আলোচনার টেবিলে ফেলানী হত্যাও রাখুন
- জসিম উদ্দিন
- ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১:০৯
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সম্মেলন হতে যাচ্ছে আগামী ১৭ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে। প্রতিবেশী দু’টি দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চার দিনব্যাপী এই শীর্ষ সম্মেলন হচ্ছে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে। আগস্টের শুরুতে ভারতের মদদপুষ্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অভ্যুদয় ঘটেছে নতুন এক বাংলাদেশের। এর আগে অনেকটাই ভারতের পছন্দে দুই দেশের সব বিষয় নির্ধারিত হয়েছে। দেশটির চাহিদা পুরোপুরি পূরণের পর বাকি থাকলে কিছু পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে দেশ দু’টির সম্পর্কে কমবেশি এ ধরনের একচেটিয়া প্রাধান্য ভারতের ছিল। ভারসাম্য বজায় রেখে সম্পর্ক অগ্রসর হয়েছে খুব কমই।
এবার বিজিবি বিএসফের সম্মেলন উপলক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত প্রস্তুতি সভায় ভিন্ন রকমের উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, এবার সীমান্ত সম্মেলনে কথার টোন আলাদা হবে। কার্যত বাংলাদেশের মানুষ বিজিবি-বিএসএফের আলোচনার টেবিলে এরই প্রতিফলন দেখতে চায়।
এর আগে দুই দেশের সীমান্তবাহিনীর ডিজি পর্যায়ে ৫৪ বার সম্মেলন হয়েছে। স্বাধীনতার পরপর নবগঠিত রাষ্ট্রটি অনেকটাই ভারতের প্রভাবে ছিল। পাখির মতো মানুষ হত্যা সীমান্তে তখনো শুরু হয়নি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর প্রথম আমাদের জাতীয় পরিচয় আত্মমর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার বিষয় প্রাধান্য পায়। সীমান্তেও তার কিছুটা প্রভাব পড়ে। এরপর ভারতের প্রভাবাধীন ও মদদপুষ্ট জেনারেল এরশাদ দীর্ঘকাল ক্ষমতায় ছিলেন। তারপরের গণতান্ত্রিক সরকারগুলো সীমান্তে এক ধরনের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করলেও ভারতীয় আগ্রাসী মনোভাব বরাবর বেড়েছে। সীমান্ত হত্যার পরিসংখ্যান দেখলে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারব। ভারতের প্রযোজনায় তাদের পছন্দের হাসিনা ক্ষমতায় এলেও সীমান্তে শত্রুতা বেড়েছে। এই সম্পর্ক ছিল বৈদেশিক সম্পর্কের এক নতুন ধাঁধা। ওই সময় উভয় দেশের পক্ষ থেকে দাবি করা হতো দুই দেশের মধ্যে রয়েছে উষ্ণ ও মধুর সম্পর্ক। বাস্তবে সীমান্তে মানুষ হত্যা, ধরে নিয়ে আটক রাখা, ক্ষতিকর মাদক দিয়ে দেশ সয়লাব করে দেয়ার কাজটি ভারতের পক্ষ থেকে করা হচ্ছিল। আবার এই দৃশ্যমান শত্রুতাকে প্রতিবেশী সম্পর্কের এক আদর্শিক নজির বলে প্রচারণা চালানো হতো। এ ধরনের নজিরবিহীন প্রতিবেশী সম্পর্ক পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায়নি। বিগত হাসিনার সময় যত ধরনের অন্যায় ভারত করেছে সব বাংলাদেশের মানুষকে মুখবুজে মেনে নিতে হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের পর তাদের অসহনীয় মাস্তানি আর মেনে নেয়া হচ্ছে না। সম্ভবত স্বাধীনতার পর প্রথমবার সীমান্তে ভারত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাংলাদেশ দেখতে পাচ্ছে। কোনো ধরনের আগ্রাসী কর্মকাণ্ড ছাড়াও যে সমতা ও ন্যায্যতার নীতি অবলম্বন করা যায় তার প্রমাণ এখন রাখছে বাংলাদেশ।
নতুন বাংলাদেশকে সহ্য করতে পারছে না ভারত। হাসিনা পালানোর পর ভারতীয় নেতারা অবমাননাকর ও অসম্মানজনক মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ নিয়ে। দেশটির সংবাদমাধ্যম বিপ্লবকে কালিমালিপ্ত করার জন্য অব্যাহত অপপ্রচার চালিয়েছে। এগুলো ব্যর্থ হওয়ার পর সীমান্তে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করে। আশার ব্যাপার হলো- বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি সেগুলোকে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় মোকাবেলা করেছে। তাদের হঠকারিতা ও উগ্র আচরণের বিপরীতে বিজিবি কখনো সীমালঙ্ঘন করেনি। চুক্তির নিয়ম ভেঙে ১৫০ গজের ভেতরে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা ভণ্ডুল করে দিয়েছে বিজিবি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের চৌকা, কুড়িগ্রাম ও নওগাঁসহ অন্তত পাঁচ জায়গায় সীমানা দেয়াল নির্মাণের প্রচেষ্টা চালায় ভারত। সবগুলো সীমান্ত পয়েন্টে বিজিবির দৃঢ়তা প্রশংসনীয়। কয়েক মাস ধরে তারা মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। একসাথে চারপাশ থেকে ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্টে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের নামে অরাজকতা করে কিছু অর্জন করতে পারবে মনে করেছিল। কার্যত বিজিবির সাথে সাথে বাংলাদেশীরা বিএসএফের অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ড মোকাবেলা করেছে। এ কাজে স্থানীয় অধিবাসীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা গেছে। ফসলের ক্ষেত থেকেও বাংলাদেশীদের ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও তারা ঘটিয়েছে। এবার আর আগের মতো পরাস্ত হওয়ার মনোভাব দেখানো হয়নি। ভারতের লোকদের সীমান্ত থেকে ধরে নিয়ে এসে তার জবাব দেয়া হয়েছে। নতুন বাংলাদেশের একটি ইস্পাতকঠিন মনোভাব টের পেয়ে সব সীমান্ত থেকে তারা লেজগুটিয়ে নিয়েছে। সীমান্তে অযাচিত বেড়া নির্মাণ, কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়া- এ ধরনের গর্হিত কাজ অতঃপর বন্ধ হয়েছে। এখন সব সীমান্তে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। বার্তাটি স্পষ্ট, সেটি হলো- তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না, আমরাও করব না।
এখন আসন্ন বিজিবি-বিএসএফ ৫৫তম সম্মেলনে আলোচনার টেবিলে এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটা দরকার। সেই লক্ষ্যে ২৯ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। তাতে ১৫০ গজের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ বন্ধ, চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ, মানবপাচার ও নদীগুলোর সুষম পানিবণ্টনসহ ১২টি বিষয়ে বিএসএফের সাথে আলোচনার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, নতুন বাংলাদেশে ফেলানী হত্যার বিচার গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। কিশোরী ফেলানীর আত্মস্বীকৃত খুনিরা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বিচারের আওতায় আনা না গেলে ভারতের সাথে সীমান্ত সমস্যা কখনো মেটানো যাবে না। হাসিনার অনুসৃত ভারতের প্রতি অনুগত অবস্থান থেকে সরতে হলে আলোচনার টেবিলে ফেলানী হত্যা প্রসঙ্গ রাখতে হবে। এবারই যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে এ আলোচনা হতে হবে। এখন যদি ছাড় দেয়া হয় তাহলে কখনো সীমান্তে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ আমরা আর পাবো না। যদি ফেলানীর খুনিদের বিচার হতো তাহলে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বরে স্বর্ণা দাশ নামে আরেক কিশোরীকে হত্যার সাহস তারা পেত না। স্কুলপড়ুয়া স্বর্ণাকে কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে মা-বাবার সাথে তার ভাইকে দেখতে ত্রিপুরায় যাচ্ছিল।
ফেলানী হত্যা ও তার বিচার প্রক্রিয়া রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অমানবিক চরিত্রই উন্মোচন করেছে। বিএসএফ সদস্যরা ভিন্ন দেশের নাগরিকদের ওপর কতটা বর্বর তা প্রকাশ করেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারত তার সীমান্তসংলগ্ন অন্য কোনো দেশের মানুষের সাথে এমন বর্বর অমানবিক আচরণ করে না। এর প্রধান কারণ যে, ‘রাষ্ট্রগুলোর শক্তিমত্তা’ তা বোঝা যায়। চীন পাকিস্তান সীমান্তে এভাবে নিরপরাধ মানুষ মারার কোনো রেকর্ড ভারতের নেই। দেশ দুটোর রয়েছে পরমাণু অস্ত্র ও বিশাল সামরিক বাহিনী। তাদের সামরিক শক্তিকে ভারত তোয়াজ করে। তাই বেঘোরে বিএসএফ তাদের মারতে সাহস করে না। দেশটি যে শক্তের ভক্ত নরমের যম সেটি নিশ্চিত করে বলা যায়। বাংলাদেশের মানুষকে তারা বেশি বেশি করে মেরেছে এমন সময় যখন হাসিনা দিল্লির প্রতি আমাদের মাথা নুইয়ে দিয়েছিল।
ফেলানী গুলি খেয়ে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে যায়। পানি পানি বলে চিৎকার করেও বিএসএফর কাছে এক ফোঁটা পানি পায়নি। তাদের চোখের সামনে মেয়েটি ২৪ ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় ঝুলে ছিল। নির্দোষ এক কিশোরীকে নির্মম কায়দায় হত্যা বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দেয়। ভারতের আরো বেশি অমানবিকতা প্রকাশ পেল যখন আত্মস্বীকৃত খুনিকে বেকসুর খালস দিয়ে দিলো দেশটির আদালত। বিশেষ আদালতে দুবার ফেলানী হত্যার বিচার হয়। দুবারই আদালত আসামি অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেন। যেখানে অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে ফেলানীকে হত্যার তথ্য প্রমাণ নিশ্চিত করে জানা যাচ্ছিল। এরপর ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এটিকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যায়। এবার দেখা গেল বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশটির আরেক চরিত্র। রিট পিটিশন শুনানির দিন বছরের বিরতি দিয়ে দুইবার পিছিয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের মার্চে শুনানির দিন ধার্য হলেও করোনা মহামারীর ছুতায় পাশ কাটিয়ে যায়। আদালতের কার্যতালিকায় শুনানির জন্য পরে আর ফেলানী হত্যা মামলা জায়গা পায়নি।
বাংলাদেশীদের হত্যার জন্য বিএসএফ চোরাচালান প্রতিরোধের যুক্তি দেখায়। ফেলানী ও স্বর্ণা দাশরা কোনো চোরাচালানের সাথে যুক্ত। এই শিশুদের দেখে কি চোরাচালানি মনে হয়? বরং এ হত্যাকাণ্ডগুলো প্রমাণ করে- প্রতিবেশীদের তারা হত্যাযোগ্য মনে করে। সীমান্তে চোরাচালান নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয়েছে। তাতে ভারতীয়দের নিজস্ব তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে, বিএসএফের কিছু কর্মকর্তাই এর সাথে জড়িত। দুই দেশের মধ্যে চোরাকারবারিদের যে দৌরাত্ম্য সেটি তাদেরই আশকারায় চলতে পারছে। দুই দেশের মধ্যে চোরাচালানের প্রকৃতি দেখেও দেশটির মনোভাব অনুমান করা যায়। চোরাকারবারি হয়ে বাংলাদেশ থেকে ভালো জিনিস দেশটিতে ঢোকে। স্বর্ণালঙ্কার, সাজসরঞ্জাম যেগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন জিনিস বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায়। অন্য দিকে ভারত থেকে মাদক, অস্ত্র ঢোকানো হয় তাদের তত্ত¡াবধানে। গত বছরের নভেম্বরে ৯ লাখ ৬৬ হাজার ৪২১টি ইয়াবা বাংলাদেশে ঢোকার সময় আটক হয়েছে। এ ছাড়া ছয় কোটি ৭৩৭ গ্রাম হেরোইন, ২৩ হাজার ৪৪৯ বোতল ফেনসিডিল, এক হাজার ৩০৯ কেজি গাঁজা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একই মাসে আটক করেছে। জব্দের তালিকায় আইস, এলএসডিসহ স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর মাদকদ্রব্যও ছিল। ২৪ ডিসেম্বর দৈনিক কালবেলার এক প্রতিবেদনে এ খবর প্রকাশ পেয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে সীমান্তের ভারতীয় অংশে অসংখ্য মাদক কারখানা গড়ে ওঠে। এগুলোর একমাত্র লক্ষ্য বাংলাদেশে সরবরাহ করা। একসাথে দুই কাজ তারা করে যাচ্ছে, বাংলাদেশের যুব সমাজকে ধ্বংস ও অর্থ উপার্জন।
সীমান্তে ভারতীয়দের পক্ষ থেকে নতুন আগ্রাসন হচ্ছে পানিদূষণ। নদী ও খাল বেয়ে দূষিত পানি বইয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশে। সীমান্ত এলাকায় নির্মিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য সরাসরি বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আগরতলা থেকে আখাউড়ায় প্রবেশ করছে চারটি খাল। এগুলো দিয়ে প্রবাহিত পানি থেকে মারাত্মক দূষণের কবলে পড়ছে বাংলাদেশ। শীর্ষ সম্মেলনে খালগুলোর ওপর পানি শোধনাগার স্থাপনের কথা বলবে বাংলাদেশ। ভারত থেকে প্রবাহিত অন্যান্য নদীগুলো প্রবাহে আরো কোথায় দূষিত পানি ঢুকছে সেগুলোও আলোচনার টেবিলে আনতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা