১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ৯ রজব ১৪৪৬
`

ভূ-রাজনীতির গতি-প্রকৃতি ও মুসলিম বিশ্ব

-

সপ্তম খ্রিষ্টাব্দ থেকে ঊনবিংশ শতকের গোড়া পর্যন্ত মুসলিম সাম্র্রাজ্য ছিল পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তি। মুসলিম শাসকদের অনৈক্য, ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ও বিলাসিতায় খিলাফতের পতন ঘটে। প্রথম মহাযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫) বিশ্ব মানচিত্রের বদলসহ ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটায়। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জার্মানির পতন ঘটে। পরমাণুু বোমার আঘাতে জাপান বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স প্রতিপত্তি ও প্রভাব নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে আবির্ভূত হয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্স আগে থেকে ঔপনিবেশিক প্রভু ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বহু উপনিবেশ হারালেও যুদ্ধে জয়লাভে চালকের আসনে বসে যায়।

যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত বিশ্বরাজনীতিতে ততটা প্রবলভাবে হাজির হয়নি। পশ্চিম ইউরোপের যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনে অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং ন্যাটো জোটগঠনের মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটন রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

১৯১৭ সালে রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়ে জার্মানির হিটলারের ফ্যাসিবাদী ও আধিপত্যবাদী আগ্রাসন একত্রে মোকাবেলা করে। যুদ্ধজয়ের পরে রাশিয়া কমিউনিস্ট আদর্শ সম্প্রসারিত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক বৃহদাকার সাম্রাজ্য গড়ে তোলে এবং পূর্ব ইউরোপে তার প্রভাব সম্প্রসারিত করে গঠন করে ‘ওয়ারশো জোট’। অন্যদিকে, কমিউনিস্ট আগ্রাসন মোকাবেলায় ন্যাটো জোট রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে পশ্চিম ইউরোপে কমিউনিজম সম্প্রসারিত হতে পারেনি।

ষাট ও সত্তরের দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলতে থাকে। বিভিন্ন দেশে কমিউনিজমের জোয়ার প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র নানা কৌশল নেয়। বিশেষত এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর সাথে কমিউনিস্টবিরোধী জোট গঠন করে। এর মধ্যে সেন্টো ও সিয়াটো অন্যতম। পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের মতো মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নেতারা সেন্টোতে এবং ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সিয়াটোর সদস্যপদ লাভ করে। এ দুটো জোটের উদ্দেশ্য ছিল কমিউনিজম প্রতিহত করা। এর দ্বারা আমেরিকা ইতিবাচক ফল লাভ করে। এসব দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বেশ তৎপর থাকলেও সে সব দেশে কখনো কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয়নি।

১৯২৪ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের হাত দিয়ে খিলাফতের অবসান হলেও বিভিন্ন মুসলিম দেশে ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। এতে মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী চেতনা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়। আলজেরিয়ায় বেন বেল্লা, মিসরের হাসানুল বান্না, তুরস্কে বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি, আফগানিস্তানে জামাল উদ্দিন আফগানি, উপমহাদেশে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মালয়েশিয়ায় তুন আব্দুর রহমান, ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ন প্রভৃতি খ্যাতিমান নেতার নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে ওঠে। মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি আলেমসমাজ ও বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন বিভিন্ন দেশে সক্রিয় ছিল।

জাতীয়তাবাদী নেতারা স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তারা পাশ্চাত্য চিন্তাচেতনায় প্রভাবিত হয়ে অনেকটা সেক্যুলার স্টাইলে দেশ পরিচালনা করেন। সেই সাথে তারা কেউ মার্কিন, কেউবা কমিউনিস্ট পরাশক্তির প্রভাববলয়ে চলে যান। কেউ কেউ ক্রীড়নক হয়ে পড়ে। এর মোকাবেলায় মুসলমানদের নিজস্ব মূল্যবোধ ও দর্শনের আলোকে রাষ্ট্রগঠন ও স্বাধীনতা অর্থবহ করে তুলতে ইসলামী রাজনীতি বিকশিত হতে শুরু করে। এর নেতৃত্ব দেন আরব বিশ্বে হাসানুল বান্না, তুরস্কে বদিউজ্জামান নুরসি, পাক-ভারত উপমহাদেশে আল্লামা ইকবাল, সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী ও ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনি।

আশির দশকের শুরুতে দুটো ঘটনা ঘটে; যা পুরো বিশ্বব্যবস্থায় নতুন উপাদানের বিকাশ ঘটায়। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের তল্পিবাহক শাহের শাসনের পতন ঘটে। আলেম সমাজের নেতৃত্বে শরিয়াহ আইন চালু হয়। যুক্তরাষ্ট্র এ বিপ্লব প্রতিহত করার এবং পরবর্তী প্রতিবিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা চালাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। ইরানের ইসলামী বিপ্লব মুসলিমবিশ্বে ইসলামী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে তুমুল উদ্দীপনা এবং আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে।

আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজমের বিপর্যয় ঘটে। স্বৈরতান্ত্রিক ও প্রকৃতিবিরোধী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অন্তর্নিহিত দুর্বলতায় তাসের ঘরের মতো উবে যায়। একদিকে পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য যেমন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করত, তেমনি ইসলামপন্থী দেশগুলো ও আলেমসমাজ প্রধানত ধর্মীয় কারণে সমাজতন্ত্রের প্রবল বিরোধী ছিল। বলাই বাহুল্য, কমিউনিস্টরা প্রকাশ্যে আগ্রাসীভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। মধ্য এশিয়ার বহু মুসলিম দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের শিকার হয়। বিশেষ করে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন মুসলিমবিশ্বকে বেশি নাড়া দেয়।

সমাজতন্ত্রের পতনে ইসলামী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শক্তিগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী ব্লক সবচেয়ে বেশি উল্লসিত হয়। দৃশ্যত পুঁজিবাদের ধ্বজাধারীরা বিশ্বরাজনীতির একক চালকের আসনে অধিষ্ঠিত হন। অবসান ঘটে স্নায়ুযুদ্ধের। ইউরোপের বিশেষ করে পূর্ব-ইউরোপে পাশ্চাত্যের প্রভাব সম্প্রসারিত হয়। বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়ে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্লক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসঙ্ঘ মিলে বিশ্বায়নের নতুন মেরুকরণ শুরু হয়। মুক্তবাণিজ্য সম্প্রসারিত হতে থাকে। রাশিয়ার প্রভাব খর্ব হওয়ায় সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে আমেরিকা স্বস্তিবোধ করলেও নতুন শত্রু চিহ্নিত করতে চিন্তা গবেষণা করতে থাকে। এরা লক্ষ করে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপীয় দেশগুলোর বিরাট অংশ মুক্তবাজার অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুসরণ করে এসে টেকসই হয়েছে। সমাজতন্ত্রের পতনের পরে পূর্ব-ইউরোপীয় দেশগুলোও বাজার অর্থনীতি ও গণতন্ত্র মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর শাসকরা গণতন্ত্র সংহত করেননি; বরং রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র হয় তাদের রাজনৈতিক কৌশল। এ দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে উপনিবেশ হিসেবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শোষণের ক্ষেত্র ছিল। এসব দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও পরোক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের আওতায় যাতে থাকে সে জন্য পাশ্চাত্য শক্তি এসব দেশে অস্থিতিশীলতা, অস্থিরতা ও তল্পিবাহী স্বৈরশাসন টিকে থাকাকে পছন্দ করে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ ও তেল সম্পদের ওপর পশ্চিমাদের লোলুপদৃষ্টি কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। অন্যদিকে পশ্চিমারা সাম্রাজ্যবাদীরা লক্ষ করে যে, জাতীয়তাবাদী, সেক্যুলার, স্বৈরতান্ত্রিক শাসকগুলো ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। বিপরীতে ইসলামী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটছে। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদীরা অর্থনৈতিক আগ্রাসন প্রতিরোধের সম্ভাব্য জনপ্রিয় ও বিকাশমান ইসলামী শক্তিগুলোকে প্রতিহতের কৌশল নেয়। তারা আরো লক্ষ করে, শুধু মুসলিম দেশগুলোতে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নয়, বিশ্বব্যাপী বিকল্প সভ্যতা ও সংস্কৃতি হিসেবে ইসলামের বিকাশ ঘটতে শুরু করেছে। স্যামুয়েল পি হান্টিংটন ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থে ইসলামকে পাশ্চাত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরার পর মার্কিন নীতিনির্ধারকরা বিশ্বব্যাপী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রতিহত করা পশ্চিমা পরাশক্তির রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাঢয় অন্তর্ভুক্ত করে। একইসাথে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের নামে নতুন রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ইসলামকে প্রতিপক্ষ ধরে নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

২০০১ সালে নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে রহস্যজনক হামলার পর থেকে ইসলামবিরোধী আগ্রাসন চূড়ান্ত রূপ নেয়। পুরো আমেরিকা ও ইউরোপে ‘ইসলামফোবিয়া’ সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, আমেরিকার ৬০ শতাংশ নাগরিক মুসলমানদের পছন্দ করে না। এখন এটি পরিষ্কার যে, আমেরিকা নিজেকে যতই উদার গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী বলে দাবি করুক না কেন, সে দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী বর্ণবাদী ও মুসলিমবিরোধী।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো মুসলিম দেশের কল্যাণে কাজ করেছে এরূপ প্রমাণ নেই। ওয়াশিংটন ফিলিস্তিনিদের জন্মগত অধিকারের বিরুদ্ধে অবৈধ ইসরাইলকে পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। সাম্প্রতিক-কালে আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় ইসরাইল গাজায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে তা এককথায় অবর্ণনীয়। ইরাককে দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে ৯ বছরের যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। মিসরের স্বৈরশাসক ও সামরিক শাসকদের পূর্ণ সমর্থন-সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। ইরাকের সম্ভাব্য সামরিক শক্তি বিপর্যস্ত করার লক্ষ্যে তথাকথিত রাসায়নিক অস্ত্রের অজুহাতে দেশটি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সিরিয়াকেও মৃত্যুপুরীতে পরিণত করা হয়। আফগানিস্তানে এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তালেবানকে পৃষ্ঠপোষকতা দিলেও পরবর্তীতে তালেবান ও আল-কায়েদা ধ্বংসের নামে আফগানিস্তানকে বিপর্যস্ত করে তল্পিবাহক সরকার বসানো হয়েছিল। আফগান মুজাহিদদের অমিত সাহসের মোকাবেলায় পশ্চিমারা লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয়। আল-কায়েদার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানকে সম্পৃক্ত করে সে দেশটিকেও ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছিল। মিসরের স্বৈরশাসক জেনারেল সিসিকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়ে সে দেশের ইসলামী আন্দোলনকে বিপর্যস্ত করেছে। আলজেরিয়ায় ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক শাসনকে সমর্থন দিয়েছে। লিবিয়াকে গৃহযুদ্ধের মধ্যে ফেলে দেশটির অস্তিত্ব বিপন্ন করা হয়েছে। ইয়েমেনে ছায়াযুদ্ধের মাধ্যমে শিয়া প্রাধান্য খর্বের চেষ্টা করা হচ্ছে। তুরস্কের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে শত্রুতায় অবতীর্ণ না হলেও সে দেশের সেনাবাহিনীর সেক্যুলার অংশকে বারবার উসকানি দিয়েছে।

এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট ব্লকের পতনের দুই দশক অতিক্রান্ত হতে না হতে রাশিয়া আবার হারানো শক্তি পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন চালিয়েছে। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। রাশিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন শক্তিমান শাসক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। দেশটি এখন মার্কিন নির্বাচনেও প্রভাব খাটাতে পারছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাশিয়া এখন আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলে না। গত দুই দশকে ভূমণ্ডলীয় রাজনীতিতে কিছুটা নীরব থাকলেও সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবেলায় নিজের সামরিক শক্তির জানান দিচ্ছে। ফলে বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রতিপত্তি আর আগের মতো থাকছে না। রাশিয়া ক্রমান্বয়ে শক্তি সংহত করে এশিয়া ও ইউরোপে নিজের অবস্থান জোরদার করছে। পাকিস্তান ও তুরস্কের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক মিত্রগুলো এখন রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে। দৃশ্যত কোনো মুসলিম দেশে রাশিয়ার ইসলামের প্রতি প্রত্যক্ষ বৈরিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

অন্যদিকে, চীন কমিউনিস্ট পার্টি-শাসিত রাষ্ট্র হলেও বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করে বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজের অবস্থান আগের চেয়ে অনেক বেশি সংহত করেছে। খোদ মার্কিন অর্থনীতি এখন চীনের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। অর্থনীতির সামর্থ্য বিচারে চীন এখন জাপানকে অতিক্রম করে দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। সামরিক শক্তি বিচারেও দেশটি দ্বিতীয়। রাশিয়ার সাথে ঐতিহাসিকভাবে চীনের ভালো সম্পর্ক রয়েছে যা বেইজিংয়ের জন্য একটি ইতিবাচক উপাদান।

লক্ষণীয় যে, বিশ্বরাজনীতিতে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের চেয়ে অর্থনৈতিক প্রভাবকে চীন গুরুত্ব দিচ্ছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান তথা প্রতিবেশীর সাথে চীন সামরিক শক্তির মহড়া দিলেও এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং ব্যবসাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। বিভিন্ন বিশ্লেষণে মনে করা যায়, চীন ক্রমান্বয়ে বিশ্বের এক নম্বর শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। লক্ষণীয় যে, চীন সারা বিশ্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান না নিলেও নিজ দেশে উইঘুর মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) মনে করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প একটি বড় শক্তি হিসেবে। তবে বহু মতপার্থক্যও রয়েছে। ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ পূর্বশর্ত হওয়ায় ইইউ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। প্রতিটি নীতিগত বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পার্লামেন্টের অনুমোদনের শর্ত থাকায় সংস্থাটির গতিশীলতা নেই। ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে ব্রিটেনে যে গণভোট হয়েছিল তাতে ব্রিটিশদের ব্রেক্সিট সমর্থন থেকে প্রতীয়মান হয়, সংস্থাটি ভবিষ্যতে অধিকতর শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা কম। ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ব্রিটেন ও জার্মান সরকার মুসলমান বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়ে উদারতা দেখালেও বেশ কিছু রাষ্ট্র অনুদার বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফ্রান্স বরং কিছুটা আগ্রাসী। তুরস্কে ইইউতে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে যে কাঠিন্য দেখানো হচ্ছে; তা থেকে মুসলমানদের প্রতি এদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement