রাজস্ব আহরণ আইন কানুনের সংস্কার
- ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
- ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:৩৫
মানুষ আয় করে তার ওপর কর দেয়। তাই আয়ের পথ ও পরিবেশ নিশ্চিত করা রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক। এমন হলে ব্যক্তি সহজে কর দিতে পারবে। কিন্তু আয় করার পুরো বিষয় বুঝে ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে গেলে নিরুৎসাহিত হওয়াই স্বাভাবিক। এ জন্য করমেলার মাধ্যমে সবাইকে বিষয়গুলো জানানো যায়। যেমন- যেসব করদাতা দূরে থাকেন তারা জানেন না, কোথায় গিয়ে কিভাবে কর দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে ভোগান্তিরও শিকার হতে হয় তাদের। মেলা আয়োজনের ফলে করদাতা অফিসে যাওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা এড়িয়ে অন দ্য স্পট সরাসরি সহজে কর দিতে পারবেন। নিজেরাও প্রশিক্ষিত হতে পারবেন। পাশাপাশি কর দেয়ার প্রক্রিয়ায় করদাতার কাছে এগিয়ে যাবেন করগ্রহীতারা। আয়ের উপর কর দিতে গিয়ে অতিরিক্ত ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর পরিস্থিতি রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনায় সুখকর হয় না।
কর আহরণের প্রকৃতি এবং বাজেট প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনা প্রয়োজন। ঔপনিবেশিক আইনের কোনো সংস্কার যেমন হয়নি, এখানে নিত্যনতুন যে পয়েন্টগুলো যুক্ত হয়েছে সেগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেই প্রযোজ্য সামঞ্জস্যতা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে- বেশ বিলম্বে শুরু হওয়া বাজেট-পূর্ব আলোচনাগুলোর কথা। বাজেট নিয়ে সবাই এমন এক সময় নিজেদের দাবি ও সুপারিশ উত্থাপন শুরু করে তখন আর বাজেট প্রস্তাব সংশোধনের কোনো সুযোগ থাকে না। আলোচনা ও দাবি-দাওয়া পেশ করার সময়ও পাওয়া যায় না ঠিকমতো। ফলে যে দাবি ও সুপারিশ আসছে তা বিবেচনার জন্য কোনো ভিত্তি হয়ে ওঠে না, ফলে দাবি ও সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন বা পূরণ করা সম্ভব হয় না ঠিকমতো।
দক্ষ লোকবল নিয়ে রাজস্ব বিভাগ পরিচালিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে এনবিআরে তুলনামূলকভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকবলের অভাব স্পষ্ট। বিশেষ করে আশির দশকে রাজস্ব বোর্ডের গুরুত্ব তেমন ছিল না। আর রাজস্ব অবকাঠামো তখন যে ক্ষুদ্র পরিসরে ছিল, তা স্থির ছিল বহু বছর। ২০০৮ সালে রাজস্ব বোর্ডের লোকবল ও অবকাঠামোগত সম্প্রসারণে প্রস্তাব রাখা হয়। লোকবল ও কাঠামো দুই-তিনগুণ বাড়ানোর যে প্রস্তাব তখন রাখা হয়েছিল তার বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৩ সালে। সেখানে দক্ষ ও উপযুক্ত লোকবল নিয়োগ দিতে একটু সময় লেগে যাচ্ছে, যারা সেখানে নিয়োগ পাবেন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না পেয়ে তারা এ কাজ কতটুকু করতে পারবেন সেটি নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। বিশেষ করে রাজস্ব বিভাগে যারা কাজ করবেন তাদের মেধা ও দক্ষতা আর দশটা দফতর বা বিভাগের চেয়ে বিশ্লেষণ ক্ষমতায়, পারঙ্গমতায় অবশ্যই বেশি হওয়া আবশ্যক। আশির দশকে বিশেষ বিবেচনায় একটি বিশেষ পর্যায়ের কিছু কর্মচারী এ বিভাগে আত্মীকৃত হন। দুই দশক তাদের সঠিকতা নির্ণয় ও আত্তীকরণের যৌক্তিকতা প্রমাণ উপলক্ষে রজ্জু করা প্রায় আট ডজন মামলার ফেরে পড়ে রাজস্ব বিভাগে প্রারম্ভিক পর্যায়ে কর্মকুশল কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগ বন্ধ ছিল। ফলে উপযুক্ত ও দক্ষ লোকবলের অভাবে ন্যায্য রাজস্ব আহরণ শেষ অবধি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত করতে ধকল সইতে হচ্ছে।
তিনটি খাত- শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর থেকে রাজস্ব আহরিত হয়। এখানে সরাসরি রাজস্ব আহরণের পথ হচ্ছে আয়কর। পরোক্ষ হিসেবে রয়েছে ভ্যাট ও শুল্ক। কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ডে রাজস্ব আহরণের দায়িত্বে আছেন বিসিএসের দুই ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এ ক্ষেত্রে বিসিএস (কর) ক্যাডার ডাইরেক্ট ট্যাক্সের দায়িত্বে। আর বিসিএস (কাস্টমস ও শুল্ক) ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স আহরণের দায়িত্বে রয়েছে। অনেক দেশে (যেমনÑ ভারতেও) ডাইরেক্ট আর ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স আহরণে আলাদা বিভাগ বা দফতর রয়েছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একই প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় দুই স্বতন্ত্র ক্যাডার কর্মকর্তা দুই প্রকার রাজস্ব আহরণ করেন। এ ক্ষেত্রে কর কিংবা ভ্যাট আরোপে মাঝেমধ্যে যে জটিলতা দেখা দেয় তা সমন্বয়ের অভাবে। অসম আন্তঃঅসমন্বয়ের জটিলতা সৃষ্টির দ্যোতক হয়ে থাকে, এ ব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। একসময় ইউটিআইন (ইউনিফাইড ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) প্রস্তাব করা হয়েছিল; যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তির ট্যাক্স, ভ্যাট, কাস্টম ডিউটি- এগুলো আন্ডার ওয়ান কোড চলে এলে সুবিধা হতো যে, দেখলে বোঝা যেত কে কত ভ্যাট, ট্যাক্স দিচ্ছেন। পাশাপাশি কার কী কী প্রতিষ্ঠান আছে তার কার্যক্রম কিভাবে চলছে; তাও বোঝা সম্ভব হতো। কিন্তু ওই যৌথ ও সমন্বিত দেখাশোনার দর্শন বাস্তবায়নুগ পাওয়া যায়নি- আন্তঃসমন্বয় সমস্যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারযোগ্য বিষয় হলো- নীতি প্রণয়নকারী ও বাস্তবায়নকারী, কার্যসম্পাদনকারী ও তার প্রতিকার প্রার্থনা শ্রবণকারী একই কর্তৃপক্ষ/কর্মকর্তা হওয়া। বাস্তবায়নকারী নীতি প্রণয়ন কিংবা নীতি প্রণয়নকারী বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকলে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন উভয় সুবিবেচনা প্রাপ্ত হয় না। একইভাবে বাস্তবায়নকারীর দ্বারা সৃষ্ট অনিয়মের পরীক্ষা পর্যালোচনা বা আপিল শ্রবণের দায়িত্ব তার কাছে থাকলে সুবিচার নিশ্চিত হয় না।
এনবিআরের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ ও দায়িত্ব পালন নিয়ে একসময় জটিলতা দেখা দিয়েছিল। ২০০৭ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে লাল কালিতে সংবাদ শিরোনাম হয়- ‘অবৈধভাবে চলছে এনবিআর’। দেখা যায়, রাজস্ব আহরণ-বিষয়ক একটি মামলায় এনবিআর আইন ১৯৭২-এর আওতায় চেয়ারম্যান নিয়োগ-সংক্রান্ত একটি ধারার সঠিক বাস্তবায়নের প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়। এটিকে আমলে নিয়ে আদালত বলেছিলেন, ‘এনবিআর চেয়ারম্যান অবৈধ’। আদালত বলেছিলেন, ১৯৭২ সালের ‘আইন’ স্পর্শ বা সংশোধন না করে ১৯৭৭ সালে ‘রুলস অব বিজনেস’ বলে আইআরডির সচিব এনবিআরের চেয়ারম্যান হচ্ছেন, এটি ঠিক হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে সে সময় আপাতত একটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৯৭২ সালের আইনে সংশোধনী এনে বিদ্যমান ধারা অব্যাহত রাখার পথ সুগম করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানে বোর্ড গঠন-সংক্রান্ত মৌল নীতি ও ধারণার আলোকে বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগের ও তার চাকরির শর্তাবলি যথাযথভাবে সুনির্ধারিত না হলে আন্তঃঅস্বস্তি তথা নানা প্রশাসনিক জটিলতা হতে থাকবে।
রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমে ও পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় আইনসঙ্গত স্বচ্ছতার মাধ্যমে গতিশীল করার স্বার্থে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আইন ও প্রক্রিয়ার যৌক্তিকতা যথা বিশ্লেষণ হওয়া উচিত। বিশেষ করে কর আহরণ প্রক্রিয়ার যে সব আইনি জটিলতা সেটি ঠিকমতো সংস্কারের মাধ্যমে স্পষ্ট করা না গেলে সমস্যা থেকে যাবে। অন্তত এ অবস্থায় রেখে ব্যাপক কর আদায়ের যে কথা চিন্তা করা হচ্ছে তা অর্জন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে আইনের আর্থ-প্রশাসনিক প্রয়োগে যদি আরো কিছু অসম্পূর্ণতা ও ফাঁকফোকর থাকে তা সংশোধন করা না গেলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এনবিআর কর্তৃপক্ষের নেতৃত্ব দেয়া কঠিন হওয়া স্বাভাবিক।
আরেকটি প্রসঙ্গ অর্থবছর-সম্পর্কিত। যেখানে অনেক দিন থেকে বলা হচ্ছে বা দেখা যাচ্ছে, খুব স্পষ্টত যে, বাংলাদেশের অর্থবছর এর সময়সীমা আসলে বদল হওয়া দরকার। আমাদের এখানে ভরা বর্ষায় অর্থাৎ ১৬ আষাঢ় পয়লা জুলাই থেকে শুরু হয়ে ১৫ আষাঢ় পর্যন্ত (৩০ জুন তা শেষ হয়), উভয় দিকে নানান প্রাকৃতিক সমস্যা থাকে। এটি যাই হোক অন্তত কর আদায়ে অর্থবছর গণনায় উপযুক্ত সময়কাল হতে পারে না। কারণ বন্যা থেকে শুরু করে নানা ধরনের ঝড়-বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোক্ষম মওসুমে কর আদায় শ্লথ হয়ে পড়ে। আয়কর আহরণে বর্তমানে যে নভেম্বর মাস বলবৎ করা হয়েছে তার সুবিধা একটিই যে, তখন প্রকৃতি বৈরী থাকে না। এরপর আরো কিছু দিক থেকে যায় যা সময়গতভাবে কিছু জটিলতা তৈরি করতে পারে। এদিকে সবাইকে একই অর্থবছর জুলাই-জুন করলে আরো কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। ব্যাংক-বীমা ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান সবার হিসাব দেখতে হয় নতুন করে। এ ক্ষেত্রে অনেক ভুলত্রুটি ধরা পড়ে। আবার সময়টি পড়ে গিয়ে সেই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে, ওদিকে পরের বর্ষার আগে আবার চলে বাজেট তৈরির কাজ। এ ক্ষেত্রে ভুল সংশোধনের পাশাপাশি কারো দেড় বছরের হিসাব নতুন করে দেখতে হয়। ফলে সময়টিতে নানা দিক থেকে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কিছু কোম্পানি দেড় বছরের মাথায় এসে হিসাব মিলাতে বাধ্য হচ্ছে। এসব নানান কারণ মিলে একটি বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায়- জুন-জুলাই যাই হোক, অন্তত বাংলাদেশে অর্থবছর হিসাবে এপ্রিল-মার্চ কিংবা জানুয়ারি-ডিসেম্বর যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে।
আয়কর বিভাগ অগ্রিম কর (এআইটি) হিসেবে ১ শতাংশ কর কাটে। এটি ফাইনাল সেটেলমেন্ট। পরে আর কোনো দাবি-দাওয়া করা যায় না। এটি সমন্বয় বা রিটার্ন করার কথা। কিন্তু সেটি করা হয় না। যদি ফাইনাল সেটেলমেন্ট করা না হয়, তাহলে অগ্রিম কর নেয়া বন্ধ করতে হবে। করপোরেট কর যা অগ্রিম কাটা হয়; তা রিটার্ন দাখিলের সময় এনবিআর গ্রহণ না করলে তার ওপর আবার কর ধরা হয় ৩০ শতাংশ। এফডিআরের লাভের ওপর কর কাটা হয় ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যাংক উৎসে কর হিসেবে কেটে রাখে ১০ শতাংশ। রিটার্ন দাখিলের সময় কাটা হয় ১৮ শতাংশ। অগ্রিম ও করপোরেট কর কাটার পর এফডিআর ব্যাংকে জমা হয়।
প্রতি মাসে ভ্যাটের রিটার্ন দাখিলের বিধান বাতিল করা যেতে পারে। অনলাইন হয়ে গেলে এর প্রয়োজন পড়বে না। কাস্টমস খাতে এইচএস কোডের প্রথম চারটি ডিজিট সঠিক থাকলে সেটি গ্রহণ করা যায়। এটিকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে হয়রানি করা ঠিক নয়। ওজনের সামান্য ক্রটি দেখিয়ে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে হয়রানি করা যাবে না। ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানার বিধান বাতিল করে সংশোধনের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। জরিমানা থেকে কর্মকর্তাদের প্রণোদনা দেয়ার বিধানও সংস্কার করা আবশ্যক।
বর্তমানে ৮০ শতাংশ কর আয় আসে পরোক্ষ কর থেকে। আয়কর খাতের উৎসে করও পরোক্ষ কর। কর বেশি দেয়ার কথা ধনীদের, যাদের আয় বেশি। কিন্তু করের বোঝা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর, গরিবের ওপর। খুচরা মূল্যের ওপর কর বসছে। কর ব্যবস্থায় সংস্কার করা দরকার। যত ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান, তার ওপর ভ্যাট বেশি। যত বড় প্রতিষ্ঠান, তত ভ্যাট কম। উৎসে ভ্যাট কর্তন আন্তর্জাতিক নিয়মের পরিপন্থী। ভ্যাটের মাল্টিপল রেট থাকলে তাকে ভ্যাট বলে না। এ ভ্যাট সিস্টেম অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পরিপন্থী। এগুলো জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা দরকার। সমাজে বৈষম্য দূর করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে রাজস্ব বোর্ডের এবং রাজস্বনীতি ব্যবস্থাপনার সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা