০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩১, ২ রজব ১৪৪৬
`

নির্বাচনী সংস্কার প্রসঙ্গে প্রস্তাব-২

-

নির্বাচনী সংস্কার প্রসঙ্গে গত ২১ ডিসেম্বর দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে আমি দুটো পদ্ধতির সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা করেছি। আজকের নিবন্ধে নির্বাচনী সংস্কার প্রসঙ্গে আমার প্রস্তাবের কিছু বিষয় উল্লেখ করতে চাই।

বর্তমান পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের সংসদীয় আসন ৩০০, নারী সদস্যের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০সহ মোট ৩৫০। সংসদীয় আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৪০০ তে উন্নীত করা যেতে পারে। আনুপাতিক হারের জন্য মাত্র ৫০টি আসন বাড়ানো প্রয়োজন। বাড়তি এই ১০০ আসনের ভেতর ৫০ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এটা দেশের সব রাজনৈতিক দলের জন্য প্রযোজ্য। সংসদীয় আসন ৩৫০ থেকে ৪০০ করা হলেও আলাদা অর্থব্যয় হবে না। বরং সমন্বিত পদ্ধতিতে ভোট করলে আমরা দুই ধরনের সুবিধা পেতে পারি। ৩০০ আসনের নির্বাচন বর্তমান পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে, ১০০ আসনের নির্বাচন আনুপাতিক হারে হবে। সেখানে প্রত্যেক ভোটার দু’টি করে ভোট দেবেন। একটি ভোট ব্যক্তিকে দেবেন এবং একটি ভোট রাজনৈতিক দলকে। এ জন্য দু’টি ব্যালট পেপার লাগবে- একটি ব্যক্তি প্রার্থীর জন্য, দলের জন্য। ফলে বর্তমান নিয়মের সাথে সমন্বয় করার জন্য শুধু একটি ব্যালট পেপার যুক্ত করতে হবে। আনুপাতিক হারে নির্বাচনের সুবিধাগুলো হচ্ছে:

১. রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে আসন বণ্টিত হবে। যদি কোনো রাজনৈতিক দল মোট প্রদত্ত ভোটের ১০ শতাংশ ভোট পায় তাহলে সে দল আনুপাতিক হারে ৩০টি আসন পাবে।

২. আনুপাতিক হারে ভোট হলে ব্যালট ছিনতাই হওয়ার সুযোগ থাকবে না।

৩. সঙ্ঘাত, মারামারি ও হানাহানি কম হবে।

৪. সব রাজনৈতিক দলের সমান সুযোগ থাকবে।

৫. সৎ ও যোগ্যলোক বেছে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে।

৬. ভালো মানুষ প্রার্থী না হয়েও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ পাবে।

এ নিয়ম চালু হলে দেশের রাজনীতির গতিপথ পাল্টে যেতে পারে। বর্তমান নিয়মে একজন ভোটারের অপশন মাত্র একটি। হয় ভোট, না হয় ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকা। কিন্তু এই নিয়মে ভোট হলে অপশন পাবে দু’টি- এক ব্যক্তি প্রার্থী, দুই দল। কোনো ভোটারের প্রার্থী অথবা দল কোনোটাই পছন্দ না হলে তিনি অন্য দলকে ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন, যা বর্তমান নিয়মে পাওয়া যায় না। বর্তমান নিয়মে একজন ভোটারের প্রার্থী পছন্দ না হলেও দলের স্বার্থে অপছন্দনীয় ব্যক্তিকে ভোট দিতে হয়। কিন্তু আনুপাতিক হারে নির্বাচন হলে ভোটদাতা ব্যক্তি প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে শুধু দলকে ভোট দিতে পারবেন। অপশন একটি থেকে বেড়ে দু’টি হলে ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলের কত শতাংশ জনসমর্থন আছে তা জানা যাবে। আনুপাতিক হারে যখন ভোট হবে তখন রাজনৈতিক দলগুলো সৎ, যোগ্য ও মেধাবী সাবেক আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী, আইনজীবী, চিকিৎসকদেরকে মনোনীত করতে পারবে। তাদেরকে দেশের স্বার্থে কাজে লাগানো যাবে। ফলে বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার মতো মারামারি, ব্যালট ছিনতাই, কেন্দ্র দখল, সঙ্ঘাত ও প্রাণহানির আশঙ্কা থাকবে না; ভয়ও তাড়িয়ে বেড়াবে না।

যে ১০০ আসনে আনুপাতিক হারে নির্বাচন হবে, সেখানে দেশের প্রতিটি ছোট-বড় রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে; ব্যক্তি করবে না। প্রত্যেকটি দলের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন করা হবে। যদি কোনো রাজনৈতিক দল মোট প্রদত্ত ভোটের ২০ শতাংশ পায় তাহলে সে দল আনুপাতিক হারে ২০টি আসন পাবে। এ নিয়ম চালু করতে পারলে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের মোট ভোটার কত তা জানা যাবে। কেউ হয়তো বলতে পারেন, বর্তমান নিয়মে তো ভোটার নির্দিষ্ট দলীয় মার্কাকে ভোট দেন। সেখান থেকেও তো দল কত শতাংশ ভোট পেল তা জানা যায়। অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমরা যে পদ্ধতির কথা বলছি, সেটা বাস্তবায়ন হলে একজন ভোটার পছন্দের প্রার্থীকে এবং একই সাথে পছন্দের দলকেও ভোট দিতে পারবে, যা বর্তমান ব্যবস্থায় পাওয়া যায় না। বর্তমান নিয়মে ভোটাররা সরাসরি দলকে ভোট দেয় না, ভোট দেয় ব্যক্তিকে। ব্যক্তির সমর্থন নিয়ে দল ক্ষমতায় যায়। কিন্তু আনুপাতিক হারে ভোট হলে সরাসরি রাজনৈতিক দলকে ভোট দেবে। এ ক্ষেত্রে দল বাড়তি সুবিধা পাবে। দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চা হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি বাড়বে। জনসমর্থন পেতে ভালো কাজ করবে। রাজনৈতিক দলগুলো মনোনীত ব্যক্তিদের সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। শুধু তাই নয়; সৎ, যোগ্য ও ভালো মানুষের নেতৃত্বে আসার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

সমন্বিত পদ্ধতির ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতে পারে! আসনের সংখ্যা কমবেশি হতে পারে! আমরা মনে করি, দেশ, জাতি, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে দেশের সুশীল সমাজ, রাজনীতিবিদ, নির্বাচন সংস্কার কমিটি উল্লিখিত বিষয়গুলো ভেবে দেখতে পারেন।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
ই-মেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement