মুসলিম না বাঙালি বনাম বাঙালিত্বের ঐতিহাসিক পটভূমি
- মুসা আল হাফিজ
- ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:০৯
বাংলায় মুসলিম জনগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক আমলের আগে বাঙালি না মুসলিম প্রশ্নের সাথে পরিচিত ছিল না। বস্তুত বাঙালি পরিচয় তাদের কাছে উপাদেয় ছিল। মুসলিম পরিচয়ের সাথে এর কোনো অনাত্মীয়তা ছিল না। মুসলিম সভ্যতা প্রতিটি অঞ্চলের পরিচয়, প্রবণতা ও স্থানিকতাকে ইতিবাচক বিচারে যথাস্থান দিয়েছে। আরব থেকে দ্রুততার সাথে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া ইসলাম কোথাও স্থানিকতার সাথে সঙ্ঘাতে লিপ্ত হয়নি। প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে তাকে মুসলিমদের পরিবেশ ও প্রতিবেশে দেখতে চেয়েছে। স্থানীয়দের ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনাচারকে কোথাও বিলুপ্ত করেনি।
অমুসলিমদের ধর্ম, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, জীবনধারায় জবরদস্তি হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ ছিল না মুসলিম শাসকদের। ফলে কোথাও স্থানীয় বাস্তবতা বনাম মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্ঘাতে মুসলিম শাসন বিপন্ন হয়নি; বরং স্থানিক পরিচয়সমূহকে আত্মউন্মোচনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে দেখেছে মুসলিম সমাজ। ফলে ইফ্রিকি, উন্দুলুসি, হিন্দি, ইয়ামানি, বাগদাদি ইত্যাদি পরিচয় ধারণ ছিল স্বীকৃত ঐতিহ্য। যার অনুমোদনের সূত্র নিহিত ছিল আল কুরআনে। বাঙালি পরিচয়ও একই বাস্তবতার ঘোষক।
মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাপুরুষদের অধিকাংশই আপন নামের সাথে স্থানীয় পরিচয় যুক্ত করেছেন। মুসলিম বাংলার প্রাচীন মনীষীরাও এই ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। শায়খ আঁখি সিরাজুদ্দিন উসমান আল-বাঙালি (১২৫৮-১৩৫৭), শায়খ আলাউদ্দিন ওরফে আলাউল হক বাঙালি (১৩০১-১৩৮৪/৯৮), নূর কুতুবুল আলম বাঙালি (ওফাত-১৪১৫ খ্রি.), কামাল-ই-করিম বাঙালি (চতুর্দশ শতক), সৈয়দ ইবরাহিম দানিশমন্দ বাঙালি (ষোড়শ শতক) থেকে নিয়ে আধুনিককালের গাজী ইমামুদ্দিন বাঙালি (১৭৮৮-১৮৫৯) কিংবা আব্দুল ওয়াহেদ বাঙালি (১৮৫০ -১৯০৫) হয়ে এই ধারা বহমান। শাসকদের মধ্যে বাঙালি উপাধি গৌরবের সাথে ধারণের ব্যাপারটি লক্ষ করা যায় সুলতানি আমলে। বস্তুত বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্ন-বিভক্ত অঞ্চলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলা নামের দেশ গঠন করেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৫৮-১৩৯০)। তিনি বাংলার ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচিতিকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুরো বাংলার অধিপতি হন। নিজেকে তিনি শাহে বাঙ্গাল ঘোষণা করেন। দিল্লিসহ বহির্বিশ্বে এর স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। দিল্লির সমসাময়িক ঐতিহাসিক শামস-ই-সিরাজ আফিফ (মৃত্যু-১৩৮৮) ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’, ‘শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’ ও ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ পরিচয়েই তাকে উল্লেখ করেন।
পরবর্তী বাংলার সুলতানরা বহির্বিশ্বে বাঙালি পরিচয়ের গৌরব প্রতিষ্ঠায় ছিলেন মনোযোগী, সক্রিয়। সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ ১৩৯০ থেকে ১৪১১ সাল অবধি তার শাসনামলে মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারায় প্রতিষ্ঠা করেন দু’টি বিশাল শিক্ষাগার। মাদরাসা দু’টির নামে ছিল বাঙালি কথাটির যোগ। আল মাদরাসাতুল গিয়াসিয়া বানজালিয়া (বাঙালি গিয়াসিয়া মাদরাসা) নামে তা ছিল বিখ্যাত।
মুসলিম সুলতানরা নিজ কর্মভূমিকায় ছিলেন বাঙালি। নিজেদের পূর্বপুরুষের ফেলে আসা ভূমিকে তারা ভুলে গেলেন। বাংলাকেই তারা গ্রহণ করলেন স্বদেশ হিসেবে। এখানকার উন্নতি, কল্যাণ, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাই ছিল তাদের অন্বেষা। তারা বাংলার মাটির প্রকৃত হাতছানি অনুভব করলেন। দিল্লির আনুগত্যের বদলে বাংলার স্বাধীনতার লড়াইকে বেছে নিলেন। এখানকার ভূমিজ বাস্তবতা, ঐতিহ্য ও জীবনের সমৃদ্ধ পটভূমি স্বাধীনতাকেই আমন্ত্রণ করে। এর সাথে একাত্ম হলেন বলেই মুসলিম শাসকরা দিল্লির মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে একের পর এক লড়াই করেছেন বাংলার স্বাধীনতার জন্য। এই লড়াই শুরু থেকেই চলছিল। চৌদ্দ শতকের ভেতরেই স্বাধীনতার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ভিত্তিকে সংহত করেন বাংলার সুলতানরা। এর পর দিল্লি বাংলার স্বাধীনতাকে কবুল করে নেয় অনেকটা বাধ্য হয়ে।
বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমল বাংলা আর বাঙালির মহিমা প্রতিষ্ঠায় ছিল অকুণ্ঠচিত্ত। সেন যুগে বাঙালির মনন বিনাশের প্রয়াস ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। এবার সেই বদ্ধ অর্গল খুলে গেল। শিক্ষা ও সংস্কৃতির নতুন দিন পেখম মেলছিল। ধর্ম-নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষের বিকাশযাত্রায় প্রসারিত হলো বাংলাভাষা চর্চার ক্ষেত্র। উদার অন্তর্ভুক্তি হিন্দু-মুসলিমের যৌথ সৃষ্টির শস্যভাণ্ডার তৈরি করল, যা আমাদের সংস্কৃতিকে দিলো তারুণ্য, গতি ও বিস্তৃতি। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবেশ চিত্তবৃত্তির নতুন প্রেরণা নিয়ে বিস্তারিত হলো। যার সূচনা ঘটেছিল মুসলিম বিজয়ের পরে। বাঙালির ভাষা ও মননের বিকাশের জন্য তুর্কি শাসনকাল ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য স্তন্যদায়ী ভূমিকা পালন করেছে এই সময়পর্ব।
এ সময়ে বাংলা ভাষায় রচিত হয় বহু অজর-অমর সাহিত্য। মোটাদাগের নিদর্শনগুলোর মধ্যে আছে পিঙ্গলের গীতিগ্রন্থ ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’, রামাই পণ্ডিত রচিত চম্পুকাব্য শূন্যপুরাণ এর কলিমা জলাল বা নিরঞ্জনের রুষ্মা, হলায়ুধ মিশ্র রচিত গদ্য-পদ্যমিশ্রিত চম্পুকাব্য ‘সেক শুভোদয়া’ এর পীর-মাহাত্ম্যজ্ঞাপক বাংলা ‘আর্যা’ ‘ভাটিয়ালি রাগেন গিয়তে’ ডাক ও খনার বচন এবং শ্রীকৃষ্ণ-কীর্তন। এ ছাড়া শ্রীধর দাসের সদুক্তি কর্নামৃত, (১২০৬ সাল) কাজী রোকনুদ্দীনের হাওকুল হায়াত (১২১০-১৩ সাল) নারায়ই এর চম্পুকাব্য (১৩৭৩) ইত্যাদি এ সময়ের প্রকাশিত গ্রন্থ। সুকুমার সেনের বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড দাবি করে, মুসলিম আমলে রচিত হয় চর্যার অনেকগুলো পদ। তার বিচারে চর্যাপদ রচনার কাল হলো একাদশ থেকে চতুর্দশ শতক।
বাংলার হয়ে ওঠার যেসব ধাত্রীগ্রন্থ একালে রচিত হয়, সেগুলোর দিকে তাকালে কখনোই এই সময়কালকে অন্ধকার যুগ আখ্যা দেয়া যায় না; বরং তা ছিল সন্ধিযুগ। সেন আমলের বৈরিতা অতিক্রম করে আত্মপ্রকাশের আনুকূল্য নিয়ে বাংলা ভাষা তখন নিজের বালকবেলা অতিক্রম করল। তারপর এলো সৃষ্টিপ্রাবল্য। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, মঙ্গলকাব্য অনুবাদ সাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, জীবনী সাহিত্য, দোভাষী পুঁথি, নাথ সাহিত্য, মর্সিয়া সাহিত্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, লোকসাহিত্য ইত্যাদির ছয় ঋতু চরিত্রে ডানা বিস্তার করল।
এই যে নতুন প্রবাহ, এতে হিন্দু-মুসলিম যৌথতা ছিল প্রবল। এখানে ধর্মের ভিন্নতা মুখ্য হয়ে ওঠেনি; বরং সম্মিলিত বাঙালি সত্তা বিকাশের পথ পেয়েছে সুলতানদের আমলে।
রুকনউদ্দিন বরবক শাহের (১৪৫৯-৭৪) পৃষ্ঠপোষকতায় কবি মালাধর বসু রচনা করেন ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’। তিনি মালাধর বসুকে দেন ‘গুণরাজ খান’ উপাধি, শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের (১৪৯৩-১৫১৯) সময়ে মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ লেখা সমাপ্ত করেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় শাহ মুহম্মদ সগীর তার বিখ্যাত কাব্য ‘ইউসুফ-জোলেখা’ রচনা করেন। সম্ভবত সুলতান কৃত্তিবাসকেও বাংলায় রামায়ণ লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। নসরত শাহ (১৫১৯-১৫৩২) ও তার সেনাপতি ছুটি খাঁ মহাভারতের অনুবাদে করেন পৃষ্ঠপোষকতা। শ্রীকরণ নন্দি মহাভারতের অশ্বমেধপর্ব অনুবাদ করেন ছুটি খাঁর আদেশে। নন্দির ভাষায় নসরত শাহ হলেন রামের মতোই প্রজাপালক, অতিমহারাজা। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজদরবারে খ্যাতনামা কবি হলেন মালাধর বসু, বিপ্রদাস, বিজয়গুপ্ত, যশোরাজ প্রমুখ। ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ গ্রন্থের লেখক যশোরাজ খান সুলতানকে আখ্যা দেন ‘শাহ হুসেন জগত-ভূষণ’। আর কবিন্দ্র পরমেশ্বর তার বন্দনায় বলেন, ‘কলিকালে হরি হৈল কৃষ্ণ অবতার’। বরিশালের কবি বিজয়গুপ্ত সুলতান হুসেন শাহের আমলে রচনা করেন ‘পদ্মপুরাণ’। হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খানের পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রামের কবি কবিন্দ্র পরমেশ্বর বাংলায় মহাভারত অনুবাদ করেন। কবি শ্রীধর ফিরোজ শাহের আমলে ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন।
হিন্দু সমাজে বাংলা ছিল নিন্দিত, উচ্চবর্ণের কাছে ছিল লাঞ্ছিত। সেই ভাষায় অষ্টাদশ পুরাণ বা রামের জীবনী পাঠকে রৌরব নরকের যোগ্য পাপ বিবেচনা করা হতো। সেখানে বাংলা ভাষা লাভ করল অসাধারণ প্রতিষ্ঠা।
নতুন পরিবেশে হিন্দু সমাজ তাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে শাণিত করার ক্ষেত্র আবিষ্কার করে। পৃষ্ঠপোষক মুসলিম শাসক, সাহিত্য স্রষ্টা হিন্দু-মুসলিমস কবিকুল।
সাধারণ হিন্দুদের আগে মুসলিম শাসনকে বরণ করেন বৌদ্ধরা। ব্রাহ্মণ্যবাদের সাথে তারা লড়ছিলেন বহু শতাব্দী ধরে। পালদের শেষ আমল ছিল নৈরাজ্যমুখর। এ সময় কঠোর ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সেন রাজাদের আধিপত্য বিস্তৃত হয় মগধ, বঙ্গ, পুণ্ড্র ও সমতট অঞ্চলে। ১০০০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কর্নাটক থেকে আগত সেনরা এসব জনপদ শাসন করে। বাংলার বিকাশমান বৌদ্ধধর্ম সেনদের হাতে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়। বৌদ্ধদের বিপদে বাংলার বিপদ বাড়ে। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ বৌদ্ধদেরই সৃষ্টি। অর্থাৎ বাংলা ভাষার জনক ছিল মুখ্যত বৌদ্ধরা। বৈদিক আধিপত্যবাদ তাদের ধর্মীয়, ভাষিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য কখনোই মঞ্জুর করেনি। রাজা শশাঙ্কের সনাতনী যুগে এর নিদর্শন প্রশস্ত। তিনি বাংলা থেকে বৌদ্ধ ধর্মের উৎখাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। গয়ার যেসব বোধিবৃক্ষ গৌতম বুদ্ধের স্মৃতি বহন করছিল, সেগুলো নিশ্চিহ্ন করেন। পাতা পল্লব তো বটেই, মূল কাণ্ডসমেত বৃক্ষগুলো ভষ্ম করা হয়। পাটলিপুত্রে গৌতম বুদ্ধের পদচিহ্ন ছিল যে পাথরে, তাও ভেঙে ফেলা হয়। গয়ায় বৌদ্ধ মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি ভেঙে সেখানে শিবের মূর্তি স্থাপন করেন।
বাংলা থেকে নেপালের সীমান্ত অবধি বৌদ্ধ নিধনের বিভীষিকা ছড়িয়ে দেন তিনি। জৈন ধর্মের ওপরও তিনি চালান উৎপীড়ন, অত্যাচার। নিজের আয়োজিত ধ্বংসযজ্ঞ এক সময় তাকে বিচলিত করে, আত্মসমীক্ষায় বাধ্য করে। শেষ অবধি ধর্মত্যাগ করে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। কনৌজ সমাবেশের সময় বিপুল সংখ্যক ব্রাহ্মণকে নৃশংসভাবে বিনাশ করেন। বৌদ্ধ ধর্ম বনাম ব্রাহ্মণ্যবাদের বিবাদ এর পরে আরো বেড়েছে।
পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ। তাদের শাসনকালে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে মেলামেশা, আচার-আচরণ ও রীতি-নীতির ক্ষেত্রে সামাজিক দেয়াল তেমন ছিল না। কিন্তু সেন আমলে প্রবলভাবে প্রাচীরগুলো মাথা তোলে। ফলে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। সমাজে নিম্ন অস্পৃশ্য ও অন্ত্যজ শ্রেণীর পাশাপাশি ব্রাত্যদের শেষ প্রান্তে বৌদ্ধরা ছিটকে পড়েন। তাদের জন্য মুসলিম বিজয় ছিল স্বস্তি ও সান্ত্বনার বিষয়। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সত্তাকে ঝড়ের উজানে ধরে রাখছিল যে বৌদ্ধরা, তারা মুসলিমদের গ্রহণ করল উদ্ধার হিসেবে।
দীনেশচন্দ্র সেন লিখেন, ইতিহাসে কোথাও এ কথা নেই যে, সেন রাজত্বের ধ্বংসের প্রাক্কালে মুসলমানদের সাথে বাঙালি জাতির রীতিমতো কোনো যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে। পরন্তু দেখা যায়, বঙ্গ বিজয়ের পরে বিশেষ করে উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলে সহস্র সহস্র বৌদ্ধ ও নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু নব ব্রাহ্মণদের ঘোর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণপূর্বক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।
মুসলিম শাসকদের উদারতা, বৌদ্ধদের প্রতি মুসলিমদের ভালো ব্যবহারের ফলে দলে দলে বৌদ্ধরা ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিতে থাকে। মুসলিম শাসকরা বৌদ্ধদের প্রতি এতটাই উদার ব্যবহার করেছিলেন, ফলে পাইকারি হারে বৌদ্ধরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন, ‘বাংলার অর্ধেক বৌদ্ধ মুসলমান হইয়া গেলো’। (ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা-৫২৮)
দীনেশচন্দ্র কিংবা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বয়ানের সাথে ভিন্নমতের জায়গা কম। তবে একটি দিক হলো পাইকারি হারে মুসলিম হওয়া বা গণধর্মান্তরের ঘটনা, তা ঘটেনি আসলে। মুসলিম হওয়ার প্রক্রিয়াটি ছিল ধীর। সমাজ ও সংস্কৃতির দীর্ঘ মেলবন্ধন এই প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করেছে। এর ফলে যা ঘটল, তার সুফল ভিড়ল বাঙালি সত্তার ঘাটে। মুসলিম আমলের আগে বাঙালি হিন্দু ছিল হিন্দু, আরো গভীর অর্থে তারা ছিল উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ। বাঙালি বৌদ্ধ ছিল বৌদ্ধ ও বাঙালি, পরস্পরে ছিল দূরত্ব-সঙ্ঘাত। যাকে মনে করা হতো অনতিক্রম্য।
মুসলিম আগমনে আরেকটি সঙ্ঘাতের চ্যানেল খুলতে পারত। ফলে বাঙালি সত্তা এতটাই বিভাজিত হতো, যা একক ও ঐক্যবদ্ধ সত্তায় বিকশিত হতে পারত না। কিন্তু ঘটল উল্টোটি। প্রত্যেকের সহাবস্থান এবং ভাষিক ও ভূমিজ মেলবন্ধনের একটি পাটাতন তৈরি করল মুসলিম শাসন। যা বাঙালি হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিমকে একক ভাষিক ও রাষ্ট্রীয় সত্তায় আত্মতা দান করল। বাঙালি লাভ করল বাঙালিত্বের বিকশিত পটভূমি।
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা