১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৭ মাঘ ১৪৩১, ১০ শাবান ১৪৪৬
`

অন্তর্ভুক্তির সরোবরে ফুটুক সাফল্যের শাপলা

লেখক : ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ - ছবি : নয়া দিগন্ত

মতৈক্য আর মতানৈক্যের মাঝখানে বিভেদের যে দেয়াল সে দেয়াল ভালো ও মন্দ উভয়েরই জন্য সঙ্কট সৃষ্টি করে। ভালোকে ভালো থাকতে না দেয়া আর মন্দকে আরো মন্দ হতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে এই সঙ্কটের সুনাম সুবিদিত। উভয় সঙ্কটে পড়ে শুভ চিন্তারা শুভ উদ্যোগের পাড়া থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়ে। আর বিভিন্ন ধরনের অশুভ আচার আচরণ পাড়া মাত করে ফেরে। ষোলো শতকের ব্রিটিশ বণিক ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা স্যার টমাস গ্রেশাম (১৫১৯-৭৯) অনেক বুঝেশুনে এই অবস্থাকে ইধফ সড়হবু ফৎরাব ধধিু মড়ড়ফ সড়হবু ভৎড়স ঃযব সধৎশবঃ বলে বর্ণনা করেছেন। ভালো আর মন্দকে একসাথে এক পাড়ায় বসবাস করতে দিয়ে ভালোর আলোয় মন্দকে কলুষমুক্ত হতে সাহায্য করা যেখানে উচিত সেখানে ভালোকে পত্রপাঠ মাঠ থেকে সাজঘরে পাঠিয়ে দিয়ে ওয়াকওভারের পরিবেশ সৃষ্টি করা আর্থসামাজিক উন্নয়ন সঙ্কট সৃষ্টির উপাদেয় উপায়।

সমাজ ও অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়ন ও অগ্রগতির অভীপ্সা আকাঙ্ক্ষায় সব পক্ষ ও অনুষঙ্গকে নিরবচ্ছিন্ন নিঃশর্ত ঐকমত্যে পৌঁছানোর তাগিদে সবাইকে বিচ্যুতির পরিবর্তে অন্তর্ভুক্তির অবয়বে আসার অবকাশ রয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়ন ভাবনায় সমন্বিত উদ্যোগের প্রেরণা ও মতবাদ হিসেবে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি (ঋরহধহপরধষ রহপষঁংরড়হ) তথা সার্বিক সামাজিক অন্তর্ভুক্তির (ঝড়পরধষ ওহঃবমৎধঃরড়হ) দর্শন যার বাঞ্ছিত বিকাশের জন্যই রাজনীতির মাঠে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এই নিরিখে স্থানকালপাত্রের পর্যায় ও অবস্থান ভেদে উন্নয়ন ও উৎপাদনে সবাইকে একাত্মবোধের মূল্যবোধে উজ্জীবিত করার প্রেরণা হিসেবে অন্তর্ভুক্তিকরণ এর দর্শন। অনেক উন্নয়নশীল দেশের জাতীয় নেতৃত্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে অন্তর্ভুক্তির চেতনা গোটা দেশবাসীকে ভাববন্ধনে আবদ্ধকরণের উপায় ও উপলক্ষ হিসেবে দেখাতে চাইছেন। দারিদ্র্য নিরসন থেকে শুরু করে সমাজে সম্পদের বণ্টন বৈষম্য দূরীকরণ এবং এমনকি সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সবাইকে দলমতধর্ম লিঙ্গ অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে এক শামিয়ানার নিচে শামিল করতে অন্তর্ভুক্তিকরণকে মন্ত্র হিসেবে মানতে ও মানাতে আগ্রহ উদ্যোগের অভাব থাকতে নেই।

এ কথা বলাবাহুল্য, জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টাতেও সমন্বিত উদ্যোগের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগে থাকা চাই প্রতিটি নাগরিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবদান। অপচয় অপব্যয় রোধ ও দুর্নীতি দমন, লাগসই প্রযুক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বনের দ্বারা সীমিত সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত হয়। এ জন্য সবার মধ্যে অভ্যাস, আগ্রহ এবং সর্বোপরি সুশাসন, সদাচারের প্রতি একাগ্রতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার। নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা ও উপলব্ধির জাগৃতিতে অনিবার্য হয়ে ওঠে যে নিষ্ঠা ও আকাঙ্ক্ষা, তা অর্জনের জন্য সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন ত্যাগ স্বীকারের। নেতিবাচক মনোভাবের দ্বারা এবং দায়দায়িত্ব পালন ছাড়া গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সুফল ভোগের দাবিদার হওয়া বাতুলতা মাত্র। ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ কথাটি এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য এ জন্য যে, উৎপাদনে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করেই ফসলের অধিক অধিকার প্রত্যাশী হওয়াটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত কর্ম ও ধর্ম নয়। কোনো কিছু অর্জনে বর্জন বা ত্যাগ স্বীকার যেমন জরুরি তেমনি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে বাস্তবতা এ জানান দেয় যে, ‘বিনা দুঃখে সুখ লাভ হয় কি মহিতে?’ ন্যায়নীতিনির্ভর, নিরপেক্ষ ও নির্ভার কাণ্ডজ্ঞানের বিকাশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অর্থবহ ও কার্যকর উপস্থিতির আবশ্যকতা অনস্বীকার্য।

মানবসম্পদ সৃষ্টি, গণসুস্থতা আর আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠার সরোবরে উন্নয়ন অর্থনীতির ফুল বিকশিত হয়। যে সমাজে শিক্ষকতা, চিকিৎসা আর আইন ব্যবসায় মহৎ পেশা হিসেবে বিবেচনার সুযোগ দিনে দিনে তিরোহিত হয় সে সমাজে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ও সমাজসেবার আদর্শ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে ওঠে, সেখানে সামাজিক সুবিচার ও গণকল্যাণ আকাঙ্ক্ষায় চিড় ধরতে বাধ্য। সুশাসন ও জবাবদিহিতার পরিবেশ পয়মাল হতে হতে সমূহ সর্বনাশও সহনশীল হয়ে ওঠে। পরীক্ষায় উত্তরণনির্ভর বিদ্যাচর্চায় বাস্তব শিক্ষার লেশমাত্র যে থাকে না সে উপলব্ধি করতে রূঢ় বাস্ত—বের মোকাবেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়লেই দেশে শিক্ষার উন্নতিসহ জনসম্পদ বৃদ্ধি ঘটে না; বরং তাতে স্বল্পশিক্ষিত বেকারের বিকারজনিত সমস্যারই উদ্ভব ঘটে। অসম্পন্ন শিক্ষা সমাধান আনে না; বরং সমস্যা বাড়ায়। শিক্ষা খাতে জিডিপির সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ মিললেও শিক্ষা জনসাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে কি না, দেশের অধিকাংশ অধিবাস যে পল্লীতে সেই পল্লীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে শহরের হাইব্রিড বিদ্যাচর্চার ব্যবধান বাড়ছে কি না সে বিচার বিবেচনা আবশ্যক।

যে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের করের টাকায় বেতন পান, বিনিময়ে তার যে দায়িত্ব পালনের কথা, তা না করে বরং তার শিক্ষকতার পরিচয়কে পুঁজি করে অত্যধিক পারিশ্রমিকে গৃহশিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারই শুধু করেন না, গণশিক্ষার ব্যয় বাড়িয়ে চলেন। সমাজের কাছে যে সম্মান ও সমীহ তার প্রাপ্য তা তার এই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে দ্রবীভূত হয়ে যায়। অথচ এই একই সমাজে এই কিছু দিন আগেও এমনকি ঔপনিবেশিক পরাধীন পরিবেশেও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে (তখন সরকারি অনুদান ছিল যৎসামান্য) শিক্ষাদান ছিল নিঃস্বার্থ জ্ঞানদানের বিষয় এবং আত্মত্যাগের আদর্শে ভাস্বর। আর সে সুবাদে শিক্ষক পেতেন সমাজের সর্বোচ্চ সমীহ ও সম্মান। শিক্ষক দায়িত্ববোধের আদর্শ হতেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালানোকে ব্রত মনে করতেন শিক্ষকরা। আর আজ শিক্ষকের মনের দৈনতা অধিক অর্থ উপার্জনের অভীপ্সায় অন্তর্লীন।

চিকিৎসাবিদ্যার প্রধান লক্ষ্যই যেখানে হওয়ার কথা দুস্থ পীড়িত জনকে রোগমুক্তির সন্ধান দেয়া সেখানে স্রেফ ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কেন মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে! অসুস্থ ব্যক্তির উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়া যেখানে মৌলিক অধিকার সেখানে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসাব্যবস্থা এতই নাজুক ও অবহেলায় ন্যুব্জ যে ক্লিনিকের কসাইয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে অগণিত অসহায় অসুস্থ মানুষকে। এনজিও দ্বারা কমিউনিটি চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে- সেখানে হাসিমুখে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে নবীন প্রবীণ স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু সরকার পরিচালিত চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে কেন সেবার মান আদৌ উন্নত হবে না, যদিও সেখানে বাজেটের বিপুল বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় দেখানো হয়ে থাকে। জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাজেটে বিপুল ব্যয় বরাদ্দ দেখানো হবে আর সেই সেবা পাওয়ার জন্য আবার বাড়তি ব্যয়ের বোঝা কেন বহন করতে হবে রাষ্ট্রের নাগরিককে।

অন্যায় অবিচারের প্রতিকার প্রার্থীর পক্ষাবলম্বনের জন্য আইনজীবী হবেন আসামি বাদি বিবাদির বন্ধু। আইনের মারপ্যাঁচে নিজের ন্যায্য দাবি যাতে হারিয়ে না যায় সে সহায়তা চেয়েই তো অসহায় অশিক্ষিত মক্কেল আসে আইনজীবীর কাছে। নিজের পেশাগত দায়িত্ব ও মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে স্রেফ ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে বাদি বিবাদি উভয়পক্ষের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অনুক্ষণ অনুযোগ বিচারপ্রার্থীর বোবাকান্নার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশ ও সমাজের স্বার্থকে থোড়াই কেয়ার করে অনেকে বিদেশী বহুমুখী কোম্পানির অনেক অন্যায্য দাবির পক্ষে লবিং করেন স্রেফ পেশাগত ও ব্যবসায়িক স্বার্থে। ‘সেবা পরম ধর্ম’ কিংবা ‘সততা সর্বোত্তম পন্থা’ এসব মহাজন বাক্য কি শুধু নীতি কাহিনীতে ঠাঁই পাবে, বাস্তবে তার সাক্ষাৎ মিলবে না?

রাষ্ট্রাচারে বিধিবিধান অনুসরণ যেহেতু দায়িত্ব ও কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে সেহেতু রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয় পক্ষেরই পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র ও নাগরিকের পারস্পরিক স্বার্থে বিষয়টি অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগের মতো। রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সেবার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করবে এবং এর জন্য নাগরিক রাষ্ট্রকে পাথেয় পরিশোধ করবে। রাষ্ট্র ধার কর্য করে নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি করলে কৃতজ্ঞ নাগরিক পাথেয় পরিশোধ করবে, না নাগরিক আগে পাথেয় পরিশোধ করলে রাষ্ট্র সুযোগ সুবিধা তৈরিতে হাত দেবে? কোনটি আগে? যেকোনো ক্ষেত্রেই সৃষ্ট জটিলতা, অসম্পূর্ণতা, অস্বচ্ছতা পুরো পরিবেশকে প্রশ্নবোধক করে তুলতে পারে। পাথেয় তথা রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ায় অনুপ্রেরণাপ্রদায়ক সহজ সাবলীল ব্যবস্থা যেমন থাকা দরকার, আবার সে সহজীয় সুযোগের অসদ্ব্যবহার যাতে না হয় তা নিশ্চিতকরণার্থে প্রতিবিধানের ব্যবস্থাও থাকা দরকার। করদাতা যাতে হয়রানির শিকার হয়ে নিরুৎসাহিত না হন এটা দেখাও যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি কর প্রদান এড়িয়ে চলার বা ফাঁকিজুঁকি দিয়ে পার পাওয়ার প্রতিরোধাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ। জবাবদিহির পরিবেশে নাগরিকের সব মৌলিক অধিকার ও দাবি পূরণে রাষ্ট্রের স্বচ্ছ আচরণ ও সেবা নিশ্চিত হয়। সেবাপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত হলে পাথেয় পরিশোধের পালে বাতাস বইবে। পারস্পরিক বিচ্যুতিতে নয়, বিভেদের দেয়াল টপকিয়ে অন্তর্ভুক্তির সরোবরে ফুটুক সাফল্যের শাপলা।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement