১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ৯ রজব ১৪৪৬
`

বেকার বেড়ে যাওয়ায় চ্যালেঞ্জে অর্থনীতি

-

দেশের চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট, বিনিয়োগে স্থবিরতা ও শ্রমবাজারে অস্থিরতাসহ বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতাগুলো গভীরভাবে মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ মূল্যায়ন শুধু আর্থিক নীতি-নির্ধারণে নয়; বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো ও কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্যও অপরিহার্য। বর্তমান অর্থনৈতিক পটভূমিতে বিনিয়োগে এমন অনেক জটিল সমস্যা বিদ্যমান, যা সমন্বিত ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমাধান করা জরুরি। কারণ বিনিয়োগে কেবল স্থবিরতা নয়, বিনিয়োগ বা পুঁজি যা আছে তা রক্ষা করা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী দেশী, কী বিদেশী সব বিনিয়োগে খরা। গত মাস কয়েক ধরে নয়; বছর তিনেক ধরে। সত্য লুকিয়ে ছড়ানো হয়েছে মিথ্যা তথ্য। শোনানো হয়েছে উন্নয়নের গল্প। বড় ব্যবসায়ীদের ডেকে নিয়ে বলানো হয়েছে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়ছে। হাজারে হাজারে কর্মসংস্থান হচ্ছে। বাংলাদেশ হয়ে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া। শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। তিনি না থাকলে বাংলাদেশ থাকবে না। তাই ব্যবসায়ীরা তাকে চান। মরণের পরও তাকে চান। তার সাথে থাকবেন। ভেতরে ভেতরে আসলে দেশকে ঘুণপোকায় খেয়ে সাফা করার অবস্থা।

এর পাকাপোক্ত আয়োজন করা হয় বিদায়ী বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে। এরপর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে বিঁধল আরেক পেরেক। ৫ আগস্টে খেল খতম। ঘুণপোকারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছে। কিন্তু দেশকে ফেলে গেছে গহ্বরে। তথ্য আর লুকিয়ে রাখার অবস্থা নেই। এ সরকারের মধ্যে তথ্য লুকানোর মানসিকতা নেই। বল-ভরসা-সাহস জোগাচ্ছে, আবার দেশের গুরুচরণ দশার কথাও জানাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও অবস্থা জানান দেয়ার একটি সংস্কার এসেছে। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের বন্দনা না করে মাঝে মধ্যে সমালোচনা করা শিখেছেন ব্যবসায়ীরা। তা না করে কোনো উপায় নেই। প্রায়ই ছোট-বড় কোনো না কোনো কল-কারখানা, প্রতিষ্ঠান বন্ধের কুখবর গোপন রাখার অবস্থা নেই। ছোটখাটো খবরগুলো গণমাধ্যমে না এলেও বড়গুলোতে বন্ধের ঘোষণা দিয়ে অফিস বা কারখানার গেটে নোটিশ টাঙিয়ে দেয়া হচ্ছে। দাফতরিক ভাষায় জানিয়ে প্রায় একই : ‘অনিবার্য কারণে আগামীকাল থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে।’

এর তাৎক্ষণিক অনিবার্য জের কর্মী ছাঁটাই ও কমানো। বেকারত্বের মধ্যে এ নতুন বেকারত্বে বুক চাপড়ানো বিলাপ-আহাজারি। তাদের পরিবারের সদস্যদের বদদোয়া। উপরওয়ালার কাছে ফরিয়াদ। এসব অভিশাপ যাচ্ছে কার আমলনামায়? দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত করে লুটেরারা পগার পাড়ি দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাড়ে সেই বোঝা। বিগত সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়ার অবস্থা নেই তাদের। নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে পারছে তেমন না। যা ছিল তাও রক্ষা করা কঠিন হচ্ছে। আবার লুটের টাকা ফেরত আনাও যাচ্ছে না। এর ফলে বেকারত্ব বাড়ছে।

গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজার। এটি সরকারি হিসাব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস প্রকাশিত ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজার। ২০২৩ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ ৭০ হাজার। বিবিএসের হিসাব অনুসারে, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশে পুরুষ বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৯০ হাজার, আর নারী বেকার ৮ লাখ ৭০ হাজার। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৮১ ও নারী বেকারত্বের হার ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০২৩ সালের একই সময়ে এ হার ছিল ৪ দশমিক ০৭ শতাংশ, যেখানে পুরুষ ছিল ৩ দশমিক ৪৬ ও নারী ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রকৃত হিসাব আরো বেশি।

বিশেষজ্ঞদের হিসাবে, দেশে প্রচ্ছন্ন বেকারের সংখ্যা কয়েক কোটি। বেকারের গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা ঠিক না হওয়ায় বেকারত্বের প্রকৃত জরিপ বা হিসাব বের করা খুব কঠিন একটি কাজ। আমাদের দেশে বেকারদের বেশির ভাগের কর্মসংস্থান হয় বেসরকারি খাতে। বিবিএসের হিসাবে দেশে মোট কর্মসংস্থানে সরকারি চাকরির অংশীদারী মাত্র ৩.৮ শতাংশ। বেসরকারিতে কর্মসংস্থান হয় ১৪.২ শতাংশ। প্রায় ৬১ শতাংশের কর্মসংস্থান হচ্ছে ব্যক্তি উদ্যোগে। বাকি ২১ শতাংশ অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত।

সরকার পরিবর্তনের পর গত কয়েক মাসে তৈরী পোশাকসহ কয়েকটি খাতে কী যন্ত্রণা তৈরি করেছে তা সংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিক দুই ভুক্তভোগী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। অন্য কারো কারো পক্ষে ধারণারও বাইরে শ্রমিক-মালিক উভয়ই কী যাতনায় ভুগছেন, তা উপলব্ধি করা। জ্বালানি সঙ্কট, গ্যাস ট্যারিফ বৃদ্ধি, কাঁচামাল আমদানিতে এলসি সমস্যায় ভোগান্তি। বাস্তবতার নিরিখে শ্রমিক মজুরি বাড়াতে হয়েছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিতে বেড়েছে প্রতিযোগিতা। এসব সমস্যার যোগফলে গত এক বছরে তৈরী পোশাক, নিটওয়্যার ও টেক্সটাইল শিল্পের ১৪০টি কারখানা বন্ধের সমান্তরালে স্বাভাবিকভাবে এক লাখের কাছাকাছি কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। সামনে আরো কী অপেক্ষা করছে, মালিকদের ভাবনায় অকুলান। কারখানা চালু রাখা, অর্ডার নেয়া, কাঁচামাল কেনা, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল নিয়ে অন্ধকার দেখছেন তারা। এখনো বেকার না হওয়া শ্রমিকরা আতঙ্কে। আর এরই মধ্যে বেকার হয়ে যাওয়াদের বাসা ভাড়া দেয়ার অবস্থা নেই। হাটবাজার বন্ধ। এর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ছে। লোকালয়েও পড়তে শুরু করেছে। বেকার বলে তারা ঘরে বসেও থাকছেন না। চলে যাচ্ছেন মিল-ফ্যাক্টরির কাছাকাছি সহকর্মীদের কাছে বুদ্ধি-পরামর্শ-সহযোগিতা নিতে। সহযোগিতা না মিললেও উসকানি মিলছে। যার জেরে সমাজে অস্থিরতায় টোকা পড়ছে। নানা বাজে কাজে জড়িয়ে সমাজে তারা আপদের মতো ভর করছে।

একটি চলমান প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে কত সর্বনাশের সংযোগ তা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়া জরুরি নয়। স্বাভাবিক যে কারো পক্ষে তা উপলব্ধি করা সম্ভব। বিনিয়োগ-ব্যবসাকে রাজনীতির বাইরে রাখলে আজকের এ অবস্থা হতো না। বিনিয়োগ থমকে যাওয়া, নতুন করে বেকারত্ব ভর করা শুধু অর্থনীতি পরিচালনার বিষয় নয়। এখানে পুঁজির নিশ্চয়তার বিষয় রয়েছে। সরকারের একার পক্ষে সেই নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়। কর্মহীন অর্থনীতি বেকারত্ব উসকে দেয়। তরুণদের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ কর্মসংস্থান, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণে নেই। দীর্ঘমেয়াদি বেকারদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের সংখ্যাও বাড়ছে। এ প্রবণতাগুলো দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে সমাজজুড়ে হতাশা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। সেখানে কর্মসংস্থানের ভরসা বেসরকারি খাতে নতুন করে বেকার তৈরি হওয়া উদ্বেগের ওপর বাড়তি উদ্বেগ। বেকার বা চাকরিহারাদের মধ্যে শেয়ারবাজারে মাথা ঢোকানোর একটি প্রবণতা থাকে। যৎসামান্য সঞ্চয় এবং ধারকর্জে বিনিয়োগ করে সেখান থেকে কিছু আয় রোজগারের অবস্থাও নেই; বরং রয়েছে পুঁজি খোয়ানোর অবস্থা। শেয়ারাবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে কিছু করতে পারেনি। পারেনি ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানকে বাজারে ফেরাতে। ফলে বেকারত্বের আরেক হাতছানি সেখানে। সরকার চেষ্টা করছে না, বিষয়টি এমনও নয়। চেষ্টায় কুলাচ্ছে না।

বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে তা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়া লাগে না। আর বিনিয়োগ বলতে মূলত বেসরকারি খাত। নিজ নিজ জায়গায় তাদের বেকার হওয়ার অবস্থা। এমনিতে ডলার ও গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটসহ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসায়-বাণিজ্য কমে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় নতুন বিনিয়োগ ও ব্যবসায় সম্প্রসারণে আস্থা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। মাঠে যে বিনিয়োগ আছে তা রক্ষা হবে কি-না তার নিশ্চয়তা নেই। এই নিদারুণ চাপে কমে গেছে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা। বেসরকারি ঋণে চলছে ধীরগতি, বিনিয়োগে নেমে এসেছে স্থবিরতা। ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতাও হারিয়ে গেছে অনেকের। বিকল্প হিসেবে বিদেশী বিনিয়োগের লক্ষণও নেই। বিদেশী বিনিয়োগ এলে ডলার মেলে। কর্মসংস্থানও হয়। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসও তার ইমেজ খাটিয়ে বিদেশী বিনিয়োগ ধরতে চাচ্ছেন। তার উপদেষ্টারাও খাটছেন কিন্তু এখন পর্যন্ত উল্লেখ করার মতো সুখবর নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৮ শতাংশ কমে গেছে। ভরসা কেবল রেমিট্যান্স। গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্স-রিজার্ভ বেড়েছে। কিন্তু তা কর্মসংস্থানে ম্যাটার করে না। অন্য দিকে বেসরকারি বিনিয়োগের স্থবিরতা দেশের শিল্প ও কর্মসংস্থান খাতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যবসায়বান্ধব পরিবেশের অভাব বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বড় বাধা। বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগ নীতি সংস্কার, কর প্রশাসন সহজীকরণ এবং আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন। অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোতে সমন্বয়ের অভাব নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এখন এমনই একটি সময়, যখন অন্তর্র্বর্তী সরকারকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় টুটকা নয়, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement