১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০১ মাঘ ১৪৩১, ১৪ রজব ১৪৪৬
`

প্রসঙ্গ : স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার

-

রাজনৈতিক বিভাজন ধর্ম বিশ্বাস ভাষা ও গোত্রের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে নাগালের মধ্যে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে যাত্রা শুরু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। ১৯৬৬ সালে জাতিসঙ্ঘ ‘the right of everyone to the enjoyment of highest attainable standard of physical and mental health’ অনুচ্ছেদটি Universal Declaration of Human Rights (UDHR) এ সংযোজন করে। উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলো যেন তার নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত বর্জ্য নিষ্কাশন, খাদ্যনিরাপত্তা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা প্রদানের কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে। বাংলাদেশ স্বাক্ষরদাতা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সদস্যরাষ্ট্র। জনগণের জন্য এই সেবা বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারেনি। এখনো এ দেশের স্বাস্থ্যসেবার ৬৫ শতাংশ ব্যয়ভার রোগীকে বহন করতে হয়। বছরে মাথাপিছু ৫৮ ডলার বরাদ্দের চিত্রই স্বাস্থ্যসেবার দুর্দশার কথা প্রকাশ করে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা মূলত সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ, ব্যক্তিগত উদ্যোগ, এনজিও উদ্যোগ, এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদীসহ Traditional Medicine প্রভৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। একই সাথে শহর ও গ্রামের চিকিৎসাসুবিধার তারতম্য, ওষুধের উচ্চমূল্য, ভেজাল ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে প্রতিরোধী জীবাণুর আধিক্য, অপ্রতুল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক, নার্স, প্যারামেডিক্যাল স্বল্পতা, লাইসেন্সবিহীন চিকিৎসকের আধিপত্য, সব মিলিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থার একটা লেজে গোবরে অবস্থা। অভিজ্ঞ শিক্ষকের স্বল্পতা ও মানসম্পন্ন ট্রেনিং প্রতিষ্ঠানের অভাব যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরির একটি প্রধান অন্তরায়। এছাড়া রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টায় শিক্ষক এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোবিহীন বিভিন্ন নতুন নতুন মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা সামগ্রিক সঙ্কটকে আরো ঘনীভূত করেছে।

স্বাস্থ্যসেবা সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিশন গঠন করেছেন। কমিটির প্রাথমিক সুপারিশ প্রকাশিত হলে এ ব্যাপারে আলোচনা ও পরামর্শের সুযোগ তৈরি হতো। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ মৌলিক কয়েকটি সমস্যায় আটকে আছে। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে এর প্রশাসন। দুর্ভাগ্যক্রমে যারা স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করেন, স্বাস্থ্য বিভাগের পদায়ন করেন, স্বাস্থ্যসেবায় প্রাধিকার নির্ধারণ করেন, তারা পেশায়, শিক্ষায়, চিন্তায়, চেতনায় স্বাস্থ্যসেবী নন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রাধিকারের ব্যাপারটি অস্বচ্ছ থেকে যায়। দ্বিতীয়ত; পুরো স্বাস্থ্যসেবাকেই রাজনীতি এবং দলীয়করণের মোড়কে ঢেকে দেয়া হয়। ফলে জনগণ অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। একই সাথে অনভিজ্ঞ দলীয় ক্যাডারদের অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের ডিঙিয়ে উঁচু পদে নিয়োগ দেয়ায় প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায় না। এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে যেখানে শিক্ষককে ডিঙিয়ে তারই ছাত্রকে একই বিভাগে উঁচু পদে বসানো হয়েছে। তৃতীয়ত; রাজনৈতিক বিবেচনায় মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা। ন্যূনতম মাপকাঠির তোয়াক্কা না করে দেশে প্রচুর বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সরকারি ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। শিক্ষকহীন, হাসপাতালবিহীন এসব মেডিক্যাল কলেজ এক দিকে যেমন স্বাস্থ্যসেবার বারোটা বাজাচ্ছে অন্য দিকে তেমনি চিকিৎসা শিক্ষার মানকেও প্রশ্নের মুখোমুখি করছে। এ অবস্থায় লাখ লাখ রোগী চিকিৎসার প্রত্যাশায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে ।

চিকিৎসাসেবার বেহাল অবস্থার আরেকটি কারণ স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষাকে একসাথে গুলিয়ে ফেলা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পৃথক পৃথক মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের প্রায় ২০০ এর কাছাকাছি প্রতিষ্ঠান এবং সমসংখ্যক সহযোগী প্রতিষ্ঠানসহ লক্ষাধিক চিকিৎসকের পদায়ন পদোন্নতি জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো একটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে পৃথক মন্ত্রণালয় থাকা নিতান্তই বাঞ্ছনীয়। Ministry of professional education নামক পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করে স্বাস্থ্য, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি, নার্সিং জাতীয় বিষয়গুলোর শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য পরিষেবাসংক্রান্ত বিষয়টি দেখভাল করবেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। একই ধারাবাহিকতায় স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাসম্ভব স্বাধিকার দেয়া প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্ব পালন করে বিদ্যুৎ বিভাগ। জরুরি প্রয়োজনে তাদের করুণার ওপর নির্ভর করে থাকতে হয়। একইভাবে ভবন নির্মাণ এবং সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে গণপূর্ত বিভাগ। ফলে সমতালে সমভাবে চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষার ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ বছরের পর বছর পড়ে থাকে অবহেলায়, অবলীলায়। এ ছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এর ছাড়পত্র আনার দুর্ভোগ তো রয়েছেই। রয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসূত্রতা। ফলে দেখা যায় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়ে পড়ে আছে, জনবল নেই, জনবল আছে, সেবা দেয়ার ব্যবস্থা নেই। এসব থেকে স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষাব্যবস্থার অবমুক্তি প্রয়োজন।

প্রয়োজনীয় ওষুধের বেশির ভাগ রোগীদের বাইরে থেকে কিনতে হওয়ায় এখানেও তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট। এদের অত্যাচারে সারা দেশেই ওষুধের সঙ্কট লেগেই থাকে। এ ক্ষেত্রে ন্যায্যমূল্যে রোগীদের জরুরি এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে ন্যায্যমূল্যে দেয়ার ব্যবস্থা করা গেলে এক দিকে যেমন সিন্ডিকেট বাণিজ্য কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকবে, অন্য দিকে সেবাপ্রত্যাশীরা উপকৃত হবেন নিঃসন্দেহে। স্বাস্থ্যসেবার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল তৈরির বিধানের অনুপস্থিতি সুষ্ঠু স্বাস্থ্যসেবার আর একটি অন্তরায়। স্বাস্থ্য বিভাগের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও সমতা বিধান করা প্রয়োজন। যারা শিক্ষাক্রমে যুক্ত থাকবেন তাদের ক্রমধারায় সচিব পদমর্যাদায় উন্নীত হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। যারা স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত থাকবেন তাদেরও একইভাবে পদোন্নতির ব্যবস্থা জরুরি। স্বাস্থ্যশিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা স্বভাবতই দু’টি ভিন্নমুখী ধারা। স্বাস্থ্যশিক্ষা ধারায় যারা সংযুক্ত থাকবেন তাদের জন্য পৃথক অধিদফতর করা হবে বাস্তবসম্মত। গবেষণা খাতে বরাদ্দ নেই বললেই চলে। গবেষণা ছাড়া চিকিৎসাক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়।
বিভিন্ন ধারার চিকিৎসাসেবাকে একটি সমন্বিত কেন্দ্রীয় ধারায় রূপান্তরিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সহযোগী ও নার্স তৈরির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এর একটি চ্যালেঞ্জ। বায়ো মেডিক্যাল প্রকৌশলের অভাব পূরণ করা অত্যন্ত জরুরি। মেডিক্যাল কলেজগুলো স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণার্থীর ভারে ন্যুব্জ। যাদের জন্য মেডিক্যাল কলেজ, তাদের শেখানোর কোনো সুযোগই নেই সেখানে। একটি পরিপূর্ণ জনমুখী সাশ্রয়ী স্বাস্থ্য পরিষেবার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি সমাধানের ব্যবস্থা করা না গেলে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement