নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়েও যন্ত্রণা
- রিন্টু আনোয়ার
- ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:৫৬
প্রধান উপদেষ্টার দেয়া ‘নির্বাচনী রোডম্যাপ’ নিয়ে আশাহত বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনী রোডম্যাপে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি প্রধান উপদেষ্টা। আমরা হতাশ হয়েছি। সেই সাথে উপদেষ্টার প্রেসসচিব যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা সাংঘর্ষিক। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘২৫ সালের শেষে অথবা ২৬-এর শুরুতে নির্বাচন হবে। আর প্রেসসচিব বলেছেন, ‘২৬-এর জুনে নির্বাচন হতে পারে।’ আমরা বুঝতে পারছি না, কোনটি সঠিক। নির্বাচন বিষয়ে রোডম্যাপ কোনো যৌক্তিকতায়ই হয়নি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, অবিরাম এ জিজ্ঞাসার জবাব আরেকটু খোলাসা করে দিতে গিয়ে ড. ইউনূস যেন আরেক ফ্যাসাদেই পড়ে গেলেন।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। এর সঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করলে আরো ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। এ ধরনের বাক্যে বার্তা মোটামুটি পরিষ্কার। কিন্তু, রাজনৈতিক দলগুলোর সেখানেও আপত্তি। তার এ ধরনের কথার মধ্যে ‘তবে কিন্তু’ আঁচ করছে তারা। তারা আরো স্পষ্টতা দাবি করেন। যার জেরে পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম জানান, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।
প্রেসসচিবের বক্তব্যে নির্বাচনের একটা খসড়া রোডম্যাপ মোটামুটি দেয়া হয়েছে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে যন্ত্রণা আরো বেড়েছে। তিনি এ তথ্য জানানোর কে এ প্রশ্নও উঠে গেছে। ভাষা বেশি ঝাঁঝালো প্রধান দল বিএনপির। প্রধান উপদেষ্টাকে সবাই মিলে, দেশের মানুষ মিলে মনোনীত করেছেন। কিন্তু প্রেসসচিব তো সরকারি চাকরি করেন, সরকারের বেতন নেন, তিনি এ ক্ষমতা পেলেন কোথায়? এখানেই শেষ নয়, প্রেসসচিব প্রধান উপদেষ্টাকেও ক্রস করে ফেলেছেন এমনো ক্ষোভ জানানো হয়েছে বিএনপি থেকে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে চাইলে চার থেকে ছয় মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সিপিবির মতে, সরকার আন্তরিক হলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন সম্ভব। সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ না করলেও নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ সময় দিতে চায় না জামায়াত। ২০২৬ সালে নির্বাচন হলে আপত্তি নেই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের। পছন্দের সময় চায় জাতীয় পার্টি। সেই পছন্দের সময়টা কখন তা এখনই বলতে চায় না দলটি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগও বসে আছে। তাদেরও আশা আছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের পথে নেই বলে মনে করছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। তারা সবার অংশগ্রহণে দ্রুত নির্বাচন চায়। এই দ্রুত মানে কত দ্রুত বা কখন সেদিকে এখনই যেতে চায় না আওয়ামী লীগ।
অবস্থাদৃষ্টে নির্বাচন নিয়ে আচ্ছা রকমের রাজনৈতিক জটিলতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজে অরাজনৈতিক ব্যক্তি, তিনি রাজনীতির ঊর্ধ্বে। কিন্তু, তার যত কাজ রাজনীতিকদের সাথেই। তাদের আয়ত্ত করতে, নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টায় যে তার অন্ত নেই! কিন্তু, কতটা পারছেন তা গোপন থাকছে না। বিতাড়িত আওয়ামী লীগ তার স্পষ্ট প্রতিপক্ষ। বিএনপি-জামায়াতসহ ডান-বামের বাকিরাও একেবারে পক্ষ শক্তি নয়। বিপক্ষে না হলেও নির্মোহ সমর্থক নয়। যথাসময়ে, যৌক্তিক সময়ে, যথাশিগগিরই সংস্কার শেষ করে নির্বাচন এ ধরনের কথায় তারা অসন্তোষ জানাচ্ছিল।
নির্বাচনের এ পথে আইনি জটিলতা কাটিয়ে সম্প্রতি আবারো তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি ফিরে এসেছে। আগামী নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, মানে বর্তমান সরকারটিই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ করবে তাও পরিষ্কার। আদালতের নির্দেশে অবৈধ ঘোষণা করে আংশিক বাতিল করা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনী। এর মধ্য দিয়ে ফিরল তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি। ১৭ ডিসেম্বর দেয়া এ রায়ে আদালতের ভাষায় বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছিল। যে কারণে এটি সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি হয়ে গেছে। হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণে বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করা হয়েছিল।
গেল কয়েকটি নির্বাচনের মতো তামাশার নির্বাচন আগামীতে হচ্ছে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন যখন একে একে ব্যর্থ হতে থাকে এবং ২০২৪ সালের ‘আমি এবং ডামি’ নির্বাচন বানচাল করতে তারা ব্যর্থ হন তখন প্রায় সবাই ধরে নিয়েছিলেন যে, আওয়ামী-ফ্যাসিস্ট সরকার ২০২৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার অংশীদার হতে চায়নি কেউ। সাধারণ জনগণও সব আশা ভরসা ছেড়ে দিয়ে চরম হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন বাংলাদেশে আসেন তখন তারা বিরোধী কোনো রাজনৈতিক নেতাদের সাথে কথা বলেননি, কথা বলেছেন সিভিল সোসাইটির নেতাদের সাথে। রাজনৈতিক শূন্যতার পরিবেশে তখনই সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, হঠাৎ করেই ছাত্রদের নেতৃত্বে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব যখন শেখ হাসিনার তখতে-তাউস ভেঙে চুরমার করে দেয় তখন সবকিছুই অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ছাত্রদের এই বিজয়ের দাবিদার হতে থাকেন অনেকেই। এটিই জাগতিক নিয়ম। ছাত্ররা তাদের বিজয় অন্য কাউকে হাইজ্যাক করতে দিতে চাইছে না। বিজয়ের কৃতিত্ব তাই আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত তারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। মানে নতুন দল সংগঠিত করছেন।
এদিকে নির্বাচিত সরকারের অধীনে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি তোলায় রাজনৈতিক দলগুলোর অতীতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, ‘আজকে তারা বলছে, সংস্কার তারাই সবচেয়ে ভালো করতে পারবে, এটিই তো গণতান্ত্রিক দেশের কথা। তাহলে তারা ৫৩ বছর কেন করেন নাই?’ কেন আজকে আমাদের দায়িত্ব নিতে হলো, উড ইউ প্লিজ অ্যানসার?
প্রধান উপদেষ্টার এবারের ভাষণে স্পষ্ট যে, সরকার কেবল একটি নির্বাচন দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দায়িত্ব শেষ করতে চায় না; তারা জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন করে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রক্রিয়ায়ও নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায়। জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কমিশন করার কথাও আছে। প্রধান উপদেষ্টার কথাদৃষ্টে নতুন নির্বাচন কমিশনের কাজ চলছে। সে অনুযায়ী নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন-ইসি প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন। জানিয়েছেন, তার কমিশন দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিন থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছে। সুন্দরভাবে নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছেন তারা।
এ আয়োজনের মধ্যে বিএনপির কিছু ‘কিন্তু’ দেখার ফের এখনো স্পষ্ট নয়। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দল ও জোটগুলোও বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যে রোডম্যাপ নয় শুধু কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের চার মাস পার হওয়ার পর সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্বাচনের সময় নিয়ে বক্তব্য এলো কেনÑ এও তাদের প্রশ্ন। বামপন্থী দলগুলোও নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এই দলগুলো সংস্কার এবং নির্বাচনের দিনক্ষণ দিয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়। তারা মনে করে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি রোডম্যাপ তৈরি করা সম্ভব। কোনো কোনো ইসলামী দলের প্রতিক্রিয়াতেও একই ধরনের অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে। রোডম্যাপ প্রশ্নে দলগুলো এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের সঙ্গে সংলাপ আশা করছে। এদিকে, কথা না ঘুরিয়ে সোজাসাপ্টা কথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটির। সমাবেশ ডেকে তারা জানিয়ে দিয়েছে, শেখ হাসিনার বিচারের আগে যারা নির্বাচন চাইবে, তারা জাতীয় শত্রু। তাদের কথা পরিষ্কার, কিন্তু উদ্দেশ্য ঝাপসা। মহান বিজয় দিবসে রাজধানীতে বিজয় র্যালি করে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলেছেন, শেখ হাসিনা গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের নাগরিকদের হয় দালাল বানিয়েছেন, নইলে দাস বানিয়েছেন। সেই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার ছাড়া বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। যারাই বিচারের আগে কোনো নির্বাচনের পাঁয়তারা করবে, তাদের জাতীয় শত্রু হিসেবে ধরে নেয়া হবে।
সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, তারা বুলেট ক্রস করেছেন, আগামী দিনে ব্যালটের রেভুল্যুশন এলে সেটিও মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। তবে সেটি বিচারের আগে নয়। বিচার হবে, এরপর নির্বাচন। জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক আলোচিত সারজিস আলম আরো তেজি। তিনি বলেন, তাদেরকে নাগরিক হয়ে উঠতে দেয়া হয়নি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর সুযোগ হয়েছে নাগরিক হয়ে ওঠার। তারা জুলাই-আগস্ট স্টাইলে কিছু নতুন স্লোগানও ছেড়েছেন। একাত্তর মরে না, চব্বিশ হারে না, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’ এসব স্লোগানের মধ্যে আগামী দিনের রাজনীতি ও নির্বাচনের বিষয় রয়েছে।
আবার তাদের পেছনে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সম্পৃক্ততার তথ্যও ঘুরছে। এমন কানাঘুষা ও তথ্য কচলানোর মাঝেই মহান বিজয় দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর বঙ্গভবনে বিজয় দিবস উদযাপনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে তারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দফতর সেল থেকে সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মহান বিজয় দিবসের মতো জাতীয় গৌরবের দিন ফ্যাসিবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে পালন করাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে করে। এসব অর্থবহ ঘটনার বহিঃপ্রকাশ বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা মাঝে মধ্যেই ঘটিয়ে আসছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইমেল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা