২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭ মাঘ ১৪৩১, ২০ রজব ১৪৪৬
`

কলুষিত নির্বাচন, নির্বাচনী বিরোধ ও অপরাধ

-

নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংস্থাটিকে যে সাংবিধানিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা হলো (ক) রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান; (খ) সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান; (গ) সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ এবং (ঘ) রাষ্ট্রপতি পদের এবং সংসদের নির্বাচনে ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ। উপরোক্ত দায়িত্বের বাইরে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের অধীন অন্য কোনো দায়িত্ব দেয়া হলে ইসি সে দায়িত্বও পালন করে থাকে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে ইসি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর বিধানাবলির অনুসরণে তার দায়িত্ব পালন করে থাকে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে দেখা যায়, ইসি বিভিন্ন স্থানীয় সরকারবিষয়ক আইনের অধীন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করে থাকে।

সংবিধানে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে, নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন থাকবে। কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন দায়িত্ব পালন করবে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা পুনঃবিজয়ী হয়েছে। অন্য দিকে ক্ষমতাসীন নয়, এমন সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে যে দল ক্ষমতাসীন ছিল সে দল পরাভূত হয়েছে।
সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে যে, এতদবিষয়ে প্রণীত আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করবেন। বাংলাদেশে ২০২২ সালের পূর্ববর্তী এতদবিষয়ে কোনো আইন প্রণীত হয়নি। ২০২২ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগবিষয়ক যে আইন প্রণীত হয়; তা ইতঃপূর্বে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাহী আদেশে যে সার্চ কমিটি গঠিত হয় উভয়ের অনুরূপ।

২০১৪ সালে নির্বাহী আদেশে গঠিত সার্চ কমিটি চারজন সাংবিধানিক পদধারী যথা- প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান সমন্বয়ে গঠিত ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাহী আদেশে যে সার্চ কমিটি গঠিত হয় তাতে উপরোক্ত চারজন সাংবিধানিক পদধারীর অতিরিক্ত ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন করে দু’জন শিক্ষক অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আইনের অধীন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০২২ সালে যে সার্চ কমিটি গঠিত হয়; তা নির্বাহী আদেশে গঠিত উভয় সার্চ কমিটির ন্যায় চারজন সাংবিধানিক পদধারীর অতিরিক্ত রাষ্ট্রপতির মনোনীত অন্য দু’জন সদস্য, যার একজন মহিলা, মোট ছয়-সদস্য সমন্বয়ে গঠিত ছিল।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর ২০২২ সালের আইনের অধীন প্রণীত সার্চ কমিটির সুপারিশে ইসি গঠিত হয়; যদিও ইসি গঠনকালীন নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম চলমান ছিল।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের কর্মরত বিচারকদের বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে যে, তারা স্ব স্ব বিভাগে আসন গ্রহণপূর্বক বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। উভয় বিভাগের বিচারকগণ সাংবিধানিক পদধারী এবং উভয় বিভাগে নিয়োগ-পরবর্তী প্রত্যেক বিচারককে শপথ গ্রহণ করাকালীন অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে হয় যে, তারা ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করবেন।

নির্বাহী আদেশে গঠিত সার্চ কমিটি এবং আইনের অধীনে গঠিত সার্চ কমিটি উভয় ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যে নামসমূহ প্রস্তাব করেছিল; তার মধ্য হতে সার্চ কমিটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকের মাধ্যমে দশটি নামের সুপারিশ রাষ্ট্রপতি বরাবর প্রেরণ করেছিল। এতদবিষয়ে ২০১৮ সালে দ্বাদশ নির্বাচন কমিশন গঠন পরবর্তী একদা তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে দরখাস্ত দাখিলের মাধ্যমে কোন দল কার নাম প্রস্তাব করেছে তা জানতে চাওয়া হলে সরকারের পক্ষ হতে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারকদের সবধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে সাংবিধানিক দায়িত্বের বাইরে অন্য কোনো দায়িত্ব পালন সংবিধান অনুমোদন করে না। সুপ্রিম কোর্টের একজন কর্মরত বিচারক তার সাংবিধানিক দায়িত্বের বাইরে নির্বাহী আদেশ বা আইনের অধীন গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে দায়িত্ব পালনে প্রশ্ন দেখা দেয়া স্বাভাবিক, কী পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অগণিত নামের প্রস্তাব হতে তারা দশটি নামের সুপারিশ প্রস্তুত করে রাষ্ট্রপতি বরাবর পাঠালেন? এতদবিষয়ে যে সারসংক্ষেপের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর নামের সুপারিশসমূহ পাঠানো হয় তাতে সুপারিশের যৌক্তিকতার কারণ উল্লেখ না থাকলে অনুরাগ বা বিরাগের প্রশ্ন অমূলক নয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ন্যায় সার্চ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত অন্য দু’জন সাংবিধানিক পদধারী যথা- মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান উভয়ে সাংবিধানিক দায়িত্ববহির্ভূত অন্য কোনো দায়িত্ব পালন করলে তাদের ক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ন্যায় সমরূপ ব্যাখ্যা প্রযোজ্য।

বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ এই তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন কলুষিত হিসেবে স্বীকৃত। সংবিধান ও আইনের উভয়ের বিধানাবলি পর্যালোচনায় স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে, উভয়ের অবজ্ঞা ও উপেক্ষায় নির্বাচনত্রয় অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসির ওপর অযাচিত প্রভাব বিস্তার করে ক্ষমতাসীনরা তাদের আকাক্সক্ষানুযায়ী ফল ঘোষণা ও ভোট প্রদানের হার নির্ধারণে নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করেছে। সার্চ কমিটির ক্ষেত্রেও যে অভিযোগ পাওয়া যায়, তা হলো ক্ষমতাসীন সরকারের আকাক্সক্ষানুযায়ী যে পাঁচজন সমন্বয়ে কমিশন গঠিত হবে; সে পাঁচজনের সুপারিশসহ অন্য পাঁচজনের সুপারিশ প্রেরিত হয়েছিল। এ কারণে কলুষিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায় ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার এবং তাদের আকাক্সক্ষায় গঠিত সার্চ কমিটি এবং ওই সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে গঠিত ইসি এড়াতে পারে না।

নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ইসি নিজস্ব স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা পরিহারপূর্বক যদি যে ক্ষমতাসীনদের আকাক্সক্ষা ও অভিপ্রায়ে তারা নিয়োগপ্রাপ্ত তাদের অভিলাষ চরিতার্থ করেন সে ক্ষেত্রে তাতে তাদের সংবিধান প্রদত্ত দায়িত্ব ও শপথের হানি ঘটে। যেকোনো সাংবিধানিক পদধারী তার সাংবিধানিক দায়িত্ব ও শপথের হানি ঘটিয়ে দায়িত্ব পালন করলে তা সংবিধানের বিদ্যমান বিধানের আলোকে অপরাধ। আর তাই এ তিনটি ইসির কৃত অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে তাদের বিচারের সম্মুখীন করে যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা হলে এটি ভবিষ্যতের নির্বাচন কমিশনসমূহের জন্য সাংবিধানিক দায়িত্ব ও শপথ হতে বিচ্যুত হয়ে দায়িত্ব পালনে অন্তরায় হিসেবে দেখা দেবে।

ইসির সাংবিধানিক পদধারীদের নিষ্কলুষ ও সবধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে সংবিধানে একজন ব্যক্তির প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে দায়িত্ব পালন পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগ বারিত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনারের ক্ষেত্রে এক মেয়াদে দায়িত্ব পালন পরবর্তী সিইসি পদে নিয়োগে যোগ্য করা হলেও প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগ বারিত করা হয়েছে। ’৭২-এর সংবিধানের বিধান অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগদানের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু অতীতে একাধিকবার সংবিধানের অবজ্ঞা ও উপেক্ষায় সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের ইসিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে সংবিধানের অবজ্ঞা ও উপেক্ষায় নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার পদে দায়িত্ব পালন-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন আধা-বিচারিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কমিশনের প্রধান হিসেবে আইন বিষয়ে ও বিচারিক অভিজ্ঞতা ছাড়া প্রশাসনিক অভিজ্ঞ ব্যক্তি আইন ও বিচারিক কার্যক্রম বিষয়ে অনভিজ্ঞ থাকায় দক্ষতার সাথে ইসির কার্য পরিচালনায় যে অক্ষম তা ইতঃপূর্বেকার একাধিক নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ পর্যালোচনায় প্রতিভাত। আর তাই সে নিরিখে কমিশনে অধস্তন বিচার বিভাগের জ্যেষ্ঠ জেলা জজ পদমর্যাদার অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের নিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে সামগ্রিকভাবে কমিশনের কর্মদক্ষতা ও সামর্থ্য যে বাড়বে এতে কারো মধ্যে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী-পূর্ববর্তী একটি ব্যতীত অপরাপর সব নির্বাচন কমিশন দুই বা সর্বোচ্চ তিন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত ছিল। বিচারিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি সমন্বয়ে গঠিত এ ধরনের ইসি দলীয় সরকারবহির্ভূত সরকারের অধীন বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করে দেশবাসীর আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছে।

নির্বাচন-পরবর্তী নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তিতে ২০০১ সালে পূর্ববর্তী জেলা জজ সমন্বয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান ছিল। ২০০১ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংশোধনী আনয়নপূর্বক নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে দিয়ে নির্বাচনী দরখাস্ত দাখিলের ছয় মাসের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সচেষ্ট থাকার কথা বলা হয়; কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগে নির্ধারিত বেঞ্চে অপরাপর মামলার আধিক্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একটি সংসদের মেয়াদ অবসানের পরও নির্বাচনী বিরোধবিষয়ক মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। নির্বাচনী বিরোধ ব্যতীত ইসির প্রশাসনিক ও আধা-বিচারিক আদেশের বিরুদ্ধে প্রায়শই হাইকোর্টে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা পক্ষ রিট দায়ের মাধ্যমে প্রতিকার প্রার্থনা করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিলম্বিত প্রতিকারে রিটের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এ অবস্থা হতে উত্তরণে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৪ দফা (২) এর বিধানাবলির আলোকে জেলা জজদের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকের মর্যাদায় নির্বাচনী বিরোধ ও নির্বাচনবিষয়ক রিট মামলাসমূহ বিচারের দায়িত্ব দেয়া সঙ্গত বিবেচিত হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নকালীন দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সে সময়ে অনুচ্ছেদ ৪৪ দফা (২) এ বিধান করে বলা হয়; সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২-এর অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটিয়ে সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোনো আদালতকে তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ওই সব বা এর যেকোনো ক্ষমতা দান করতে পারবেন। সংবিধান প্রণয়ন পরবর্তী দেশের জনসংখ্যা ও মামলার সংখ্যার তুলনামূলক বিচারে ব্যাপক বাড়লেও সংবিধানের নির্দেশনা কার্যকর করে দেশের বিচারপ্রার্থী জনমানুষকে প্রতিকার প্রদানে সংসদ তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে বিফল হয়েছে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পরবর্তী এবং ফল ঘোষণা অবধি নির্বাচন সংশ্লেষে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ নিরাময়ে দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ধারা ১৭১ঙ হতে ১৭১জ-তে বর্ণিত অপরাধসমূহের সাজা বাড়িয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৭৩ হতে ৮৬-তে বর্ণিত অপরাধে কার্যকর করা হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ বিশেষ আইন হওয়ায় স্বভাবত এটি দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ওপর প্রাধান্য পায়।

১৯৯৪ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ সংশোধনী আনয়নপূর্বক নির্বাচনপূর্ব অনিয়ম বিষয়ে তদন্তপূর্বক সুপারিশ প্রণয়নে যুগ্ম জেলা জজ ও সহকারী জজ সমন্বয়ে প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক ‘ইলেকট্রোরাল ইনক্যুয়ারি কমিটি’ গঠনের বিধান করা হয়। পাশাপাশি নির্বাচনের পূর্ব ও পরক্ষণে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত বিচারিক প্রক্রিয়ায় সাজা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এতে দেখা যায়, বিচারিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত তিন ধরনের ব্যক্তি সমন্বয়ে গঠিত কমিটি বা আদালত সমগোত্রীয় অপরাধের ক্ষেত্রবিশেষে তদন্ত ও বিচারিক কাজে নিয়োজিত। এ তিনটির প্রথমোক্তটির জ্যেষ্ঠ সদস্য উচ্চতর বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও এ কমিটিকে শুধু তদন্ত-পরবর্তী কমিশন বরাবর সুপারিশ পাঠানোর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

নির্বাচনকালীন যেসব অপরাধ সংঘটিত হয় এর অধিকাংশ আচরণবিধির সাথে সম্পৃক্ত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ইসির উদ্যোগে সব প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জন্য সর্বোচ্চ তিন থেকে চারটি প্রজেকশন মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে প্রচারণায় এসএমএস, ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতির ন্যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের বিধান করে পোস্টার, ব্যানার ও স্ব বা দলীয় উদ্যোগে আয়োজিত সভার ব্যবস্থা পরিহার করা হলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, নির্বাচন সংশ্লেষে সংঘটিত সবধরনের অপরাধ ও অনিয়ম নগণ্য সংখ্যায় নেমে আসবে। এতে সমগোত্রীয় অপরাধ বা অনিয়ম তদন্ত বা বিচারে বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন একাধিক কমিটি বা আদালতের কার্যকারিতা গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। সে বিবেচনায় ‘ইলেকট্রোরাল ইনক্যুয়ারি কমিটি’ অবসানে নির্বাচনকালীন এককভাবে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট মামলাসমূহ তাৎক্ষণিক ও দ্রুত বিচারে প্রতিটি জেলায় একজন যুগ্ম জেলা জজ এবং ম্যােিজস্ট্রেটের ক্ষমতাপ্রাপ্ত একজন সহকারী জজকে নির্ধারিত করে দেয়া যেতে পারে। যারা নির্বাচন সংশ্লেষে উদ্ভূত সবধরনের মামলা দ্রুত ও কার্যকরভাবে নিষ্পত্তি করবেন।

বর্তমানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা নির্বাচনী ব্যয়ে অনুমোদনপ্রাপ্ত। যদিও অতীতের কলুষিত নির্বাচনসমূহেও এই ব্যয়সীমা অতিক্রম প্রায়শই পরিলক্ষিত হয়েছে। উপরোল্লিখিত অনুচ্ছেদে বর্ণিত ব্যবস্থায় প্রচারণার কার্যক্রম পরিচালিত হলে নির্বাচনী ব্যয় ব্যাপক কমবে। এ হ্রাসকৃত অর্থ দিয়ে ইসির ব্যবস্থাপনা ও নির্দেশনায় প্রচারণাবিষয়ক সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে।

নির্বাচন পরিচালনায় রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসাররা মাঠপর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অতীতের অধিকাংশ নির্বাচনসমূহে প্রত্যক্ষ করা গেছে যে, দলীয় সরকারের অনুগত প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যগণ রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া-পরবর্তী সরকারের আকাক্সক্ষা ও নির্দেশনানুযায়ী দায়িত্ব পালন করে নির্বাচনকে অতিমাত্রায় বিতর্কিত করেছেন। এ অবস্থা হতে নিষ্কৃতির জন্য রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার পদে বহুমাত্রিক পেশা যেমন- সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষিজীবী প্রভৃতিতে কর্মরতদের নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এ ধরনের নিয়োগ দেয়া হলে বহুমাত্রিক পেশায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের মধ্যে কার চেয়ে কে সুষ্ঠুভাবে ও দক্ষতার সাথে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব পরিলক্ষিত হবে।

আইনের সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। গতিশীল সমাজে আইন স্থবির হলে তা কখনো সময় ও যুগের চাহিদা মেটাতে পারে না। কলুষিত নির্বাচন, নির্বাচনী বিরোধ ও অপরাধ বিষয়ে বিদ্যমান সংবিধান ও নির্বাচনী আইনে যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে; উপরোল্লিখিত আলোচনার আলোকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হলে তা নিরসনে এটি হবে একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
e-mail : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement