১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩ মাঘ ১৪৩১, ১৬ রজব ১৪৪৬
`

ভ্যাট আরোপে মূল্যস্ফীতি বাড়বে

-

ভ্যাট নিয়ে কথা বলার আগে এই সরকারের প্রতি জনগণের আকাক্সক্ষার কথা মনে করতে চাই। টানা ১৫ বছরের শাসনামলে ফ্যাসিস্ট শাসক হাজারো গুম-খুন, জেল-জুলম, গণহত্যা-গণধর্ষণ, লুটপাট-অর্থপাচার, রাষ্ট্রের সমস্ত মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করে দেশের সার্বভৌমত্ব হারানোর শঙ্কায় ফেলে দেশকে। আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য, তার উপর একের পর এক ট্যাক্স ধার্য এবং সেবার মূল্যবৃদ্ধি দুর্ভিক্ষের আভাস দিচ্ছিল। মানুষ অপেক্ষা করছিল ফ্যাসিজম ধ্বংসের জন্য একটি বলিষ্ঠ আহ্বানের। জুন মাসের ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ডাকে মানুষ সে সুযোগটি পেয়ে যায়। ছাত্রদের নেতৃত্বে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা; নারী-পুরুষ এমনকি শিশু-কিশোরও। সরকারের পেটোয়া বাহিনী ও তার সাথে সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্রের মুখে প্রতিরোধ গড়ে তোলে নিরস্ত্র জনতা। মাত্র ২০ দিনে দুই সহস্রাধিক তাজা প্রাণ, ৩০ সহস্রাধিক পঙ্গুত্ববরণের বিনিময়ে সক্ষম হয় ফ্যাসিজম তাড়াতে; পেয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।

এত ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর ক্ষমতায় বসানো হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তেমন ভূমিকা না রাখা কয়েকজনের সমন্বয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে। সঙ্গত কারণেই এই অন্তর্বর্তী সরকারের উপর জনগণের আকাক্সক্ষা ছিল আকাশচুম্বী। প্রথম দিকে সরকারের ভূমিকায় জনগণ আশাবাদী হয়ে উঠলেও ধীরে ধীরে সে আশা ক্ষীণ হয়ে আসছিল। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ফ্যাসিস্ট দুঃশাসন-পরবর্তী বিপ্লবের সরকারের জনআকাক্সক্ষার কোনো কাজই সুসম্পন্ন করতে না পারা। সরকারের অনেকেই বিপ্লবের স্পিরিট ধারণ করে না; অনেকের ব্যাপারে জনমনে অত্যন্ত নেতিবাচক ধারণা আছে। এতদসত্ত্বে¡ও এই সরকারের প্রতি দেশপ্রেমিক জনগণ আস্থা এখনো রাখছে এবং রাখতে চাচ্ছে।

এ কথা সত্যি, ১৫ বছরের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি মেরামত করা রাতারাতি সম্ভব নয়; তদুপরি অর্থনীতি মেরামতের আশায় বুক বেঁধে আছে দেশের জনগণ। কারণ সরকারের কাণ্ডারি যে একজন বিশ্ববরেণ্য নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ। রেমিট্যান্স সংগ্রহ, রিজার্ভ বৃদ্ধি, রাজস্ব আয়ে ইতিবাচক ধারা, বিমান, শিপিং করপোরেশনের স্মরণকালের সবচেয়ে লাভে আসাসহ অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক ধারায় দেশের অর্থনীতি। কিন্তু মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে এখনো জনগণ হতাশ। এখন অবশ্য শীতের শাক-সবজির উৎপাদন মৌসুম হওয়ায় দাম অনেক কম হলেও অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তদুপরি জনগণ ভবিষ্যতের আশায় বুক বেঁধে থাকলেও হঠাৎ অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে অধ্যাদেশের মাধ্যমে হুট করে শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর বা (ভ্যাট) বাড়ানোর পাশাপাশি ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি বন্ধ হওয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিদায়ী বছরের পুরো সময় দেশের মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে চাপে ছিল জনগণ। বিবিএস তথ্য মতে, নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ওই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত মাসে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। তার উপর সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত গোটা বাজারেই প্রভাব ফেলবে এবং উসকে দেবে মূল্যস্ফীতিকে; প্রান্তিক আয়ের মানুষের সাথে মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাবে। রাজনৈতিক দল ছাড়াও ভোক্তারা সরকারের এ পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়া না হলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজস্ব আদায়ে ধস নামার প্রভাব ঠেকাতে এবং আইএমএফের কাছ থেকে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন ডলার পেতেই সরকার কর আদায়ের এ সহজ পথ বেছে নিয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের অনুমোদন দিয়েছিল আইএমএফ। এই ঋণের চতুর্থ কিস্তির টাকা পাওয়ার অপেক্ষায় সরকার। পাশাপাশি আইএমএফ থেকে আরো এক বিলিয়ন ডলার সহায়তা চাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, আইএমএফের সাথে আলোচনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দরকষাকষিতে দক্ষতার অভাবেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হয়েছে। উল্লেখ্য, আইএমএফের কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর শর্ত গত কয়েক বছরের সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কিভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর বিষয়ে একমত হলো সেটিই আশ্চর্যের বিষয়। অবশ্য কয়দিন আগে অর্থ উপদেষ্টা বলেছিলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, জরুরি অনেক পণ্যের শুল্ক কমিয়ে ‘শূন্য’ করা হয়েছে। এর আগেও বিতাড়িত সরকার আইএমএফের চাপে বেশ কিছু হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যার বোঝা দেশের জনগণ বইছে।

কিসে বেড়েছে শুল্ক ও কর

যেসব পণ্য ও সেবায় শুল্ক বেড়েছে তার মধ্যে অন্যতম, মুঠোফোনের সিম বা রিম কার্ডের সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে ২৩ শতাংশ; সাথে ইন্টারনেট সেবার শুল্কও বেড়েছে। পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ; সব ধরনের রেস্তোরাঁর বিলের ওপর ভ্যাট ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ; মিষ্টির দোকানের ভ্যাটও সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের টিস্যুর ওপর ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ; শিশুদের পছন্দের বিস্কুট, জুস, ড্রিংক, ফলের রস, ইলেকট্রোলাইট ড্রিংক, কেক, আচার, টমেটো সস ও কেচাপ ইত্যাদির উপর পণ্যভেদে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে। শুল্ক-কর বৃদ্ধি পেয়েছে আমদানি করা বাদাম, আম, কমলালেবু, আঙুর, আপেল ও নাশপাতি, ফলের রস, যেকোনো ধরনের তাজা ফল, রং, ডিটারজেন্টে। এ ছাড়া পটেটো ফ্ল্যাকস, প্লাস্টিক ও মেটাল চশমার ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, সান গ্লাস, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও তাতে ব্যবহৃত তেল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, সিআর কয়েল, জিআই তারে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া এলপি গ্যাসে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ; ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট হার ২ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি যেকোনো ধরনের স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।

বর্তমানে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ৫০ লাখ টাকা থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক লেনদেনে টার্নওভার কর দিতে হতো। এখন বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার বা লেনদেন কর দিতে হবে। অভ্যন্তরীণ পথে বিমানযাত্রায় আবগারি শুল্ক ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা; সার্কভুক্ত দেশভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা, সার্কভুক্ত দেশের বাইরে দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার এবং ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণে আবগারি শুল্ক তিন হাজার থেকে বাড়িয়ে চার হাজার টাকা করেছে।

বিকল্প কী হতে পারত

এ কথা সত্যি, সরকার যে খুশি মনে এই ভ্যাট এবং শুল্ক আরোপ করেছে, তা-ও নয়; বরং আইএমএফের অর্থ পেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে এবং বিনিময় হারের চাপ কমবে মনে করেই এই অজনপ্রিয় পথে হেঁটেছে। জানা গেছে, আইএমএফের শর্ত হলোÑ চলতি বছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে, যা সরকার করতে পারেনি। আবার জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এই প্রান্তিকে রীতিমতো বিপর্যয় হয়েছে এবং এই পরিস্থিতির কীভাবে উন্নতি হবে তা নিয়ে উদ্বেগ আছে। সরকারি হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায় করেছে এক লাখ এক হাজার ২৮১ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অন্তত ৩১ হাজার কোটি টাকা কম। দেশের পরিস্থিতির উন্নতি হোক আর না হোক, আইএমএফের ঋণ চুক্তিমাফিক ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি অনুপাতে কর সংগ্রহ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ পয়েন্ট বাড়াতে হবে। ব্যর্থ হলে সামনের ঋণ কিস্তি তো পাবেই না, এক বিলিয়ন ডলার ঋণের আশাও পূরণ হবে না।

তবে, দেশের পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী শুল্ক বা ভ্যাট এভাবে না বাড়িয়ে সরকার প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে এবং কর ফাঁকি রোধের উদ্যোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর এ চাপ তৈরি নাও করতে পারত। পাশাপাশি, সুযোগ ছিল টিআইএন নম্বরধারীদের রিটার্ন সাবমিট নিশ্চিত করা এবং করযোগ্য যারা করের আওতার বাইরে আছেন তাদের করের আওতায় নিয়ে আসা। উল্লেখ্য, যদিও কিছু ক্ষেত্রে সরকার ব্যয় সাশ্রয় করা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনায় কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারপরও সরকার ঢালাওভাবে শুল্ক কর না বাড়িয়ে সম্পত্তি কর, যেমন- একাধিক বাড়ি বা গাড়ির ক্ষেত্রে কর পুনর্বিন্যাস, সম্পদের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে করের স্লাব নির্ধারণ ইত্যাদি করলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়াতে হতো না। এ ছাড়াও, দুর্নীতিবাজ যাদের সম্পদ জব্দ হয়েছে বা অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ হয়েছে সেগুলোকে ব্যবহার করা এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যেত। এতে বৈষম্য কমত, দুর্নীতি দমন ও লুটপাটকারীদের শাস্তির কর্মসূচি অগ্রসর হতো এবং মুদ্রাস্ফীতিতে কোনো বাড়তি চাপ পড়ত না।

পরিশেষে বলব, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবায় শুল্ক, কর, ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা সরকারের প্রতি দেশপ্রেমিক নাগরিকদের দাবি। এ ছাড়াও টিসিবির মাধ্যমে ট্রাক সেল আবার শুরু এবং আইএমএফ ঋণের চুক্তিশর্ত পুনর্বিবেচনারও আহ্বান জনসাধারণের। সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যাতে নেমে না যায় এবং তাদের ভোগান্তি যেন বেড়ে না যায়। বিগত অবৈধ সরকারের গণবিরোধী লুটেরা অর্থনৈতিক নীতি ও বিদেশে সীমাহীন অর্থ পাচারের ফলে সাধারণ মানুষও মধ্যবিত্তের জীবন ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে। মহামারী করোনায় নিঃস্ব হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়েছিল। তারা এখনো শহরে ফিরতে পারেনি।

সর্বোপরি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যেমন ঠিক রাখতে হবে তেমনি কোনো অবস্থায়ই ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে তড়িঘড়ি করে নির্বাচন দিয়ে জনগণের আকাক্সক্ষার বিপরীতে অবস্থান নেয়া যাবে না। খেয়াল রাখতে হবে, জনগণের অনেক বড় ত্যাগের বিনিময়ে গড়া অন্তর্বর্তী সরকারের সফল হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কারণ অনেক রাজনীতিবিদ মুখিয়ে আছে ক্ষমতায় গিয়ে লুটপাটের জন্য; তা যদি দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আধিপত্যবাদীদের সাথে আপস করার বিনিময়ে হয় তাও।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement

সকল