১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০১ মাঘ ১৪৩১, ১৪ রজব ১৪৪৬
`

রাখাইনে নতুন বাস্তবতা ও রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ফেরা

-

রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সাত বছরের ব্যর্থ কূটনীতির পর রাখাইনে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি বাংলাদেশ। দেশের অন্তর্বর্তী সরকার নতুন পরিস্থিতির আলোকে রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের দিকে এগোতে চাইছে। এই উদ্যোগের কেন্দ্রে থাকবে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ফোরামগুলো। সেই সাথে এ বিষয়ে সক্রিয় পক্ষকে আরো প্রত্যক্ষ উদ্যোগে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা থাকবে। এ জন্য একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের চেষ্টা করছে ঢাকা। প্রত্যাবাসন এগিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের তিনটি পক্ষ- জান্তা সরকার, এনইউজি ও আরাকান আর্মির সাথে ঢাকা সম্পর্ককে কিভাবে বিন্যাস করবে সেই চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে।

গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা শাসনের পতনের পর আগস্টে ক্ষমতা গ্রহণের পরে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে বিশেষ প্রচেষ্টা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন প্রশাসনের প্রধান হিসেবে প্রথম বক্তৃতায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে আশ্রিত ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সহায়তা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি ‘টেকসই প্রচেষ্টা’ নিয়ে তাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। একই সাথে তিনি এ জন্য মিয়ানমারে একটি নিরাপদ জোন গঠনের বিষয়টিও সামনে আনেন।

গত নভেম্বরে, অন্তর্বর্তী সরকারের লবিংয়ের ফলে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ পরের বছর একটি ‘উচ্চ-স্তরের সম্মেলন’ করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাব অনুযায়ী, এই সম্মেলন ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনসহ সঙ্কটের টেকসই সমাধানের জন্য একটি ব্যাপক, উদ্ভাবনী, সুনির্দিষ্ট ও সময়সীমাবদ্ধ পরিকল্পনায়’ অবদান রাখবে। এ সম্মেলন আগামী সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হতে পারে। এপ্রিলের মধ্যে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। সম্ভাব্য ভেন্যু হিসেবে বাংলাদেশ ও কাতারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

গত এক দশকে আরাকান আর্মির উত্থান শেখ হাসিনার সরকার মূলত উপেক্ষা করেছে। সে সময় সরকারের রোহিঙ্গা কৌশল নানা ধরনের বৈপরীত্য ও নিষ্ক্রিয়তায় অনেকখানি অকার্যকর হয়ে পড়ে। অন্তর্বর্তী সরকার এসে এ ক্ষেত্রে একটি সক্রিয় নীতি গ্রহণ করেছে। প্রধান উপদেষ্টা একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগ করেছেন। উৎসাহব্যঞ্জক এই উদ্যোগে হাসিনার শাসনামলে অনাকাক্সিক্ষত বিষয়গুলোর সমাধানের উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মধ্যে সামরিক জান্তা সরকারের সাথে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক যোগাযোগ অক্ষুণ্ন রাখার পাশাপাশি রাখাইনের কার্যত নিয়ন্ত্রক আরাকান আর্মি এবং বিরোধীদের সমন্বিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) সাথে সংলাপের সম্ভাবনা নিয়ে আধা-আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ স্থাপন করা হচ্ছে।

রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের চ্যালেঞ্জ ও নতুন বাস্তবতা

বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক সূত্রের অনুমান অনুসারে সারা বিশ্বে ২৮ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে, যাদের মধ্যে মাত্র ২৩ শতাংশ তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে রয়ে গেছে। এদের বড় অংশই অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত। মিয়ানমার বাদে, সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা জনসংখ্যার চারটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১১ লাখ, পাকিস্তানে চার লাখ, সৌদি আরবে তিন লাখ ৪০ হাজার এবং মালয়েশিয়ায় দুই লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে।

এসব দেশের রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন। সৌদি আরব ও পাকিস্তানে, বেশির ভাগ রোহিঙ্গা কয়েক দশক আগে গিয়েছিলেন এবং তাদের সন্তানরা নিজেদের মাতৃভূমি দেখেনি। তবে গত পাঁচ বছরের মধ্যে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়। যারা বিদেশে ২০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছে তাদের মধ্যেও ২৮ শতাংশ স্বদেশে ফিরতে চায়। সেখানে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে এই সংখ্যা অনেক বাড়বে বলে ধারণা করা যায়।

মিয়ানমারের সামরিক সরকার এখন দেশের বেশির ভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। রাখাইনে, বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির পর, এর কর্তৃত্ব রাজ্যের রাজধানী সিটওয়ে, মুনাউং দ্বীপ ও কিয়াউকফিউ এবং গওয়া শহরের ছোট অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। শেষেরটিরও পতন হতে চলেছে।

একটি প্রধান শক্তি হিসেবে আরাকান আর্মির আবির্ভাবের আগেও, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক পদ্ধতি ব্যর্থ হওয়ার পথে ছিল মিয়ানমারে। ২০১৭ সাল থেকে, চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা নেয় কিন্তু এগুলো বহুলাংশে ব্যর্থ হয়। রোহিঙ্গা ও রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে এই প্রচেষ্টায় মূলত বাইরে রাখা হয়। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রত্যাবাসন পুনরায় শুরুর প্রচেষ্টা আরো কম সফল উদ্যোগে পরিণত হয়। প্রত্যাবাসন সফল করতে হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরাকান আর্মির প্রকৃত আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ মেনে নিয়ে রোহিঙ্গা সম্পর্কিত অন্যান্য জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে এগোতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

রোহিঙ্গাসংক্রান্ত যেকোনো আন্তর্জাতিক আয়োজনের জন্য সামরিক সরকারের সাথে যোগাযোগ থাকতে হবে। সেটি বাংলাদেশ সরকারের রয়েছে এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ফোরামগুলোর সাথে এ নিয়ে যোগাযোগ রয়েছে ঢাকার। এর পাশাপাশি দেশটির বৃহত্তর অংশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকারীদের সমন্বয়ক শক্তি হিসেবে এনইউজির সাথে আধা-আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের প্রয়োজন রয়েছে। এর পাশাপাশি আরাকানের বৃহত্তর ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রক আরাকান আর্মি এবং রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বকারী গ্রুপকেও এই উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক পক্ষ হিসেবে নিয়ে আসতে হবে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন আরএসওকে এক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা যেতে পারে। এর বিকল্প হতে পারে রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিত্বশীল একটি কাঠামো তৈরি করা। রাখাইনে স্পষ্টতই ডি ফ্যাক্টো কর্তৃত্ব থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ এখনো একটি অ-রাষ্ট্রীয় পক্ষকে সংলাপে জড়িত করার বিষয়ে দ্বিধায় রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দ্বিধা দেখা যায় রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও।

আরাকান আর্মির সাথে যেকোনো সংশ্লিষ্টতার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দেয়ার বিষয়ে এনইউজি সরকারের আনুষ্ঠানিক ইতিবাচক বক্তব্য রয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকারও এ বিষয়ে নমনীয়তা গ্রহণ করেছে এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের বিষয়টি মেনে নিয়েছে। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার এখনো অস্বীকার করে চলেছে এবং তাদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ হিসেবে উল্লেখ করছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চল দখলের পর সেখানে গণহত্যা চালানোর অভিযোগও উঠেছে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে। ফলে আরাকান আর্মির সাথে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক যে ধরনের যোগাযোগই তৈরি করা হোক না কেন সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের নাগরিক ও অর্থনৈতিক অধিকারসহ পুনর্বাসনের বিষয়ে তাদের সম্পূর্ণ স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে হাসিনা সরকারের একটি আত্মঘাতী উদ্যোগ ছিল তাদের মিয়ানমার সীমান্ত থেকে সরিয়ে দুর্গম দ্বীপ ভাসানচরে পুনর্বাসন। এর মাধ্যমে রাখাইনের বাইরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে বাংলাদেশের নমনীয়তার প্রকাশ ঘটে। এরপর রোহিঙ্গা পুনর্বাসন নিয়ে যা কিছু হয়েছে তা কার্যত কথামালার মধ্যে সীমিত ছিল। সাফল্যের ধারে কাছেও যায়নি কোনো উদ্যোগ।

এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপদ অঞ্চলের যে ধারণা সামনে এগিয়ে নিতে চাইছে তা হতে পারে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে কার্যকর কৌশল।

এখনো অস্পষ্ট গন্তব্য

রাখাইনে সাবেক শাসকদের প্রতিস্থাপনের জন্য কোন ধরনের রাষ্ট্রের উত্থান হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। আরাকান আর্মির নেতৃত্ব স্পষ্ট করেছে যে, তারা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অতীত তথা মিয়ানমারের বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তবে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সমন্বয়ে ফেড়ারেশন গঠনের মতো অন্যান্য বিকল্প বাদ দেয়নি। বিগত কয়েক বছরে, আরাকান আর্মির বেসামরিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান, রাখাইনের কিছু অংশে প্রশাসনিক ও বিচারিক পরিষেবা সম্প্রসারিত করেছে এবং আরো বেসামরিক কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেছে। এটি, বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন নির্মাণের জন্য সূচনাবিন্দু অথবা বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগও হতে পারে।

২০২৩ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া সর্বশেষ লড়াইটি রাখাইনকে মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রাখাইনে রাষ্ট্রের অবরোধ আরো জোরদার করেছে, অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। এতে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মৌলিক পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে;, এমনকি ব্যাংকনোটের ঘাটতিও সৃষ্টি রয়েছে। জাতিসঙ্ঘের উন্নয়ন কর্মসূচি এবং অন্যান্যরা গুরুতর খাদ্য ঘাটতি এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির আশঙ্কা সম্পর্কে সতর্ক করেছে।

এ ছাড়া আন্তঃসংঘর্ষে সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। জান্তা সরকার যুদ্ধে হারলেও পরীক্ষিত বিভাজন এবং শাসনকৌশল ব্যবহার করে জাতিগত রোহিঙ্গা ও রাখাইন যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষে পরিণত করেছে। এই পটভূমিতে আরাকান আর্মিকে এখন সাবধানে মূল্যায়ন করতে হবে কিভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা যায়। যুদ্ধের বিপর্যয় থেকেও রাখাইনের পুনর্গঠন হবে বড় চ্যালেঞ্জ। উভয়পক্ষই পরস্পরের প্রতি গভীর ভয় পোষণ করছে।

এ সঙ্কটে বিশ্ব যদি অর্থপূর্ণ অবদান রাখতে চায়, তাহলে তাকে শুধু রোহিঙ্গাদের দুর্দশা মোকাবেলা করা নয়, রাখাইনের সব মানুষকে একসাথে করে তাদের স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য বা রাষ্ট্র পুনর্গঠনে সাহায্য করতে হবে। ২০১৭ সালের আগস্টে, জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের সভাপতিত্বে কমিশন রাখাইনের উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের সমাধানের প্রস্তাব করেছিল, যা শান্তি ও সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা এবং সবার জন্য মানবাধিকারের পথের প্রস্তাব দেয়। সেসব সুপারিশের অনেকগুলোই আজও প্রাসঙ্গিক। এটি এখন রাজ্যের জনগণ এবং তাদের নেতাদের দেখার বিষয় যে, তারা কিভাবে একটি নতুন রাখাইনের পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

নিরাপদ অঞ্চল গঠন ও আশাবাদ

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত লোকদের সহায়তা এবং চলমান মানবিক সঙ্কট মোকাবেলায় জাতিসঙ্ঘ-গ্যারান্টিযুক্ত একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরির প্রস্তাব করেছেন। ইউনূস ঢাকায় মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত টমাস অ্যান্ড্রুজের সাথে এক বৈঠকে এ প্রস্তাব দেন। তিনি প্রস্তাবিত নিরাপদ অঞ্চলটিকে প্রভাবিত সম্প্রদায়ের জন্য সম্ভাব্য ‘সহায়তা পাওয়ার সর্বোত্তম উপায়’ হিসেবে বর্ণনা করেন, এটিকে সঙ্কট সমাধান এবং বাংলাদেশে উদ্বাস্তুপ্রবাহ হ্রাস করার একটি ‘ভালো সূচনা’ বলে অভিহিত করেন।

‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরি হতে পারে প্রাথমিকভাবে মংডু, বুথিদাউং এবং রাথেডাংয়ের তিনটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম এবং সিটওয়ে ও কালাদান-লেমরো নদী উপত্যকার অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যেখানে বেসামরিক ও অ-যোদ্ধারা নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। এই উদ্যোগকে কার্যকর করতে ‘নিরাপদ করিডোর’ তৈরি করতে হবে যা পৃথক ‘নিরাপদ অঞ্চল’কে সংযুক্ত করবে। এই নিরাপদ করিডোরগুলো নিরাপদ অঞ্চলজুড়ে মানবিক অভিনেতাদের অবাধ ও বাধাবিহীন চলাচলের সুবিধা দেবে। ‘নিরাপদ অঞ্চল’-এর বাসিন্দাদেরও ‘নিরাপদ করিডোর’ ব্যবহার করে ‘জোন’-এর মধ্যে চলাচলের অনুমতি দেয়া হবে এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাণিজ্য, কৃষি এবং জীবিকার বিবেচনায় অ্যাক্সেস উপভোগ করবে। করিডোরগুলো সবসময় বা দিনের নির্দিষ্ট সময়ে বা সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে খোলা রাখা হবে।

জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা যারা মিয়ানমারে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে চায় তাদের মূল আবাসস্থলে পুনর্বাসিত না হওয়া পর্যন্ত নির্ধারিত ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ বসবাস করতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। এছাড়াও, যেসব রোহিঙ্গা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়নি এবং এখনো রাখাইন রাজ্যে অবস্থান করছে, কিন্তু ক্রমাগত প্রান্তিকতা ও দুর্বলতার ঝুঁকিতে রয়েছে তাদেরও সেই ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ সুরক্ষা প্রদান করা যেতে পারে। এতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে মিয়ানমারে ফেরার আস্থা তৈরি হবে।

‘নিরাপদ অঞ্চলের’ অভ্যন্তরে থাকা বেসামরিক নাগরিকদের মৌলিক পরিষেবা, আশ্রয়, খাদ্য, ওষুধ ইত্যাদির পাশাপাশি নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে। মিয়ানমার সরকারের মনোনীত কর্তৃপক্ষকে বাধ্যতামূলক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা মিয়ানমার রেড ক্রস, আইসিআরসি, ইউএনএইচসিআর, ইউএনডিপি এবং প্রমাণিত ট্র্যাক রেকর্ডসহ অন্য সংস্থাগুলোর সহায়তায়, প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নিরাপদ অঞ্চলগুলো পরিচালনা করার দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে।

‘নিরাপদ অঞ্চলের’ অভ্যন্তরে নিযুক্তির নীতি ও নিয়মগুলো পর্যবেক্ষণ করতে এবং সেই সাথে বেসামরিক এবং মানবতাবাদী অভিনেতাদের নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য, জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা যেতে পারে। আসিয়ান এর সদস্য-রাষ্ট্র এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলো এই ধরনের পর্যবেক্ষণে অবদান রাখতে পারে।

এ ধরনের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা থাকতে পারে। রাখাইন ও মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ বাইরের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও রয়েছে প্রতিবেশী চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, আসিয়ান, ওআইসি, ইইউ এবং জাতিসঙ্ঘ। রাশিয়া জাপান সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশ রয়েছে যারা পরোক্ষভাবে মিয়ানমার ইস্যু নিষ্পত্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যথাসম্ভব সব পক্ষের সাথে এক ধরনের কম্পার্টমেন্টাল সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তবে শক্তির সমর্থন ছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ জোন গঠনের প্রচেষ্টা সফল হবে কি না সন্দেহ। আপস আলোচনায় রাখাইনের কার্যত নিয়ন্ত্রক আরাকান আর্মি এই উদ্যোগে সম্মত না হলে আন্তর্জাতিক পক্ষকে শক্তির ভারসাম্য তৈরির বিষয় ভাবতে হতে পারে।

বৈশ্বিক শক্তিগুলোর বাইরেও আসিয়ান ও ওআইসির নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর বিশেষ সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে এতে। এর মধ্যে আসিয়ানের চেয়ার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানের ব্যাপারে তুরস্ক সৌদি আরবের মতো দেশেরও বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। তবে এ উদ্যোগের সফলতা অনেকখানিই নির্ভর করে বাংলাদেশের কার্যকর প্রচেষ্টার ওপর। প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্ব এক্ষেত্রে আশাবাদী হওয়ার একটি বড় কারণ।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement