মুসলিম বিশ্বে উপনিবেশের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
- ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব
- ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:১০
(দ্বিতীয় কিস্তি)
সভ্যতার ইতিহাসে পাশ্চাত্য শক্তির অভ্যুদয় একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। ইউরোপে আল্পস পর্বতমালার উত্তরাঞ্চলের দেশগুলো সর্বদা পশ্চাৎপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। দক্ষিণে রোমান সাম্রাজ্য ও গ্রিক সভ্যতা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে খ্রিষ্টধর্ম ও সংস্কৃতি বিকাশের চেষ্টায় ছিল। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ উল্লেখযোগ্য কোনো শক্তি হিসেবে আদৌ বিবেচিত হতো না। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দী থেকে তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে তারা বিশ্বকে নাড়া দিয়ে এক বিস্ময়কর শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
দু’-তিন শ’ বছরে পশ্চিম ইউরোপ অর্থনীতি, সমরশক্তি, শিক্ষা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে যে অগ্রগতি সাধন করে তার মোকাবেলায় মুসলিম উসমানীয় সাম্রাজ্য নিজেদের সংগঠিত করতে তেমন কার্যকর কোনো কৌশল গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। উসমানীয় শাসকরা পশ্চিম ইউরোপের উত্থানে সতর্কতা অবলম্বন করলেও তাকে দুর্বল প্রতিরোধ ছাড়া কিছু বলা যায় না। এ সময় মুসলিম সাম্রাজ্য প্রধানত কৃষিভিত্তিক ছিল এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানেও কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। পক্ষান্তরে, পশ্চিম ইউরোপ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে শিল্পায়নে অনেক দূর এগিয়ে যায়। ষোড়শ শতক নাগাদ তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশেষত চিকিৎসা, নৌ-যোগাযোগ, শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে দেড় হাজারের বেশি নতুন জিনিস আবিষ্কারে সক্ষম হয়; যা তাদের জীবনযাত্রায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেয়। পরবর্তী শিল্পবিপ্লবের ফলে প্রচলিত উৎপাদন পদ্ধতির স্থান দখল করে যন্ত্রপাতি; ফলে উৎপাদন বহুগুণ বাড়ে। একদিকে শিল্প পণ্যের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় সেগুলোর বাজারজাতকরণে তাদের নতুন নতুন বাজারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়; অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামালের সরবরাহ বৃদ্ধি করাও দরকার হয়ে পড়ে। নৌ-যোগাযোগে বিশেষত বড় বড় জাহাজ নির্মাণে তারা সাফল্য অর্জন করলে কাঁচামাল ও বাজারের সন্ধানে তারা এশিয়া ও আফ্রিকায় অভিযানে নেমে পড়ে। ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ ও ওলন্দাজরা এসব অভিযানে আবার পারস্পরিক স্বার্থের দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে পড়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয়দের দ্বারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে বারুদ, কামান ও বন্দুক আবিষ্কারে তারা সামরিক শক্তিতে প্রাধান্য অর্জন করে। এর মাধ্যমে তারা উপনিবেশ স্থাপনে সাফল্য পায়। একদিকে, নিজস্ব ও উৎপাদন ব্যবস্থা সংহত করা এবং অন্যদিকে, উপনিবেশ স্থাপনে সফলতা পাওয়ায় পশ্চিম ইউরোপীয়দের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন ও কাঠামোতেও পরিবর্তন আনে। ক্রমান্বয়ে যুক্তিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেক্যুলার রাজনৈতিক দর্শনকে প্রাধান্য দিতে থাকে। এ সময় পশ্চিম ইউরোপীয় সমাজে শিক্ষার হার দ্রুত বাড়ে এবং নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা ও ভোগস্পৃহা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সমবণ্টন ও শাসন পরিচালনায় তাদের অংশীদারিত্ব দেয়ার দাবি জোরদার হতে থাকে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তথা পরমত সহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও ধর্মীয় সহনশীলতার সংস্কৃতি বিকশিত হতে থাকে। শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশীদারিত্বের সুযোগ সৃষ্টি, অর্থনীতি ও শিক্ষার বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় পশ্চিম ইউরোপ দ্রুতগতিতে প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে সমর্থ হয়। সারা বিশ্বে তাদের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক শক্তির সম্প্রসারণ ঘটে।
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির সম্প্রসারণে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উপনিবেশগুলোর ওপর যে প্রভাব প্রতিক্রিয়া পড়ে তা ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।
প্রথমত, ইউরোপীয়রা উপনিবেশগুলো থেকে সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজ দেশে নিয়ে আধুনিক কলকারখানায় পণ্য উৎপাদন করত এবং সে পণ্য আবার সস্তায় উপনিবেশের বাজারে বিক্রি করত। এর ফলে ঔপনিবেশিক দেশগুলোর স্থানীয় শিল্পগুলো দ্রুত ধ্বংস হয়ে যায়। যেমন- বাংলার নীল ও তুলা সংগ্রহ করে ব্রিটিশরা বস্ত্রশিল্প গড়ে তোলে। ফলে বাংলার বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয়রা উপনিবেশগুলোতে তাদের স্বার্থসংরক্ষণ দীর্ঘায়িত করতে তাদের নিজস্ব আধুনিকীকরণের ধারণা ও শিক্ষা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। এ জন্য একটি ক্ষুদ্র সংখ্যাকে তারা ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেয়। অবশ্য তা ছিল সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের ইউরোপীয় চিন্তা-চেতনায় শিক্ষিত করে একটি অনুগত শ্রেণী গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
তৃতীয়ত, ইউরোপীয় বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সংহত করার লক্ষ্যে আইন-কানুন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ম-কানুনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়; যা ছিল দীর্ঘকালের স্থানীয় ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক।
চতুর্থত, ইউরোপীয়রা উপনিবেশগুলোতে স্থায়ীভাবে বসবাসের কৌশল না নিলেও তারা নতুন নতুন নগরী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। ইউরোপীয় স্টাইলে অবকাঠামো ও নগর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে অবিরাম কাজ করতে থাকে। এতে সুবিধাভোগী ছিল প্রধানত আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণী ও তাদের বংশধররা। এর ফলে বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নিজেদের নগর থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে থাকে। শহরের আধুনিক শ্রেণী ঔপনিবেশিক প্রভুদের সাথে হাত মিলিয়ে শাসন ক্ষমতায় অংশীদার হয়ে উঠে।
পঞ্চমত, ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে স্থানীয় অধিবাসীরা যে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তাকে নির্মমভাবে প্রতিহত করা হয়। অধিকন্তু, তারা একদিকে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে মিশনারিদের উৎসাহ ও সুযোগ করে দেয়; অন্যদিকে স্থানীয়দের মধ্যে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিরোধ এবং প্রতিহিংসা ছড়িয়ে দেয়। তারা ‘ভাগ করো-শাসন করো’ (ডিভাইড অ্যান্ড রুল) নীতি অনুসরণ করে।
ষষ্ঠত, ইউরোপিয়ানরা সরকারি ভাষা পরিবর্তন করে ইংরেজি, ফরাসি ইত্যাদি ভাষা অফিস-আদালতে চাপিয়ে দেয়। অন্যদিকে, তরুণদের একই ভাষায় লেখাপড়া শিখতেও বাধ্য করে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষানীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। শুধু অনুগত একদল ভৃত্য তৈরি করাই ছিল তাদের শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য। ব্রিটিশ ভারতে রবার্ট ম্যাকলের সুপারিশকৃত শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্টভাবে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়েছিল।
অবশ্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকরা এশিয়া ও আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে যে সব দেশে আধুনিকতার প্রক্রিয়া শুরু করে তাতে হিতে বিপরীত হয়। তাদের আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া স্বল্পসংখ্যক আধুনিক শিক্ষিত সামরিক আমলা ও চিহ্নিত কয়েকটি শ্রেণীর মধ্যে কিছুটা সাড়া জাগালেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে তা বহিরাগত ও অনাকাক্সিক্ষত বলে বিবেচিত হয়। যেমন- ভারতর্বষ শত শত বছর ধরে ইসলামী আইন-কানুনের আওতায় মুসলিম শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে; যেখানে হঠাৎ করে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য উৎখাত করে ইউরোপীয় নিয়ম-কানুন প্রবর্তনকে ভারতবাসী সহজে গ্রহণ করেনি। তবে ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত কতিপয় ক্ষুদ্র গোষ্ঠী তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিরোধিতা এরূপ প্রেক্ষাপটে ঘটেছিল। ইউরোপীয়রা সম্পদ লুণ্ঠন ও বাজার প্রতিষ্ঠায় উপনিবেশ স্থাপন করলেও আধুনিকতার নির্বাচিত কিছু উপাদানকে উপনিবেশগুলোতে কৃত্রিমভাবে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সমাজ পরিবর্তন বা নতুন কিছু প্রবর্তনে সংশ্লিষ্ট সমাজের অন্যান্য পারিপার্শ্বিক দিকগুলো বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখা প্রয়োজনা হলেও ইউরোপীয়রা তা করেনি। ফলে সর্বক্ষেত্রে তারা আধুনিকতাকে টেকসইভাবে প্রবর্তন করতে পারেনি।
মুসলিম অধ্যুষিত উপনিবেশগুলোতে তথাকথিত আধুনিকতার প্রভাব ছিল ভয়াবহ। কারণ কোনো দেশেই মুসলমানরা ঔপনিবেশিক শাসকদের মেনে নিতে পারেননি। একদিকে, মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া এবং অন্যদিকে, স্থানীয় ও ইউরোপীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আইন-কানুন তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ায় মুসলমানরা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ঔপনিবেশিক শাসকরা বিকল্প শক্তিকে তাদের কাছে টেনে নেয়। মুসলমানদের পশ্চাৎপদ, হীনম্মন্যযুক্ত ও প্রগতিবিরোধী গণ্য করতে ফন্দি-ফিকির করে। মুসলমানরা ইউরোপিয়ানদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখালেও শেষ পর্যন্ত তাদের দাপটের সামনে সফল হতে পারেননি। অচিরে তারা দীর্ঘকালের জন্য ইউরোপিয়ানদের পদানত হয়ে পড়েন। এতে করে এককালের পশ্চাৎপদ ইউরোপীয়রা ভাবতে এবং দাবি করতে থাকে, তারা অত্যন্ত প্রগতিশীল এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতি। এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারা উপনিবেশগুলোর জনগোষ্ঠীকে শাসন করার উদ্যোগ নেয়। এমনকি তারা এ জনগোষ্ঠীকে ‘শ্বেতাঙ্গদের বোঝা’ ‘হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন বলে গণ্য করতে থাকে। ব্যাপক হারে খ্রিষ্টান মিশনারিদের এসব দেশে পাঠিয়ে তারা খ্রিষ্টবাদ প্রচারের কর্মসূচি গ্রহণ করে। কিন্তু মজার বিষয় হলো- খ্রিষ্টান মিশনারিদের উদ্দেশ্য তেমন সাধন না হলেও ইউরোপীয়রা উপনিবেশগুলোতে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির যেসব বিষয় প্রবর্তন করে; সেগুলো তাদের শাসন-শোষণ সংহত করতে সহায়ক হয়।
ইউরোপীয় আগ্রাসী শক্তির কাছে একের পর এক মুসলিম ভূ-খণ্ডের পতন ঘটতে থাকলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর কোনো কোনো নেতা তাদের সাথে আপসের নীতি নিয়ে অধীনতামূলক মিত্রতায় নিজেদের টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়। যেমন- ভারতবর্ষে স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদের ব্রিটিশদের সাথে শত্রুতার নীতি পরিহার করে সমঝোতার নীতি গ্রহণ এবং ইংরেজিসহ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি এ লক্ষ্যে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। ইরানের অন্যতম বুদ্ধিজীবী মির্জা মুলকুম খান (১৮৩৩-১৯০৮) ইরানিদের মধ্যে সেক্যুলারিজমের পক্ষে এবং আগা খান কিরমানি (১৮৫৩-১৮৯৬) ইরাকি মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ ও ইসলামী আইনের পরিবর্তে ইউরোপীয় আইন গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। মিসরের লেখক রিফাহ আল তাহতাওঈ (১৮০১-১৮৭৩) তার লেখনীতে ইউরোপীয় রেনেসাঁর আদর্শে বিশেষত ফরাসি সংস্কৃতি গ্রহণে মিসরীয়দের অনুপ্রাণিত করেন। কেউ কেউ সংস্কৃতি বর্জন করে ‘জাতে উঠার’ চেষ্টা করতে থাকেন। উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের মুখে মোস্তফা কামাল ইউরোপীয় স্টাইলে তুরস্ক নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইসলামী মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য সমূলে বিনাশের পথ গ্রহণ করেন।
১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট বিপ্লব হলে মধ্য এশিয়া ও বলকান অঞ্চলে মুসলিম ভূ-খণ্ডগুলোতে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকরা বিভিন্ন দেশকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হলেও তারা এমন কিছু ভূ-রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয় যার ফলে ঔপনিবেশিক অভিশাপের বিষবাষ্প থেকে মুসলমানরা আজও মুক্ত হতে পারেননি। ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এর প্রমাণ।
মিসরের মোহাম্মদ আলী পাশা ইউরোপীয় আধুনিকতার ধারণাকে নিজ দেশে বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগ নেন। তিনি সুয়েজ খান খনন, ৯০০ মাইল রেলওয়ে লাইন নির্মাণ এবং ১৪ লাখ একর জমি সেচসুবিধার আওতায় নিয়ে অসেন। তিনি তার দেশে শত শত স্কুল এবং কায়রোকে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলেন। তিনি সেক্যুলার আদর্শে দেশ শাসন করেন। সেনাবাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করেন। তিনি তার বিরোধীদের নির্মমভাবে নির্মূল করেন এবং আধুনিক প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে। তিনি শরিয়াহ আইনকে পর্যায়ক্রমে বাতিল করেন এবং ওলামাদের ক্ষমতা কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। ফলে মিসরের আলেমসমাজ আধুনিকায়নকে সন্দেহের চোখে দেখেন এবং তাকে জাতির জন্য অকল্যাণকর বিবেচনা করেন। মোহাম্মদ আলী ও ইসমাইল পাশার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা মিসরে মঙ্গল বয়ে আনেনি। অচিরে দেশটি ঋণভারে জর্জরিত হয়ে পড়ে। এ সুবাদে ব্রিটিশরা দেশটির মাটিতে ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ পায়। পরিণামে এক সময় মিসর কার্যত ব্রিটেনের উপনিবেশে রূপান্তরিত হয়।
ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো সবচেয়ে ক্ষতিকর যে কাজটি করে গেছে তা হলো- ছোট ছোট মুসলিম রাষ্ট্রে তাদের পছন্দের স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে যায়। ইউরোপীয়দের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত ও তাদের স্বার্থের প্রতিভূ হিসেবে ক্ষমতাসীনদের অধিকাংশ ইউরোপীয় দর্শন ও রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে ইসলামের মতো মহান আদর্শকে তারা সামনে এনে বিবেচনা করতে আগ্রহী হননি। ফলে দেখা যায়, স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘদিন পরও মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ শাসক পাশ্চাত্য প্রভুদের স্বার্থে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না।
নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মুসলিম দেশগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে পাশ্চাত্যের দ্বারস্থ হয়। অথচ আগে থেকে এসব সমাজে ইসলামী আইন-কানুন, শিক্ষা ও অর্থব্যবস্থা জারি ছিল। সেসব ঐতিহ্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মুসলিম শাসক ও এলিট শ্রেণী পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু কোথাও তা সুফল বয়ে আনেনি। অন্যান্য ক্ষেত্রেও পাশ্চাত্য নীতি-আদর্শের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেমন- দ্রুত নগরায়নের ফলে সামাজিক অবকাঠামোর অভাব দেখা দেয়, ক্রমবর্ধিত হারে বেকারত্ব, সরকারি খাতে দুর্নীতির বিস্তার এবং ধনী-গরিবদের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। উন্নত জীবনযাত্রায় মানুষ স্বার্থান্বেষী হতে থাকে। যৌথপরিবার ভেঙে একক পরিবারের প্রতি অনেকে ঝুঁকে পড়েন। পাশাপাশি চিত্তবিনোদনে নতুন নতুন আধুনিক ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম প্রবর্তনে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হতে থাকে।
নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা অপরিহার্য উপাদানের পরিবর্তে একটি আপেক্ষিক বিষয়ে পরিণত হয়। রাজনৈতিক কাঠামোতে দেখা যায়, বহু মুসলিম দেশে রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহ, সামরিক স্বৈরশাসক ক্ষমতায় শক্তভাবে বসে আছেন। তাদের ক্ষমতায় যেতে জনগণের সমর্থনের কোনো প্রয়োজন হয়নি। তাদের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত। এসব দেশে মুক্ত পরিবেশের পরিবর্তে একটি কর্তৃত্ববাদী পরিবেশ ও কাঠামো অনুসৃত হচ্ছে; যা সিভিল সোসাইটি ও অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা