০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১, ৪ রজব ১৪৪৬
`

সার্বভৌমত্ব রক্ষা হোক বিপ্লবের অঙ্গীকার

-

জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ, যার চূড়ান্ত সফলতা আসে ৫ আগস্ট। এক মাসের ব্যবধানে ১৫ বছরের তিলে তিলে গড়ে ওঠা ফ্যাসিবাদের মসনদ এভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। তার পরও প্রশ্ন জাগে, এ ঐতিহাসিক ঘটনা কি ছাত্র-জনতার ‘বিপ্লব’ নাকি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ‘গণ-অভ্যুত্থান’। যদি বিপ্লব হয় তাহলে তার লক্ষ্য কী ছিল এবং শিক্ষাইবা কী?

মূলত বিপ্লব একটি মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন, যা তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ে ঘটে এবং জনগণ চলমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জেগে ওঠে। অনেকের মতে, বিপ্লব একটি আন্দোলন প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত রূপ যা একটি গতিশীল প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন ধাপে যার গতিবিধি ও চরিত্র পাল্টাতে পারে। গণ-অভ্যুত্থানের পর আন্দোলন ‘বিপ্লবে’ রূপ নিতে পারে। তবে গণ-অভ্যুত্থানকে ‘বিপ্লবে’ রূপ দেয়ার জন্য চাই আদর্শ, লক্ষ্য ও বিপ্লবী চিন্তাচেতনা। অন্য কথায়, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কোনো স্বৈরাচারী নীতি এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তনের বিরুদ্ধে জনগণের অধিকাংশের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের নাম বিপ্লব। এটা কোনো একটা দেশ বা কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; এক দেশ থেকে উত্থান হয়ে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে বহু দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে।

আমেরিকান বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীনা বিপ্লবের প্রতিটির ক্ষেত্রে ছিল আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের ফলে জারের স্বৈরশাসন উৎখাত হয়ে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৪৯ সালে চীনা বিপ্লবের ফলে চীনে একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ঘটা ইসলামী বিপ্লব রাজতন্ত্র উৎখাত করে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হয়। আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের হটিয়ে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠাও একটি সফল বিপ্লব। বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে সফল বিপ্লব ছিল চৌদ্দ শ’ বছর পূর্বে রাসূল সা:-এর নেতৃত্বে বিপ্লব। সে বিপ্লব তৎকালীন আরববাসীর জীবনে আমূল পরিবর্তন বয়ে এনে একটি রাষ্ট্রকাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে যার ফসল আজও ভোগ করছে মানুষ। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্রযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সফল বিপ্লবের উদাহরণ।

অন্যদিকে, বিদ্রোহ মূলত সরকারের শোষণ, নির্যাতন এবং জুলুমের বিরুদ্ধে গণ-মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। বিদ্রোহ থেকেই গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা হয় তবে এই গণ মানুষের নির্দিষ্ট একটা পক্ষ কিংবা রাজনৈতিক চরিত্র নাও থাকতে পারে। যেমনটি ছিল ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালের গণ-অভ্যুত্থান। গণ-উভ্যুত্থানে কোনো নীতি-আদর্শ বিবেচ্য নাও হতে পারে, এমনকি সরকারের কাঠামো পরিবর্তন এবং শাসনও গুরুত্ব না পেয়ে বরং স্বৈরশাসককে বিতাড়িত করাই প্রাধান্য পায়। পরিকল্পিত কোনো আন্দোলন না হয়ে হঠাৎ করেই এটি ঘটতে পারে। যেমন আরব বসন্ত। ২০১০ সালের শুরু থেকে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে যায়।

বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন

বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলনের কথা বলতে ১৩৮১ সালের ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের ‘হানড্রেড ইয়ার্স ওয়ার’ বা শতবর্ষী যুদ্ধের কথা বলা যায়। ঐ যুদ্ধে বকেয়া খাজনা আদায় নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরোধ ক্রমেই গ্রামের সাধারণ কৃষক, বিভিন্ন পেশার শ্রমিক-কারিগরসহ সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সেই আন্দোলনে হাজার হাজার কৃষকও যোগ দিয়েছিল এবং বিপ্লব সফল হয়েছিল। ২০২৪-এ বাংলাদেশে সরকারি আমলা, সেনা, নৌ ও পুলিশ অফিসার, রাজনীতিবিদ ও সরকারের তল্পিবাহকরা জনগণের ওপর জুলুম ও শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো এমনকি মেয়েদের ছাত্রীনিবাসের গণরুম, র‌্যাগিং ও অন্যান্য বর্বরতার কথা সর্বজনবিদিত। মানুষের বাস্তব ভোগান্তি, গণহত্যা, গুম, খুন, আয়নাঘরে বন্দিত্ব এগুলো মানুষ দেখেছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। যখন-তখন সাদা পোশাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া, জঙ্গি নাটক ইত্যাদি অত্যাচারের কাহিনী মানুষের মধ্যে ক্ষোভের পাহাড় সৃষ্টি করে। সব ক্ষোভ যুক্ত হয় কোটাবৈষম্যের মধ্যে যা জুলাইয়ের কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। হাইকোর্টের রায়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্ততিদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ভীষণ হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম হয়; শুরু হয় আন্দোলন। আন্দোলন কোটার বিরুদ্ধে হলেও তা এক পর্যায়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। এ নাম থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, কেবল কোটা নয় বরং সমাজে বিদ্যমান আরও অনেক ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধেও এ আন্দোলন। মূল আন্দোলন ১ জুলাই শুরু হয়ে ১৬তম দিনেই আবু সাঈদ শহীদ হলেন রংপুরের মাটিতে যা ঐক্যবদ্ধ করেছিল পুরো জাতিকে। আন্দোলনে যুক্ত হয় আপামর জনগণ। আন্দোলনে স্বৈরাচারের পলায়নের সাথে একে একে বিদায় নিয়েছেন স্বৈরাচারের দোসর ও সুবিধাভোগী দুর্বৃত্তরা।

বাংলাদেশের অভ্যুদয় ১৯৭১ সালে হলেও তার পরিকল্পনা হয় ১৯৪৭ সালে। ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান আলাদা হওয়ার সময়ই ভারতের দৃষ্টি ছিল ভারতবর্ষ থেকে ভাগ হওয়া দেশগুলো আবার দখল করার। সে মাফিক ভারত কাশ্মিরের একাংশ, হায়দরাবাদ এবং সিকিম দখল করে। বাকি ছিল তখনকার পূর্ব-পাকিস্তান অংশটি। চলতে থাকে পূর্ব-পাকিস্তান দখল করার ষড়যন্ত্র। বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির প্রচেষ্টা থেকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশ তৈরিতে সহায়তা করে ভারত। তারপর শুরু হয় বাংলাদেশকে করদ রাজ্যে রূপান্তরের প্রক্রিয়া। ১৯৭১ সালেই সে চেষ্টা সফল হয়নি। এরপর স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হরণের চেষ্টা করতে থাকে দেশটি।

১৯৭৫ সালে বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে আসেন মূলত তার পরিবারের হত্যার বিচার করতেই। তার এই প্রতিশোধপরায়ণতা, হত্যায় জড়িতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের আপামর জনগণ তথা দেশের সার্বভৌমত্বের ওপরও আঘাত হানে। তার এই মনোভাব কাজে লাগিয়েছে ভারত। ভারতের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ ক্রমান্বয়ে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্টে রূপান্তরিত করে। দেড় যুগের শাসনে রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে শুরু করে নাগরিকদের সব অধিকার খর্ব করে। এমনকি মানুষের বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করে, ভোটের অধিকার খর্ব করে, স্বাভাবিক বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে, গুম-খুন, ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যার মহোৎসব চালায়। পাশাপাশি শেখ হাসিনা, তার পরিবার এবং শেখ পরিবারের আত্মীয় স্বজন ও তাদের দোসররাও শেয়ার মার্কেট, ব্যাংক এবং রিজার্ভ লুট করে বিদেশ পাচার করে দেশের অর্থনীতি ফোকলা করে দেয়।

শেখ হাসিনা তার সব ফ্যাসিবাদী কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং প্রতিবাদকারী ভিন্নমত দমনে সরাসরি ভারতের সহযোগিতা নেন। বিনিময়ে বিলিয়ে দেন বিভিন্ন অবৈধ সুবিধা। ফ্যাসিস্ট কেবল সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করেনি বরং পার্লামেন্ট ধ্বংসসহ, রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক কাঠামো, বিচারব্যবস্থা, নির্বাহী ব্যবস্থা এবং মিডিয়া, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সামাজিক মূল্যবোধ ধুলায় মিশিয়ে দেয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা ছিল নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশ থেকে ইসলাম মুছে দেয়ার অপচেষ্টা। ‘স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি’ ‘ইসলামী মৌলবাদী’ ‘সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি’ ইত্যাদি অভিধায় বিভক্ত করে তারা তাদের শাসন এবং শোষণ চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করে। আর এ কাজে দেশের আমলা, পুলিশ এমনকি বিচার বিভাগকেও দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করে। প্রতিটি কাজে ফ্যাসিস্টকে মদদ দেয় ভারত।

আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের তীব্র ক্ষোভের কারণ শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের পাশাপাশি ছিল ভারতের কাছে সার্বভৌমত্ব হারানোর ভয়। ফলে এক মাসের ব্যবধানে বিপ্লবের সফলতা আসে। অধিকার হারা, বঞ্চিত ও প্রতারিত মানুষের মুক্তি ঘটে। ১৯৭১-এর পর দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশের মানুষ।

এ কথা সত্যি যে, জুলাই বিপ্লব কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়নি তবে বৈষম্যের শিকার ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে দেশের সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন এবং নারী-পুরুষ সবার এতে ভূমিকা ছিল।

জুলাই বিপ্লবে হাসিনার পদত্যাগ ও ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর ভারত এখনো চেষ্টা চালাচ্ছে এ দেশে কলকাঠি নাড়ার। তবে এবার ছাত্র-জনতা সজাগ ও সতর্ক আছে। তারা আর সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দেবে না।

তবে ইতোমধ্যে আন্দোলন-পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণে অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি হয়েছে। বিপ্লবের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে ফ্যাসিবাদের দোসরদের এখনো প্রশাসন থেকে সরিয়ে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। এতে আশঙ্কার কারণ রয়েছে। সুতরাং দেশের বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও কাঠামো ভেঙে নতুন একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করে বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে হবে। বিশেষ করে, আধিপত্যবাদ ঠেকাতে না পারলে, ফ্যাসিবাদ বিতাড়িত করা হবে অর্থহীন এবং সময়ের ব্যবধানে ফ্যাসিবাদ আবার গেড়ে বসবে জাতির ঘাড়ে। সে জন্য ছাত্র-জনতার সাথে দেশপ্রেমিক সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
রাতের ভোটের ৩০ জেলা প্রশাসক গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচনের তারিখ নির্ভর করছে সংস্কার কতটা তার ওপর জটিলতা না থাকলে মঙ্গলবার বিদেশ যাচ্ছেন খালেদা জিয়া ধ্বংসস্তুপ থেকে অর্থনীতি টেনে তোলার চ্যালেঞ্জে অন্তর্বর্তী সরকার সম্মিলিত কল্যাণমুখী সরকার দেশের কল্যাণ আনবে : ডা: শফিক ছাত্রদলকে পড়ায় মনোযোগী হতে বললেন মির্জা ফখরুল বিএফআইইউ প্রধান হতে এস আলম ও আ’লীগের সুবিধাভোগীদের দৌড়ঝাঁপ পদ ছাড়াই রূপালী ব্যাংকে ঢালাও পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যাচ্ছেন নিম্ন আদালতের ৫০ বিচারক দুপুরে সূর্য উঁকি দিলেও রাত কেটেছে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সকল