২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩ মাঘ ১৪৩১, ২৫ রজব ১৪৪৬
`

আফগানিস্তানের খবর কী

-

আফগানিস্তানে তালেবানপ্রধান সরকারের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে ভারতের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ। বিবিসি এক বিশ্লেষণে বলেছে, ভারত আফগান অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নতুনভাবে দেখছে। তালেবানের কাছে আফগান রাজধানী কাবুলের পতনের তিন বছর পর ভারতের এই পদক্ষেপ। তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পরে ভারত বড় ধাক্কা খেয়েছিল। কারণ, সামরিক প্রশিক্ষণ, বৃত্তি ও নতুন সংসদ ভবন নির্মাণের মেগা প্রকল্পে ভারতের দুই দশকব্যাপী প্রচুর বিনিয়োগ মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়। কাবুলের পতন আফগান অঞ্চলে পাকিস্তান ও চীনের প্রভাব সুপ্রশস্ত করে। পাশাপাশি ভারতের দুর্বলতা ফুটে ওঠে। নয়াদিল্লির কৌশলগত ভিত্তি দুর্বল হওয়ার ফলে সুরক্ষা সম্পর্কিত উদ্বেগও তৈরি হয়। এবার এই পরিস্থিতি বদলানোর একটি প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ে ভারতের শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক বিক্রম মিশ্রী তালেবানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। দুই পক্ষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের জন্য এ সাক্ষাৎ ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ। তালেবানের দৃষ্টিতে ভারত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি। অর্থনীতির দিক দিয়েও ভারত বিরাট। ওই বৈঠকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল চাবাহার বন্দর, যা ভারত তৈরি করছে করাচি ও গোয়াধর বন্দরকে পাশ কাটানোর জন্য।

মার্কিন থিংকট্যাংক উইলসন সেন্টারের মাইকেল কুগেলম্যান বিবিসিকে বলেন, ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তালেবান নেতৃত্ব যে বৈধতা চেয়ে এসেছিল, দিল্লি এখন তা দিয়ে দিয়েছে। এই পদক্ষেপ এমন একটি দেশের পক্ষ থেকে এসেছে, যার সাথে এর আগে তালেবানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। এতে বিষয়টি আরো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং তালেবানের জন্য কূটনৈতিক বিজয় বলে মনে করা হচ্ছে।

আফগানিস্তান তালেবানের অধীনে চলে যাওয়ার পর থেকে সে দেশে মানবাধিকার ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ দেখা দিয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। তালেবান সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে বিভিন্ন দেশ নানা ধরনের পন্থা অবলম্বন করছে। যেমন নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা চিন্তা করে তালেবান সরকারের সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পর্ক রেখেছে চীন। এখন পর্যন্ত কোনো দেশ তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না দিলেও ৪০টি দেশ কোনো না কোনোভাবে তালেবান সরকারের সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ রেখেছে। আফগানিস্তানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত জয়ন্ত প্রসাদ ভারতের সাম্প্রতিকতম পদক্ষেপের বিষয়ে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি রেখে জানিয়েছেন, গত তিন বছর ধরে তালেবানের সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে ভারত।

নব্বইয়ের দশকে গৃহযুদ্ধের সময়ে ভারত আফগানিস্তানে তার কনস্যুলেটগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ২০০২ সালে আবার তা চালু করেছিল। জয়ন্ত প্রসাদের মতে, ‘আমরা চাইনি ওই বিরতি ঘটুক। তাই আমরা যোগাযোগ গড়তে চেয়েছি। খুব সহজভাবেই এটি সম্পর্কের একটি ধাপ। ভারতের সাথে আফগানিস্তানের বন্ধন ঐতিহাসিক ও সভ্যতার বন্ধন। ভারতের পার্লামেন্টে গত বছর এমন মন্তব্য করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। আফগানিস্তানে পাঁচ শতাধিক প্রকল্পে ভারত ৩০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেছিল।

আফগান মেয়েদের জন্য স্কুল খুলে দিতে জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তালেবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানাকজাই। তিনি বলেন, ‘নারীদের শিক্ষার উপর বিধিনিষেধ আরোপ ইসলামী শরিয়াহ আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নারীদের জন্য শিক্ষার দরজা খুলে দেয়ার জন্য ইসলামিক আমিরাতের (আফগান তালেবান) নেতাদের কাছে অনুরোধ করছি।’

২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী প্রত্যাহারের জেরে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয় আফগান সশস্ত্র রাজনৈতিক দল তালেবান। এরপর নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত দেশটিতে নারীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় দলটি। এই নীতি আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।

শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানাকজাই ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে বহুজাতিক বাহিনী প্রত্যাহারের আগে কাতারের দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আলোচকদের একটি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তালেবান প্রশাসন স্তানাকজাইয়ের মন্তব্যের বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

তালেবান সরকার আফিম চাষ বন্ধ করে সেখানে কৃষিকাজ, বিশেষ করে ডালিম ও আঙুর চাষ করে, জুস তৈরি করে বিদেশে রফতানি করে অর্থ উপার্জন করছে। শরিয়াহ বাস্তবায়নের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে দেশটিতে।

আফগানিস্তানের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে দেশটির সম্পর্কের উপর। তালেবান সরকারের শাসনামলে দেশটিতে সহিংস ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হ্রাস পেয়েছে; নিরাপত্তা ব্যবস্থায় উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। দেশটিতে তালেবানের শক্তিশালী রাজনৈতিক কিংবা সশস্ত্র কোনো প্রতিপক্ষও নেই। এ ছাড়া দেশটি দুর্নীতি ও বিভিন্ন সশস্ত্রগোষ্ঠীকে দমন করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। রফতানি প্রধানত কৃষি, খনিজ ও বস্ত্রপণ্যকেন্দ্রিক, যা দিন দিন বাড়ছে। সর্বোপরি, বিশ্বের দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে যেহেতু আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত করতে পেরেছে, সুতরাং কোনো পরাশক্তি আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করবে না, যুদ্ধবিগ্রহ হওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে আফগানিস্তান তাদের নিজেদের ভাগ্য গড়তে পারবে। পরাশক্তির নিয়ন্ত্রণবিহীন, সামরিক কৌশলে অভিজ্ঞ, খনিজসম্পদে ভরপুর; সৎ, যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিরাট শক্তি হওয়ার সম্ভাবনা আফগানিস্তানের রয়েছে।

দুই দশকের যুদ্ধ শেষে ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের সেনাদের হটিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবান। ইসলামিক শরিয়াহ আইনের ভিত্তিতে দেশ চালানোর সিদ্ধান্ত তাদের। ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরেও দেশটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি কোনো দেশ। আসতে থাকে নিষেধাজ্ঞাসহ আন্তর্জাতিক চাপ। তালেবান নেতারা সেই ধাক্কা সামলিয়েছেন সফলভাবেই। সমাধান করেছেন বিভিন্ন গ্রুপের দ্বন্দ্ব। বিশ্বের সমর্থন ব্যতিরেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান পুনরুদ্ধার, দুর্নীতি দমনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। বদলেছে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন অর্জন করা। ২০২৩ সালের জুনে প্রথমবারের মতো উচ্চপর্যায়ের কোনো আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে আফগানিস্তান সফর করেছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী। স্বীকৃতি না পেলেও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের প্রত্যাশায় অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন, কাজাখস্তানসহ বিভিন্ন দেশের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে আফগান সরকার। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া ও ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে আটকে থাকা দেশটির শত শত কোটি ডলার অর্থ ছাড়ে আলোচনা চলছে। এসব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বরাবরই আফগানিস্তানে নারীদের ওপর তালেবানের বিভিন্ন বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল