১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১, ১৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রয়োজনীয়তা উদ্ভাবনের জননী

-

বাংলাদেশী রোগীদের বয়কটের ডাক দিয়েছিল ভারতের একাধিক হাসপাতাল, বয়কটের পরপর আবার কোনো কোনো হাসপাতাল ১০ শতাংশ ছাড়ে চিকিৎসাসেবার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশীদের জন্য সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছিল ত্রিপুরা বাজ্যের হোটেলও। খোলা ছিল কলকাতার মুকুন্দপুর এলাকার হোটেল রেস্টুরেন্ট। আমরা উঠেছিলাম হোটেল সম্র্রাটে। হোটেল সম্রাটের দক্ষিণে বৌদির হোটেল, বীথি হোটেলসহ আরো কয়েকটি হোটেল।

হোটেলের পূর্বদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সাইন্স হাসপাতাল। হোটেলে মালামাল রেখে হাসপাতালের গেটে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি, হাসপাতালের বেশির ভাগ রোগী বাংলাদেশের। হাসপাতালে সব ধরনের রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও হার্টের রোগী বেশি। অনেক রোগীকে ভোর ৫টায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে দেখা যায়। পরদিন চা খাওয়া শেষ করে ভোর সাড়ে ৬টায় হাসপাতালের সামনে যাই। প্রধান গেট খোলা থাকলেও হাসপাতালের দরজা বন্ধ। বন্ধ দরজার সামনে ১০-১২ জনের লাইন। লাইনের কাছে যেতে একজন সহাস্যে বললেন আমি আলম। আমাদের বাড়ি সোনারগাঁ পশু হাসপাতালের পাশে। আমি শাহজাহানের ছোট ভাই। তৌহিদ ভাই আমাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে গেছেন।

তুমি এখানে কেন? শাহজাহান ভাইকে নিয়ে এসেছি। ভাইয়ের চোখের সমস্যা। বড় বোনও সাথে আছেন। আমরা আজ পাঁচদিন।

হাসপাতালের দরজা খোলে সাড়ে ৮টায়। রিসিভারের রুম খোলে ৯টায়। ২৫০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি। চিকিৎসকের ভিজিট ৬০০ টাকা। রেজিস্ট্রেশনের সময় রোগের বিবরণসহ কোনো চিকিৎসক চয়েজ আছে কি-না জানতে চাওয়া হয়। আমাদের পছন্দের চিকিৎসক ছিলেন কে কে আগারওয়াল। দু’টি রিংয়ের নিমিত্তে দুই লাখ ১৯ হাজার টাকা জমা দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম।

মুকুন্দপুর একসময় ছিল জলাভূমি। কয়েকটি জনস্বাস্থ্যসেবা গড়ে ওঠায় এখন প্রায় ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত। গত দেড়-দুই দশকে এখানে গড়ে উঠেছে একের পর এক বড় বেসরকারি হাসপাতাল। হাসপাতালগুলোতে স্থানীয় লোক ছাড়াও বেশি চিকিৎসা করতে আসেন বাংলাদেশ থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল কার্ডিয়াক সাইন্স হাসপাতালের চেয়ারম্যান খ্যাতনামা সার্জন ডা: দেবী শেঠী সূত্রে প্রকাশ, ভারতের তৃতীয় বৃহত্তর হার্ট সার্জারি ইনস্টিটিউট এটি। এখানে প্রতি মাসে ২৫০ রোগীর সার্জারি হয়। আরো জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের কেম্যান আইল্যান্ডে এই হাসপাতালের শাখা উদ্বোধন হতে চলছে অচিরেই। গত বছর এ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসেন ১৪ হাজার বাংলাদেশী।

ভারতীয় ভিসা পদ্ধতি একসময় জটিল হলেও এখন সহজ। ভিসার দরখাস্তে নামমাত্র প্রসেসিং ফি ছাড়া ফি নেই বললেই চলে। ঢাকা টু কলকাতা সরাসরি বাস-ট্রেন চালু হওয়ায় সর্বনিম্ন ৬০০ টাকায় কলকাতা পৌঁছানো সম্ভব। এসব চিন্তা মাথায় রেখে গড়ে উঠছে হোটেল রেস্টুরেন্ট। এখানে যারা হোটেলে উঠেন তাদের প্রায় সবাই আসেন চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। কখনো কখনো একজন রোগীর সাথে আত্মীয় থাকেন চার-পাঁচজন। হোটেলে অবস্থানকারী বোর্ডারদের মূল উদ্দেশ্য রোগের চিকিৎসা। কোনো কোনো সময় এক কক্ষে ছয়-সাতজনও অবস্থান করতে দেখা যায়। আমরাও রোগী। আর ১০ জন রোগীর মতো আমাদের অবস্থান করতে হবে। সম্রাটের মালিক মিহিররঞ্জন সরকার ও রীনা সরকার। বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ তাদের পূর্বপুরুষের বাড়ি। বৌদি হোটেলের মালিকও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। বিরোধ ধর্মান্ধদের নিয়ে।

যেমন- গত ৪ ডিসেম্বর ২০১৮ আনন্দবাজার পত্রিকাসহ প্রায় সব পত্রিকার শিরোনাম ছিল- ‘ভারতের উত্তর প্রদেশের বুলন্দশহর জেলায় গোহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভের মুখে পুলিশসহ দুই ব্যক্তি নিহত।’ ৮ ডিসেম্বর আমি কলকাতা মুকুন্দপুর হাসপাতালে। পাশের বেডে সহরোগী ছিলেন সমির মুখার্জি। তিনি ইংলিশ সিরিয়ালের অভিনেতাসহ একজন হাউজিং ব্যবসায়ী। কথাবার্তায় রাশভারী। রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম ও দর্শন আলাপচারিতায় কোনো বিষয়ই বাদ পড়েনি। মুখার্জিদার কাছে পুনরায় জানতে চাই, ৩ তারিখে যা ঘটেছে তা মুসলমান কর্তৃক হয়ে থাকলে তা ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে গরু জবাই, সনাতন ধর্মের দৃষ্টিতে গোহত্যা, আইনের দৃষ্টিতে কী?

উত্তরে তিনি বলেন, ধর্মান্ধ সব ধর্মে আছে। ধর্মান্ধের হাতে ধর্ম পরিচালনা আর অন্ধের হাতে গাড়ি পরিচালনা এক কথা। ধর্মের কোন নীতি কোন উদ্দেশে কখন অপরিহার্য ছিল তা জানা আবশ্যক। ঋগবেদ এবং সংহিতাগুলোতে অশ্বমেধ যজ্ঞের ন্যায় গোমেধ যজ্ঞের কথাও বলা আছে। কিন্তু তৎকালীন কৃষিতে গরুর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাই এই নির্বিচার গোহত্যার ফলে খাদ্যের আবাদে সমস্যা শুরু হয়। তাই ধর্মীয় অনুশাসনের মোড়কে গোহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়। ধর্মের জন্ম হয়েছিল সুন্দর জীবনব্যবস্থার জন্য। সুন্দর জীবনব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষকে কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলতে হয়। যখন আইন ছিল না তখন ধর্ম ছিল সে নিয়ম-শৃঙ্খলার ধারক-বাহক। এখন ধর্মটা ব্যবহার হয়েছে রাজনীতির প্রয়োজনে। লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য আইনের বুলি যেখানে অচল সেখানে ধর্মের বুলি ব্যবহার করা হয়।’

রাজনীতির ক্ষেত্রে কথাটি সঠিক। ধর্মকে হাতিয়ার করে ক্ষমতায় আসার পরেও ধর্মান্ধদের কার্যকলাপকে মৌন সম্মতি দিয়ে যাচ্ছেন। উদাহরণ, ধর্মান্ধদের হাতে বাবরি মসজিদের ধ্বংস। অজগর হরিণশাবককে যেভাবে আস্তে আস্তে গ্রাস করে; তেমনি প্রশাসনও আস্তে আস্তে গ্রাস করেছে বাবরি মসজিদকে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসে প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ডিএইচপি) এবং অন্যান্য হিন্দু সংগঠনকে দায়ী করা হলেও মৌন সম্মতি ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রেরও। ঘটনার ধারাবাহিকতা তাই বলে। যে ধর্মান্ধদের হাতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছিল, এখন ক্ষমতায় তারা। ১৫২৭ সালে সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত মসজিদটি নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ শুরু ১৮৫৩ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ১৪০ বছরের ঘটনাক্রম পর্যালোচনা করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাবরি মসজিদ নিয়ে যত বিরোধ হয়েছে ততবারই ফসল উঠেছে ধর্মান্ধ করসেবকদের ঘরে।’ (ভারতে চিকিৎসা সফর, পৃষ্ঠা : ১০৫ ও ১০৬)

দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে ভারত যেভাবে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ মাছের আবদার করে থাকে সেভাবে এক সময় ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ভারতের কাছে গরুর আবদার করে ছিল। গরু এবং ইলিশের সাথে পেঁয়াজের সম্পর্ক কি? ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার পর থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে। এ দাম খুচরা বাজারে ৩০০ টাকা উঠেছিল। এক সময় ঈদুল আজহার আগে ভারত থেকে প্রচুর গরু আমদানি হতো। গরুর হাটের একাংশ পূর্ণ থাকে ভারতীয় বইল (বড় আকারের সাদা) গরু। ১৯৫০ সালের পশ্চিমবঙ্গ পশুবলি নিয়ন্ত্রণ আইনের পর ২০১৮ সালের কলকাতা হাইকোর্টেও প্রধান বিচারপতি অরিজিৎ ব্যানার্জি বলেছিলেন, ‘ঈদুল আজহায় গরু কোরবানি দেয়ার কোনো ধর্মীয় প্রয়োজনীয়তা নেই।’ বলার পরপর ভারতীয় গরু কোরবানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। গরুর দাম বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের কৃষকরা গরুর পালন বাড়ায়। যেসব জমিতে পেঁয়াজসহ রবিশস্যের চাষ করত সেসব জমিতে ঘাসের চাষ করে। গরুর ওজন তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায়। কোরবানির সময় দু’টি গরু বিক্রি করলে এক সন্তানকে বিদেশে পাঠাতে পারে। ফসলের তুলনায় গরু পালন লাভজনক। কয়েক বছরের মধ্যে কোরবানির গরু দিয়ে বাংলাদেশ স্বাবলম্বী হয়ে উঠেলেও কমে গেছে পেঁয়াজ, রসুন, গম, মসুর, আদাসহ চালের উৎপাদন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ির আঙ্গিনাসহ অনাবাদি জমিতে বস্তায় আদা চাষ শুরু করেছে দেশের কৃষক। ফলও পাচ্ছে প্রচুর। নতুন পদ্ধতিতে চাষ করা আদা ফেরিওয়ালারা ১০০ টাকা কেজি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করে। গত প্রবন্ধের একাংশে লিখেছিলাম, ‘প্রয়োজনীয়তা উদ্ভাবনের জননী’- এই প্রয়োজনীয়তা দেশে কোরবানির গরুর অভাব দূর করেছে, খুব দ্রুত দূর হবে পেঁয়াজ, রসুন, আদার অভাব। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা চেষ্টা করলে রবিশস্যের অভাব দূর করতে পারব। কিন্তু প্রকৃতির দান ইলিশ মাছ। বিশ্বে মোট উৎপাদিত ইলিশের ৭৫ শতাংশ বাংলাদেশে হচ্ছে। বিশেষ করে বর্ষার শেষে দুর্গাপূজার সময় পশ্চিমবঙ্গবাসী বাংলাদেশের ইলিশের অপেক্ষায় থাকে। বাংলাদেশ ছাড়া দুর্গাপূজায় ইলিশ মাছ খাওয়ার সাধ পূরণ করা কঠিন। শুধু মাছ নয়, বিরোধ না করলে আর্থিক দিক থেকেও ভারত লাভবান। ২০২৩ সালের আগস্টে যেখানে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রায় ৯৪৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছিল; সেখানে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ভারত থেকে রফতানি একবারে ২৮ শতাংশ কমে গেছে। বিরোধ করলে বাংলাদেশের চেয়ে লোকসানটা ভারতের বেশি।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
নতুন ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে : প্রধান উপদেষ্টা সিদ্ধিরগঞ্জে ৫ শতাধিক অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডকে মিটিং করতে বাধা দেয়ায় নিন্দা সোনার দাম আবারো বাড়ল সিলেটে সাংবাদিক তুরাব হত্যা মামলার আসামি এডিসি দস্তগীর গ্রেফতার কয়েক দিনের মধ্যেই শিক্ষা কমিশন ঘোষণা করা হবে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের গুপ্তহত্যার ঘটনায় ছাত্রশিবিরের উদ্বেগ সাদপন্থীদের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করতে হবে : হেফাজত আমির ডেঙ্গুতে আরো ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ২৭৪ চকরিয়ায় ইট তৈরির কারখানায় ২ শ্রমিকের মৃত্যু ইজতেমায় সংঘর্ষে নিহত বেড়ে ৪, আহত ৪০

সকল