাম্প্রতিক উৎপাতটি এড়ানো যেত। আওয়ামী লীগের এসব মানুষ ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’। আমাদের জনচরিত্র সম্পর্কে সাধারণভাবে এ প্রবাদটি প্রযোজ্য লেট বেটার দেন নেভার। দেরি হলেও শয়তানের খোঁজে নামার সিদ্ধান্তটি প্রশংসাজনক। তবে রাজনৈতিক সরকারের আমলে পরিচালিত এ ধরনের বিশেষ অভিযান কখনোই সুখকর ছিল না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সময়ও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ঘটেছে ১৭ জনের। এটি কাক্সিক্ষত নয়। দেশের মানুষ আশা করে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ সাধারণভাবে প্রায়োগিক হবে। অসাধারণ ও অস্বাভাবিকভাবে অথবা রাজনৈতিকভাবে এর প্রয়োগ হলে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হবে। ডেভিল মানে যদি অন্যায়, অপরাধকারী হয় তাহলে সব অপরাধীর বিরুদ্ধেই যেন এটি পরিচালিত হয়।
পুলিশের বিরুদ্ধে সব কালে, সব সময়ে এই অভিযোগ বহমান রয়েছে যে, তারা গ্রেফতার বাণিজ্য করে। এবারে অবশ্য অন্য বাহিনীগুলোর সংশ্লিষ্টতা ও নেতৃত্ব রয়েছে। এটি স্বস্তিদায়ক। কোনোভাবেই যেন নিরীহ মানুষ পুলিশি হয়রানির শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেই সাথে আমাদের আবেদন যৌথবাহিনী ব্যতীত অন্য ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠী যেন আগের মতো সরকারের ‘হেলমেট বাহিনী’ না হয়।
দেশের সর্বত্র শান্তি, শৃঙ্খলা ও স্থিতাবস্থা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। আগে নির্লিপ্ত থেকে পরে সক্রিয় হওয়ার বদনাম থেকে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। দেশের জনগণ যেকোনো স্থানে হামলা ও ভাঙচুর পছন্দ করে না। জনগণকে প্রশমিত রাখা, কৌশলে শৃঙ্খলা বিধান সরকারের দায়িত্ব। সেই সাথে মুখরামুখ বন্ধ করাও প্রয়োজন। তিনি আশ্রয়ে আছেন, এর বাধ্যবাধকতা বোঝা যায়। কিন্তু প্রশ্রয় পান এ রকম সিদ্ধান্ত শুধুই ৩২ নম্বরের মতো ধ্বংস ও প্রতিবাদ ডেকে আনবে এরূপ মনে করলে প্রতিবেশীই লাভবান হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের এই সময়ে নাগরিকদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই ঘরে-বাইরে টেকসই শান্তি অর্জিত হবে।
লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও
রাজনীতি বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা