ঘোড়ার আগে গাড়ি, কাজের কথা নয়
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:৫২
নির্বাচন নিয়ে ছোট-বড় সব দলের এ মুহূর্তের জিজ্ঞাসা, কবে নাগাদ এয়োদশ সংসদ নির্বাচনের দিন-তারিখ নির্ধারণ হবে। এ প্রশ্নের জবাব এখনো কারো কাছে স্পষ্ট নয়; বরং অনুমানের পর্যায়ে রয়েছে। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য একটি সময়ের কথা বলা হলেও, সেটি কিছুটা পেছানোর আভাসও আছে। তবে অনেকেরই আগ্রহ প্রবল, আগামী সংসদের স্বরূপ কেমন হতে পারে তা নিয়ে। বস্তুত সে সংসদের ‘কম্বিনেশনটা’ কেমন হতে পারে সেটিই আগ্রহের বিষয়। আগামী সংসদে কোন দলের কতজন প্রার্থী বিজয়ী হবেন সেটি ভবিষ্যতের হাতে। যথার্থ অর্থে নির্বাচনের মাধ্যমেই সেই সংখ্যাটি বেরিয়ে আসে। জয়-পরাজয় নির্ভর করে ভোটারদের একান্ত নিজস্ব চয়েসের ওপর। এখানেও শর্ত থাকে, যদি সে নির্বাচনে নিজস্ব চয়েস প্রয়োগের সুযোগ থাকে, তবেই তা প্রার্থীভেদে ওঠানামা করতে পারে। দলগুলো আগামী নির্বাচনে কাদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয় তার ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকবে সব ভোটারের। এবার ভোটারের সংখ্যা ১২ কোটির উপর, নতুন ভোটারদের সংখ্যাও উপেক্ষা করার মতো নয়। এখন এই নতুন ভোটারদের প্রার্থী চয়েস করার ক্ষেত্রে অনেক নির্বাচনী আসনের জয়-পরাজয়ের ‘ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করতে পারে। এই নতুন ভোটারদের মন নতুন চেতনায় উজ্জীবিত। তাদের হিসাবকিতাব বড় জটিল, তাদের বিবেচনাবোধও গতানুগতিক নয়। সে জন্য সব দলকেই সতর্কভাবে প্রার্থী বাছাই করতে হবে। আগামীতে ওরা কেবল মার্কা দেখে ভোট দেবে না। প্রার্থীর যোগ্যতা দক্ষতার হিসাব কষে নিয়ে ভোট দেবে। এসব হিসাবকিতাবে প্রার্থীর যোগ্যতা দক্ষতা সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠা গুরুত্ব পাবে। সে কারণেই প্রার্থী মনোনয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা সংসদের বিজয়ী প্রার্থীরাই স্পিকার, সংসদ নেতা তথা সরকারপ্রধান ও বিরোধী দলের নেতা নির্বাচন করবে। বিদ্যমান ব্যবস্থা বজায় থাকলে তারাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। এই বাছাইয়ের ওপরই নির্ভর করবে আগামী সরকারের স্বরূপ, অর্থাৎ তাদের কর্মদক্ষতা কেমন হবে। এখন তরুণদের এগিয়ে থাকা ধ্যানধারণা নিয়ে কেউ কেউ মনে করতে পারেন, ‘বাবার আগে পোলা হাঁটে’। সঙ্গত কারণেই পোলারা এখন এগিয়ে থাকবেই। কারণ বাবাদের কাছে যৌক্তিক কারণে ‘যুগ জিজ্ঞাসা’ ও জবাবটা থাকে না। সেটি পোলাদের (তরুণদের) কাছে থাকে, যা আজকের প্রবীণদের ছিল ৫০ বছর আগে। বর্তমানে যুগে বিশ্বব্যবস্থার এমনই ধারা। এ জন্যে দুঃখ অভিমান করা ঠিক হবে না। তরুণদের এমন বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতার প্রমাণ আগস্ট ’২৪ বিপ্লব। তবে এটিও মনে রাখতে হবে, প্রবীণদের মূল্যবান অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’। হাসিনার যুগে দীর্ঘ ১৫ বছর এই প্রবীণদের ত্যাগতিতিক্ষা, সংগ্রাম, আন্দোলনের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়ার মতো নয়। প্রবীণদের নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার পরিণতি হচ্ছে ’২৪-এর বিপ্লব। তবে তারুণ্যের আরো একটি ধারণা আছে। সেটি সময়ের নয়, অর্থাৎ বয়সের নয়, মনের। বয়স হলেও মনটা যদি সজীব থাকে, বোধবিবেচনা যদি বর্তমানকে ধারণ করতে পারে তবে সে প্রবীণ নয়; বরং নবীন। যা-ই হোক সংসদ কতটা কার্যকর ও ফলপ্রসূ হবে, সরকার কতটা দক্ষ যোগ্য হবে, সরকারের প্রতিপক্ষ সরকারকে কতটা জবাবদিহির আওতায় আনবে। উপরের বক্তব্যকে কেউ যদি প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার বিষয়কে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মতো ধরে নেন; সে ক্ষেত্রে নিকট অতীতের সংসদ নিয়ে একটু ভাবুন। দ্বাদশ বা তার আগের সংসদ নির্বাচন, সংসদ গঠন, স্পিকার মনোনয়ন, সংসদ নেতার ভূমিকা ও এমপিদের শ্রেণিবিন্যাসের কারণে তথাকথিত ওই তিন সংসদের কাছ থেকে জনগণ, জুলুম-নির্যাতন, বৈষম্য-অবিচার, পক্ষপাতিত্ব ও দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়াটাই প্রাধান্য পেয়েছে। ওই সব সংসদের সদস্যরা কোনোকালেই এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করেননি। সদস্যদের এমন নিষ্ক্রিয়তাও দেশের সংবিধানের ত্রুটিজনিত কারণেই যত অঘটন ঘটেছে। এমন সব কারণের পাশাপাশি বশংবদ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। অতীতের সেই ব্যর্থতা মনে রাখলে ভবিষ্যতের দিকে তাকানো যাবে। অর্থাৎ যাবতীয় ব্যত্যয়ের পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাসের কাজ করা সম্ভব হতে পারে।
সব দলই নির্বাচন চায়; কিন্তু দলগুলো নির্বাচনে যাওয়ার আগে তাদের প্রস্তুতি কেমন সেটি পর্যালোচনার এখনই সময়। এ নিয়ে এখন অতীতের মতো দুলকি চালে চললে নতুন জমানায় কি চলা যাবে? অবশ্যই শুদ্ধ একটি নির্বাচনের দাবি যৌক্তিক এবং সে নির্বাচন যথাসময়ে হতে হবে। ’২৪-এর বিপ্লবপরবর্তী সরকারকে কোনোক্রমেই ইমম্যাচিওরড ভাবা উচিত হবে না। তারা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার বঞ্চনা পূরণের জন্য আবার একটি আন্দোলনের মুখে ইজ্জত খুইয়ে বাড়ি ফিরবেন তা কী করে হয়। তা ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার একটি আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা আছে। সেটি হারিয়ে, তিনি ক্ষমতালিপ্সু হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবেন, তার ব্যাপারে এমন কিছু ভাবা ঠিক হবে না। যারা তার মিশন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বরং তাদেরই উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
কেউ কেউ মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার আকাক্সক্ষা এখন প্রবল। রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্যই হলো তাদের নিজস্ব আদর্শ বা মত-পথ অনুসারে রাষ্ট্র সাজানো। দলের হাতে ক্ষমতা বা দায়িত্ব না এলে রাষ্ট্র সাজানোর সেই স্বপ্ন সফল হবে কিভাবে। সে কারণেই তারা নির্বাচন চান। যেকোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল কেবল নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রযন্ত্রের চালক হতে পারে। নির্বাচন ছাড়া এর দ্বিতীয় বিকল্প কোথায়। এসব বিবেচনায় তারা নির্বাচন চাইবে, এটিই স্বাভাবিক। তবে সব দলকে একটি কথা ভাবতে হবে, গত ১৫ বছরে নীরবে নিভৃতে নতুন যে প্রজন্মের জন্ম হয়েছে তাদের চাহিদা আকাশচুম্বী না হলেও, গতানুগতিকতার অনেক ঊর্ধ্বে তাদের দাবি। এ নিয়ে আপস করা বা উপেক্ষিত হওয়া কোনোটিই কি মেনে নিতে চাইবে তারা। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করে, তাদের ‘দেবো-দিচ্ছি, হবে-হচ্ছে’, এমন বক্তব্য নিয়ে তারা এখন হয়তো নীরব থাকছে। পতিত হাসিনা সরকারের প্রেতাত্মাদের দুরভিসন্ধিও মোকাবেলা করতে হচ্ছে বলে বর্তমান সরকারের গতি স্বাভাবিক কারণেই শ্লথ, কিন্তু স্থবির নয়। গত দেড় দশকে রাষ্ট্রকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে রাষ্ট্রকে বের করে আনা কষ্টসাধ্য, সময়সাপেক্ষও বটে। এসব বিষয় উপলব্ধি ও বিবেচনা করে তরুণরা হয়তো তত বেশি ক্ষোভ এখন প্রকাশ করছে না। এটি অবশ্যই ইতিবাচক। সাথে এ কথাও মনে রাখতে হবে, বহু অপেক্ষার পর যখন মানুষের ভোটে নির্বাচিত সরকার দায়িত্বে আসবে তখন তাদের ওপর যেমন আস্থা ও বিশ্বাস থাকবে ষোলোআনা, একই সাথে মানুষের প্রত্যাশাটা হবে দ্বিগুণ। সে সময় সরকারের এতটুকু ব্যত্যয় বা ত্রুটি কেউই কিন্তু ক্ষমা করতে চাইবে না। যারা আগামী দিনে ক্ষমতার কনটেন্ডার, তাদের এসব বিষয় মনে রাখতে হবে। তখনকার সম্ভাব্য যেসব দাবিদাওয়া উঠতে পারে এবং তার সুরাহা কিভাবে হবে তার অনুশীলন করা এখন জরুরি। সবাই জানেন, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য যেসব কমিশন হয়েছে; সব কমিশনের রিপোর্ট বর্তমান সরকারের হাতে আসবে; কিন্তু যৌক্তিক কারণেই সব সুপারিশ হয়তো এই সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের দায় এসে পড়বে। তখন দায়সারা গোছের কিছু করলে সেটি যেমন টেকসই হবে না, তেমনি মানুষের গঞ্জনারও শেষ থাকবে না। আর সে দলিল লুকিয়ে রাখাও সম্ভব হবে না। আগামীতে নির্বাচিত সরকারকে মানুষ অতীতের পতিত লীগ সরকারের সাথে তুলনা করতেও পিছপা হবে না। জনতার পার্লামেন্টে এসব নিয়ে সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে। তখন কোনো খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করালে পার পাওয়া যাবে কি?
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা নিজের দলের এবং তাদের দেশ-বিদেশের সুহৃদদের স্বার্থে বাংলাদেশকে গত ১৫ বছরে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করেছে। গঠিত কমিশনগুলো সেখান থেকে বাংলাদেশকে ‘ইউটার্ন’ করানোর যে দিকদর্শন পথ-নকশা তৈরি করছে, সেই সুপারিশগুলো বিশেষজ্ঞদের প্রচুর পরিশ্রমের ফসল। এ নিয়ে হেলাফেলা করা হলে মানুষ তখন সোচ্চার হবে। বিজ্ঞদের কলম থেকে অনবরত বের হয়ে আসবে পরিশীলিত তিরস্কার। আগামীতে যারা রাষ্ট্রযন্ত্রে ‘ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন’ হওয়ার প্রত্যাশা করেন, তাদের এই অবসরে তেমন দক্ষ-সক্ষম ম্যান হওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার অংশ হিসেবে হোমওয়ার্ক করা জরুরি। এই আগাম বার্তাকে কেউ ভবিষ্যদ্বাণী ভাববেন না। এসব কোনো পরামর্শও নয়, এটিই সামনের বাস্তবতা।
গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো ব্যবস্থাপত্র, পথ-নকশা বা পদচিহ্ন তাদের রিপোর্টে দিয়ে যাবে। অতএব, সব কনটেন্ডারের বিষয়গুলো নিয়ে শুধু ভাবা নয়, বাস্তবায়নের পথ-পদ্ধতি তৈরি করতে হবে। যেসব সুপারিশ নিয়ে কনটেন্ডার কিছু যোগ করতে পারেন বটে কিন্তু বিয়োগ করতে চাইলে কেউই কি সেটি গ্রহণ করবে! তবে কনটেন্ডারদের দেশ-বিদেশে আরো কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে। পতিত হাসিনার প্রতি কোনো করুণা করা বা তাদের স্বজন-সুহৃদদের সাথে সমঝোতায় যাওয়ার কোনো দুর্বলতা দেখতে পেলে জনগণ কোনোভাবেই গ্রহণ করবে না। ‘সুগার কোটিন দেয়া’ ‘কুইনাইন’ আর কেউ গিলবে না। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অগে এসেছিল, তার চেয়ে কম মূল্যে এই তৃতীয় স্বাধীনতা আসেনি। ১৫ বছরের সংগ্রাম আত্মত্যাগ আত্মোৎসর্গের পর ২০২৪ ছাত্র-জনতার গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছে। বহু মূল্যে কেনা স্বাধীনতা শেখ হাসিনার বিনামূল্যে অন্যের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা ছিল, সেটি জাতির সাথে বিশ্বাস ঘাতকতারই নামান্তর।
জাতি বহু মূল্যে স্বাধীনতা ক্রয় করেছে। এই আমানত এমন এক রক্ষাকারীর হাতে সোপর্দ করা হয়েছিল যে ওই আমানতের মূল্য না বুঝে খেয়ানত করেছে। এখন এমন ভুল আর করা যাবে না। যোগ্য আস্থাভাজন আমানতদারের হাতে দেশের স্বাধীনতাকে সংরক্ষণের দায়িত্ব তুলে দিতে হবে। যারা দেশের অমূল্য স্বাধীনতার মূল্যটা সঠিক বুঝতে পারে। এ ক্ষেত্রে জনগণের দায়িত্বটাও কম নয়। সঠিক আমানতদারদের ভোট দিতে যদি ভুল করা হয়, তবে তার দায় প্রতিটি ভোটারকে বহন করতে হবে। বলে রাখা ভালো, স্বাধীনতার পরিধি শুধু ভৌগোলিক সুরক্ষাই নয়, সাথে আরো অনেক কিছু যোগ করতে হয়। তবে ভৌগোলিক সুরক্ষার গুরুত্ব অবশ্যই সর্বাধিক। সীমান্ত সুরক্ষিত না হলে, নাগরিকদের সব অধিকার বানের পানিতে ভেসে যাবে। সুযোগ ব্যক্তি বা জাতির জীবনে বারবার আসে না। যে সুযোগ পাওয়া গেছে তার সদ্ব্যবহার করাই বর্তমান সময়ের চাহিদা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা