কী হলো সিরিয়ায়, এর গন্তব্য কত দূর?
- মাসুম খলিলী
- ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:৪২
সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনে কি মধ্যপ্রাচ্য নতুন অবয়ব নিচ্ছে? এর প্রভাব কি পড়বে বিশ্বব্যবস্থাতেও? এ ধরনের অনেক হিসাব-নিকাশ নানা পক্ষ থেকে এখন শুরু হয়েছে।
সিরিয়ার বিদ্রোহীরা বাশার আল-আসাদকে পতন ঘটিয়েছে গত রোববার সকাল সাড়ে ৮টার পরে। বিদ্রোহীরা বাশার আসাদের শাসনকে উৎখাতের জন্য বিনা বাধায় স্থানীয় সময় ভোর ৫টার দিকে রাজধানী দামেস্কে প্রবেশ করে। তারা দ্রুত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, টিভি ও রেডিও ভবন এবং অন্যান্য অনেক নিরাপত্তা ও সরকারি ভবন দখল করে নেয়।
সরকারি বাহিনী ও কর্মীরা নিজেদেরকে অবস্থান থেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে বিদ্রোহীদের জন্য একটি মসৃণ দখলের সুযোগ করে দেয়। বিদ্রোহীরা রাজধানীতে পৌঁছানোর আগে রাষ্ট্রপতি বাশার একটি বিমানে চড়েছিলেন। পরে রুশ সূত্র থেকে জানা যায় তিনি সপরিবারে সিরিয়ায় রয়েছেন।
সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজী আল-জালালি একটি ভিডিওতে বলেছেন, তিনি তার বাড়িতে রয়েছেন এবং শাসনের ধারাবাহিকতা সমর্থন করতে প্রস্তুত। আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি নামে পরিচিত বিদ্রোহী নেতা আহমেদ আল-শারা যোদ্ধাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে না যেতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেছিলেন, এটি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত ‘প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী’ এর তত্ত্বাবধানে থাকবে। শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর হয়।
সব পক্ষ মেনে নিলেন?
সিরিয়ার পুরো পরিবর্তন সম্ভবত ১২ দিনের মধ্যে সম্পন্ন হলো। ইদলিব থেকে আলেপ্পো, এরপর হামা এবং সেখান থেকে হোমস হয়ে দামেস্ক পর্যন্ত জয় সম্পন্ন করতে মাত্র ১২ দিন সময় নেয় বিরোধী যোদ্ধারা। এরপর তারা লাতাকিয়া অঞ্চলের পর উত্তরের দার আজ জোর, রাক্কা ও মানবিজের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
তাদের পুরো অভিযানের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো তারা ঝড়ো গতিতে অভিযান শুরু করেছে। আর যে সব অঞ্চলে এই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে সেখানে বড় কোনো প্রতিরোধ হচ্ছে না। হামাতে কিছু যুদ্ধ হলেও অন্য কোনো স্থানে বড় কোনো প্রতিরোধ দেখা যায়নি। যদিও কুর্দি অঞ্চলের গভীরে পৌঁছার পর কী হবে সেটি এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
এভাবে স্বল্প প্রতিরোধে বিজয়ের পেছনে দু’টি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত. সিরিয়ায় বাইরের যে সব দেশের সম্পৃক্ততা রয়েছে তাদের মধ্যে আগে থেকে পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো বোঝাপড়া হয়ে থাকতে পারে। সেটি মাঠের বিরোধীদের সরাসরি না হলেও তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রের সাথে সমঝোতা হয়ে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত. হতে পারে, আসাদ বিরোধী বিপ্লবের ছক এমনভাবে কষা হয়েছে যে, এতে তার পক্ষের শক্তিগুলো পেছনে দাঁড়ানোর মতো যে মৌলিক শক্তি দরকার সেটি আসাদ বাহিনী হারিয়ে ফেলেছে। আসাদের সেনাবাহিনী ক্লান্ত হয়ে অথবা সাদ্দামের সময় ইরাকি বাহিনীর শীর্ষ অনেক কর্মকর্তার মতো সুবিধা নিয়ে সরে পড়ার মতো কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে যেটিই হোক না কেন যারা বিপ্লবের এই পরিকল্পনা করেছেন তারা জনগণের রক্তক্ষয় এড়ানোর জন্য এক পরিণামদর্শী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন।
আর আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সব পক্ষ সিরিয়ার বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছে। যদিও এখন যা দেখা যাচ্ছে তা হয়তো চূড়ান্ত কোনো পরিস্থিতি নয়। এরপরও যেকোনো কিছু ঘটতে পারে।
পরিকল্পনার কেন্দ্রে কি এরদোগান?
সিরিয়ার এই অভিনব বিপ্লবে বাইরের নেপথ্য কোনো ব্যক্তি সেভাবে দাবি নিয়ে সামনে আসেনি। তবে সব পরিকল্পনার মূল ব্যক্তি মনে করা হচ্ছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে। দামেস্কের পতনের পরপরই এরদোগান আনুষ্ঠানিকভাবে এক বিবৃতি দিয়েছেন। এতে তিনি বলেছেন, “এখন সিরিয়ায় একটি নতুন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বাস্তবতা রয়েছে। সিরিয়া এখন তার সমস্ত জাতিগত, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উপাদানসহ সব সিরিয়ানের অন্তর্গত। সিরিয়ার জনগণই তাদের নিজেদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। আমি এটা জানাতে চাই যে, তুর্কি হিসেবে, আমরা এমন কোনো পদক্ষেপের অনুমতি দেবো না যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থকে বিপন্ন করে। আমাদের সমগ্র অঞ্চলের জন্য এটি সর্বোত্তম হবে যদি সমস্ত দায়িত্বশীল অভিনেতা এবং সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সহায়তা করে।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘সিরিয়ার ভূমি যুদ্ধ, রক্ত ও অশ্রুতে পরিপূর্ণ। আমাদের সিরীয় ভাই ও বোনেরা স্বাধীনতা, নিরাপত্তা এবং তাদের নিজ দেশে শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ প্রাপ্য। তুরস্কের একমাত্র লক্ষ্য সিরিয়ার জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গল। আঙ্কারা দেশটির সব অংশে এটি নিশ্চিত করতে চায়। গণহত্যা ও নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা আমাদের ভাইদের জন্য এবং সিরিয়া সঙ্কটের সমাধান খুঁজে বের করার জন্য আমরা আমাদের দ্বার উন্মুক্ত করার সময় এ লক্ষ্য সর্বদা আমাদের ছিল। কিন্তু দামেস্কের আসাদ শাসন তুরস্ক যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার মূল্য ধরতে পারেনি এবং এর অর্থ কী তা বুঝতে পারেনি। আজ যেমনটি গতকাল ছিল, তুরস্ক ইতিহাসের সঠিক দিকে রয়েছে।’
উপসংহারে এরদোগান বলেন, ‘আমরা এমন একটি সিরিয়া দেখতে চাই যেখানে শান্তি ও স্বস্তি বিরাজ করবে; যেখানে কেউ বাদ পড়ে না, কেউ নিপীড়নের শিকার হয় না, কারো অধিকার ও স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হয় না এবং বিভিন্ন পরিচয়ের মানুষ শান্তিতে পাশাপাশি বসবাস করে; তারা আরব, তুর্কমেন, কুর্দি, আলেভি, সুন্নি, নুসাইরি বা খ্রিষ্টান যাই হোক না কেন।”
এরদোগানের এই বক্তব্য আর বিপ্লব পরবর্তী সিরিয়ার স্বল্প সময়ের বাস্তবতায় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এর সমর্থন পাওয়া যায় তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদানের কথায়ও। তিনি বলেছেন, আস্তানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, আমরা সিরিয়ায় চলমান সঙ্ঘাতে বিরতি দিয়েছি এবং সরকারকে তার জনগণের সাথে শান্তি স্থাপনের জন্য সময় দিয়েছি কিন্তু এর সুবিধা আসাদ সরকার নিতে পারেনি। এখন থেকে সিরিয়ার জনগণ একটি নতুন দিন শুরু করেছে যেখানে তারা তাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। এখন থেকে সিরিয়ার ক্ষত সারাতে এবং এর ঐক্য, অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার দায়িত্ব নিতে তুরস্ক প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্র কী করছে?
যুক্তরাষ্ট্র এখন এক ক্রান্তিকালে আছে। ক্ষমতায় আছেন বাইডেন আর একমাসের কিছু বেশি সময় পর আসছেন ট্রাম্প। ফলে ট্রাম্পের চিন্তাটি এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দামেস্কের পতনের সময় ট্রাম্প এক টুইটারে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘সিরিয়ার বিরোধী যোদ্ধারা, একটি অভূতপূর্ব পদক্ষেপে, একটি অত্যন্ত সমন্বিত আক্রমণে অনেক শহর সম্পূর্ণরূপে দখল করেছে এবং এখন দামেস্কের উপকণ্ঠে রয়েছে। স্পষ্টতই তারা আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য একটি খুব বড় পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাশিয়া সিরিয়ার মধ্য দিয়ে এই আক্ষরিক অগ্রযাত্রা থামাতে অক্ষম বলে মনে হচ্ছে। কারণ তারা ইউক্রেনে এতটাই বেঁধে গেছে, যে দেশ তারা বছরের পর বছর ধরে রক্ষা করেছে তা আর এখন করতে পারছে না। এখানেই সাবেক রাষ্ট্রপতি ওবামা বালুর মধ্যে আঁকা লাল রেখা রক্ষার প্রতিশ্রুতিকে সম্মান করতে অস্বীকার করেছিলেন এবং রাশিয়ার পা দেয়ায় সমস্ত নরক ভেঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু এখন তারা, সম্ভবত আসাদের মতোই, জোরপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত হচ্ছে এবং এটি বাস্তবে হতে পারে। ওবামাকে সত্যিকারের বোকা দেখানো ছাড়া সিরিয়ায় রাশিয়ার জন্য খুব বেশি লাভ হয়নি। যাই হোক না কেন, সিরিয়া একটি জগাখিচুড়ি, কিন্তু আমাদের বন্ধু নয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এটি নিয়ে কিছু করার নেই। এটা আমাদের লড়াই নয়। এটি যাদের খেলা তাদের খেলতে দিন। এখানে আমাদের জড়িত পাবেন না!’
ট্রাম্পের এই বক্তব্যে স্পষ্ট বার্তা রয়েছে। এই ভাবনার সাথে বাইডেনের ভাবনা এমনকি ইসরাইলের ভাবনারও মিল নেই। সিরিয়ার এই অঞ্চলে ডেমোক্র্যাট প্রশাসন এবং ইসরাইল দীর্ঘ সময় যুক্ত ছিল। একটি কুর্দি রাষ্ট্রের জন্য অনেক সম্পদ বিনিয়োগ করেছেন তারা। ট্রাম্প সম্ভবত সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চান। কিন্তু ক্ষমতাতো এখনো বাইডেনের হাতে। প্রশ্ন হলো তিনি কী করবেন?
মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ বলেছে, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা প্রধানরা সিরিয়া এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। পেন্টাগন বলেছে, মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব তুরস্কের বৈধ নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা স্বীকার করেছেন এবং আইএসআইএস এবং এই অঞ্চলে অন্যান্য ক্ষতিকর অভিনেতাদের দ্বারা সৃষ্ট ঝুঁকি নিয়ে কথা বলেছেন।
তুরস্কের জাতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াসার গুলার এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন একটি ফোন কলে সিরিয়ার সর্বশেষ অগ্রগতি এবং নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে যে আলোচনা করেছেন সেটি তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও এক্স-কে জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রোববার কলের সময়, গুলার ও অস্টিন দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছেন।
এতে স্পষ্টত মনে হয়, বাইডেন প্রশাসন কুর্দি স্বার্থ নিয়ে আঙ্কারার সাথে সমঝোতার চেষ্টা করবে। অন্য দিকে ট্রাম্প প্রশাসন এক ন্যাটো মিত্রকে শত্রু বানিয়ে কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার মধ্যে যুক্তি দেখেন না। ট্রাম্পের টুইটটির অন্তর্নিহিত বার্তা সেটিই মনে হয়।
আরবরা কী করবে?
একটি কৌশলগত অবস্থানে থাকা আরব দেশ হিসেবে প্রতিবেশী আরব দেশগুলো সিরিয়া নিয়ে নিষ্ক্রীয় থাকে না। বেশ কয়েকটি আরব দেশ সিরিয়ার বিরোধী পক্ষকে স্বাগত জানিয়েছে যারা বাশার আল আসাদের শাসনের পতন ঘটিয়েছে। আরবরা সাধারণভাবে স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে এবং পরিস্থিতিকে বিশৃঙ্খলার দিকে যাতে না যায় সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে।
এক বিবৃতিতে, সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে যে তারা সিরিয়ার ভ্রাতৃপ্রতিম দেশটির দ্রুত অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং সিরিয়ার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, রক্তপাত রোধ করতে এবং সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ সংরক্ষণের জন্য গৃহীত ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতিতে বলেছে যে, দোহা সিরিয়ার উন্নয়ন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং দেশটিকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের ঐক্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।
বাহরাইনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও একটি বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে যে, মানামা সিরিয়ার অগ্রগতি ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করছে, সিরিয়ার নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি তার প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দিচ্ছে।
মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে যে কায়রো সিরিয়ার পরিবর্তনগুলোকে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে অনুসরণ করছে এবং সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং এর জনগণের ঐক্যের প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। তারা সিরিয়ার সব পক্ষকে তাদের অভিমুখ নির্বিশেষে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংরক্ষণ করতে, জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে, উদ্দেশ্য ও অগ্রাধিকারগুলোকে একীভ‚ত করতে এবং সিরিয়ার পুনরুদ্ধারের জন্য ঐকমত্য ও অভ্যন্তরীণ শান্তির একটি নতুন পর্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ব্যাপক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বলেছেন যে, তার দেশ ‘সিরিয়ার জনগণের সাথে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের ইচ্ছা ও পছন্দকে সম্মান করে।’
ইরাকে, সরকারের মুখপাত্র বাসিম আল-আওয়াদি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইরাক সিরিয়ার অগ্রগতি অনুসরণ করছে এবং স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা এবং সিরিয়ার জনগণের সুরক্ষার দিকে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য ভ্রাতৃপ্রতিম ও বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সাথে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে।
আলজেরিয়া, একটি বিবৃতিতে সিরিয়ার জনগণের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে, ভাগ করা ইতিহাস এবং সংহতির ভিত্তিতে আলজেরিয়ান ও সিরিয়ার জনগণের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছে।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্সি বলেছে, ‘ফিলিস্তিন এবং এর জনগণ সিরিয়ার জনগণের সাথে দাঁড়িয়েছে, তাদের ইচ্ছা ও রাজনৈতিক পছন্দকে সম্মান করে, তাদের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করে।
ইসরাইল কিভাবে দেখছে পরিবর্তনকে
রোববার ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তাদের সৈন্যরা গোলান হাইটসে একটি আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা বাফার জোনে প্রবেশ করেছে এবং সেখানকার সিরিয়ার গ্রামগুলোতে কারফিউ জারি করেছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে ইসরাইল সাময়িকভাবে সেখানে মোতায়েন করছে। ইসরাইল বলে থাকে সিরিয়ায় সামরিক তৎপরতা মূলত হিজবুল্লাহ ও ইরানের সিনিয়র সামরিক কর্মী, অস্ত্র উৎপাদন সুবিধা ও ট্রান্সপোর্ট করিডোর, যার মাধ্যমে ইরান হিজবুল্লাহকে অস্ত্র পাঠায় তার বিরুদ্ধে বিমান হামলার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
তবে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে আসাদের কারাগারে হামাসের বন্দী পাওয়া নিয়ে। পতনের প্রাক্কালে আসাদ সরকারের সেদনায়া কারাগারে প্রবেশকারী বিপ্লবীরা হাজার হাজার মানুষকে মুক্তি দিয়েছে। এ সময় আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে সাহায্যের জন্য চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করার পরে সেলারের দিকে যাওয়ার পথগুলোর মধ্যে একটি পাওয়া যায়। সেখানে মাটির নিচে গোপন নির্যাতন কেন্দ্রের চারটি তলা ছিল। সেখানকার সারি সারি ওয়ার্ডে হাজার হাজার মানুষকে উদ্ধারের অপেক্ষায় দেখা যায়, এমন এক পরিবেশে যেখানে ভেতরে আলো নেই, লোহার দরজার ছাদের রেলিংয়ে উঠে আসা বন্দীরা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন।
গাজার কাসাম ব্রিগেডের অনেক সৈন্য, যাদের নিখোঁজ ও মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল, তারাও সেদনায়া কারাগারের নির্যাতন কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসে।
এ ঘটনায় প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে বাশার আসাদ আসলে কার জন্য কাজ করেছিল? কেন বারবার পতনের কাছে পৌঁছানোর পরও আসাদকে টেকানোর জন্য জায়নবাদ কাজ করেছে। পরিবর্তনের পর এখন অনেক রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে।
রাশিয়া ইরান ও পেরাডাইম শিফট
সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনকে অনেক বড় মোড় পরিবর্তনকারী বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের মস্তিষ্ক হিসেবে খ্যাত রাশিয়ার ভ‚রাজনীতি বিশ্লেষক ও দার্শনিক আলেকজান্ডার ডুগিন এ ঘটনার পর একটি তাৎপর্যপূর্ণ টুইট করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে সবকিছু ওভারল্যাপ হচ্ছে। স্মোট্রিচ ও অন্যান্য জায়নবাদীরা থার্ড টেম্পল নির্মাণ শুরু করার জন্য আল-আকসা মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা বলেছে। আর তারা সম্ভবত তা করবে। এটি ইসলামী বিশ্বকে প্রভাবিত করবে। আর রাশিয়া পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবে। শিগগিরই সবকিছু বদলে যাবে।’
ডুগিনের এই উপলব্ধি আমার কাছে হালকা কোনো বিষয় বলে মনে হয়নি। রাশিয়ার বিমান হামলার মুখে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ইদলিবে আটকে গিয়েছিল। সেই রাশিয়া কেন তার পুনরাবৃত্তি করল না? এটি কি কেবলই ইউক্রেনে তার আটকে পড়ার কারণে? আমার মনে হয় না সেটি আসল কারণ। বৈশ্বিক রাজনীতির অন্তরালে একটি গভীর বোঝাপড়া হয়েছে বলে মনে হয়। এই বোঝাপড়ার কারণে লাতাকিয়া ছাড়া বাকি এলাকা থেকে রাশিয়া নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অনেকে একমত হবেন না, কিন্তু আমার বিশ্বাস এ বোঝাপড়ার সাথে ইরানের সম্মতি রয়েছে।
ইরানের নীতিনির্ধারকেরা এটি মনে করতে পারেন যে, জায়নবাদ ও তার পৃষ্ঠপোষকদের মোকাবেলা করতে হলে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে এক হয়ে লড়াই করতে হবে। আর এ মুসলিম ঐক্যের পথে বাশার আসাদের শাসন একটি বাধা। আস্তানা প্রক্রিয়া তার জন্য অগ্রসর হয়নি।
ইরান ও হিজবুল্লাহ যে হামাস বা প্রতিরোধ আন্দোলনকে সাহায্য করতে গিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব শহীদ হওয়ার মতো ত্যাগ শিকার করেছে তাতে সন্দেহ নেই। আর ইসরাইল অব্যাহতভাবে সিরিয়ায় ইরানি স্বার্থে আঘাত হানলেও সিরিয়ার মৌলিক সামরিক স্থাপনায় আঘাত করেনি। অথচ বাশারের পতনের পর সেখানে কেমিক্যাল অস্ত্র তৈরির কারখানা পাওয়া গেছে। যেসব অস্ত্র বিরোধীদের ওপর আসাদ প্রয়োগ করেছিল। ইসরাইল এসব স্থাপনায় বাশারের সময় হামলা না করে তার পতনের পর করেছে।
ইরানি স্থাপনায় হামলা ও জেনারেলদের হত্যার পরও বাশার আসাদ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি ইসরাইলের ব্যাপারে। তেহরান গোলান হাইটসের উদ্ধারে কাজ করতে চাইলেও বাশার তাতে সাড়া দেয়নি। বাশার তার বাবা হাফিজ আসাদের ইসরাইলের সাথে করা অনাক্রমণ শান্তি চুক্তিকে বরাবর অনুসরণ করে গেছেন। এসব বিবেচনায় ইরান বাশারকে রক্ষার জন্য আর মূল্য দিতে চায়নি বলে মনে হচ্ছে। বাশারের বাম চিন্তা আর ইরানের আদর্শবোধকে এক জায়গায় যে আনা যায়নি সেটি তার আশ্রয় গ্রহণেও দেখা যায়। আগেই বউবাচ্চা রাশিয়ায় পাঠিয়ে দিয়ে তিনি সেখানে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছেন।
সম্ভবত সিরিয়ার এই পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় প্যারাডাইম শিফটের সূচনা করতে যাচ্ছে, যা নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাস নিয়ে আসতে পারে।
আহমদ ইয়াসিন ও ২০২৭ সাল
সিরিয়ার পরিবর্তনের পর মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ এখন শুরু হয়েছে। ২০২৫ থেকে ২০৩০ সাল- এ সময়ে পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটতে পারে বলে ভবিষ্যৎ বিশ্লেষকরা, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বরা আগেও উল্লেখ করেছেন, এখনো বলছেন।
হামাস আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহমদ ইয়াসিন ইসরাইলি হামলায় শহীদ হওয়ার বছরখানেক আগে আলজাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ইসরাইল রাষ্ট্রের পতন ঘটবে এবং এটি ঘটবে ২০২৭ সালের মধ্যে। কেন এটি ঘটবে তিনি এর ইতিহাস ও সমাজ পরিবর্তন তত্তে¡র ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন। ইসরাইল আহমদ ইয়াসিন ও তার উত্তরসূরিদের বোমা হামলায় হত্যা করে এটি ঠেকাতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস প্রায় সোয়া এক বছরের যুদ্ধে অনেক নেতা শহীদ হওয়ার পরও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ ১৯৭৩ সালের ৬ দিনের যুদ্ধেই আরব দেশগুলো অনেক ভ‚মি হারিয়েছিল।
আহমদ ইয়াসিনের সাক্ষাৎকারের বক্তব্যের গভীরতা ইসরাইলের নেতারা ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। ইসরাইলের অষ্টম দশকে এসে বিলুপ্তির আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন দখলদার রাষ্ট্রটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক সেনা ও গোয়েন্দা প্রধানের মতো ব্যক্তিরাও।
৭ অক্টোবরের আগে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতেন তারা, যারা বিতর্কিত এ রাষ্ট্রটিকে গভীর থেকে অবলোকন করতেন। গাজা যুদ্ধের সোয়া এক বছর পর এই আতঙ্ক সাধারণ ইসরাইলিদের ওপরও ভর করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ ইসরাইলি দেশ ত্যাগ করে ভিন্ন দেশে আশ্রয় তৈরি করেছে। ইসরাইলের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জায়নবাদের সমর্থক রাষ্ট্র ও জনমত সীমিত হয়ে আসছে। ইসরাইলের ওপর অর্থনৈতিক চাপও প্রবল হয়ে উঠছে। আরো অনেক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে মধ্যপ্রাচ্যে। সিরিয়া দিয়ে সম্ভবত এর সূচনা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা