১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ৯ রজব ১৪৪৬
`

ব্রাদারহুডের সাথে সমঝোতা চান সিসি

-

মিসরের প্রেসিডেন্ট আল সিসি ও ব্রাদারহুডের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ের পটভূমিতে ১০ বছরেরও বেশি সময় মিসর নানা অমানবিক ঘটনার কলঙ্ক ও সমালোচনার বোঝা টানছে। এই মুহূর্তে দেশটির প্রেসিডেন্ট ব্রাদারহুডের সাথে সমঝোতায় আসতে চাইছেন। এতে পুরাপুরি না হলেও রাজনৈতিক বিভাজনের অবসান হয়তো কিছুটা ঘটবে।

সিসি নির্বাচনে জেতার জন্য প্রতিপক্ষের লোকজনদের জেলে পুরেছেন, মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন, প্রতিদ্বন্দ্বীকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। এসব অপরাধ কেউ ভুলে যাবে না। মিসরীয় সংবাদপত্রগুলো এর মধ্যে মিসরীয় প্রেসিডেন্টকে দায়ী করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, তারা লিখেছে, “আল-সিসি বিরোধীদের প্রথমবারের মতো ‘তার লোক’ হিসেবে উল্লেøখ করেছেন, ‘শয়তানের লোক’ হিসেবে নয়, যার ফলে শাসকদের অতীতের পৃষ্ঠা উল্টানোর, সুরক্ষা মামলা বন্ধ করা এবং বন্দীদের ফাইল নিষ্পত্তি করার ইচ্ছার ইঙ্গিত দিতে পারে।” অবশ্য পদক্ষেপটি ইতিবাচক হলেও এর পেছনে লক্ষ্যটি অস্পষ্ট। আমরা পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করছি যা এই অস্পষ্টতা দূর করতে পারে।

মুসলিম ব্রাদারহুড বাহরাইন, ইরান, তুরস্ক, ইরাক, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, জর্দান, কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব, সিরিয়া, আরব আমিরাত, ইয়েমেন, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, সোমালিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় সক্রিয়। ইউরোপের জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম ব্রাদারহুড ইসলাম ও রাজনীতির উপর প্রকাশ্যে মত প্রকাশ করে এবং বিভিন্ন প্রকাশনা প্রকাশ করে। তাদের জনপ্রিয় স্লোগান হলো ‘ইসলামই সমাধান’ এবং ‘বিশ্বাসীরা ভাই ভাই’।

সাধারণত কোনো দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা, জনগণের চাহিদা বিশ্লেষণ করে ব্রাদারহুড তাদের করণীয় নির্ধারণ করে। যেমন কুয়েত ও জর্দানে সহযোগিতা ও সরকারে অংশগ্রহণমূলক নীতি, মিসরে শান্তিপূর্ণ অবরোধ ও বিরোধিতা, লিবিয়া ও সিরিয়ায় সশস্ত্র প্রতিরোধ।
ব্রাদারহুডের নীতি ও কার্যধারা কেমন হবে সেটি ইউসুফ আল কারজাভী তার বই Towards a Worldwide Strategy for Islamic Policy-তে লিখেছেন। সেটিকে ব্রাদারহুডের ১২ দফা বা সংক্ষেপে ‘প্রজেক্ট’ বলে অভিহিত করা হয়।

মুসলিম ব্রাদারহুডের কাছে রাজনীতি করে ক্ষমতারোহণ করা মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। তবে ব্রাদারহুড বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সংগঠনও গঠন করেছে।

অনেক উপসাগরীয় ও আরব দেশ ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করতে চায় না তার একটি কারণ হামাসের সাথে ব্রাদারহুডের সম্পর্ক। কাতার ব্রাদারহুডকে সমর্থন করায় সৌদিরা ক্ষিপ্ত। সৌদিতে ব্রাদারহুড কালোতালিকাভুক্ত। সৌদি চাপ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে ব্রাদারহুডকে ঢালাওভাবে কণ্ঠরোধ করতে এগিয়ে আসেনি। টিলারসন মনে করতেন, ব্রাদারহুডের সক্রিয় সদস্য সংখ্যা ৫০ লাখের উপর, তাদের একচেটিয়াভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে রাজনীতির মঞ্চকে উত্তপ্ত করা গেলেও অনেক সমস্যার সৃষ্টি হবে। তাই টিলারসন সাবধানে পা ফেলার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনকে সর্তক করে দিয়েছিলেন।

বাহরাইন, মিসর, রাশিয়া, সৌদি আরব, সিরিয়া ও আরব আমিরাত ব্রাদারহুডকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। সৌদি আরব ২০১৩ সালে ব্রাদারহুড দমনের সময় মিসরকে সহায়তা করে এবং ২০১৪ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তার সমর্থকরা রাবা স্কোয়ারে সমবেত হলে ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট এই হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। ট্যাঙ্ক, অ্যাপাচি হেলিকপ্টার নিয়ে নিজ দেশের নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর মিসরের সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড ঘটায় রাবা আল-আদওয়া স্কয়ারে। সে দিন সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে নিহত হন দুই হাজার ৬০০ জন বিক্ষোভকারী, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মী-সমর্থক। ১৫ হাজার গ্রেফতার হয়, অনেককে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, ২০০ ব্রাদারহুড সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। মোহাম্মদ বদিসহ ১৮২ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়, এর মধ্যে দু’জন মহিলাও ছিলেন। তখন মিসরের তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি। গ্রেফতারকৃতদের অনেকে গাড়ি ও কয়েদখানায় অজ্ঞান হয়ে পড়লেও তাদের জন্য ডাক্তার আনা হয়নি। মিসরীয় আইনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে গ্র্যান্ড মুফতির মতামত প্রয়োজন হয়, এ ক্ষেত্রে সেটিও প্রতিপালিত হয়নি।

সেই প্রেসিডেন্ট আল-সিসি বর্তমানে মিসরের ব্রাদারহুডের সখ্য চাইছেন! গত ডিসেম্বরে কর্তৃপক্ষ ৭১৬ জনকে কথিত ‘সন্ত্রাসী তালিকা’ থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টি সিসির শাসন-সঙ্কটের কোনো সমাধানের সূচনা কি না তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এই পদক্ষেপের সমর্থক এবং বিরোধী উভয়ের মধ্যে বিভক্তি ও অস্পষ্টতা বেড়ে চলেছে। কথিত ‘সন্ত্রাসী তালিকায়’ মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা রয়েছেন। আল সিসি ‘শান্তির মিসর’ বানানোর লক্ষ্যে ২০১৩ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডকে ‘সন্ত্রাসী’ দল হিসেবে চিহ্নিত করেন। মূল তালিকায় চার হাজার ৪০৮ জনের নাম সন্ত্রাসী হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকলেও মানবাধিকার কর্মীদের তালিকায় ছয় হাজার ৭০০ জনের নাম রয়েছে।

সরকারি বিধি অনুসারে মিসরে সন্ত্রাসী তালিকায় নাম থাকার অর্থ ওই ব্যক্তির সম্পত্তি জব্দ করা যাবে, বিনাবিচারে জেলে ভরে রাখা যাবে, তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকে, যারা বন্দী নন তারা বিরক্তিকর নজরদারির মধ্যে থাকেন। যতই খ্যাতিমান হোক না কেন, তাদের জন্য কোনো ছাড় থাকে না (যেমন ইমামুল ওয়াসাতিয়াহ ড. ইউসুফ আল-কারজাভী ও তার কন্যা পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ইলহাম ইউসুফ আল কারজাভী); এরা সরকারি চাকরিতে কর্মরত থাকলে যেকোনো সময় ‘সন্ত্রাসের সাথে সংযুক্ত’ দেখিয়ে চাকরিচ্যুত করা যায় ইত্যদি।

সন্ত্রাসী তালিকা থেকে যে ৭১৬ জনকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্তটি হয়েছে তাদের মধ্যে কিছু মৃত ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত, বিশেষত মুসলিম স্কলারদের আন্তর্জাতিক ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইউসুফ আল-কারজাভী এবং প্রয়াত সংসদ সদস্য সায়েদ আসকার, পাশাপাশি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ওয়ালিদ আসফোর, আলী তালাবা এবং আবদেল ওয়াহাব আবদেল গাফফার। তাদের নাম দেখে বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হয়। তালিকা থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডের জ্যেষ্ঠ অনেক কর্মকর্তাই বাদ পড়েছেন।

কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত ২০১৮ সালের মামলার স্টেট সিকিউরিটি কনফাইনমেন্ট সিদ্ধান্তের বিস্তারিত প্রকাশ করেনি, যার মধ্যে সন্ত্রাসী তালিকায় ১৫২৪ জনের নাম রয়েছে। এর অর্থ হলো অবশিষ্ট লোকদের ভাগ্য এখনো জানা যায়নি, বিশেষত সক্রিয় কর্মী আয়েশা আল-শাতের; শক্তিশালী মিসর পার্টির উপপ্রধান মোহাম্মদ আল-কাসাস; মানবাধিকার কর্মী আহমেদ আমাশা; মিসরের সাবেক জাতীয় ফুটবলার মোহাম্মদ আবুত্রিকা প্রমুখ।

কোনো জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন অনেকে। সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমগুলোও প্রশংসা করেছে। তারা আরো উল্লেখ করেছে, মানবাধিকারের জন্য জাতীয় কৌশল অনুসারে সরকারকে দ্রুত কাজ করা উচিত এবং দ্রুত ন্যায়বিচার অর্জন করা উচিত এবং রাষ্ট্র ও আইনের ভূমিকা সমুন্নত রাখা উচিত। মিসরের সুপরিচিত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আমর আদিব সিসির সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছেন এবং ব্রাদারহুডের সাথে পুনর্মিলনের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর ঘনিষ্ঠ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আহমেদ মুসা দাবি করেছেন, ‘ব্রাদারহুড একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবেই থাকবে’। রাজনৈতিক মহল বিশ্বাস করে, এই সিদ্ধান্তের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রয়েছে, প্রথমটি হলোÑ এটি জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে পর্যালোচনা করার কারণে বিদেশে মিসরের ভাবমর্যাদা আড়াল করার এক প্রচেষ্টা।

অন্যরা মনে করেন, দেশে একটি রাজনৈতিক সাফল্য আনার ব্যবস্থা সম্পর্কিত তৃতীয় একটি দৃশ্যকল্প রয়েছে, যা শাসক এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের মধ্যে যুদ্ধবিরতি বা পুনর্মিলনের পথ প্রশস্ত করেছে। তবুও অন্যান্য দল চতুর্থ আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছে, এটি সরকারের হাতে একটি কার্ড যা উপসাগরীয় মিত্রদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা যাবে বিশেষত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ মিসর স্টেট ইনফরমেশন সার্ভিসের (এসআইএস) প্রধান দিয়া রাশওয়ান বিবিসিকে বলেন, কর্তৃপক্ষ ও ব্রাদারহুডের মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা কম, তবে বিষয়টি প্রশংসনীয় ও বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুটা জটিলতা নিরসনের প্রেক্ষাপটে আমরা এর প্রশংসা করি। ধারণা করা হচ্ছে, ব্রাদারহুডের সদস্যদের জন্য শর্তসাপেক্ষ রাজনৈতিক ক্ষমার আকারে পর্দার আড়ালে একটি চুক্তি প্রণয়ন করা হবে, বিনিময়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সম্পূর্ণরূপে অবসর নেয়ার বিনিময়ে এবং মিসরের কারাগারে আটক সদস্যদের দলে দলে মুক্তি দেয়া হবে। তবে, এই পদক্ষেপ সম্পর্কে সুরক্ষা পরিষেবাগুলোর আপত্তি এবং উপসাগরীয় রাজধানীগুলোর প্রত্যাখ্যান করার কারণে জটিল হয়ে উঠবে। বাস্তবতা হচ্ছে এই আন্দোলন, যার নেতারা বর্তমানে কারারুদ্ধ, রাস্তায় তাদের কোনো চাপ কার্ড নেই এবং মিসরীয় সরকারকে এমন কিছু দেয়ার নেই যা তাদের বৈধতা স্বীকার করা ছাড়া পুনর্মিলনের দিকে অগ্রসর হতে প্ররোচিত করবে। তবে, দম বন্ধ করা অর্থনৈতিক সঙ্কট ও চলতি মাসে মার্কিন নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে ফিরে আসার সাথে সাথে তার ঘর গুছিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা মিসরীয় রাজনীতিতে স্বস্তি ও পরিবর্তনের দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে, এমনকি সীমিত হলেও।

মুসলিম ব্রাদারহুড মিসরে আবারো কি ফিরে আসবে? পশ্চিমা বিশ্লেষকরা আবারো বিষয়টি সামনে এনেছেন। তবে রাজনীতির সামনের দিন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। ব্রাদারহুডের স্থিতিস্থাপকতা এবং তৃণমূলে সমর্থনের উজ্জ্বল দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। যদিও সিসির কর্মকাণ্ড তাদের শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে। এটি বলা কঠিন যে, তারা কখনোই মিসরে প্রভাব ফিরে পাবে না। বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে যেকোনো সময়, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে যেতে পারে, নতুন গতিপ্রকৃতির উদ্ভব হতে পারে, ব্রাদারহুড দুর্বল হয়েছে, নিঃশেষ হয়নি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement