ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের মুখে ভারত
- রিন্টু আনোয়ার
- ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:২২
এক দিনের সফরে নতুন বাংলাদেশ দেখে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। ঠেলায় পড়ে আপাত বলে গেছেন, ‘বাংলাদেশের সাথে একটি ইতিবাচক, গঠনমূলক ও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক চায় ভারত। দেশে ফিরেই সংসদের পররাষ্ট্রবিষয়ক স্থায়ী কমিটির ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে যেসব সমালোচনা করেন তা ভারত সমর্থন করে না। ভারতের সম্পর্ক বাংলাদেশের সাথে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এই সম্পর্কের ভিত্তি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যেই নিহিত।
ঢাকায় তার সফরের সময় তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জানিয়েছেন, ভারত জনগণের সাথে সম্পর্ক অগ্রাধিকার দেয় এবং বর্তমান সরকারের সাথে কাজ চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আগের তাচ্ছিল্য ও হুমকি থেকে সরে এসে নমনীয় কথা বলছেন। উপলব্ধিতে এসেছে, একটু বেশিই বলে ফেলেছিলেন। আর তার এক সময়ের সহচর পরে বিজেপিতে পল্টি দেয়া শুভেন্দু কখন কী বলতে গিয়ে কী খেয়ে ফেলেন তা আমলে নেয়ার মতো নয়। ভারতের বাদবাকিদেরও বুঝতে হবেÑ এই বাংলাদেশ আর সেই বাংলাদেশ নেই। বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের আড়ালে কেবল আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার সাথে বন্ধুত্ব করার পরিণাম এখন ভারতকে ভুগতে হচ্ছে! সামনে আরো কত কী ভুগতে হতে পারে!
আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশের পর সিরিয়ার দৃশ্যপট ভারতের জন্য এক আতঙ্কের। ধাওয়া খেয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় জুটেছে সিরিয়ার প্রতাপশালী বাশার আল-আসাদের। শেখ হাসিনার আশ্রয় হয়েছে ভারতে। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার ১৯৮১-তে যেখান থেকে বাংলাদেশে তার আগমন ২০২৪-এ সেখানেই তার নির্গমন। একাত্তরে পাকিস্তানিরা রিয়েলিটি মেনে না নিয়ে পরিণাম ভুগেছে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রিয়েলিটি মানছে না ভারত। তাছাড়া চারদিকের প্রতিবেশীদের জ্বালিয়েও জ্বালা-যন্ত্রণা দিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলছে তারা। শেষতক তার চারদিক থেকেই এখন প্রতিপক্ষ। একনায়কত্বের দর্প যে এভাবেই গুঁড়িয়ে যায়, তা শুধু নির্দিষ্ট কোনো দেশে নয়। সিরিয়া, শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশ সবখানেই। প্রতিবেশীদের ত্যক্ত-বিরক্ত করতে করতে বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত এখন নিজেই কোণঠাসা। বিশ্বের সুপার পাওয়ার হওয়ার মোহগ্রস্ত দেশটি দক্ষিণ এশিয়াতেই দুষ্টরাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে এখন। ফলে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানও এড়িয়ে চলছে ভারতকে। সবগুলো দেশেই এখন ভারতীয় মর্জির বিপরীত সরকার। পাকিস্তান, চীন ও শেষতক বাংলাদেশও ছেড়ে কথা বলছে না। বিশেষ করে বাংলাদেশকে পিষিয়ে মারতে মারতে এখন গোটা বিশ্বময় ভারতের স্বরূপ উদাম হয়ে গেছে। এক সময় বলা হতো ভারতের জন্য বাংলাদেশের দম ফেলার সুযোগ নেই। কারণ এর তিন দিকেই ভারত এক দিকে বঙ্গোপসাগর। অথচ এখন ভারতের চারদিকেই তার প্রতিপক্ষ বিরাজমান।
সম্প্রতি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতনের নাটক ও ভুয়া অভিযোগ সাজাতে গিয়ে ভারতের চরিত্রের এক ভয়াবহ কদাকার দিক প্রকাশ পেয়েছে। বলা হচ্ছে, নতুন এক বাংলাদেশ মানতে ভারতের কলিজা ছিঁড়ে যাওয়ার কষ্টে তাল-লয়ও হারিয়ে ফেলেছে। গণ-আন্দোলনের তোড়ে গদিচ্যুত পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে আশ্রয়ে নেয়ার পর থেকে ভারত পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার হেন চেষ্টা নেই যা না করছে। সর্বহারার মতো এখন ভারতের ঠুনকো অস্ত্র সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে ঘায়েল করার চেষ্টায় হাল না ছেড়ে খেলছে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস-ইসকনকে নিয়ে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে তাণ্ডবলীলা চালানো হয়েছে, সেটি কোনোভাবেই স্বাভাবিক প্রতিবাদ নয়। মমতা ব্যানার্জি হিন্দুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশে শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করতে জাতিসঙ্ঘের প্রতি আবেদন জানিয়ে মূর্খতার পরিচয় দিয়ে সেখান থেকে সরে এসেছেন। এর আগে, আগরতলায় বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলা, লুট-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশ ও ভারতের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের বাকযুদ্ধ ক্রমান্বয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি রাজ্য নিয়ে ভারত এমনিতেই ঝামেলায় আছে। মনিপুরে নাজুক পরিস্থিতি। সম্প্রতি মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লাল দুহোমা যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ভারতে একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। লাল দুহোমা এ আহ্বান এক মাস আগে দিলেও এত দিন তা গোপন রাখা হয়েছিল। চিকিৎসাসেবা ও সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থেকে শুরু করে দুই দেশে পতাকা পোড়ানো বা পদদলিত করা, বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি, ভিসা বন্ধ বা সীমিত করার ঘটনাসহ সাম্প্রতিক অস্থিরতা বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত ১৫-১৬ বছর ভারতের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত নানা স্বার্থ রক্ষা করেছে শেখ হাসিনা সরকার। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত-বিরোধিতা কেবল বেড়েছেই। গত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো তুলনামূলক ভালো করেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন করা হচ্ছে, এমন প্রচার চালিয়ে ভারতের জনগণকে আরো বেশি মুসলিমবিদ্বেষী করার অ্যাজেন্ডায় নরেন্দ্র মোদির বিজেপিতে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এই ইস্যুটি জিইয়ে রাখতে চায়। একইভাবে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন সম্পর্কে ভুয়া ও অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করছে। যা বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা আরো বেগবান হচ্ছে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যের নিরাপত্তা এবং কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী শক্তিকে ক্ষমতায় দিল্লি দেখতে চায় না। সেই সমীকরণে ভারতের খাস পছন্দ আওয়ামী লীগ। যাদের দিয়ে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বহু অপকর্ম চালিয়ে এসেছিল দেশটি। হাসিনা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ভারতকে তিনি যা দিয়েছেন, তারা তা আজীবন মনে রাখবে। এর মধ্য দিয়ে বিষয়টি আরো আগেই পরিষ্কার। যার প্রমাণ, গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনা পালানোর পর ভারত ছাড়া দুনিয়ার কোনো দেশ তাকে আশ্রয় না দেয়া। এটি ভারতের জন্য কত লজ্জা, কষ্টের তা ভারতই জানে। যে বিপ্লব তাদের খাস পছন্দের নেতা হাসিনার পতন ঘটিয়েছে, তাকে খাটো করে দেখাতে ভারত বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের দুর্দশাকে একটি আবেগপূর্ণ রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছে। হিন্দু জাগরণ মঞ্চের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেফতার হওয়ার পর ভারতের বিজেপি সরকার এবং বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা সব ধরনের রাখঢাকের পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। দেশটি একদিকে নিজের ঘর সামলাতে পারছে না। আরেক দিকে চারদিক থেকেই ইটের বদলে পাটকেল খাচ্ছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপই নিচ্ছে সেটিতেই মার খাচ্ছে। বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে সব চাতুরী। বাংলাদেশে কেবল সংখ্যালঘু নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চলছে সংবাদ রটিয়ে দিতেও কলকাঠি নেড়েছে।
অবস্থাটা এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে, সেখানে এখন ভারত যত বেশি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছে তত বেশি এই সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনের মতো কিছু আয়োজন করার ফাঁক এখন আর ভারতের নেই। ব্যাপক ভোট কারচুপি, রাতে ভোট চুরি এবং দিনে ভোটের মহাডাকাতির দিন ফুরিয়ে গেছে বাংলাদেশে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী ও গদি মিডিয়ায় অপপ্রচার চালিয়ে কিছু ঘটিয়ে ফেলবেÑ সেই চান্সও আর নেই। কত দিন আর মিথ্যা যুদ্ধ চালাবে? বাংলাদেশে এখন প্রকাশ্যে ভারতের আধিপত্যবাদী শক্তির পক্ষে কথা বলার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কী এক কঠিন বিপদে পড়েছে ভারত। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও সিরিয়ার ঘটনাবলি ভারতকে হতবাক করে দিয়েছে। তার মিত্র রাশিয়ার দুরবস্থার অর্থই হলো ভারতের করুণ পরিণতি। অতীতে রাশিয়ার শক্তির ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারত যেভাবে দরকষাকষি করত সে অবস্থারও এখন পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। অতিদ্রুত ভারতকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক ভারত নির্মাণের দিকে যেতে হবে, নইলে বারাক ওবামার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হবে ‘ভারত খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হবে ’।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং প্রভাবশালী দেশের শীর্ষ সংসদীয় শুনানিতে অন্যায্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি সেক্যুলার সংবাদপত্র ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে বাংলাদেশের কথিত ধর্মীয় সহিংসতার মামলাগুলো তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সারা বিশ্বে বক্তৃতা দিয়ে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। এখন তিনি নিজ দেশে ক্ষমতায় এসে তারুণ্যের শক্তি কিভাবে প্রয়োগ করেন তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বিশ্ববাসী। তারুণ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সেতুবন্ধ রচনা করতে দক্ষ ড. ইউনূস যা করলে বাংলাদেশ বাঁচবে। ১৯৭১ সালে তরুণরাই দেশ স্বাধীন করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। এবার দেশ গঠন করার কাজে তারা পিছিয়ে থাকবেন না।
ভারত ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে পুতুল হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে সাড়ে ১৫ বছর ধরে খাঁচার মধ্যে বন্দী করে রেখেছিল। কিন্তু গত ৫ আগস্টের বিপ্লবের (অভ্যুত্থান নয়, কারণ ফ্যাসিস্টের পতন শুধু যুদ্ধ ও বিপ্লবের মাধ্যমে হয়) মাধ্যমে হাসিনার পতনের পর দিশেহারা হয়ে পড়েছে ভারত তথা নয়াদিল্লি। একটির পর একটি বাংলাদেশ-বিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি মদদ দিচ্ছে ভারত ও তার গণমাধ্যম। এ নিয়ে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে এখন চরম উত্তেজনা চলছে; ড. ইউনূস জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে ভারতের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন।
ঐক্য হলো শক্তির প্রতীক। তা ব্যক্তিতে, দলে, চেতনায় সবদিকেই হতে পারে। আবার একক বিষয়েও হতে পারে। একাত্তরে স্বাধীনতার প্রশ্নে গোটা জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ; আর এ কারণেই সম্ভব হয়েছিল আমাদের বিজয় অর্জন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, স্বাধীনতার পর নানা ইস্যুতে দেশ বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর একটি সুযোগ আসে নব্বইয়ে। তাও বেশি দিন টেকেনি। এ বিভক্তি দিন দিন বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতেও জাতি অভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় ব্যর্থ হয়। চব্বিশের ঘটনাবলি ও আবহ একেবারে ভিন্ন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা