সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার
- ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
- ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:১২
দৈনন্দিন জীবনযাপনে নির্ধারিত ও নিয়মিত করণীয় বিষয় (যেমন- ইবাদত, উপাসনা, শরীরচর্চা, পড়াশোনা) পরিপালনের ক্ষেত্রে অনিয়ম এবং শৈথিল্য লক্ষ করা গেলে প্রাত্যহিক কর্মভাবনা ও সম্পাদনে শ্লথ হওয়ার লক্ষণ দেখা গেলে, হাতে প্রচুর কাজ থাকা সত্ত্বেও যেন কাজগুলোতে যথা মনোযোগ সমর্পিত হয়নি বলে মনে হলে এক ধরনের অবসাদ, অতৃপ্তি ও উৎকণ্ঠা সেখানে উপস্থিত হয়। মহৎ চিন্তাভাবনা ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনার ক্ষীণ স্রোতধারা প্রবাহিত হতে চেয়ে হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যেতে পারে। সুশৃঙ্খল কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দৃশ্যমান শিথিলতা মনকে পীড়া দিতে পারে। সে কারণে সামনের দিনগুলোকে বেশ অগোছালো মনে হতে পারে। আশঙ্কা থেকে যায় যে, এর জন্য পরে অনুশোচনা বাড়বে, আক্ষেপ আবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে পারে। কার্যকর ও সৃজনশীল কিছু করতে না পারার অতৃপ্তির সাথে না পারার বেদনাও প্রায়শ মনকে পীড়া দেবে। আর এসবের ওপর যুক্ত হচ্ছে অপরিকল্পিত অবয়বের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
ভেবে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে যে, বর্তমানে দেশ সমাজ ও অর্থনীতির যে ক্রান্তিকাল বিরাজ করছে এ অবস্থার কী কারণ । হয়তো দেখা যাবে কর্মপরিবেশে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা, কারো অসমর্থনযোগ্য আচরণ দ্বারা আহত হওয়া, সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা, অনিয়ম ও সক্ষমতা অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ ছাড়া কিছুই করতে না পারা ইত্যাদি। নিজের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা সমুন্নত রেখে, সঙ্কোচের বিহ্বলতায় নিজেকে অপমানিত হতে না দিয়ে, আশপাশে ঘটে যাওয়া অন্যায় ও অনিয়ম প্রশ্রয় দেয়া দেখে হতাশ না হয়ে বরং নিজের কাজে, পড়াশোনায়, চিন্তাভাবনায় একাগ্র হওয়াই উত্তম। জীবন সংগ্রামে যথাযথভাবে টিকে থাকতে হলে চাই সুস্থ ও সবল মনোবল। এর জন্য সাধনা ত্যাগ ও সহিষ্ণুতাসহকারে অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। আপনা আপনি আত্মশক্তির বিকাশ হয় না। ছেলের হাতের মোয়ার মতো সহজপ্রাপ্য নয় সব সমস্যার সমাধান। জীবনের কৈশোর তারুণ্য ও যৌবনের কর্মচাঞ্চল্য বয়ঃক্রমকালে লোপ পেতে পারে বৈকি, কিন্তু অর্জিত অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা কাজে লাগানোর সুযোগ কেন হবে লাপাত্তা। এ জন্য চাই সময় ও সুযোগের সক্রিয় ও সুচিন্তিত সদ্ব্যবহার। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তুলে নিতে হবে কাজ এবং একে একে সম্পাদন হবে লক্ষ্য; মন হবে তারুণ্যে টগবগ। বিশ্রাম যতটুকু প্রাপ্য ও প্রয়োজন সেটুকু থাকবে। খোঁড়া যুক্তিতে সমর্পিত হলে চলবে না শৃঙ্খলাবিহীনতায়। আনন্দ সর্বনাশ, ভালো-মন্দ উত্থান-পতনের সময় ও কর্মপ্রবাহে উজ্জ্বল সূর্যের ও চেতনার আকাঙ্ক্ষাকে থাকতে হয় সদা জাগ্রত। ব্যর্থতার গ্লানিতে আকণ্ঠ হয়ে নয়; ব্যর্থতাকে জয় করে এগোতে হবে।
নিজের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুৎ না হতে হয়, কোনো অবস্থাতে ছিন্ন না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে। একে মজবুত করতে হবে। ভারসাম্য থাকতে হবে, আনতে হবে চিন্তায় চৈতন্যে আবেগ উৎকণ্ঠায় কর্ম প্রণোদনায়। সময়ের ও সুযোগের সদ্ব্যবহারে হতে হবে সুগ্রথিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। আত্মবিশ্বাসে হতে হবে বুক টান। লক্ষ রাখতে হবে, নিষ্ফল প্রয়াস ও অলসতায় যেন সময় নষ্ট না হয়। অনেক অদরকারি কাজ অনেক শুভ মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে, তা নিক। যার লেখার অভ্যাস আছে তার সৃজনশীল কলমের কালিকে শুকাতে দেয়া ঠিক নয়। অনেক সময় বড় বড় কিছু করার ভাবনা আসবে, কিন্তু তা যদি মুকুলেই ঝরে যায় তার চেয়ে বেদনাদায়ক কিছু নেই। যদি দেখা যায় সেই ভাবনায় ছোট কিছুও করা হয়নি। অথচ ছোট ছোট করেও বড় কিছু করা যেত।
যেটি অন্তত করা যেত এবং এভাবে হতে পারত তা হলো বড় কিছু করার পথে অগ্রযাত্রা। পরিকল্পনা মতো কাজ করতে যে সময় প্রয়োজন- সে সময় হয়তো বের করা যেত। কিন্তু পরিকল্পনায় যদি না থাকে স্থিরতা কিংবা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রয়াস, যার ফলে সময় বের করার আগ্রহ ও প্রচেষ্টাও হয়নি গঠনমূলক তাহলে তো কিছু করা সম্ভব নয়। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। একেকটি কাজ ধরতে হবে এবং শেষ করতে হবে। এক কাজের মধ্যে আরেক কাজের কথা ভাবা ও কাজ করা শুরু করা যাবে না। সুযোগ সময় ও জীবন সীমাবদ্ধ এ কথা মানতেই হবে। অনেক কিছু একসাথে করা সম্ভব নয়। এ কথাও বুঝতে হবে। সুতরাং যা করতে হবে এক এক করে করতে হবে। আস্তে হোক কিন্তু করতে হবে।
চিন্তা অবশ্যই করতে হবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অবশ্যই হবে তবে তার বাহ্যিক প্রকাশ ঘটবে গঠনমূলকভাবে। নিজের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে থাকতে হবে সচেতন যে যেখানে যে পর্যায়ে থাকি না কেন, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দেয়া বরং আরো সচেতন সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালনই অধিকতর কাম্য। দুশ্চিন্তা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রাগ-অভিমানকে সমাহিত করতে পারা অন্যকে সহজে তা বুঝতে না দেয়াই উচিত। অন্যায় অব্যবস্থা অনিয়মের প্রতিবাদ গঠনমূলক দায়িত্বশীল ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হওয়া উচিত। নিজেকে কখনো ক্লান্ত মনে হবে। মনে হবে ইতোমধ্যে অনেক কিছু করে ফেলেছি। সবাই সে কারণে আমাকে সমীহ করে চলবে, তোয়াজ করবে ইত্যাদি। অধিকাংশ সময় সরকারি ও দরকারি কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। আর সে সুবাদে সবার সাথে সব সময় সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কখনো কখনো বড় ব্যক্তিগত আক্ষেপ আক্রোশ বিরক্তি প্রকাশ পায়। নিজের মনে সেসব আবেগ সমাহিত রাখা সম্ভব হয় না। এ বড় বিব্রতকর বটে। সবার সাথে সুমিত আচরণের নিষ্ঠ হওয়াটা বিবেচনাপ্রসূত প্রতীয়মান হয়। পরিমিত আচরণে নিজের এনার্জি বেঁচে যায় ফলে অন্যের সাথে সৌজন্য প্রকাশের সময় টানাটানি পড়ে না। একই আবেগ ভিন্নভাবে প্রকাশ করা চলে। সরাসরি কারো প্রতি রাগ বিরক্তি ও বিদ্বেষ প্রকাশের চাইতে যা আমি মনে মনে জানি তা নিজের কাছে রাখা এবং সবক্ষেত্রে নিরপেক্ষ আচরণ করাই শ্রেয়।
আমরা হঠাৎ করে অনেক কিছু কাজের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়ি- হা হুতাশ করি নানান আশঙ্কায় আপতিত হই কিন্তু অভিজ্ঞতায় বলে যথানিয়মে এবং সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে গেলে আশঙ্কার কোনো কারণ থাকে না। নিষ্ঠাবান দায়িত্ব পালনকারীর দ্বারা কোনো অসম্ভব ভুল বা অন্যায় সাধিত হতে পারে না। তবে হ্যাঁ সব কাজ একসাথে সুচারুরূপে, পরিতৃপ্তির সাথে কাঙ্ক্ষিত উপায়ে করা হয়তো সম্ভব হয় না। নানান সীমাবদ্ধতার কারণেই তা হতে পারে। এ জন্য আশঙ্কা কেন, উদ্বিগ্ন হওয়া কেন? এ রূপ সব মুহূর্তে বরং সুচিন্তিতভাবে সুস্থিরতার সাথে আনন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের সাথে কাজ করে যাওয়া উচিত। চিলে কান নিয়ে গেল কি না এ জাতীয় ক‚পমণ্ডুকতায় হিংসা বিদ্বেষবশত অহেতুক বাক্য কর্ম ও মনোযোগ ব্যয় পরিহার করা উচিত। সবার ওপরে এ লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে যে যতদূর সম্ভব শ্রেয়তর কাজগুলো করার ব্যাপারে মনোনিবেশ থাকবে। আর সব কাজে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য কামনা থাকবে। তিনিই তো ভূত ভবিষ্যৎ সব জানেন। বর্তমানে যে বিষয় নিয়ে বড় বড় ভাবনায় মনোযোগ ব্যয় হচ্ছে কালের প্রবাহে তার অংশীদারত্ব নিতান্ত সামান্য। আর ব্যক্তির সম্মান প্রতিপত্তি সবই তো তিনি জানেন কোনটি কখন কার্যকর। আল্লাহ কখনো কারো সৎ পরিশ্রম বৃথা যেতে দেন না- তিনি সবার সৎ নিয়ত, মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। অন্যের ষড়যন্ত্রে নিজেকে পর্যুদস্ত ভাবার ব্যাপারটি বড় করে না দেখে নিজের কাজ যথাযথভাবে করে যাওয়ায় মন দেয়া উচিত। কে কাকে কিভাবে পর্যুদস্ত কিংবা অপদস্থ করে- সবই তো তিনি দেখেন। আর নিজের আত্মমর্যাদা ও বিশ্বাসের প্রতি নিজের আস্থা থাকাই যথেষ্ট। নিজেকে খাটো বা ছোট ভাবা সঙ্গত নয়। কারো দ্বারা খাটো হলাম কি না এ দুশ্চিন্তা বা ড়ভভবহংরাব চিন্তাচেতনার চেয়ে নিজের প্রতি নিজের আস্থা বৃদ্ধির চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা উচিত।
যা কিছুই আমি করি না কেন তার মধ্যে সৌন্দর্য, সততা, নিষ্ঠা ও নিয়মতান্ত্রিকতা থাকতে হবে। আমার কাছ থেকে সমাজ সংস্থা, দফতর ও দেশ সব সময় ভালা কিছুই আশা করতে পারে। আমাদের উচিত আমার ভালো কিছুই ডেলিভারি করা। আমার পদবি, পর্যায় এবং অবস্থানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আচার-আচারণই আমার থেকে প্রত্যাশিত। সুতরাং পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ চলন বলন সম্পাদন নিয়ন্ত্রণ অনুধাবন প্রক্ষেপণ প্রকাশ পাওয়া উচিত। সব কাজে যথাযথ সচেতনতা গাম্ভীর্য ও মর্যাদাবোধ রক্ষা করে চলা উচিত। আমার অসাবধানতা অজ্ঞতা কিংবা অবজ্ঞা দ্বারা আমি নিজে, আমার সংসার সমাজ দফতর ও দেশ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, বঞ্চিত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আমার কাছ থেকে সময় ও সমাজ যতখানি নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যপরায়ণতা প্রত্যাশা করে তা পূরণে আমার চেষ্টা অবশ্যই থাকতে হবে। এভাবেই আমি যদি আমার কাছে জবাবদিহির পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারি তাহলে সার্থক হবে আমার পথ চলা এবং আমার দ্বারা উপকৃত হবে দেশ সময় ও সমাজ।
পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক দাফতরিক সব বিষয় সামগ্রিকভাবে মন মানসিকতার ওপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলতে সক্ষম এবং মন মানসিকতার সার্বিক সুস্থতার ওপরই আবার পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক দাফতরিক সব পর্যায়ে বলিষ্ঠ পদচারণার প্রকৃতি ও সুযোগ নির্ভর করে। অর্থাৎ এরা একে অপরের পরিপূরক। সুতরাং পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণে ভালো, সুস্থ ও সাবলীল মন মানসিকতা থাকতে হবে। আবার মন মানসিকতার সার্বিক সুস্থতা ও সমৃদ্ধির জন্য ভালো পরিবেশ থাকতে হবে। দু’টিই আপেক্ষিক। অতএব, তা নিয়ন্ত্রণ তদারকি, পোষণ ও তোষণে সজাগ সদা সচেতন থাকতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান, বয়স, পদমর্যাদা, প্রায়োরিটি অনুযায়ী ছোটখাটো ব্যাপারগুলোতে সময় ব্যয় বা মন নিবদ্ধ করা অনুচিত। বড় কাজের জন্য বড় মন, বড় প্রত্যাশা ও বড় আয়োজন প্রয়োজন। থাকা চাই সুনিয়ন্ত্রিত আবেগ ও মনোনিবেশ।
ছোটখাটো ব্যাপারে ব্যাপৃত হওয়াতে মন, ছোট হয়- সময়, এনার্জি সবই অপব্যয় হয়। দরকার নেই। কাউকে কৌশলে ঘায়েল করার জন্য বুদ্ধি আঁটতে গিয়ে কিংবা কিভাবে কাউকে, এটাতে, সেটাতে বেকায়দায় ফেলা যায় সেসব চিন্তায় সুচিন্তারা অস্থিরতায় ভোগে। অতএব, তা পরিত্যাজ্য।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা