০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯ মাঘ ১৪৩১, ২ শাবান ১৪৪৬
`

জাকাত অর্থনীতির স্বরূপ ও ভূমিকা

লেখক : ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ - ছবি : নয়া দিগন্ত

জাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। আল কুরআনে সালাত বা নামাজ কায়েমের নির্দেশের পরপরই প্রায় ক্ষেত্রে জাকাত আদায়ের কথা এসেছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ বা সঞ্চয় থাকলে জাকাত আদায় আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। জাকাত আদায় সম্পদশালী ব্যক্তির পক্ষ থেকে দুস্থ দরিদ্রের প্রতি সাহায্যের আদেশ প্রতীয়মান হলেও এটি মূলত জাকাত আদায়কারীর কল্যাণ বাড়ানোর জন্যই।

পবিত্র কুরআনে জাকাত-সংক্রান্ত মুখ্য নির্দেশনাগুলো-
১. ‘(হে রাসূল) তাদের মালামাল থেকে সাদাকা (জাকাত) গ্রহণ করুন যাতে আপনি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পারেন এর মাধ্যমে। আর আপনি তাদের জন্য দোয়া করুন, নিঃসন্দেহে আপনার দোয়া তাদের জন্য সান্ত¡নাস্বরূপ। বস্তুত আল্লাহ সবকিছুই শোনেন, জানেন।’ (সূরা তাওবাহ-১০৩)

২. সাদাকা তো কেবল ফকির-মিসকিনদের জন্য এবং সাদাকা-সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত লোকদের জন্য, যাদের চিত্তাকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটি আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা তাওবাহ-৬০)

আল কুআনের নবম সূরা তাওবার মধ্যে জাকাত আদায় ও প্রদানের বিষয়টি সবচেয়ে বেশিবার বর্ণিত হয়েছে। মুশরিকদের বিরুদ্ধে নানান ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে- তবে তারা যদি তাওবাহ করে, নামাজ কায়েম করে এবং জাকাত দেয় তাহলে তাদের ‘পথ ছেড়ে দাও’ (আয়াত-৫), তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই (আয়াত-১১), তারা হেদায়েত প্রাপ্ত (আয়াত-১৮)। যখন জাকাত বণ্টনের ব্যাপারে বৈষম্যের দোষারোপ করা হয়, বলা হয়, জাকাত পেলে খুশি হয়, না পেলে ক্ষুব্ধ হয় (আয়াত-৫৮)। এই পরিপ্রেক্ষিতেই কারা সাদাকা বা জাকাত প্রাপক হবে তার নির্দেশনা বা বর্ণনা দেয়া হয়েছে ৬০ সংখ্যক আয়াতে। এরপর ৬৯ আয়াতে এসে বলা হলো- (জাকাত না দিয়ে) অতীতের লোকেরা তাদের ধনসম্পদের ফায়দা নিয়েছে ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ৭১ আয়াতে এসে আবার বলা হয়- যারা নামাজ কায়েম করেছে এবং জাকাত দেয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। ৯৮ আয়াতে জাকাতকে জরিমানা বলার চেষ্টা করেছে মুশরিকরা, ৯৯ আয়াতে এসে বলা হয়েছে- জাকাত আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়। ১০২ আয়াতে এসে বলা হয়েছে- কোনো কোনো লোক রয়েছে যারা নিজেদের পাপ স্বীকার করছে এবং নেককাজ ও মন্দকাজ মিশ্রিত করেছে, শিগগিরই আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ১০৩ আয়াতে এসে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হয়েছে- ‘(হে রাসূল) তাদের মালামাল থেকে সাদাকা (জাকাত) গ্রহণ করুন যাতে আপনি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পারেন এর মাধ্যমে। আর আপনি তাদের জন্য দোয়া করুন, নিঃসন্দেহে আপনার দোয়া তাদের জন্য সান্ত¡নাস্ব^রূপ। বস্তুত আল্লাহ সবকিছুই শোনেন, জানেন।’ পরবর্তী ১০৪ আয়াতে আরো স্পষ্ট করা হয়েছে- ‘তারা কি এ কথা জানতে পারেনি যে, আল্লাহ নিজেই স্বীয় বান্দাদের তাওবাহ কবুল করেন এবং সাদাকা (জাকাত) গ্রহণ করেন? বস্তত আল্লাহই তাওবাহ কবুলকারী, করুণাময়।’

জাকাত প্রদান ধনবান ব্যক্তি, পরিবার বা সমাজের মন-মানসিকতার মৌলিক পরিবর্তন ও সংশোধনের সুযোগ এনে দেয়। অর্থের প্রাচুর্যের জন্য মানুষের মধ্যে কার্পণ্য, স্বার্থপরতা অপরকে হেয় জ্ঞান করার প্রবণতা এবং নৈতিক অধঃপতন বৃদ্ধি পায়। এই চারিত্রিক দোষত্রুটি থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য নিজের অর্জিত সম্পদের কিছু অংশ অকুণ্ঠচিত্তে ব্যয় করা অপরিহার্য। জাকাত প্রদানের ফলে সামাজিক বৈষম্যবোধ হ্রাস পেয়ে পারস্পরিক ঐক্য স্থাপিত হয়। এই পারস্পরিক ঐক্যবোধই পরে উন্নত নৈতিকতার ভিত্তি স্থাপন করে। সমাজ একমাত্র অর্থনৈতিক উপকরণাদির মাধ্যমে অভাবীদের প্রয়োজন মেটাতে পারে। এই পদ্ধতি যথার্থ অনুসৃত হলে সমাজকে ভিক্ষার অভিশাপ হতে মুক্ত করা সম্ভব। সমাজের গোষ্ঠীবিশেষের হাতে জাতীয় সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে জাকাত ব্যবস্থা তাও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মেরুদণ্ড জাকাত। সম্পদের সুষম বণ্টনের ওপর গুরুত্বারোপ ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কারো হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত থাকা নয়, মানুষের কল্যাণে তার ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের চাকা সচল ও গতিশীল রাখার স্বার্থে জাকাতের বিধান। ইসলামের জাকাত ব্যবস্থা মুনাফার ওপর আরোপিত কোনো পদ্ধতি নয়; বরং মূল পুঁজির ওপর এর দাবি। এর উৎস ও দার্শনিক তাৎপর্য হলো- এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা যাতে সম্পদ গুটিকয়েক লোকের মধ্যে আবর্তিত না হয়। বস্তুত এটিই প্রকৃত কল্যাণ অর্থনীতির আদর্শিক রূপ। জাকাত প্রদান মূলত দু’টি কর্মসূচিরই নির্দেশ করে। ১. সম্পদের ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ হিসাব করে প্রদানের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া এবং ২. সেই অর্থ কাকে এবং কী উদ্দেশ্যে দেয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত। জাকাত প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যে বিত্তবানের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন শুরু হয় এবং প্রকৃত প্রাপক ব্যক্তিকে উপযুক্ত উদ্দেশ্যে প্রদানের মাধ্যমে সেই দায়িত্ব পালন শেষ হয়।

জাকাত প্রদানে কোনো প্রকার অহঙ্কার বা দম্ভের প্রকাশ বাঞ্ছনীয় নয়। আবার তা এমনভাবে প্রদান করা উচিত, যাতে প্রাপক প্রকৃতই আর্থিক সচ্ছল কিংবা স্বনির্ভর হতে পারে। জাকাত গ্রহণ কারো কাছে যেন অব্যাহত পরনির্ভরশীলতা ও অসহায়ত্বের অবলম্বন হিসেবে বিবেচিত না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। জাকাত বিতরণ উপলক্ষে অসহায় আর্ত-মানবতার প্রচণ্ড ভিড় জমে। সেই ভিড়ের চাপে মানুষের মৃত্যু হয়, যা এক করুণ ও অনভিপ্রেত অবস্থার নির্দেশ করে। যৎসামান্য সাহায্য প্রাপ্তিতে প্রাপকের অতি সাময়িক সংস্থান হয়। তার সার্বিক উন্নয়নে এর কোনো অবদান নেই। মানুষের বেকারত্ব বৃদ্ধি, বিপন্ন নারীত্বের অসহায়ত্ব, দুঃখ ও দারিদ্র্যতাড়িত আর্তনাদ নিয়ন্ত্রণ করা জাকাত ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। বিক্ষিপ্তভাবে নয়, অসহায়কে অধিক পরনির্ভরশীল হতে দেয়া নয়; বরং স্বাবলম্বনের দিকে মনোবল বৃদ্ধি ও কর্মপ্রেরণার দিকে উৎসাহিত করা জাকাত ব্যবস্থার অন্যতম কর্মসূচি হওয়া উচিত। আয়ের সংস্থান হয় এমন কিছু কিনে দিয়ে জাকাত প্রার্থীকে স্বাবলম্বী হওয়ায় সহায়তা করা যেতে পারে। একার অর্থে না হলে কয়েকজনের জাকাতের অর্থ একত্র করে গঠনমূলক কিংবা কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হতে পারে। জাকাত ফান্ডে জমাকৃত জাকাতের অর্থ দিয়ে আয়বর্ধনমূলক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় সমন্বিতভাবে এমন প্রকল্প গ্রহণ করা যায়।

দারিদ্র্যই দারিদ্র্যের কারণ ও উৎস। গরিবের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের যে সঙ্কট তা ব্যক্তি, পরিবার সমাজের স্বাস্থ্য শিক্ষা নিরাপত্তায় যেমন সমস্যার সৃষ্টি করে, সেই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার পরিবেশও বিনষ্ট করে। সার্বিক পুষ্টিহীনতায় স্বভাব চরিত্রে নৈতিকতায় ঠিক থাকা থেকে শুরু করে এমনকি দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যম ও আগ্রহের ক্ষেত্রেও জড়তা স্থবিরতা এসে যায়। এটি একটি ভয়াবহ ঘূর্ণাবর্ত।

সুতরাং শুধু অন্ন শুধু বস্ত্র শুধু বাসস্থান দিলেই দারিদ্র্য নিরসন হবে না। এ সম্পর্কিত কার্যক্রমকে হতে হবে দারিদ্র্যের সার্বিক ও সমূলে নিরসনের কার্যকর উদ্যোগ। ব্যক্তির দারিদ্র্য সমাজের দারিদ্র্যের প্রতিফল হিসেবে দেখতে হবে। সুতরাং সমন্বিতভাবে সঙ্ঘবদ্ধ দারিদ্র্য নিরসনের কর্মসূচি প্রয়োজন।

বিদ্যমান ধ্রুপদ ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যক্তি ও পারিবারিক দারিদ্র্য নিরসনে একটি মাত্র অবলম্বন হিসেবে প্রতিভাত হতে পারে, তা ব্যক্তির কর্মসৃজন ও তার বা বড়জোর তার পরিবারের উন্নয়ন ইচ্ছার বাস্তবায়ন, এমনকি তার ক্ষমতায়ন হতে পারে; কিন্তু যে সমাজে তার অবস্থান, যে পরিবেশে তার চলাচল সেই সমাজ ও পরিবেশে দারিদ্র্য বিদ্যমান থাকলে তার একার বা পরিবারের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি অর্থবহ ও টেকসই হবে না। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির উদ্ভাবকরা তাই এখন সামাজিক ব্যবসায় ধারণার প্রচার প্রসার কামনা করছেন এ কারণে যে, সমাজকে শক্তিশালী হতে হবে। এ জন্য সামাজিক ব্যবসায়, যে ব্যবসায় সমাজে এমন সক্ষমতা তৈরি হবে যাতে সব প্রকার দারিদ্র্য (অন্ন বস্ত্র বাসস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, চিন্তাচেতনার, সবকিছুর) নিরসন সম্ভবপর হবে।

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে কিংবা যথার্থ কার্যকারিতার অবর্তমানে জাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্য নিম্নের ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে :
ক. সঙ্ঘবদ্ধ জনসমষ্টি তথা সংস্থা বা সংগঠন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিকল্প বা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামী শরিয়তের বিধানাবলি বাস্তবায়নে জাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের ব্যবস্থা করতে পারে।

খ. শরিয়তসম্মতভাবে পরিচালিত ব্যাংক বা অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমেও জাকাত উসুল ও বণ্টনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতদুদ্দেশ্যে ব্যাংকে একটি করে জাকাত বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। ওই বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ব্যাংক জাকাত দানকারী সাহিবে নিসাবদের কাছ থেকে জাকাতের অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। নিজ গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট থেকেও তাদের অনুমতিসাপেক্ষে জাকাত সংগ্রহ করে জাকাত ফান্ডে জমা করতে পারে এবং জাকাত বোর্ডের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে হকদারদের মধ্যে তা বণ্টন করতে পারে।

সুতরাং সার্বিক দারিদ্র্য নিরসনের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত প্রয়াস, এমন উদ্যোগ যা নিরাপদ ও কল্যাণপ্রদ অর্থ উৎসারিত এবং স্বয়ম্ভর সক্ষমতা সৃষ্টির দ্যোতক।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement
যমুনার যাওয়ার পথে বাধা, রাস্তা অবরোধ অভ্যুত্থানে আহতদের কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হওয়ার আবারো প্রস্তাব ট্রম্পের প্রাইজ বন্ডের ১১৮তম ড্র অনুষ্ঠিত ফেনীতে জামায়াত নেতা-কর্মীদের স্বাগত মিছিল যশোর সীমান্তে ২৩ লাখ টাকার ভারতীয় মাদকসহ বিভিন্ন পণ্য জব্দ বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা আরো সহজ করল থাইল্যান্ড নবাবগঞ্জে স্বামী হত্যার অভিযোগে স্ত্রী ও শাশুড়ি আটক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আ’লীগ নিষিদ্ধের দাবি বেনাপোল দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যাত্রী যাতায়াত কমেছে ৮৩ শতাংশ নাটোর জেলা বিএনপির কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক আজিজ, সদস্য রঞ্জু বিশ্ব ইজতেমার দুই কিলোমিটারের মধ্যে ড্রোন উড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা

সকল