০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

মুসলিম বিশ্বে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমের বিকাশ

ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব - ছবি : নয়া দিগন্ত

ইউরোপীয় আগ্রাসী শক্তির মোকাবেলায় মুসলিম দেশগুলোতে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা হলেও শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়। এর পর একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তারা অবসাদগ্রস্ত ছিল। সাম্রাজ্য ও শাসন কর্তৃত্ব হারিয়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। কিংকর্তব্য হয়ে পথের দিশা খুঁজে পাচ্ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু প্রতিরোধ লক্ষ্য করা গেলেও তা টেকসই হয়নি। এমতাবস্থায় ভারতবর্ষে সৈয়দ আহমদ খান, ইরানে মুলকুম খান, তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক, মিসরে মোহাম্মদ আলী পাশা ও লেখক রশিদ রিদাহর মতো ব্যক্তিত্ব ইউরোপীয়দের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলিম উম্মাহকে কথিত আধুনিকতা ও সেক্যুলার মতের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মুসলিম উম্মাহর এমন সন্ধিক্ষণে কয়েকজন ইসলামী চিন্তাবিদ ও মনীষী আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে জামালউদ্দীন আফগানী (১৮৩৯-৯৭) অন্যতম। তিনি দৃঢ়ভাবে মুসলিম উম্মাহকে ইউরোপীয় শিক্ষা ও দর্শন তথা আধুনিকতার ধারণা পরিহার করার আহ্বান জানান। এর বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। তিনি পুরো আরব, মিসর, তুরস্ক, রাশিয়া ও ইউরোপ সফর করে পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মুসলমানদের সচেতন করে তোলার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার সময় তিনি ভারত সফরে ছিলেন। তিনি কুরআন-সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও ইজতিহাদের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

জামালুদ্দীন আফসানির বন্ধু মুহাম্মদ আবদুহু (১৮৪৯-১৯০৫) মিসরে চিন্তার জগতে নাড়া দিতে সক্ষম হন। তিনি পাশ্চাত্য দর্শন গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। এর ইতিবাচক দিকগুলোর প্রশংসা করেন; তবে তিনি বলেন, মিসরের মতো মুসলিম অধ্যুষিত সমাজে শরিয়াহ ও ফিকাহ উপেক্ষা করে কোনো আধুনিক ধারণা প্রতিস্থাপন করা যাবে না। তিনি মনে করেন, ইসলামের শূরা (পরামর্শ) পদ্ধতির আলোকেই পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রকে বুঝতে হবে। তিনি মাদরাসায় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয়াদি শেখানোর তাগিদ দেন। আবদুহুর সমসাময়িক বিশিষ্ট সাংবাদিক ও চিন্তাবিদ রশীদ রিদা (১৮৬৫-১৯৩৫) অভিমত প্রকাশ করেন, আবদুহুর ধারণার আলোকে সমাজ পরিবর্তন প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘায়িত হবে। তিনি আরব পণ্ডিতদের মধ্যে সেক্যুলারিজমের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন, মুসলিম জাতি যদি সেক্যুলার মতবাদ গ্রহণ করে তাহলে তা তাদের আরো দুর্বল করে দেবে। একই সাথে ইউরোপীয়দের কাছে তারা দুর্বল শিকারে পরিণত হবে। রশীদ রিদা হচ্ছেন অগ্রণী ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে অন্যতম; যিনি শরিয়াহ সংস্কার করে তার ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা পেশ করেন। তিনি একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন; যেখানে ছাত্ররা ফিকহ, ধর্মতত্ত¡, আধুনিক বিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক আইন, সমাজতত্ত¡, বিশ্ব ইতিহাস ইত্যাদি অধ্যয়ন করবে। তিনি আশা করেন, এ সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধিত হলে পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স গড়ে তোলা সম্ভব হবে এবং তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাশ্চাত্যের সমক্ষমতা অর্জন করতে পারবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উপনিবেশগুলো থেকে ইউরোপীয়রা পশ্চাদপসরণ করে। ফলে বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। অবশ্য স্বাধীনতা-পরবর্র্তী শাসন ক্ষমতা চলে যায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও চিন্তাধারায় বিকশিত সামরিক বা বেসামরিক আমলা অথবা তথাকথিত রাজবংশের হাতে। এসব শাসক ইউরোপীয় স্টাইলে জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলার মতবাদ বা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু কোনোটি মুসলিম উম্মাহর জন্য ফলপ্রসূ হয়নি।

অটোমান সাম্রাজ্য বা উসমানীয় খেলাফত বিযুক্তির পেছনে আরব ও তুর্কি জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প ঘৃতাহুতির মতো কাজ করে। ইউরোপের ইহুদি ও খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা তুর্কি ও আরব জাতীয়তাবাদের উপর পৃথক গ্রন্থ রচনা করে তরুণ তুর্কি ও আরবদের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষের বীজ বপন করেছিলেন। মেজর লরেন্স তুর্কিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরবদের দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত খেলাফতের পতন ঘটে। এমনকি খেলাফতের বিলুপ্তি শুধু আরব ও তুর্কিদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়নি; বরং আরব ভ‚খণ্ডও বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। জাতীয়তাবাদের নানারূপ প্রকট আকার ধারণ করে। লেবাননে তিনটি জাতীয়তাবাদী চেতনা তথা- শিয়া, সুন্নি ও ম্যারোনাইট খ্রিষ্টান, সুদানে মুসলিম-খ্রিষ্টান, জর্দানে শরিফ হোসেনের বংশীয় আধিপত্য, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, আবুধাবিতে আমিরের শাসন ইত্যাদি জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। ইরানের রেজাশাহ পাহলভী পারসি জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন যা ছিল ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। তুরস্কে মোস্তফা কামাল (আতাতুর্ক) ও মিসরের জামাল আবদুল নাসের যথাক্রমে তুর্কি ও আরব জাতীয়তাবাদের উগ্রপন্থা গ্রহণ করেন। এসব উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার সাথে মূলত সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা ছিল না; বরং ক্ষমতাসীন ও শহরের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এলিট শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দীর্ঘকাল ধরে আরব ও তুর্কি শাসকরা পারস্পরিক সহমর্মিতার ভিত্তিতে মুসলিম খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। তুর্কি খলিফার দরবারে অনেক আরব আলেম ও পণ্ডিতদের প্রাধান্য ছিল। তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো বিরোধ বা হীনম্মন্যতা পরিলক্ষিত হয়নি। ইউরোপের খ্রিষ্টান ও ইহুদি বুদ্ধিজীবীরা ক‚টকৌশলে আরব ও তুর্কি মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প অনুপ্রবিষ্ট করিয়ে দেয়। প্রাচ্য ইতিহাস বিশারদ বার্নার্ড লুইস লিখেন, তিনজন ইউরোপীয় ইহুদি তুর্কিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ধ্যান-ধারণার লেলিহান শিখা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ইংরেজ ইহুদি আর্থার লুমলে ডেভিড (১৮১১-৩২) ইংল্যান্ড থেকে তুরস্কে এসে চৎবষরসরহধৎু উরংপড়ঁৎংবং নামে একটি বই লিখেন; এতে তিনি তুর্কি জাতিকে আরবদের চেয়ে উন্নত ও স্বাধীনচেতা হিসেবে তুলে ধরেন। বইটি তরুণ তুর্কিদের মধ্যে সাড়া জাগায়। বইটি তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ডিভিড লিয়ন কোহন নামের আরেকজন ফরাসি ইহুদি ১৮৯৯ সালে তুর্কি জাতীয়তাবাদের পক্ষে এবহবৎধষব ধ খঐরংঃড়রৎব ফব খ’অংরব নামের একটি বই লিখেন। এতে তিনি তুর্কিদের অতীত গৌরব তুলে ধরেন। বইটি তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করে বিপুল সংখ্যায় বিতরণ করা হয়। ‘ইয়ং তুর্ক’ নামে খলিফার বিরোধী একটি গ্রুপকে কাজে লাগানো হয়। তাদের সমর্থকদের নিয়ে প্যারিস ও মিসরে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এরা তুর্কি জাতীয়তাবাদের পক্ষে প্রচারণা চালাতে থাকে। তৃতীয় ইহুদি ব্যক্তিটি ছিল হাঙ্গেরীয় আরমিনিয়াম ভ্যাম্বারি (১৮৩২-১৯১৮)। তিনি তুর্কি ভাষা, সাহিত্য ও জাতীয় ঐতিহ্যকে দেশপ্রেমের সাথে সম্পৃক্ত করে তুলে ধরেন। তিনি সমাজের উঁচু স্তরের রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। ক্রমান্বয়ে তাদের তুর্কি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন।

প্রকৃতপক্ষে ইহুদিদের লক্ষ্য ছিল তাদের কাক্সিক্ষত ভ‚মি ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করা। এ জন্য তাদের প্রাথমিক কৌশল ছিল তুর্কি খিলাফত ধ্বংস করে দিয়ে ফিলিস্তিনের দিকে অগ্রসর হওয়া। তাদের দৃষ্টিতে কাজটি সহজ করতে প্রয়োজন ছিল আরব ও তুর্কি মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী বিভেদ জাগিয়ে তোলা। এদের চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে নামেক কামাল, জিয়া পাশা ও জোয়াদাত পাশার মতো জাতীয়তাবাদী নেতারা বিষয়টি উগ্রতার পর্যায়ে নিয়ে যান।

অন্য দিকে, আরবদের মধ্যে কোনো তুর্কি-বিদ্বেষ ছিল না। কিন্তু তুর্কিদের মধ্যে আরব-বিদ্বেষ তীব্র হয়ে উঠলে আরবরাও তাদের জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষায় সক্রিয় হয়ে উঠে। এরূপ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা। ব্রিটিশরা আরবের খ্রিষ্টান মিশনারি ও পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে আরব জাতীয়তাবাদী চেতনা শানিত করে তোলে। প্রথমে তারা সফল হয় মিসর, সিরিয়া, লেবানন ও জর্দানে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের এজেন্ট নাজিব আজৌরি ১৯০৪ সালে প্যারিস থেকে আরব জাতীয়তাবাদের পক্ষে খব জবাবষ ফব খধ ঘধঃরড়হ অৎধনব নামে একটি বই লিখেন। সেই সাথে প্যারিসভিত্তিক আরব জাতীয়তাবাদী সমিতি গড়ে তোলেন। তিনি একটি ম্যাগাজিনও প্রকাশ করেন।

১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশরা ১৯১৬ সালে তুর্কিদের বিরুদ্ধে জর্দানের শরিফ হোসেনকে (বাদশা হোসেনের দাদা) যুদ্ধে প্ররোচিত করে এবং তাকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়। শরিফ হোসেন ছিল ব্রিটিশ এজেন্ট। তার ছেলে আবদুল্লাহ (বাদশা হোসেনের বাবা) ব্রিটিশ জেনারেল কিচনারের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন। শরিফ হোসেন তুর্কি খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তা টি ই লরেন্স ও প্যাস্টোইনে নিযুক্ত ব্রিটিশ কমান্ডার জেনারেল এলেনবি তুর্কিদের বিরুদ্ধে আরবদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন।

পাশ্চাত্যের ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের প্ররোচনায় আরব ও তুর্কি মুসলমানরা ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। শরিফ হোসেন ও কয়েকটি আরব গুপ্ত সংগঠন ব্রিটিশদের সাথে চক্রান্ত করে আরব বিশ্বকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। এর ফলে প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হয় ফিলিস্তিনের বুকে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র। ব্রিটিশরা দখলে নেয় মিসর, সাইপ্রাস, এডেন, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও পারস্য উপসাগরীয় শেখ-শাসিত রাজ্যগুলো। ফ্রান্স দখল করে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কো। রাশিয়া দখলে নেয় আর্মেনিয়া। ইতালি উপনিবেশ স্থাপন করে লিবিয়ায়। তুর্কি খেলাফত একবারে দুর্বল হয়ে পড়ে এং বিশাল সাম্রাজ্য ইস্তামবুল ও আনাতোলিয়ার একাংশে সীমিত হয়ে পড়ে।

১৯২২ সালে তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সমবেত হয়ে সুলতানের পদ বিলোপ এবং ১৯২৩ সালে তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। কামাল পাশা দেশের প্রেসিডেন্ট হন। তিনি তুরস্কের ইসলামী ঐতিহ্য ধ্বংস করে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও জীবনধারা চালু করার পদক্ষেপ নেন। আরবি ভাষাকে অফিস-আদালত ও শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিদায় দেন। তিনি দেশে পূর্ণ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন। তার দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়। কামাল পাশা তুরস্ককে একটি সেক্যুলার (লায়েকিজম) রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তবে ইসলামী আইন-কানুন তুর্কি সমাজে এমন শক্তভাবে শেকড় গেড়েছিল যে, তা সহজে উপড়ে ফেলার মতো ছিল না। এটি উপলব্ধি করে কামাল পাশা কতিপয় ইসলামী আইন-কানুনকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসেন। তিনি ‘দিয়ানেত’ নামক একটি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ধর্মীয় সংস্থা গঠন করেন। ১৯৩৭ সালে দেশটির পার্লামেন্ট যে সংবিধান অনুমোদন করে তাতে সেক্যুলারিজমকে (লায়েকিজম) রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সে নীতি এখনো বহাল আছে। দেশটির সেনাবাহিনী ও সাংবিধানিক আদালত এ নীতি বহাল রাখার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে থাকে।

শুধু জাতীয়তাবাদী আদর্শ নয়, একই নামে সেক্যুলার মতাদর্শকেও প্রতিষ্ঠিত করতে বিভিন্ন শাসক কঠোর উদ্যোগ নেন। তুরস্কে কামাল আতার্তুক সুফি দর্শন ও ইসলামী মূল্যবোধ প্রত্যাখ্যান করে মসজিদ, মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন। তিনি আজান নিষিদ্ধ করেন। আরবির পরিবর্তে তুর্কি ল্যাটিন ভাষা বাধ্যতামূলক করেন। মুসলিম নারীদের ইউরোপীয় পোশাক পরতে বাধ্য করেন। অবশ্য এতে করে ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ নিঃশেষ হয়ে যায়নি; তবে আড়ালে চলে যায়।

মিসরে মোহাম্মদ আলী পাশা এবং পরবর্তীতে জামাল আবদুন নাসের (১৯১৮-৭০) সেক্যুলার মতবাদের জন্য কঠোর নীতি গ্রহণ করেন। তারা মিসরীয় আলেমদের প্রভাব ও কর্তৃত্ব খর্বের চেষ্টা করেন। হাজার হাজার আলেম ও মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ ও নানা ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়। ইরানের রেজাশাহ পাহলভী (১৯২১-৪১) ইরানের আলেমদের ক্ষমতা ও মর্যাদা ছিনিয়ে নেন। তিনি ইরানে ইসলামী আইনের পরিবর্তে সেক্যুলার সিভিল কোড প্রবর্তন করেন। তিনি আশুরা পালন ও হজে গমন নিষিদ্ধ করেন। তার সৈন্যরা ইরানে মুসলিম নারীদের হিজাব ও নেকাব বেয়নেটের খোঁচায় ছিঁড়ে ফেলত। শাহের এসব পোশাক নীতির বিরুদ্ধে ১৯৩৫ সালে মাসাদ নগরীতে অষ্টম ইমামের মাজারে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করলে সৈন্যরা গুলি চালিয়ে শত শত মানুষকে হতাহত করে। প্রখ্যাত আলেম আয়াতুল্লাহ মুদ্দারিস পার্লামেন্টে শাহের সমালোচনা করে বক্তৃতা করলে ১৯৩৭ সালে তাকে হত্যা করা হয়। এর ফলে ইরানের আলেম সমাজ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এতে শাহের প্রকাশ্য সমালোচনা হ্রাস পায়। এরপর শাহের পুত্র মুহাম্মদ রেজাশাহ (১৯৪৫-৭৯) সিংহাসনে আসীন হয়ে পিতার মতো একই কায়দায় সেক্যুলার ও ইসলামবিরোধী নীতি গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মূলত ইসলামবিদ্বেষী। তার নীতির বিরোধিতা করায় বিক্ষোভরত শত শত মাদরাসা ছাত্রকে হত্যা করা হয়। মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। আলেমদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়। অনেককে কারাগারে বা নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়। শাহের গুপ্ত পুলিশ বাহিনী সাভাকের নির্মম মানবাধিকার লঙ্ঘনের লোমহর্ষক বহু কাহিনীর সাথে বিশ্ববাসী পরিচিত।

পাশ্চাত্য স্টাইলে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে মুসলিম দেশগুলোতে কোনো সফলতা আসেনি। যদিও ইসলামের শূরা পদ্ধতি (পরামর্শ ব্যবস্থা) গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, তা সত্তে¡ও শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক গণতন্ত্র কার্যকরের ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ দেখা যায়নি। আর পাশ্চাত্য শক্তিগুলো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রায়নের কথা বললেও নিজেদের স্বার্থে গণতন্ত্রবিরোধী আমিরতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বানচাল করেছে। যেমন- ইরানে ১৯০৬ সালে সাংবিধানিক বিপ্লবের ফলে মজলিস (পার্লামেন্ট) স্থাপিত হলেও রাশিয়ার সহযোগিতায় রেজা শাহ তা বাতিল করে দেন। পরবর্তীতে ১৯২০ সালে ব্রিটিশরা যখন ইরানকে প্রোটেক্টরেট রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্যোগ নেয় তারা বিভিন্ন নির্বাচনে কারচুপি করে ফল তাদের পক্ষে নিয়ে নেয়। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে মোহাম্মদ রেজা শাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধলে শাহ মজলিস ভেঙে দেন।

মিসরে ১৯২৩ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বহুবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রত্যেকবার ওয়াফদ পার্টি জয়লাভ করে। কিন্তু তারা মাত্র কয়েকবার দেশ শাসনের সুযোগ পায়। প্রত্যেকবার হয়তো রাজা নতুবা ব্রিটিশরা ওয়াফদ পার্টিকে ক্ষমতায় যেতে বাধা দেয় অথবা ক্ষমতা থেকে নেমে যেতে বাধ্য করে। তুরস্কে বারবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও নির্বাচিত সরকার সামরিক বাহিনীর অপরিসীম প্রভাবে বারবার শাসনকাল পুরো করতে পারেনি। তুরস্কের সামরিক বাহিনী কামাল আতাতুর্কের সেক্যুলার নীতির রক্ষক হিসেবে দেশে এক ধরনের সামরিক স্বৈরতন্ত্র বজায় রাখে।

পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সব সম্প্রদারের কাছে গ্রহণযোগ্য সেক্যুলার নীতির অনুরাগী ছিলেন। অবশ্য তিনি দেশটির সংবিধান রচনার আগে ইন্তেকাল করেন। বহু বিতর্কের পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খান সংবিধান বাতিল করে সামরিক আইন জারি করেন। তিনি ছিলেন সেক্যুলার মতবাদে বিশ্বাসী। ইসলামী নীতির আবরণে সেক্যুলার মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালান। এমনকি মাদরাসা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ ও উত্তরাধিকার আইনে ইসলামী আইনের পরিবর্তে সিভিল কোড চালু করেন। তিনি ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে সীমিত মাত্রার গণতন্ত্র চালু করেন যা দেশটির ইসলামপন্থী ও সমাজতন্ত্রী দলগুলোর বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। অবশেষে তিনি ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন।

আরেক সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। এর প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। কিন্তু জনমতের প্রতি সম্মান না দেখিয়ে উল্টো পাকিস্তান বাহিনী সেখানে গণহত্যা চালায়। ফলে ৯ মাসের যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি সেক্যুলার সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি একদলীয় বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্র হত্যা করেন। অন্যদিকে, পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো সেক্যুলার বামপন্থা নীতি গ্রহণ করে দেশটির প্রেসিডেন্ট হন। তিনি ১৯৭৭ সালে ইসলামপন্থী সামরিক শাসক জিয়াউল হকের সামরিক শাসনের ধাক্কায় ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন এবং হত্যা মামলায় ফাঁসিতে ঝুলেন। জিয়াউল হক সামরিক ক্ষমতাবলে দেশে ইসলামী শরিয়াহ আইন চালুর চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক পদ্ধতিকে ইসলামীকরণ করেননি।

১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত সৌদি রাজতন্ত্র ছিল বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ভিন্নতর। এখানে জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, গণতন্ত্র বা আধুনিকতার পথে অগ্রসর হয়নি। সৌদি রাজতন্ত্রের উপর ইসলামী ধর্মীয় সংস্কারক মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের নৈতিক প্রভাব ছিল। ফলে রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান তার নির্দেশনায় পরিচালিত হয়। সৌদি সরকার মনে করে, কুরআন-সুন্নাহ বিদ্যমান থাকায় রাষ্ট্রের জন্য আলাদা কোনো সংবিধান রচনার প্রয়োজন নেই। দেশের প্রখ্যাত আলেমদের পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় আইনকানুন, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি পরিচালিত হয়। চুরির শাস্তি হাত কর্তন, প্রকাশ্যে শির-েদ ইত্যাদি কঠোর আইন করা হয়। তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতার অনুপস্থিতি ও রাজতন্ত্রের বৈধতার প্রশ্ন এখানে অমীমাংসিত উপর্যুক্ত পর্যালোচনা থেকে এটি প্রতীয়মান হয়, উমাইয়া, আব্বাসীয় আমল থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ইসলামীকরণ করেনি। তারা বিচার, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতিতে ইসলামী মূল্যবোধের পৃষ্ঠপোষকতা করলেও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তথা ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করে রেখেছিলেন। তবে মুসলিম সমাজে বিভিন্ন ইসলামী পণ্ডিত ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব নির্ভেজাল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ইসলামের শেষ নবী মোহাম্মদ সা: ধর্মীয় আদর্শের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তা ছাড়া আল-কুরআন রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূলনীতিতে যে সার্বভৌমত্বের রূপরেখা দিয়েছে তাকে মুসলমানরা উপেক্ষা করতে পারে না।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement

সকল